এই মহানগরে - ০২

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: বুধ, ২৯/০৩/২০২৩ - ৪:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(ক) ঘটোৎকচ সরণিতে আইসক্রীম

ধানমণ্ডি ৮ নাম্বার সেতুর পশ্চিম প্রান্ত থেকে হাতের বামে যে রাস্তাটা রবীন্দ্র সরোবরের গা ঘেঁষে দক্ষিণ দিকে গেছে সেটার নাম ৭/এ। তবে এই রাস্তা বেশিক্ষণ ৭/এ নামে দক্ষিণ দিকে যেতে পারেনি অল্প পরেই ৭/এ সোজা পশ্চিম দিকে রওনা দিয়েছে, আর দক্ষিণগামী রাস্তার নাম হয়ে গেছে ৬/এ। এই ৬/এ-ও এক সময় দক্ষিণ দিকে যাবার পথ না পেয়ে পশ্চিম দিকে রওনা দিয়েছে।

যেখানে এসে ৬/এ দিক পাল্টেছে ঐ কোনটিতে একসময় বেশ কয়েকটি চটপটির গাড়ি বসতো, সেই সাথে চা-সিগারেটের দোকানও ছিল। আশির দশকের শেষ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ঐ কোনটিতে প্রায় সন্ধ্যায় আমরা আড্ডা মারতাম। ওখানকার চটপটির মান মোটামুটি ভালো ছিল, তবে লোকজন চটপটির লোভে নয় বরং আড্ডার লোভে সেখানে যেতেন। ঐসময়ে দক্ষিণ দিকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে শুরু করে উত্তর দিকে শ্যামলী পর্যন্ত বিস্তৃত যে বিশাল এলাকা তার অনেক তরুণ মূলতঃ ধানমণ্ডির বিভিন্ন বয়সী গ্রুপগুলোর সূত্র ধরে সেখানে আড্ডা দিতে জড়ো হতেন। পেছনের রবীন্দ্র সরোবর নামক অ্যাম্ফিথিয়েটারটি তখন হয়তো কারো দূর স্বপ্নে ছিল, কিন্তু বাস্তবে হ্রদের পাড় ঘেঁষে ঘাসের জমি, আর গাছপালা ছাড়া তেমন কিছু ছিলো না। অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা এড়ানোর জন্য সন্ধ্যার পরে আমরা রাস্তার পাড় ঘেঁষেই থাকতাম, হ্রদের পশ্চিম পাশের পাড়ের দিকে যেতাম না।

সন্ধ্যার যে সময়টিতে আমরা সেখানে আড্ডা দিতাম তখন স্বাস্থ্য সচেতন লোকজন ঐ রাস্তা দিয়ে দৌড়ে ধানমণ্ডি হ্রদের পূর্ব পাড়ের দিকে চলে যেতেন। একদিন এক বন্ধু বললেন,

- দেখ! এই রাস্তা দিয়ে যে লোকগুলো যান তাঁদের কেউই হালকা পাতলা নন্‌, সবাই মোটামুটি স্থুলকায়।
- এই কারণেই তো তাঁরা হ্রদের পাড়ে সন্ধ্যায় দৌড়ান।
- যেহেতু এই রাস্তা দিয়ে প্রধানত স্থুলকায় লোকজন যান তাই আজ থেকে এই রাস্তার নাম দিলাম ‘ঘটোৎকচ সরণি’।

প্রস্তাবটি সুবিবেচিত নয়, সংবেদনশীলও নয়। তখন এসব বোধের বিশেষ উন্মেষ আমাদের মধ্যে হয়নি। যেহেতু সময়ের সাথে সাথে সমাজে সুবিবেচনা ও সংবেদনশীলতার সংজ্ঞা ও সীমা পালটে যায় তাই ভবিষ্যতে আমাদের আজকের অনেক আচরণের জন্য লজ্জা পেতে হতে পারে, কিন্তু সে কারণে এই ইতিহাসকে অস্বীকার করা যাবে না। যাই হোক, এভাবে আমাদের খুব অল্প কয়েকজনের কাছে রাস্তাটির নাম ঘটোৎকচ সরণি হয়ে গেলো। এই নামটি আমরা অন্যদের সামনে ব্যবহার করেছি বলে মনে পড়ে না। অবশ্য আমরা ঐ কয়েকজন এখন এমন সব অলঙ্ঘনীয় দূরত্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছি যে আমাদের নিজেদের মধ্যেও এই নামটি ব্যবহারের আর উপায় নেই।

৬/এ রাস্তাটির দক্ষিণ প্রান্ত পায়েচলা পথ হয়ে ধানমণ্ডি হ্রদের পাড় ঘেঁষে চলে গেছে। এদিকে হ্রদের অপর পাড়ে ‘শেরে খাজা’ নামের এক লোকের জাহাজাকৃতির একটি প্রাসাদ ছিল। প্রাসাদটি যখন তৈরি হয়নি তখন ঐ বাড়িটির পাশের বাড়িতে ‘সেন্ট প্লাসিড টিউটোরিয়াল’ বলে একটি বাচ্চাদের স্কুলে আমরা কোচিং করতে যেতাম। স্কুলটির বর্ণিল ক্লাসরুম দেখে আমার কিঞ্চিত আফসোস হতো। শৈশবে আমাকে নিষ্ঠুর অবয়বের সব ক্লাসরুমে, নির্দয় স্বভাবের সব শিক্ষক/শিক্ষিকাদের কাছে, বর্ণহীন সব বইখাতা দিয়ে, অমানবিক সব পড়াশোনা করতে হয়েছে। প্রাসাদের ঠিক উলটো দিকের হ্রদের পাড়ের ঘাসেঢাকা জমিতে শুয়ে বসে দক্ষিণ আর পশ্চিমের বাতাসে আমরা লম্বা লম্বা সময় পার করেছি। দিনের যে সময়টিতে ঐ জায়গায় লোকে আড্ডা মারতে যেতো না ঐ সময়ে আমাদের আড্ডার দলগুলোর কেউ কেউ সেখানে বান্ধবী (girlfriend অর্থে) নিয়ে সেখানে বসতেন। ঐখানের পেছনের দেয়ালে একবার কে যেন বড় বড় করে লিখেছিলেন ‘I LOVE YOU NEELANTI’ একটু দূরে আবার লিখেছিলেন ‘I LOVE YOU NEELA AUNTI’। নাছোড়বান্দা প্রেমিকটি কি ‘নীলান্তি’ নামের কাউকে ভালোবাসতেন নাকি ‘নীলা’ নামের কোনো আন্টিকে ভালোবাসতেন সেই রহস্য আমরা কখনো ভেদ করতে পারিনি।

