মরণের পরে
আমি দেখলাম আমি একটা রাস্তার ধারে মরে পড়ে আছি। আমি ঠিক কোথায়, কী করে এখানে এলাম আর কী করেই বা মারা গেলাম তা রহস্যময় থেকে গেলো। যেভাবেই হোক বুঝতে পারলাম আমি আর বেঁচে নেই, এবং এখানে মরে পড়ে আছি। আমার কানে ম্যাগপাইয়ের ডাক, কাকের কা-কা রব ভেসে এলো। তাজা বাতাসে সোঁদা মাটির গন্ধ আমার নাকে লাগলো। বোঝা গেল সময়টা সকাল। আমি চোখ খোলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু চোখের পাতারা আর আমার নিয়ন্ত্রণে ছিলনা। হাত নাড়াতে চেষ্টা করলাম, একই ব্যাপার ঘটলো। মৃত্যুর কারণে এমনটা হয়েছে বুঝে ভয়ে আমার ভেতরটা কুঁকড়ে উঠলো।
যখন জীবিত ছিলাম তখন এটা ভেবে শিহরিত হতাম যে - যদি মানুষের মৃত্যু মানে তার ঐচ্ছিক স্নায়ুতন্ত্রের পক্ষাঘাতগ্রস্থতা হয় কিন্তু অনুভূতি সম্পূর্ণ বিদ্যমান থাকে তাহলে সেটাতো একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার হবে! কে জানতো আমার সেদিনের কল্পনাই একদিন বাস্তব হয়ে দেখা দেবে আর আমাকেই সেই রূঢ় বাস্তবের স্বাদ নিতে হবে!
কারো পায়ের শব্দ শোনা গেলো। বোঝা গেলো কেউ পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেন। মাথার কাছ দিয়ে একটা ঠেলাগাড়ি চলে গেলো। গাড়িটা নিশ্চয়ই মালবোঝাই ছিল। গাড়ির চাকার ক্যাঁচকোঁচ শব্দে আমার স্নায়ুতন্ত্র ঝিন ঝিন করে উঠলো, আমার দাঁতে দাঁত ঠোকাঠুকি খেতে লাগলো। একসময় চারদিকটা গাঢ় নীলচে-লাল রঙে ডুবে যেতে লাগলো। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সূর্য উঠে গেছে, আর আমি নিশ্চয়ই পূব দিকে মুখ করে পড়ে আছি। এগুলোর কিছুই তখনো কোন সমস্যা ছিলনা।
কৌতুহলী লোকজনের কণ্ঠস্বর শোনা গেলো, তাদের আগ্রহী দৃষ্টিও যেন অনুভব করলাম। তাদের চলায় ওড়া ধুলো মেঘের মত আমার নাকের উপর দিয়ে উড়ে গেলো। আমার ভীষন হাঁচি পেল, কিন্তু হাঁচি দিতে পারলামনা। নাকে অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম - কিসের অপেক্ষা তাও জানিনা। আরো অনেক মানুষের পায়ের শব্দ আমার কাছে এসে থেমে যাচ্ছিল, আবার দূরেও চলে যাচ্ছিল। যারা পাশে দাঁড়াচ্ছিলেন তারা ফিসফিসিয়ে কথা বলছিলেন। তাই তারা কী বলছিলেন বোঝা যাচ্ছিলনা, কেবল টুকরো টুকরো কথা শোনা যাচ্ছিল। যেমন, ‘মরে গেছে?’ ‘হুঁম!’ ‘ভালো।’ ‘কিন্তু ... আমার মনে হয় ... খুব খারাপ...’। আমি এই ভেবে খুশি হচ্ছিলাম যে সেখানে একটা কণ্ঠস্বরও আমার পরিচিত না। যদি তাই হতো, তাহলে পরিচিতদের কেউ হয়তো আমার জন্য দুঃখিত হতেন, কেউ হয়তো খুশি হতেন, আবার কেউ হয়তো রাতের খাবারের পর আলোচনা করার জন্য একটা ভালো বিষয় পেতেন। এবং এভাবে আমার জন্য তারা তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করতেন। এমনটা হলে ব্যাপারটা আমাকে কষ্ট দিত। যেহেতু এখানে কেউ আমাকে চেনেননা, তাই তাদের ক্ষেত্রে অমন কিছু ঘটবেনা বলে মনে করি। যাকগে, যাই হোক, মরে গিয়ে আমি তো কারো কোন ক্ষতি করলামনা!
