নামে কিবা আসে যায়!

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৭/০৮/২০২৩ - ১:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৯৬৭ সালে প্রকাশিত গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের উপন্যাস ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’-এ (Cien años de Soledad) কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া যখন হৃদয়ঙ্গম করেন চলমান গৃহযুদ্ধ নিস্ফলা, যুযুধান দুই পক্ষ কেবল নিজেদের ‘মর্যাদা’ রক্ষার দোহাই দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তখন গভীর হতাশা থেকে তিনি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক তাঁর বুকে আয়োডিন দিয়ে একটি বৃত্ত এঁকে দিয়েছিলেন। অপরাহ্ন তিনটে পনের মিনিটে কর্নেল তাঁর তাঁবুর ভেতরে খাটের এক ধারে বসে শার্ট খুলে ঐ বৃত্তে গুলি করেন, কিন্তু কর্নেল এতে মরতে পারেননি। গুলি তাঁর বুকে ঢুকে হৃদপিণ্ড, যকৃৎ, বা ফুসফুসের মতো প্রধান কোনো অঙ্গের ক্ষতি না করে পিঠ ভেদ করে বের হয়ে যায়। এর অনেক পরে কর্নেল নিজেদের বাড়ির পুরনো চেস্টনাট গাছের তলায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানের প্রধানমন্ত্রী (১৮-অক্টোবর-১৯৪১ – ২২-জুলাই-১৯৪৪), যুদ্ধমন্ত্রী (২২-জুলাই-১৯৪০ – ২২-জুলাই-১৯৪৪), ও রাজকীয় জাপানী সেনাবাহিনীর জেনারেল স্টাফ প্রধান (২১-ফেব্রুয়ারি-১৯৪৪ – ১৮-জুলাই-১৯৪৪) হিদেকি তোজোর অবস্থা কিছুটা কর্নেল অরেলিয়ানোর সাথে মেলে, যদিও গ্যাবো এই উপন্যাস লেখার উপযুক্ত হবার ঢেড় আগেই তোজোর মৃত্যু ঘটে। ১৯৪৪ সালের জুলাইয়ের মধ্যে সকল প্রকার রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়ে তোজো আলোচনার বাইরে চলে গেলেও মার্কিনীরা তাঁকে ভোলেননি, কারণ ০৭-ডিসেম্বর-১৯৪১ সালে পার্ল হারবারে জাপানী হামলার জন্য মার্কিনীরা তাঁকেও দায়ী করেছিলেন। ফলে তোজোর ক্ষমতাচ্যুতির প্রায় এক বছর পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থামলে মার্কিনীরা তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য ধরার পরিকল্পনা করেন। লেফটেন্যান্ট জন জে. উইলপার জুনিয়র আর তাঁর দলবল ১১-সেপ্টেম্বর-১৯৪৫-এ (তারিখটি লক্ষণীয়) যখন তোজোকে ধরতে তাঁর বাড়ি ঘিরে ফেলেন তখন তাঁরা একটি গুলির চাপা শব্দ শুনতে পান। ধরা দেবার পরিবর্তে সম্মানজনক মৃত্যুর আশায় তোজো নিজের বুকে নিজে গুলি করেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক তাঁর বুকে কয়লা দিয়ে একটি বৃত্ত এঁকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন হৃদপিণ্ড কোথায় থাকে। কিন্তু ২২ বছর পরে কর্নেল অরেলিয়ানোর ভাগ্যে যা হবে তোজোর ক্ষেত্রে তাই ঘটে। গুলি তাঁর বিশেষ ক্ষতি না করে পিঠ ফুঁড়ে বের হয়ে যায়। তোজোকে সুস্থ করে তুলে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। হয় অনুশোচনাবশত অথবা রাজকীয় পরিবারকে বাঁচাতে তোজো নিজে সব দোষ স্বীকার করেছিলেন। বিচারে ১২-নভেম্বর-১৯৪৮-এ তোজোর ফাঁসির দণ্ড হয় এবং ২৩-ডিসেম্বর-১৯৪৮ তা কার্যকর করা হয়। জেনারেল তোজো কর্নেল অরেলিয়ানো্র মতো স্বাভাবিক মৃত্যুর সুযোগ পাননি, তাঁকে তাঁর কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে।