আড্ডাকালের প্রায় দুই যুগ পরের এক ঘোরতর শীতের সন্ধ্যায় ধানমণ্ডিতে একজনের সাথে সাক্ষাত করতে যাবার কথা। আমার হাতে সাক্ষাতের আগে মিনিট পনের সময় ছিল। সাক্ষাতের স্থান আড্ডাস্থলের নিকটে হওয়ায় আমি সেখানে দাঁড়িয়ে সময় কাটাতে মনস্থ করি। দেখি রাস্তার ওপরে নানা রকমের যানবাহনের ভীড়, ফুটপাতের উপর আর পার্কের ভেতরে মানুষের ভীড়। চটপটির দোকানগুলো সেখান থেকে একটু দূরে সরে গেছে বটে তবে গোটা পার্কটি হরেক রকমের দোকানে থিকথিক করছে। আমি এক কাপ চা নিয়ে আস্তে আস্তে চুমুক দিতে দিতে জায়গাটির নীরবতা আর জনবিরলতা হারিয়ে যাবার কথা ভাবি, কিন্তু পুরনো আড্ডার কারো কথা মনে পড়ে না। আমার সামনে একটি আইসক্রীম ভ্যান। আমি ভাবি এই শীতে আইসক্রীম কে খাবেন? অবশ্য আমার দুজন বন্ধু ছিলেন যারা শীত যত তীব্র হতো তত বেশি আইসক্রীম খেতে আগ্রহী হতেন – বিশেষত শীতের রাতে। তাঁদের একজন এখন এমন একটি শহরে থিতু হয়েছেন যেখানে বছরের পাঁচ মাস তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে থাকে। আশা করি সেই পাঁচ মাস তিনি বেশ মজা করে আইসক্রীম খেয়ে থাকেন। এই দুই বন্ধুর পাল্লায় পড়ে বনানী বাজারের ‘লা দলচে ভিতা’ নামের আইসক্রীম পার্লার কাম বুক শপে অনেক শীতের রাতে আইসক্রীম চাখতে যাওয়া হয়েছে। অধুনা বিলুপ্ত এই দোকানটি থেকে কেনা বই দিয়ে নব্বইয়ের দশকে আমার লাতিন জাদুবাস্তবতার সাহিত্যের হাতে খড়ি হয়। সেখান থেকে কেনা এক বইয়ে João Guimarães Rosa’র ‘A Terceira Margem do rio’ বা ‘The Third Bank of the River’ নামের গল্পটি পড়ে আমার একটি রাত নির্ঘুম কেটেছিল।

আমার চা খাওয়া যখন প্রায় শেষ তখন আমার সামনে একটি রিকশা এসে থামলো। রিকশা থেকে এক যুগল নামলেন – হয় তাঁরা নববিবাহিত অথবা তাঁরা সদ্য যুগল হয়েছেন। সদ্য জোড়া বাঁধার প্রাথমিক আনন্দ-উচ্ছ্বাস তাঁদের গোটা অবয়ব আর আচরণে ফুটে উঠছে। এই সময়কালে কোনো কোনো নারী হঠাৎ হঠাৎ করে তাঁর সঙ্গীর দিকে একটি ‘সখী ধরো ধরো’ ধরনের চাহনী দেন তাতে সঙ্গী ভদ্রলোক একইসাথে পৃথিবীর সবচেয়ে গর্বিত মানুষ এবং সবচেয়ে বলশালী পুরুষে পরিণত হন (নিন্দুকদের ভাষায়, আসলে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশুদ্ধ ভেড়াতে পরিণত হন)। যুগলটির কল্যাণে অমন একটি বিরল দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হলো। তাতে সঙ্গী ভদ্রলোক ‘কী করি আজ ভেবে না পাই’ অবস্থায় পড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আইসক্রীম খাবে? এই প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বা না বলতে হয় না, একটা বিশেষ ভঙ্গীতে মাথা ঝাঁকাতে হয় আর মুখে এমন একটি ভাব ফুটিয়ে তুলতে হয় যার মানে – আরে! আমি তো এটিই চাইছিলাম! অতএব একটি কোন আইসক্রীম কেনা হলো। আইসক্রীমবিক্রেতা যদি এই সময় আইসক্রীমটির মূল্য লক্ষ কোটি টাকা চাইতেন তাহলে ঐ ভদ্রলোক তাঁর ওয়ালেট খুলে ঐ পরিমাণ টাকা পরিশোধ করতে রাজি থাকতেন। ‘Once Upon a Time in Mumbai’ সিনেমাটিতে সুলতান মীর্জা এভাবে রিহানার জন্য একটি সাধারণ পেয়ারা অসম্ভব বেশি দামে কেনার চেষ্টা করেছিলেন। নারীটি কোন আইসক্রীমটির একপাশ একবার চেটে পুরুষটির দিকে বাড়ালেন, পুরুষটি সেটির অন্য পাশ একবার মাত্র চাটলেন। এইমাত্র বলা বাক্যটি পড়তে একটু কুৎসিত বটে, বাস্তবে সেটি দেখতে, বিশেষত তাঁদের দুজনের অভিব্যক্তির কারণে পৃথিবীর অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটিতে পরিণত হলো। তারপর নারীটি খুব ধীরে আইসক্রীমটি একাই খেতে লাগলেন, আর তাঁরা পরস্পরের বাহুলগ্ন হয়ে পার্কের ভেতরের দিকে চলে গেলেন। কেবল সুবাসী ফুল চারপাশে সুগন্ধ ছড়ায় না, কিছু কিছু অপার্থিব দৃশ্যও চারপাশে সুবাস ছড়াতে পারে – এমনকি বহু বহু পরে তার স্মরণেও।