একটু পর মনে হল একটা পিঁপড়ে আমার পিঠ বেয়ে ওঠা শুরু করেছে। পিঠ সুড়সুড় করতে লাগলো। স্বাভাবিক অবস্থায় স্রেফ আরেক পাশে ফিরে শুলেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। মরে যাওয়ায় নড়াচড়া করার উপায় নেই তাই এর হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেলনা। এবার মনে হল আরেকটা পিঁপড়ে আমার উরু বেয়ে উঠছে। ভালো! তুচ্ছ পোকামাকড়ের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার উপায় এখন আর নেই। অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকল। গুন গুন শব্দে উড়ে এসে কেউ আমার গালে বসলো। তারপর কয়েক পা হেঁটে আমার নাকের ডগায় চড়ে বসলো। ‘আমি বিখ্যাত কেউ নই স্যার! আমার নাকে গল্প করার মত কোন মশলা খুঁজে পাবেননা’, আমার খেদোক্তি কেউ শুনতে পেলনা। এবার জনাব আমার নাকের ডগা থেকে নেমে আমার ঠোঁটের উপর বসে তার চট্চটে জিভ দিয়ে চাটতে শুরু করলো। আমার মনে হল, আহা! এটা যদি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হত! কিছুক্ষণের মধ্যে উনার সঙ্গীসাথীরা হাজির হলো। তারা আমার ভ্রূর উপর দিয়ে হাঁটতে লাগলো। তাতে ভ্রূ সুড়সুড় করে উঠলো। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ার ধাক্কায় তারা সব উড়ে গেলো। যেতে যেতে তাদের আক্ষেপ শুনলাম, ‘বেচারা’! অপমানে আমি চিৎকার করতে চাইলাম, পারলামনা।
এইসময় আমার খুব কাছে ধপ্ করে কাঠের ভারী কিছু ফেলার শব্দ পেলাম। কপালের ওপর মনে হলো খড় পড়ে আছে। আমার চারপাশ থেকে সবাই বোধহয় একটু সরে গেলেন। তাদের ছায়ার পর্দাটা সরে যাওয়ায় প্রখর সূর্যের তাপটা টের পাওয়া গেলো।
‘ব্যাটা মরার আর যায়গা পেলনা!’ আমার উপর প্রায় ঝুঁকে কেউ একজন বললেন। কিন্তু একজন মানুষ কোথায় মারা যেতে পারে? বেঁচে থাকতে আমি ভাবতাম একজন মানুষ যেখানে খুশি সেখানে বাস করতে পারেনা ঠিক, অন্ততঃ সে যেখানে খুশি মরতে পারে। আমার এই ধারনাটা ঠিক ছিলনা। এমনকি মরে গিয়েও প্রত্যেককে সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়। আফসোস্ হল এই ভেবে যে এই বোধোদয়গুলো লিখে ফেলার জন্য হাতের কাছে কাগজ-কলম নেই। অবশ্য থাকলেই বা কী হত, আমি তো আর লিখতে পারতামনা। যদি কোনভাবে লেখাও যেত তাহলে সেগুলো ছাপতো কে? যাকগে, ওসব নিয়ে মিছে ভাবার দরকার নেই।