**************

দ্বিতীয় ফিৎনার কালে কারবালার যুদ্ধে কে ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলেন? একজন বাঙালী মুসলিম নির্দ্বিধায় এর উত্তর দেবেন ‘সীমার’। এ’কথা সত্যি, যে দলটি ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে নিরস্ত্র ও আহত অবস্থায় পানি পানরত অবস্থায় হত্যা করতে এসেছিল আবু আল-সাবিগা শামির ওরফে শিমর তার নেতৃত্বে ছিলেন। শিমর তাঁর দলের দ্বিধান্বিত সদস্যদেরকে ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করতে অপমানসূচক কথাও বলেছিলেন। শিমর নিজ হাতে ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে হত্যা করেছিলেন কিনা এটা নিশ্চিত না। ইতিহাসের কোনো কোনো ভাষ্যকারের মতে ঐ দলের সিনান ইবনে আনাস এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটান।

শিমর ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে নিজ হাতে হত্যা করুন বা না করুন, এই হত্যাকাণ্ডে তাঁর দায়ভার হ্রাসের কোনো সুযোগ নেই। মীর মশাররফ হোসেন বিরচিত মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’-তে এই ঘটনা মর্মস্পর্শী ভাষায় বর্ণিত হয়েছে এবং ইমামের কর্তিত মস্তক নিয়ে ‘সীমার’-এর কুকীর্তিও উপযুক্ত সাহিত্যিক রঙসহ সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। বাঙালী মুসলিমের বৃহদাংশ বিষাদ সিন্ধু পাঠ করুন বা না করুন ঐ উপন্যাসের কাহিনী বিলক্ষণ জানেন এবং সীমারের নামও জানেন। এবং গত ১৩৮ বছরে বাংলা ভাষায় ‘সীমার’ বিশেষ্যটি নির্মম, নিষ্ঠুর, মায়াহীন, জঘন্য চরিত্রের মানুষের প্রতিশব্দ হয়ে গেছে। সাধারণ্যে সীমার শব্দটি জঘন্য গালি হিসাবে বিবেচিত। ফারুক-রোজিনা-প্রবীর মিত্র অভিনীত এইচ. আকবরের চলচ্চিত্র ‘সীমার’ (১৯৮৩), অথবা মান্না-পপি-ডিপজল অভিনীত মনতাজুর রহমান আকবরের চলচ্চিত্র ‘কঠিন সীমার’ (২০০৩)-এর নামকরণের উৎস বিষাদ সিন্ধু এবং এখানেও সীমার দয়াহীন, নিষ্ঠুর, জঘন্য চরিত্রের মানুষকে নির্দেশ করে।

**************

মীর জাফর কে ছিলেন, কেন তাঁর নাম সবাই জানেন ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষত বাংলায় এই প্রশ্ন অবান্তর। মীর মুহম্মদ জাফর আলী খান বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজ্যের বখশী বা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী ছিলেন। তিনি সিংহাসন লাভের আশায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ২৩-জুন-১৭৫৭ সালে পলাশীতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে সংঘটিত যুদ্ধে মীর জাফর তাঁর বাহিনীসহ স্বেচ্ছায় নিষ্ক্রিয় থাকার এবং সিরাজউদ্দৌলাকে সর্বাত্মক আক্রমণ থেকে বিরত রাখার ফলে যুদ্ধে নবাবের পরাজয় ঘটে। মীর জাফর কোম্পানির সহায়তায় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন এবং কার্যত কোম্পানির ক্রীড়ানক পরিণত হন। এর ফলে বাংলা স্বাধীনতা হারায় এবং ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় দুই শতাব্দীব্যাপী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা হয়। পরিণতিতে ইতিহাসের পাতায় মীর জাফরের নাম বিশ্বাসঘাতকের সমার্থক হয়ে যায়। আড়াইশত বছরেরও অধিক কাল পরেও মীর জাফরের এই কুখ্যাতি সমানভাবে সাধারণের মনে বিরাজমান।