(খ) নাখালপাড়ার রাস্তায় সেন্টোরেস

আরজতপাড়া-শাহীনবাগ-রসুলবাগ-নাখালপাড়া-তেজকুনীপাড়া-তেজগাঁও-কাওরানবাজার মিলে ঢাকা মহানগরের ঠিক বুকের মধ্যিখানে উরঃফলকের (sternum) মতো যে বিশাল আয়তক্ষেত্র তৈরি হয়েছে সেখানে নাখালপাড়ার ভাগটি বেশি। পূর্ব আর পশ্চিম নাখালপাড়া মিলিয়ে যে ভুলভুলাইয়াটি বিদ্যমান তার বিভাজন যে কী করে হয়েছে সেটি বলা কঠিন। তবে নাখালপাড়ার পুরনো বাসিন্দা না হলে এর রাস্তায় হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজগুলোর একটি। যেহেতু গৃহনির্মাণের সময় আমরা জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের পক্ষপাতী অথবা এক্ষেত্রে আমাদের নীতি জ্যেষ্ঠ কৌরবের নীতির সমতুল ‘বিনা নির্মাণে নাহি ছাড়িব সূচ্যগ্র মেদিনী’ তাই গুগল ম্যাপ যেমনই দেখাক এখানে টানা ৫০০ মিটার সোজা রাস্তা পাওয়া কঠিন, আর ১০০ মিটার ধরে সমান প্রস্থের রাস্তা পাওয়া মোটামুটি অসম্ভব। ‘বিএনবিসি ২০২০’ বা ‘ডিএপি ২০২২’ নামক বিধিগুলোতে বর্ণিত গৃহনির্মাণের বিধিমালা আর এই অঞ্চলে নির্মিত গৃহসমূহ পরিসংখ্যানের ভাষায় ‘পারস্পরিক একচেটিয়া’ (mutually exclusive) কিনা সেটা গবেষণা করে দেখা যেতে পারে। এসব সর্পিল, ভঙ্গুর, ক্ষীণতনু রাস্তার উপরে বসা বাজার, হকারকুল, সাইকেল ভ্যান বা ঠেলাগাড়ি করে চলমান দোকানের দরুণ রাস্তার প্রশস্ততা আরও কমে যায়।

এই উরঃফলকের কোনো রাস্তায় বাস বা টেম্পোজাতীয় (human hauler) কিছু চলে না – আসলে চলা সম্ভব নয়। ফার্মগেট থেকে নাখালপাড়ার খুব অল্প একটু দূরত্ব পর্যন্ত একটি রুটে ব্যাটারিচালিত টমটম চলে, তাছাড়া বাকি সব রাস্তায় চলাচলের একমাত্র উপায় হয় রিকশা অথবা ব্যক্তিগত বাহন। এই রাস্তাগুলোতে চলমান ব্যক্তিগত গাড়িগুলোর আকার যত বড় হতে থাকে (coupe < hatchback < sedan < station wagon < crossover < SUV < minivan < van) পথচলতি অন্যদের আতঙ্ক ততই বাড়তে থাকে। একটু বড় আকারের গাড়ি মানে সামনে পেছনে অবধারিত জ্যাম। কোনো বাসা থেকে একটি গাড়ি বের হওয়া বা বাসায় ঢোকানো মানে দু’প্রান্তে অবধারিত জ্যাম। এর মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো অত্যন্ত বিপদজনক গতিতে পঙ্খীরাজের মতো ছুটে চলে, আর মোটরসাইকেলগুলোর গতি আর চলার ধরন নিয়ে যত কম বলা যায় ততই স্বস্তি। এই শহরের অদম্য মোটরসাইকেলগুলো আসলে বিভীষিকার অপর নাম, এই উরঃফলকে সেগুলো এক ধাপ উপরে একাক্ষ দানবের রূপ নেয়।

পশ্চিম নাখালপাড়ার লুকাস মোড়ের কাছে একটি অ্যাকুয়ারিয়ামের দোকানের বন্ধ দরজায় একটি তীর চিহ্ন দিয়ে লেখা ‘মাছের জন্য পাশের পাখির দোকানে খোঁজ করুন’! নির্দেশনা পড়ে আমি গভীর চিন্তায় পড়ে যাই। সুযোগ পেলে পাখিরা মাছ খায় বটে, তাই বলে তারা কি মাছের দোকান দিয়ে বসে? অ্যাকুয়ারিয়ামে মাছের চাষ করে? অবশ্য দুনিয়াজুড়ে শেয়ালেরাই যেখানে মুরগীর বর্গাচাষী, ডাকাতেরা হয় রোকড়ি মহাজন সেখানে পাখির পক্ষে মাছের দোকানদার হতে বাধা কোথায়! একটু সামনে দেখি একটা দোকানে খাঁচাভর্তি সব পাখি। বুঝলাম এটা কাঁটাবন-নীলক্ষেতের পশুপাখির বাজারের মতো একটি পোষা পাখি-মাছের দোকান, যেখানে স্থানাভাবে মাছগুলো আরেক দোকানে রাখতে হয়েছে। ষোড়শ শতকে তেজগাঁ এলাকায় পর্তুগীজদের কোয়ার্টার ছিল, ১৫৯৯ সালে সেখানে প্রথম গির্জা স্থাপিত হয়। পর্তুগীজরা তেজগাঁ এলাকায় আরও দেড়-দু’শ বছর থেকেছে। চারশ’ বছর আগে নাখালপাড়া কি ছিল? সেখানেও কি পর্তুগীজ কোয়ার্টার ছিলো? বলা মুশকিল। এই 'নাখালপাড়া' নামটির মানেই বা কী? ‘নাখাল’ মানে কি 'খাল নয়'? নাকি ‘নাকাল’ থেকে 'নাখাল' হয়েছে? অবশ্য আমি প্রতি দফাতেই এখানে পথ হারিয়ে নাকাল হই।