কিছু লোক আমাকে নিতে আসলেন। কিন্তু তারা কারা তা বুঝতে পারলামনা। তলোয়ারের ঠুং ঠুং শব্দে বুঝতে পারলাম ভীড়ের মধ্যে পুলিশও আছে। আমি ভাবতে চাইলাম আমি এখনো মারা যাইনি। বার বার পাশ ফিরতে চাইলাম। কল্পনা করলাম যেন উঠে বসেছি। কিন্তু সব চেষ্টাই বৃথা গেল। টের পেলাম আমাকে কফিনে ঢুকিয়ে ডালা বন্ধ করে দেয়া হলো। আশ্চর্যের ব্যাপার মাত্র দুটো পেরেক মেরে তারা কাজ শেষ করলেন। তাহলে কি সব সময় দুটো পেরেক মেরেই কফিনের ডালা বন্ধ করা হয়? বুঝলাম এবার যথার্থই সবকিছু শেষ হয়ে গেলো। কফিনের এই ছয় দেয়ালে ভেতর আমাকে পেরেক ঠুঁকে আটকে দিয়েছে, এখন এর মধ্যে থেকেই আমাকে মনে মনে মাথা ঠুকতে হবে।
যদিও নিশ্চিত ছিলামনা আমাকে কোথায় কবর দেয়া হবে, অথবা আদৌ কবর দেয়া হবে কিনা। তবু আগের দুরবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ায় শান্তি পাচ্ছিলাম। মাথার পেছনে খড়ের দড়ি বেশ লাগছিলো তবু মনে হল এমন কফিনও মন্দ না। একটা ব্যাপারে শুধু খটকা লাগছিলো আমার অন্ত্যেষ্টির জন্য খরচটা কে করলেন? কিন্তু যেসব বদমাশ আমাকে কফিনে ঢুকিয়েছে তাদেরকে অভিশাপ দিতে ইচ্ছে করলো। আমার শার্টের একটা কোনা কুঁচকে পিঠের নিচে চলে গিয়ে অস্বস্তি বাড়িয়ে দিচ্ছিল। ব্যাটারা ওটা সোজাও করে দেয়নি। ওরা ভেবেছে কী? মরে গেছি বলে কি আমার কোন অনুভূতি অবশিষ্ট নেই? আর সেজন্য এমন অসাবধানের মত কাজ কারবার!
যখন বেঁচে ছিলাম তখনকার চেয়ে আমার শরীর আর ভারী হয়ে গেছে। আর এই ভারী শরীরের চাপে কুঁচকে যাওয়া শার্ট অস্বস্তিটা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। নিজেকে এই ভেবে সান্ত্বনা দিলাম, হয় এটা শীঘ্রই সহনীয় হয়ে যাবে অথবা শীঘ্রই আমার শরীর পঁচে যাবে। কিন্তু এতেও কষ্টটা ভোলা গেল না। হঠাৎ একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, ‘কেমন আছেন স্যার? আপনি কি মারা গেছেন’? এবার চোখ মেলতে পারলাম। দেখি পোকুচাইদের বইয়ের দোকানের পিয়ন। বিশ বছর আগে তাকে শেষ দেখেছিলাম। সে কিন্তু বিশ বছরে একটুও বদলায়নি, দেখতে ঠিক আগের মতই লাগছিল। এবার আমার কফিনের সবগুলো পাশ খুঁটিয়ে দেখলাম - একেবারেই রদ্দি মাল। ভেতরটা মসৃন করার কোন চেষ্টাই করা হয়নি।
‘কিছু মনে করবেন না, এসব কোন ব্যাপারই না’ গাঢ় নীল রঙের একটা কাপড়ের বান্ডিল খুলতে খুলতে সে বলল। ‘আপনার জন্য কুঙ ইয়াঙের লেখা মিঙ রাজবংশের উপর সমালোচনার একটা বই এনেছি - চিয়া চিঙ-এর আমলের। এই বইটার মার্জিনগুলো কালো রঙের। এটা রাখুন, আর এটা ...’।
‘তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? তুমি কি দেখতে পাচ্ছনা আমি কী অবস্থায় আছি”? এবার দেখি কথা বলতেও পারছি! ‘এই মিঙ রাজবংশের সমালোচনা দিয়ে আমি কী করবো”?