১৭৪৬ সালের ডিসেম্বরে মেদিনীপুরে মারাঠাদেরকে পরাজিত করায় আলীবর্দী খান মীর জাফরকে ওড়িশার নায়েব নাযিম নিযুক্ত করেন। এই নিযুক্তি এবং মারাঠাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত সাফল্য মীর জাফরকে ঊচ্চাভিলাষী করে তোলে। এর দুই মাস পরে জানুজী ভোঁসলে ও আলীবর্দী খানের সাবেক সেনাপতি মীর হাবিব ইসফাহানীর নেতৃত্বে মারাঠারা আবার আক্রমণ করতে আসলে তিনি বর্ধমানে পালিয়ে আসেন। তাঁর সাহায্যার্থে সসৈন্যে আতাউল্লাহ খানকে পাঠানো হলে উভয়ে মারাঠা দমনে অগ্রসর না হয়ে আলীবর্দী খানকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। আলীবর্দী এই সংবাদ জানতে পেরে নিজেই সসৈন্যে অগ্রসর হয়ে তাঁদের বিদ্রোহ দমন করেন এবং মীর জাফরকে বখশী পদ থেকে অপসারণ করেন। কিন্তু অমাত্যকূল, সেনাবাহিনী ও সামন্তপ্রভুদের একাংশের চাপে তাঁকে বখশী পদে পুনর্বহাল করা হয়। একই কারণে ১৭৫০ সালে মীর জাফরের ব্যাপক দুর্নীতির তথ্য প্রকাশিত হলেও তাঁকে অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। বরং তাঁর ওপর দৃষ্টি রাখার জন্য তাঁরই কনিষ্ঠ ভ্রাতা মির্জা ইসমাইলের পরিবর্তে খাজা আবদুল হাদীকে সহকারী প্রধান সেনাপতি হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। এই সময়ে আবারও তাঁকে রায় দুর্লভরামসহ মারাঠা দমনের জন্য পাঠানো হলেও তিনি যুদ্ধের ব্যাপারে নিশ্চেষ্ট থাকেন। এই সময়ে দুই স্বভাবজাত লোভী ও বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর ও মীর হাবিবের উদ্যোগে নবাবের সাথে মারাঠাদের সন্ধির উদ্যোগ গ্রহন করা হয়। নবাব শেষ পর্যন্ত মারাঠাদেরকে ১২ লক্ষ রূপী বার্ষিক চৌথ ও ৩২ লক্ষ রূপী বকেয়া চৌথ পরিশোধে সম্মত হলে মারাঠারা আর বাংলা আক্রমণ না করার ব্যাপারে সম্মত হন।

দেখা যাচ্ছে, মীর জাফর কেবলমাত্র পলাশীর যুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গ করেননি, বরং তিনি নবাব আলীবর্দী খানের আমল থেকেই বহু বার বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন। ফলে বাংলা ভাষায় ‘মীর জাফর’ আর বিশ্বাসঘাতক সমার্থক হয়ে গেছে।

**************

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে নূন্যতম জানা একজন মানুষ জানেন হিটলার কে ছিলেন, কী ছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু মানুষের কাছে হিটলার মহান ব্যক্তিত্ব হিসাবে পূজিত। তাঁদের কেউ কেউ হিটলারের নামের সাথে মিলিয়ে তাঁদের নিজেদের বা নিকটজন কারো পুত্রের নাম ‘হিটলার’ রাখেন। এমনটা ভাবার কারণ নেই যে তাঁরা জার্মানীর বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে তাঁদের সন্তানদের নাম রাখতে পছন্দ করেন। যদি তাই হতো তাহলে আমাদের দেশে প্রচুর বিথোফেন, বিসমার্ক, আইনস্টাইন, গ্যোটে, গুটেনবাখ, শুমাখাহ নামের লোকের দেখা পাওয়া যেতো। বাস্তবে তা দেখা যায় না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আরেকটু বেশি জানা মানুষ তোজোর কীর্তি সম্পর্কেও জানেন। তাঁদের মধ্যে যারা তোজোকে মহান ব্যক্তিত্ব মনে করেন তাঁদের কেউ কেউ তোজোর নামের সাথে মিলিয়ে নিজেদের বা নিকটজন কারো পুত্রের নাম ‘তোজো’ রাখেন। এবং এখানেও আমরা এদেশে হিরোহিতো, আকিহিতো, নারুহিতো, নগুচি, কাওয়াবাতা, মুরাকামি ইত্যাদি জাপানী নামের মানুষ খুব একটা দেখতে পাই না।