পূর্ব নাখালপাড়ার লিচুবাগানের নতুন রাস্তায় আমার উলটো দিক থেকে একটি কালো রঙের লম্বা মোটরসাইকেল আসছিল। তরুণ চালকের আপাদমস্তক কালো রঙের পোশাক-রোদচশমা-জুতায় ঢাকা। চালকের পেছনের তরুণী আরোহিনীর সর্বাঙ্গের পোশাকও কালো রঙের। দু’জনের কারো মাথায় হেলমেট নেই। হঠাৎ তরুণীটি কী যেন বললেন, অমনি তরুণটি হাসতে হাসতে সামনের দিকে ঝুঁকে স্টীয়ারিং-এ প্রায় মাথা ঠেকিয়ে দিয়ে চলতে লাগলেন। তরুণীটি দু’হাতে তরুণটির কোমরের বেল্ট ধরে ঘোড়া চালানোর ভঙ্গী করলেন। দৃশ্যটি দেখে আমার কাছে তরুণীটিকে রোমান কবি ওভিদের লেখা ‘মেতামরফোসিস’ কাব্যে বর্ণিত সেন্টোরেস (অর্ধ মানবী- অর্ধ ঘোটকী) হাইলোনোম-এর মতো মনে হলো, কেবল এখানে ঘোটকাংশ সন্মুখে প্রলম্বিত। নাখালপাড়ার রাস্তার সেন্টোরেস লাপিথদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রিয়তম কিলারোসের করুণ মৃত্যুদৃশ্যে তাঁকে কোলে ধরে রাখা শোকবিহ্বল হাইলোনোমের মতো নয়, বরং পেলিয়াম পাহাড় পেরিয়ে পেনেউস উপত্যকা ধরে থেসালির দিকে ছুটে চলা প্রাণোচ্ছ্বল হাইলোনোমের মতো প্রাণৈশ্বর্য্যে ভরপুর। ঘিঞ্জি রাস্তাটা সহসাই পৌরানিক থেসালির এক প্রান্তরে পালটে যায়।

হস্তিনাপুর, ২৮ মার্চ ২০২৩


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

পূর্ব আর পশ্চিম নাখালপাড়া মিলিয়ে যে ভুলভুলাইয়াটি বিদ্যমান তার বিভাজন যে কী করে হয়েছে সেটা বলা কঠিন।

রেললাইন কোথায় এই চিন্তা মাথায় রেখে চলে হারিয়ে যাবার সময়টা একটু সংক্ষিপ্ত হয়। রেললাইন পার হয়ে পশ্চিমে গেলে পশ্চিম নাখালপাড়া। পূবদিকে পূর্ব নাখালপাড়া। তবে সবশেষে গুগল ম্যাপই ভরসা। ওখানকার লোকেদের কাছে জিজ্ঞেস করেও তেমন লাভ হয় না।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

রেললাইনকে রেফারেন্স ধরে চলতে পারলে হয়তো পথের দিশা পাওয়া যাবে, তবে গলিগুলো এতো প্যাঁচানো যে রেললাইন কোন দিকে সেই খেই হারিয়ে ফেলি।

রেললাইন দিয়ে নাখালপাড়ার পূর্ব-পশ্চিম বিভাজনের কথা শুনেছি, তবে দেখেছি প্রায়ই এই সীমা মানা হয়নি।

শুধু নাখালপাড়া কেনো, বাংলাদেশের খুব কম জায়গায় খুব কম সময়েই লোকজনকে জিজ্ঞেস করে সঠিক পথের দিশা পাওয়া যায়। এই ব্যাপারে সাহায্য চাইলে কিছু মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে, নিষ্ঠার সাথে মানুষকে বিভ্রান্ত করেন।

গুগল ম্যাপ মোটামুটি ভরসা করা যায়, তবে পুরোপুরি নয়। এখানে ব্যক্তি উদ্যোগে এন্ট্রি দেয়া হয় বলে প্রচুর ভুলভাল এন্ট্রি থাকে। আমি দিনের পর দিন আমার পরিচিত জায়গাগুলোর এমন ভুল এন্ট্রি সংশোধন করে গেছি। তার কিছু গুগল গ্রহন করেছে, কিছু গ্রহন করেনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংশোধন করার সুযোগ রহিত করে রাখা আছে। গুগল ম্যাপে বাংলাদেশের রেললাইনগুলোকে খুব অস্পষ্ট করে দেখানো হয়। বাস্তবে যেখানে রেললাইন থাকে সেখানে অন্য সব পথ রেললাইন দিয়ে প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ওডিন এর ছবি

সার্জারির ব্রেকে ইফতারির জিলিপি খেতে খেতে পড়ছি।

হপ্তায় কমপক্ষে চারদিন এই এলাকায় নিজের ঘটোতকচত্ব নিবারণকল্পে পায়চারি করি। জায়গাটার নাম খুবই প্রাসঙ্গিক হয়েছে