‘এটা কোন ব্যাপার না স্যার। কিছু মনে করবেন না”।
আমি রাগে চোখ বন্ধ করলাম। কিছুক্ষণ আর কোন শব্দ শুনতে পেলাম না। পোকুচাইদের পিয়ন নিশ্চয়ই চলে গেছে। তখন আবার মনে হল একটা পিঁপড়ে আমার গলা বেয়ে মুখে চলে এসেছে। এবার সে আমার চোখের চারপাশে ঘুরতে শুরু করলো।
মানুষ কখনো ভাবতে পারেনা যে মৃত্যুর পর তার চিন্তাধারা বদলে যেতে পারে। এমন চিন্তা আমার হৃদয়ে আঘাত করে আমার প্রশান্তিটা নষ্ট করে দিল। এক ঝাঁক অস্পষ্ট স্বপ্ন আমার চোখে ভেসে উঠলো। আমার কিছু বন্ধু আমাকে সুখী দেখতে চেয়েছিলেন আমার কিছু শত্রু আমাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। এখন আমি সুখী হইনি, ধ্বংসও হয়ে যাইনি। আমি এখন এমন এক দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছি যা আমাকে কোথাও পৌঁছে দেয়নি। আমি যে মারা গেছি এই ভাবনাটা এখন আমার কাছে এক পলাতক ছায়ার মত - যার কোন মূল্য নেই। অথচ এই মারা যাবার ব্যাপারটা আমার শত্রুদের সামান্য হলেও আনন্দ দিত।
আমার বিজয়ে আমি কাঁদতে চাইলাম - মৃত্যুর পর আমার প্রথম কান্না। কোন অশ্রু বের হলোনা, আমার চোখ পিঁটপিঁট করে উঠলো - আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম।
(ইংরেজী অনুবাদ থেকে বাংলায় রূপান্তরকাল - ১৯৮৯)
মন্তব্য
এক নাগাড়ে করতে থাকুন।
তাঁর ‘ডায়েরি অফ আ ম্যাডম্যান' এর অনুবাদ পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে।
-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
১৯৮৯ সালে উচ্চমাধ্যমিক দেবার পর বেকার সময়ে ল্যু স্যুন অনুবাদ করতে ধরেছিলাম। এই লেখাটা তখনকার। গাজর রঙা ল্যু স্যুনের বইটা হারিয়ে গেছে, সেই সাথে আমার বেশিরভাগ অনুবাদ। বাসার জঞ্জাল পরিষ্কার করার সময় এইটা আর কয়েকটা ছোট-খাট অখাদ্য অনুবাদ পেয়েছি। 'বুনো ঘাস'-এর ইংরেজী অনুবাদটা পেলে সেগুলোকে ঘষামাজা করে পাতে দেয়া যেত। ইংরেজী অনুবাদটার জন্য একজনকে বলে রেখেছি, দেখি পাই কিনা।
সেই আমলে 'উন্মাদের ডায়েরী' অনুবাদ করতে ধরে পিছিয়ে এসেছিলাম। তবে 'কুঙ আই চি' অনুবাদ করেছিলাম সেটা মনে আছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কী ভাল অনুবাদ!!!!
এই লাইনগুলো মনে গেঁথে নিলাম।
এরকম অনুবাদ আর গল্প যদি আরো আসত.....
ল্যু স্যুনের লেখা পড়লে লাইনের পর লাইন কোট করা যাবে।
অনুবাদটা জুতের হয়েছে বলে মনে হচ্ছেনা। পাঠককুলও খেয়েছে বলে মনে হচ্ছেনা।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অসাধারণ... দাদা অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে
_____________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ
আপনাকেও ধন্যবাদ।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
facebook
মৃত্যুর পরও কারো অনুভূতি টিকে থাকলে আসলেই ভয়ংকর হবে!!
এটা অসাধারণ হয়েছে দাদা!
.........
রংতুলি
নতুন মন্তব্য করুন