স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইউব খান কে সেটা কোনো বাংলাদেশীকে বলে দিতে হবে না। তার পরেও মার্শাল আইউব নামের লোকজনও আমাদের চারপাশে দেখতে পাই। নিজেদের সন্তানের এমন নাম রাখার কারণ কী? এই প্রশ্নের উত্তরে শোনা যায়, ‘আহা! এই নামের অর্থ তো খারাপ না। তাছাড়া আইউব একজন নবীর নাম’। কথা সত্য, আইউব নামের অর্থ সহনশীল, কিন্তু মার্শাল আইউব বললে তো আর তা বোঝায় না। তা শিমর (মৌরী) অথবা মীর (রাজপুত্র) জাফর (জলধারা) নামগুলোর অর্থই বা খারাপ কী? তাহলে ঐসব লোকজন তাঁদের পুত্রদের নাম শিমর বা মীর জাফর রাখেন না কেন? জাফর নামের তো লাখ লাখ মানুষ এদেশে আছেন তাহলে মীর পরিবারের লোকজন তাঁদের পুত্রদের নাম জাফর রাখেন না কেন? কেন এই দ্বিচারিতা?

**************

বীর পূজার নামে এক প্রকারের ‘বুতপরস্তি’ আমাদের মাঝে আছেন। ফলে কিছু বীরের অন্ধ ভক্তকুল ঐতিহাসিক সত্যগুলো ক্রমাগত অস্বীকার করে যান। যারা সন্তানের নাম হিটলার বা মার্শাল আইউব রাখেন তাঁরা হিটলারের বা আইউব খানের কীর্তি সম্পর্কে কেবল অবগত নন্‌ সেসবের সমর্থকও বটে। হিটলারের করা গণহত্যা বা দেশ দখল তাঁদের কাছে বীরের কাজ। হিটলার কর্তৃক ষাট লাখ ইহুদী ধর্মাবলম্বীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা তাঁদের কাছে ‘উচিত শিক্ষা’ বলে মনে হয়। এমন না যে এই মানুষগুলো সব গণহত্যাকে সমর্থন করেন। তাঁরা মধ্যপ্রাচ্য বা আফগানিস্তানে চালানো মার্কিনী নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর গণহত্যার নিন্দা করেন বটে কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী বাহিনী আর তাদের দোসদের দ্বারা পরিচালিত গণহত্যার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেন। তাঁদের এই দ্বিচারিতার কোনো ব্যাখ্যা তাঁদের কাছে পাওয়া যায় না।

যারা প্রায়ই বলে থাকেন ‘আইউব খানের আমলই ভালো ছিল’ তাঁরা এই কথা কীসের ভিত্তিতে বলে থাকেন সেটি বলেন না। ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মাথাপিছু আয় মাত্র ৬২ ডলার আর পশ্চিম পাকিস্তানে মাথাপিছু আয় মাত্র ১৪৩ ডলারের কথা বলেন না। তাঁরা ভুলে যান শুধু পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষও আন্দোলন করে আইউব খানকে উৎখাত করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে গণআন্দোলনে কমপক্ষে ১৯৬ নিহত হবার সাথে সাথে পশ্চিম পাকিস্তানেও কমপক্ষে ৪৩ জন নিহত হয়েছিলেন। লুটপাটের অলিগার্কি প্রতিষ্ঠা করা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করা, দেশকে অধঃপাতের চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে যাবার জন্য আইউব খানের দায়কে তাঁরা নির্লজ্জের মতো অস্বীকার করেন। অথচ এই মানুষগুলো তাঁদের অপছন্দের শাসকদের সমালোচনায় মুখর হন। এই প্রকারের দ্বিচারিতাকে ‘জাতীয় বৈশিষ্ট্য’ বলার উপায় নেই, তবে এটি জনগোষ্ঠীর একাংশের মধ্যে যে প্রকটভাবে বিদ্যমান সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। নামকরণ নিয়ে দ্বিচারিতা ঐ বৈশিষ্ট্যেরই অংশ।


মন্তব্য

নীড় সন্ধানী এর ছবি

বুকে দাগ দিয়ে তোজোর আত্মহত্যার ঘটনাটা আগে জানা ছিল না। মার্কেজের উপন্যাসে পড়ে খুব চমকপ্রদ এবং অবিশ্বাস্য লেগেছিল। সত্যি সত্যি যে ওরকম ঘটনা ঘটে গেছে জানাই ছিল না। মার্কেজ তাহলে ওই ঘটনা থেকেই উপন্যাসে ব্যাপারটা নিয়েছেন।