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ঘটোৎকচ বিশালদেহী ছিলেন বটে, তবে তিনি স্থুলকায় ছিলেন এমনটা বলা বোধহয় ঠিক হবে না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

এক লহমা এর ছবি

তোমার সব লেখাই ভালো লাগে। তার মধ্যে এই লেখাগুলো আরো প্রিয়। আমি একসাথে একটি চেনা এবং একটি অচেনা জগৎ দেখতে পাই।

ঘটোৎকচ নামটি ছোটবেলায় তুমি যে অর্থে রাস্তার নামকরণ করেছ সেই অর্থেই ব‍্যবহার করেছি। বড় হতে হতে এই বিষাদবিধুর রোমান্টিক নায়ক সম্পর্কে ধারণা সম্পূর্ণ বিপরীত প্রান্তে। সাম্প্রতিক বালি ভ্রমণে দেখে এলাম ওঁরা মর্যাদা দিয়েছেন এই মহাকাব‍্যিক চরিত্রের।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

রাস্তার নামকরণটি আমার করা নয়, তৎকালীন এক বন্ধুর করা।

ঘটোৎকচের ব্যাপারে আমার অবস্থা আপনার অনুরূপ। তাঁর বীরত্ব, ন্যায়নিষ্ঠতা, বঞ্চনার ইতিহাস জানতে আমার অনেক দেরি হয়ে গেছে। তিনি আসলে মহৎ হিসেবে গণ্য। মাহবুব লীলেন তাঁর 'অভাজনের মহাভারত'-এ ঘটোৎকচ, তাঁর মাতা ও পিতাকে যথাযথভাবে অঙ্কন করার চেষ্টা করেছেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তিথীডোর এর ছবি

পূর্ব নাখালপাড়ার লিচুবাগানের নতুন রাস্তায় আমার উলটো দিক থেকে একটা কালো রঙের লম্বা মোটরসাইকেল আসছিল। তরুণ চালকের আপাদমস্তক কালো রঙের পোশাক-রোদচশমা-জুতায় ঢাকা। চালকের পেছনের তরুণী আরোহিনীর সর্বাঙ্গের পোশাকও কালো রঙের। দু’জনের কারো মাথায় হেলমেট নেই

এক আলো মরে যাওয়া বিকেলে মিরপুর রোডে এক যুগলকে দশাসই সাইজের রেসিং বাইক চালাতে দেখেছিলাম।

তরুণীটি সম্ভবত সদ্য ক্লাচে পা দেওয়া শিখেছে, তরুণকে পেছনে বসিয়ে, দর্পিত ভঙ্গিতে যেভাবে ইউ টার্ন নিয়ে পথ কাঁপিয়ে চলে গিয়েছিল, দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসে!

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

অহেতুক অবদমনের সংস্কৃতির অবসান ঘটানো গেলে অনেক সুন্দর দৃশ্যই রচিত হতে পারে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বহুদিন পর অত্যন্ত সুখপাঠ্য একটি লেখা পড়লাম। একেবারে আমার মনের মতো। তুলনাগুলো সুচয়িত; ধুসর গোধূলীর কথা তুলে আনলেও সেগুলো লুব্ধক নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল হয়ে মানসপটে ভাসে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লিখে যাও, পাণ্ডব। তোমার কলমের এই কালি যেন কখনো না ফুরোয়।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। আপনার মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করে।

কলম বা কালি আসলে ফুরোয় না। সময় ফুরিয়ে যায়, মানুষ ফুরিয়ে যায়, লেখার ক্ষমতা ফুরিয়ে যায়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সত্যপীর এর ছবি

হ্রদের পাশে জাহাজ বাড়ির ঐপারে এক লোক চরম ভেলপুরি বানাইত। শক্ত পুরির মাঝখানে কেটে ঘুগনি জাতীয় হাবিজাবি, আর কাটা শসা মরিচ। এ পৃথিবী একবারই পায় তারে পায় নাকো আর।

অনেক দিন পরে লিখলেন।

..................................................................
#Banshibir.

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এই খাবারটা সম্ভবতঃ একান্তই বাংলাদেশের আবিষ্কার। এই খাবারটার একটা ঠিকঠাক নাম হওয়া দরকার। এটাকে লোকে ভেলপুরি বললেও এটা মোটেও ভেলপুরি নয়।

ধানমণ্ডির ৩ নাম্বার রোডের এনায়েত মসজিদের কাছে একজন এই বস্তু বিক্রি করতেন। পুরির crispiness, ঘুগনির মান, মশলার আর টকের পরিমিতি, শশা-টমেটো-ধনেপাতা-কাঁচামরিচের freshness - সব মিলিয়ে চমৎকার! সমস্যা হচ্ছে এই মানের কারিগরেরা খুব দ্রুত পেশা পালটে ফেলেন অথবা বিদেশে চলে যান।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ এর ছবি

চমৎকার পাণ্ডবদা। ‘একদম রুমাল নাড়িয়ে গেলেন পরানের গহীন ভিতর’ ৷
করোনার মহামারি পেরিয়ে বেশ কয় বছর পর ঢাকায় গিয়ে বুকে ধাক্কার মত লেগেছে, শুধুমাত্র দেখলাম ধানমন্ডি তেমন পরিবর্তন হয়নি। কত স্মৃতি একসাথে এসে ভীর করল।
চাকুরি জীবনের শুরু, আড্ডা, বসবাস, হঠাৎ ক্যারিয়ার পরিবর্তন, ক্ষণকালের জন্য বলশালী পুরুষ কিংবা বিশুদ্ধ ভেড়ায় পরিনত হয়ে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতে শোনা…।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ।

ধানমণ্ডি আসলে একটা মায়া! যারা এখানে কখনো বাস করেছেন, অথবা কখনো চাকুরি/ব্যবসা করেছেন, অথবা লেখাপড়া করেছেন তাঁদের বেশিরভাগ জন হয় ধানমণ্ডির কাছে বার বার ফিরে আসেন অথবা নিজের ভেতর থেকে ধানমণ্ডিকে মুছে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মন মাঝি এর ছবি

যারা ৭০ বা ৮০-র দশকের ধানমণ্ডি দেখেছেন তারা এখনকার এই ধানমণ্ডি নামক শ্বাসরোধী জাঁতাকলের কাছে আর ফিরতে চাইবেন বলে মনে হয় না। বড়জোর সেই পুরনো ধানমণ্ডির স্মৃতিই রোমন্থন করে যাবেন বাকি জীবন।

আমার বিচরণ ক্ষেত্র ছিল ধাণমণ্ডি, লালমাটিয়া, মানিক মিয়া এভিনিউ, আসাদ গেট শের-ই-বাংলা নগর (তখন এখানেই থাকতাম), মনিপুরি পাড়া, আগারগাঁও আর ইন্দিরা রোড। ৭০-এর দশকের ২য়ার্ধে নির্মীয়মান সংসদ ভবনের দক্ষিণ দিকের মাঠ পেরিয়ে তারপর মানিক মিয়া এভিনিউর বিশাল রাস্তার দুধারে এবং বিশেষ করে মাঝখানে বিশাল (আমার স্মৃতিতে আকাশছোঁয়া) গাছের সারি পেরিয়ে ধানমণ্ডি বয়েজ স্কুলে যেতাম। সংসদের দক্ষিণ মাঠের পশিমার্ধে তখনও স্বাধীণতা পূর্বকালে সংসদ ভবনের জন্য রাঁখা ইটের স্তুপ পড়ে ছিল। এতে ততদিনে প্রায় জঙ্গল গজিয়ে গেছিল। সন্ধ্যায় এর চিপাচাপা থেকে শহরের মধ্যিখানে শিয়ালের পালের হুক্কা হুয়া শোনা যেত। সংসদ ভবনের পশ্চিম দিকে একদম লাগোয়া যে লেক আছে এখন তখন তা ছিল না। পুকুর ছিল দুইটা। আমার চোখের সামনেই সেটা হয়েছে। সেই পুকুরে সাঁতার শিখতে গিয়ে হাবুডুবু খেয়েছি। পরে যখন এখনকার লেক হয়েছে তখন এর পারটাই ছিল আমার ও বন্ধুদের আড্ডাস্থল। স্থানীয় পোলাপাইনদের অনেকের ডেটিং-এর জায়গা। তুলনাহীণ একটা জায়গা। বিশাল খোলামেলা প্রায় নির্জন এরিয়া, সবদিকেই ধূ-ধূ মাঠ, নেকলেসের মত লেক, লুই কানের অসাধারণ বিশ্বমানের আর্কিটেকচার চারদিকে। সবুজ-মেরুন-সাদার অপূর্ব কম্বিনেশন। একটা সময় পর্যন্ত বাইরের লোকজন আসতো না। আমরা-আমরাই সেই মাঠে ফুটবল-ক্রিকেট খেলতাম। কলাবাগান, লালমাটিয়ার টিম আসতো মাঝে-মধ্যে। মনে হয় যেন স্বর্গে ছিলাম। তারপর ওখান থেকে ধানমণ্ডি যেতাম বন্ধুদের সাথে গুলতানি মারতে আর ঘুরাঘুরি করতে। ২৭ থেকে ২ নং পর্যন্ত। একতলা/ দোতলা গাছপালা আর ফুলের বাগানে ঘেরা শান্ত-স্নিগ্ধ-নীরব বাসাবাড়ির মধ্য দিয়ে দু'পাশে গাছের সারি বিশিষ্ট নীরব-নির্জন ছায়া-সুনিবিড় সড়ক। দুরে-দুরে একটা দুটা রিকশার টুং-টাং। পশ এলাকা। রাশান / জার্মান কালচারাল সেন্টারের লাইব্রেরী আর সিনেমা। ধানমণ্ডি লেক। তখনকার ঢাকাকে না দেখলে বিশ্বাসই হবে না ঐ পরিবেশটা। তখন ঢাকা সত্যি লিভেবল ছিল। তখন রাস্তাগুলি এপার-ওপার কাভার্ড ছিল। আমি ভাবতাম বিদেশের মত কবে সেটা হবে, কবে আরও "উন্নত" হবে!!! এখন ভাবি, ইশ্‌, সেই পুরনো ঢাকাকে যদি আবার ফিরে পেতাম!!!

****************************************

মন মাঝি এর ছবি

তখন রাস্তাগুলি এপার-ওপার কাভার্ড ছিল।

আমার উপরের কমেন্টের এই লাইনের শেষে একটাঃ

না

বাদ গেছে!!

পাকিস্তান আমল থেকে জিয়ার শাসনকাল পর্যন্ত মেইন রোডগুলির দুই পাশে প্রচুর
ধুলি-ধূসরিত মেঠো খালি জায়গা রেখে মধ্যিখানের অংশটুকুই শুধু পিচ-ঢালা রাস্তা হত। প্রস্থে মোট স্পেসের প্লাস/মাইনাস এক-তৃতীয়াংশের মতই শুধু কাভার্ড থাকত মনে হয়। সঠিক মনে পড়ছে না। এগুলি পুরোপুরি - অর্থাৎ প্রস্থে এন্ড-টু-এন্ড
ঠিক কবে থেকে কাভার্ড হল এখন আর মনে পড়ছে না। তবে এরশাদামলের কোনো সময় মনে হয়। আগে ভাবতাম কবে রাস্তা চওড়া হয়ে টিভিতে দেখা বিদেশের মত হবে। এখন ভাবি রাস্তা কবে ফাঁকা হবে!!! ভাবি আগের হাল্কা শহরটাই বরং ভাল ছিল। যাহা চাই ভুল করিয়া চাই, যাহা পাই ভুল করিয়া অযাচিতটাই পাই।