বাঙালীর দ্বিচারিতার সীমা নাই। দুটো উদাহরণ দেই আপাততঃ

ছেলেবেলায় অনেককে ছন্দ মিলিয়ে বলতে শুনতাম, "শেখ মুজিবের ভাষণ, আইয়ুব খানের শাসন"। এই দুইটা জিনিস তাদের চোখে সেরা। তখন ব্যাপারটা নিয়ে বোঝার ক্ষমতা ছিল না। বড় হবার পর ভেবে অবাক হয়েছি একই মানুষের এরকম বিপরীত দুটো জিনিস পছন্দ হবার কারণ কী? শেখ মুজিবের ভাষণ যার পছন্দ তার তো আইয়ুব খানের শাসন পছন্দ হবার কথা নয়। এটার কোন হিসেব মেলাতে পারিনি কখনো।

এরশাদের আমলে বিরোধী দলের মুখে নানা শ্লোগানের মধ্যে একটা বিচিত্র শ্লোগান শুনতাম রাস্তাঘাটে। "গোলাম-আজম সাঈদী, বাংলার ইহুদি"। এটারও মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারিনি। কখনো হিসেব মেলাতে পারিনি সাঈদী কোন হিসেবে ইহুদীর তুল্য হয়?

এরকম অদ্ভুত ব্যাপার আরো অনেক আছে। এমনিতে সরল বলে বিবেচিত আবহমান বাঙালীর মানসিকতা বোঝা তেমন সহজ নয়। তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হলো বাঙালী মুসলমানের মানসজগত।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বিস্তারিত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

কর্নেল অরেলিয়ানোর ঘটনাটি মার্কেজ তোজোর ঘটনা থেকে নিয়েছিলেন কিনা আমি নিশ্চিত নই। তবে নেয়াটা খুবই সম্ভব। ঐ সময়কালে তোজো খুবই আলোচিত ব্যক্তিত্ব। সুতরাং তাঁর আত্মহত্যার প্রচেষ্টাও বেশ আলোচিত হবার কথা। এবং সেটি আঠারো বছর বয়সী গ্যাবোর মনে ছাপ ফেলাও বিচিত্র কিছু নয়।

উদাহরণ-১ঃ আমার মনে হয় এই প্রবচনে আইউব খানের শাসনকে মহিমান্বিত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর ভাষণের তুলনা টানা হয়েছে। এই প্রবচনের উদ্ভাবক এবং প্রচলনকারীরা মোটেও বঙ্গবন্ধুর প্রশংসাকারী নয়। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রশ্নাতীত গ্রহণযোগ্যতার মোড়কে মুড়ে আইউব খানের শাসনের আবর্জনা বাজারে চালাতে চেয়েছেন। এই লোকগুলো শুধু ধূর্ত নয়, তাঁরা বাংলাদেশবিরোধীও বটে।

উদাহরণ-২ঃ খুব আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আশির দশকে আমি এই শ্লোগানটি একটি বড় বাম রাজনৈতিক দলের মিছিলে প্রথম শুনি। আমরা স্বীকার করি বা না করি বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে ইহুদীবিদ্বেষ কাজ করে। এর প্রধান কারণ ফিলিস্তিনে দশকের পর দশক ধরে চালানো ইসরায়েলের বর্বর নৃশংসতা। এর বাইরেও অন্য কারণ আছে সেসব আলোচনার প্রয়োজন নেই। এদেশের সাধারণ মানুষের কাছে ইহুদী = ইসরায়েল। এই অতিসরলীকৃত সমীকরণটি সঠিক নয়, তবে এটিকে এক কথায় উড়িয়ে দেবার উপায় কম। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের এই মনোভাবটিকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে এই মূঢ় শ্লোগানটি আবিষ্কৃত হয়েছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