****************************************

মন মাঝি এর ছবি

মধ্যাশি থেকে প্রায় মধ্যাব্বই পর্যন্ত এই ধানমণ্ডির মধ্য দিয়ে - ২ থেকে ২৭ নং পর্যন্ত - পায়দলে কতই না চরকিবাজি করেছি সেসব ভোলার নয়। বহুতল ভবন, স্কুল, অফিস আর ভীড়/ট্রাফিক এসবের দৌরাত্ন্য শুরু হওয়ার পর অবশ্য সেই সুখে যবনিকাপাত হয়েছে। আরেকটা জিনিস হঠাৎ মনে হল। পান্থপথ হওয়ার আগে ঐ এলাকাটার কথা মনে আছে? তখন কি আমরা কল্পনাও করতে পেরেছিলাম বর্তমানের ঐ এলাকাটার চেহারা? বা কখনো যে এরকম হতে পারে সেটাও? কিম্বা যারা তখনকার অর্থাৎ পান্থপথ হওয়ার আগের অবস্থাটা দেখেনি তারা কি কল্পনাও করতে পারবে ঐ অবস্থাটা? ভাবতেই হাসি পাচ্ছে। হাসি

****************************************

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনার এই মন্তব্যটি এবং উপরে নৈষাদদা’র মন্তব্যের থ্রেডে করা মন্তব্যটির ঠিকঠাক প্রতিমন্তব্য করতে গেলে আমাকে ‘এই মহানগরে’ অথবা ‘রোদের ঘ্রাণ আর বাতাসের রঙ’-এর এক বা একাধিক পর্ব লিখতে হবে। সে সুযোগ কখনো হবে কিনা জানি না, তবে ধানমণ্ডি নিয়ে আমার আরও লেখার পরিকল্পনা আছে। সেখানে আপনার এই মন্তব্যে যে সুতোগুলো এসেছে সেগুলো বুননে রাখার ইচ্ছে করি।

সত্তর-আশি’র দশকের ধানমণ্ডি নব্বইয়েই মরা শুরু করেছে, এখন তার মৃতদেহ আর সেটিকে ঘিরে তাণ্ডব নৃত্য অবশিষ্ট আছে। আর শুধু ধানমণ্ডি কেন? এমনকি নব্বইয়ের দশকের গুলশান-বনানী-বারিধারা’র (তথাকথিত ট্রাই-স্টেট) বিবেচনায় আজকের ওই অঞ্চল স্রেফ অপরিকল্পিত কংক্রিটের জঙ্গল আর হাইরাইজ বস্তিতে পরিণত হয়েছে। (বস্তিবাসীদের প্রতি কোনো অশ্রদ্ধা না রেখে বস্তি ব্যবস্থাটিকে নির্দেশ করা হলো)

জনসংখ্যা বাড়লে তাঁদের জন্য আবাসন ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা বাড়াতে হবে – এটি অবশ্যম্ভাবী। তবে এর জন্য নির্বিচারে বৃক্ষ নিধণ, জলা (water body অর্থে) ধ্বংসের প্রয়োজন ছিলো না। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, সীমাহীন লোভ, অজ্ঞতা, নির্বুদ্ধিতা, অবিমৃষকারিতা এই মহানগরটিকে একটি আবর্জনার স্তুপে পরিণত করেছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সৌখিন  এর ছবি

এই এলাকা দিয়ে হাটার সময় প্রাসাদপ্রতিম বাড়িগুলির বারান্দা দেখা যেত। সেই বারান্দাগুলির ছাদে ২ টা করে ফ্যান ঝুলানো থাকতো। সেই ফ্যানগুলি ফুলস্পীডে ঘুরতো আর বারান্দায় মেলে দেয়া কাপড় শুকাতো। গড়াগড়ি দিয়া হাসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এই দৃশ্য প্রথম দেখি ধানমণ্ডি এক নাম্বার রোডের এক বাসায়। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গানের অনুকরণে আমরা বলতাম "মাথার উপর মিছেই মিছি ঘুরছে পাখা"।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সৌখিন  এর ছবি

দেঁতো হাসি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

এদিকে হ্রদের অপর পাড়ে ‘শেরে খাজা’ নামের এক লোকের জাহাজাকৃতির একটি প্রাসাদ ছিল।

আহা জাহাজবাড়ি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায়ও এটি পেয়েছি, পরে ভেঙে ফেলা হয়েছিল!

শৈশবে আমাকে নিষ্ঠুর অবয়বের সব ক্লাসরুমে, নির্দয় স্বভাবের সব শিক্ষক/শিক্ষিকাদের কাছে, বর্ণহীন সব বইখাতা দিয়ে, অমানবিক সব পড়াশোনা করতে হয়েছে।

জীবনের এই একটি ক্ষেত্রে আমি বোধহয় বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী। এখন স্মৃতির সরণিতে পেছন ফিরলে দেখতে পাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে সুন্দর ও মানবিক সময়টি কাটিয়েছি শৈশবে, জীবনের প্রথম ইশকুলে। আমি জানি, দুঃখজনকভাবে পরিচিত প্রায় সকলেরই অভিজ্ঞতা এর ঠিক উল্টো।

পূর্ব আর পশ্চিম নাখালপাড়া মিলিয়ে যে ভুলভুলাইয়াটি বিদ্যমান তার বিভাজন যে কী করে হয়েছে সেটি বলা কঠিন।

তা বৈকি, আমরা একে ডাকতাম "র‍্যাডক্লিফ লাইন" নামে! আমার ধারণা, ভালমত খুঁজলে পূর্বের মাঝে পশ্চিম নাখালপাড়ার কিংবা পশ্চিমের মাঝে পূর্ব নাখালপাড়ার ছিটমহলও খুঁজে পাওয়া যাবে।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নাখালপাড়ার পুর্ব-পশ্চিমের বিভাজন মানে না। তাদের রেকর্ডে একটিই নাম - নাখালপাড়া, বর্তমান ২৫ নং ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং ছিটমহল পাওয়া গেলেও সেসবের সরকারী স্বীকৃতি নেই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

ঘটোৎকচের নাম প্রথম দেখেছিলাম ছেলেবেলায়, মাসুদরানা পড়তে গিয়ে। সেখানে যাঁর এই নাম ছিল, তিনি ছিলেন পালোয়ান কিসিমের মানুষ। মাসুদরানার সাথে তাঁর ডুয়েল লড়াই হয়েছিল এবং বলাইবাহুল্য মাসুদরানা তাঁকে ইচ্ছামত ধোলাই করেছিলেন। আর আমরাও বিমলানন্দ লাভ করেছিলাম কিম্ভূত কিমাকার নামের এই ল্যাঙ্গট পরিহিত পালোয়ান মহাশয়কে আমাদের হিরোর হাতে নাকাল হতে দেখে। অনেক পরে আসল ঘটোৎকচের সাথে পরিচয় হয়েছিল কাশিদাসী মহাভারতে। তখন দেখেছিলাম তাঁর নামটা আসলে তাৎপর্যপূর্ন এবং চমৎকার, ঘটের ন্যায় উৎকচ যাহার- ঘটোৎকচ! লিলেন ভাইয়ের পর্যবেক্ষন মতে তিনি বাংলারই এক বীর্যবান যুবাপুরুষ ছিলেন। সুতরাং আমরা আশা করতে পারি, রবীন্দ্র সরোবর ধরে দৌড়াদৌড়ি করা ভুঁড়িওয়ালা মানুষগুলো একসময় ঘটোৎকচের মতই সুঠাম দেহের অধিকারী আর বলবান হয়ে উঠেছেন, উঠবেন।

নাখালপাড়ার সেই ক্ষীণতনু সড়কগুলোয় বাস বা টেম্পোজাতীয় কিছু চলে না, এ তথ্য সঠিক নয়। নাবিস্কোর পশ্চিম দিকে যেখান থেকে নাখালপাড়ার দিকে রাস্তা চলে গেছে, সেখান থেকে টেম্পু চলতো দুই নাখালপাড়ার বুক পেট চিরে, ড্রাম ফ্যাক্টরি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, কলমিলতা মার্কেট হয়ে ফার্মগেট বিজ্ঞান কলেজের সামনে অবধি। জানি না, নাখালপাড়া বাসীদের সেই সুবিধা এখন পর্যন্ত বলবত আছে কি না।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

মনে হয় অনেকদিন পর এদিকে আসলাম। আপনার এই ঘরানার লেখাগুলো পড়ে আমি ভ্রমণকাহিনীর আনন্দ পাই। ঢাকা শহরের অনেক কিছু বদলে গেছে।
আরো বদলে যাবে। একদিন এই লেখাগুলো ইতিহাস হয়ে থাকবে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রযুক্তির ওপর ভরসা না করে উপায় নেই, তারপরেও প্রযুক্তির ওপর আস্থা রাখতে পারি না। দুম করে কোনো এক বিপর্যয়ে দেখা যাবে সব লেখা হারিয়ে যাবে। তাদের আর ইতিহাস হয়ে ওঠা হবে না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মন মাঝি এর ছবি

গাণিতিক শূন্যের উপর আপনার লেখাটা পড়লাম (আরও কিছু লেখাও পড়েছি)। এবার প্রকৃত শূন্য বা আরও ভালভাবে বললে "শূন্যতা"-র উপর কিছু লিখুন। বিশেষ করে যে শূন্যতায় কিছু নেই না, এমনকি "নেই"-টাও নেই কারন ঐ "নেই"-টাও শেষ পর্যন্ত দেখা যায় আসলে একটা "কিছু"!!! বুঝাতে পারছি? বিজ্ঞান আর দর্শন কি বলে এরকম প্রকৃত শুন্যতা বা শুন্যতার ধারণা সম্পর্কে? কিছু বলে কি? পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

****************************************

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পপকর্নের ঠোঙ্গাটা নামিয়ে রেখে এবার নিজেই কী-বোর্ড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুন 'শূন্য' আর তার যাবতীয় ডেরিভেটিভের উর্ধ্বতন আর অধঃস্তন চৌদ্দ পুরুষের ঠিকুজি বের করতে। বল আমার কোর্টে না দিয়ে নিজেই সচলে পোস্ট নামান।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কল্যাণ এর ছবি

দারুণ লিখেছেন পান্ডবদা। কত কিছু যে মনে পড়ে যাচ্ছে আপনার লেখা পড়ে!

ছুডুবেলায় ধানমন্ডি লেকে আমরা ক্লাসের শেষে বিকালে গপসপ করার জন্য যেতাম (কার সাথে সেটা প্রাইভেসি রক্ষার্থে বলা যাচ্ছে না)। আমাদের পকেটে বাড়ি ফেরার বাস ভাড়া ছাড়া খুব একটা টাকা থাকত না বলে আমরা লাল চা (ইয়ে মানে দলছুটের লালা চা নয়, আগেই কিলিয়ার করে দিচ্ছি) আর ঝাল মুড়ি খেতাম।

নাখালপাড়ায়ও অনেক যাওয়া হয়েছে সেসময়, বন্ধুদের সাথে মিলে সারা রাত আজগুবি আর বেসামাল যত কাজ কার্বার!!

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য চোখ টিপি । আশা করি ইঙ্গিতের অবগুণ্ঠন খুলে এই মন্তব্যের পেছনের গল্প (ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে চা-ঝাল মুড়ি খাওয়ার গল্প) একদিন আমরা পড়তে পাবো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।