গোলাম আজম বা সাইদীকে বলার আগে একসময় ওদের গুরু আবুল আলা মউদুদিকে নিয়েও একই ধরনের শ্লোগান দেয়া হয়েছে- পাকিস্তানের ইহুদী। আবুল আলা মউদুদি।। এরকম অভিধার কারন মউদুদি কৃত কোরানের তফসির ও বিভিন্ন ইসলামী ফতোয়া, যা কোন কোন ক্ষেত্রে এদেশে প্রচলিত শরীয়তী ইসলামের সাথে মারাত্মকভাবে সাংঘর্ষিক। সে কারনে এদেশের আলেম সমাজের অনেকে মউদুদিকে ইসলামের শত্রু বলে বিবেচনা করতেন। সুতরাং ইসলামের শত্রুকে ইহুদী বলে অভিহিত করা তো যেতেই পারে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মওদুদীকে নিয়ে এমন শ্লোগানের কথা জানতাম না।
ইহুদী মানেই ইসলামের শত্রু এমন ভাবাটি কি ভ্রান্ত ও অতী সরলীকরণ হয়ে গেলো না?
যে কোনো ধর্মের বা নিধর্মী মানুষ ইসলামের শত্রু বা মিত্র হতে পারেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ডুপ্লি ঘ্যাঁচাং


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

স্কুলে আমাদের সাথে একজন পড়তো, তার নাম মির্জা এনামুল হক। কিন্তু দৈহিক উচ্চতায় আমাদের চেয়ে কিঞ্চিৎ খাটো হওয়ায় দুষ্ট বালকেরা তাকে গ্যেটে বলে ডাকতো। আমি বাংলাদেশে ঐ একজনই পেয়েছি, যার নাম হিটলার ছাড়া অন্য কোন বিশিষ্ট জার্মানের নামের নামে রাখা হয়েছে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

'রোমেল' নামেও লাখ লাখ বাঙালী পাবেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মেঘলা মানুষ  এর ছবি

বাঙালির দ্বিচারিতা বোঝা বড় দায়। মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া একটা দেশের মানুষরাই এক প্রজন্ম পরে, 'একটা স্বাধীন দেশকে আরেকটা দেশ এসে গায়ের জোরে দখল করে নেবে' -সেটা সমর্থন করে।

ছয় মাসে আগে পুকুর দখল করে নেয়া বাহিনী যখন আবার ফিরে আসে গৃহস্থের বসতবাড়ি দখলে, তখন বাঙালি গৃহস্থেরই খুঁত ধরে: "গ্রামের গেরস্ত ক্যান শহর থেকে আনা গুলতি দিয়া কেন বসতবাড়ি রক্ষা করবে? শহরের দোকানদাররা খ্রাপ।"

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বাঙালীদের অনেকের মধ্যে দ্বিচারিতা আছে এটা সত্য, যেমন সেটা অন্য অনেক জাতির বহু মানুষের মধ্যে আছে। এটাকে বাঙালীর জাতিগত বৈশিষ্ট্য বলা যাবে কিনা সেটা গবেষণাসাপেক্ষ। তবে কিছু কিছু সময়ে সেটা mass level-এ দৃষ্টিকটু রকমভাবে প্রকট হয়। এটা কেন সেটাও গবেষণাসাপেক্ষ।

আপনার মন্তব্যের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে কী বোঝাতে চেয়েছেন বুঝতে পারিনি। একটু বুঝিয়ে বলবেন?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

স্পর্শ এর ছবি

লেখাটা ভাল লাগলো।

মীরজাফর আগে একবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো জানতাম, (সিনেমা দেখে)। তবে সে যে আলিবর্দিখার আমল থেকেই বারংবার বিশ্বাসঘাতকতা করে এসেছে এটা জানতাম না। এরকম লোককে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার কারণ বুঝলাম না। যেখানে রাজা-রাজড়া রা মুখের কথায় যে কাওকে শুলে চড়াতে পারে। সেখানে মীরজাফর এতদিন ক্ষমতায় টিকলো কীভাবে।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপাতদৃষ্টিতে ঐসব আমলের নবাবদেরকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী মনে করা হলেও বাস্তবে তা ছিলো না। ঐ সময়ের ক্ষমতাকাঠামোটা মূলত অভিজাততান্ত্রিক ছিলো। নবাব হিসাবে সিরাজ অল্পবয়স্ক, অনভিজ্ঞ, ও দুর্বল হওয়ায় অভিজাতদের ওপর তাঁর নির্ভরশীলতাও বেশি ছিলো। যেমন, সিরাজকে টাকার জন্য জগতশেঠদের ওপর, সৈন্যদলের জন্য মীর জাফরের ওপর নির্ভর করতে হতো। ফলে নবাব চাইলেও শক্তিশালী ব্যাককগ্রাউন্ডের কারো বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারতেন না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।