রসে-বশে -০৪

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: রবি, ১০/১০/২০১০ - ৫:১৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দোহাইঃ   এটা কোন ধারাবাহিক লেখা নয়। একই ধরণের লেখার জন্য প্রতিবার নতুন নতুন নাম খোঁজার ঝামেলা এড়াতে শিরোনামের পরে ক্রমবাচক সংখ্যা বসানো হয়েছে। অনিয়মিত এই সিরিজের প্রত্যেকটি লেখা মাসুদ রানার মত স্বয়ংসম্পূর্ণ। পাঠকের পক্ষে আমার নতজানু মনন, অপচিত মেরুদণ্ড সিরিজের সাথে এই সিরিজের মিল পাওয়া আশ্চর্যের কিছু না।

 

একটা বিষয় যদি লক্ষ করেন তাহলে দেখবেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি-নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রসঙ্গে মোটামুটি এরকমটা বলেন যে, আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছি, খুনীদের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে, কয়েকজনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে, বাকি খুনীদের খুঁজে বের করে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হবে। এই বক্তব্যটা দেবার সময় তাদের টোনে এই আত্মতৃপ্তির আভাস পাওয়া যায় যে, তারা এই নৃশংস, বর্বরোচিত ও জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য সম্পাদন ও আংশিকভাবে রায় কার্যকর করতে পেরেছেন। তাদের কেউ কেউ এও বলেন, এতে এতদিন পর জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে না পারা ও হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে না পারা নিঃসন্দেহে জাতির জন্য কলঙ্কজনক। কিন্তু যে বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে তাতে আমরা কি বলতে পারি সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে? এবং আমরা কলঙ্কমুক্ত হয়েছি?

 

যে কোন অপরাধের একটি উদ্দেশ্য থাকে। এক বা একাধিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠির সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়া দেশের রাষ্ট্রপতি ও দেশের ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতাকে হত্যা করার ঝুঁকি কেউ নেবে না। একথা কেউ বলবেন না যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বারো জন আসামীর কারো সাথে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার পরিজনের এমন কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিলো যার দরুন তারা সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারে ও এমন বিরাট ঝুঁকি নিতে পারে। হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়ে আমরা দেখতে পাই এই খুনীদেরকে বছরের পর বছর বিদেশে পালিয়ে থাকতে হয়েছে। তাদের কেউ দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধাণমন্ত্রী, মন্ত্রী বা এমপি হতে পারেনি (একজন কেবল স্বল্পসময়ের জন্য এমপি হয়েছিলো)। তারা ক্ষমতার স্বাদ পায়নি, সমাজ বা রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এখনো তাদেরকে মৃত্যুর পরওয়ানা মাথায় করে দেশে দেশে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। অর্থাৎ তাদের এই অপকর্মের বিশেষ সুফল তারা ভোগ করতে পারেনি। এই হত্যাকাণ্ডে না জড়ালে তারা এরচেয়ে সমৃদ্ধ, নিরাপদ ও সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারতো। তার মানে হচ্ছে, তাদেরকে বলি দিয়ে অন্য কেউ (একাধিক জন অর্থে) এই হত্যাকাণ্ড থেকে সুফল ভোগ করেছে।
  
আদালতে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ঐ বারো জন হত্যাকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিল (অর্থাৎ তারা হত্যা করেছে, হত্যায় সহযোগিতা করেছে)। এহেন অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে, এবং তাই হয়েছে - এনিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু এই বিচারপ্রক্রিয়ায় এটি স্পষ্ট হয়নি এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য কী ছিলো, মূল পরিকল্পনা কী ছিল, কাদের পরিকল্পনায় এটি ঘটেছে। দেশের রাষ্ট্রপতিকে হত্যার পিছনে কী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিলো সেটি স্পষ্ট হয়নি। এই ঘটনায় একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা হয়, সেই সরকার উৎখাতের বিচারও হয়নি।

 

বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল বেনেফিশিয়ারীরা আজ নানা দলে নানা দেশে মিশে গেছে। এই ঘটনার ফল হিসাবে যারা রাষ্ট্রপতি, প্রধাণমন্ত্রী, মন্ত্রী বা এমপি হয়েছিলো, যারা রাষ্ট্রদূত বা অন্যান্য সরকারী চাকুরীর সুবিধা পেয়েছিলো আজ তাদের কথা, তাদের নাম উচ্চারিত হয়না। যারা বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকের মুখে ঠেলে দিয়েছিল, যারা কর্তব্যে অবহেলা করে বঙ্গবন্ধুকে মরতে দিয়েছিল, যারা বঙ্গবন্ধুর খুনীদেরকে গ্রেফতারের বদলে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল, যারা খুনীদেরকে বছরের পর বছর বিদেশে অর্থ সাহায্য করে গিয়েছিল, যারা খুনীদেরকে দূতাবাসে চাকুরী দিয়েছিল বস্তুতঃ তাদের প্রত্যেকেই এই হত্যাকাণ্ডের দায় বহন করার কথা। কিন্তু সেকথাও আজ কেউ বলেনা। বরং মাঝে মাঝে অনেককে তাদের পক্ষে সাফাই গাইতেও দেখা যায়। সবাই বাকি খুনীদের ফাঁসি কার্যকর করার ব্যাপারেই কেবল জোর দেয়। এবিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে বাকি খুনীদের ফাঁসি কার্যকর করাটা জরুরী। তার মানে এই না যে বাকি বিষয়গুলো আলোচনা না করলেও চলবে। বরং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বাকি বিষয়গুলোও বিচারের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। নয়তো ভবিষ্যতে এমন অন্যায়ের পূনরাবৃত্তি হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

আমাদের স্বাধীনতার জন্য, আত্মপরিচয়ের জন্য যে মানুষটার কাছে আমরা সবচে বেশি ঋণী সেই মানুষটাকে হত্যার সঠিক বিচারের ব্যাপারে আমাদের উদাসীনতা এবং অন্যায় মেনে নেবার প্রবনতা আশ্চর্য রকমের। এনিয়ে কোনো উদ্যোগের কথাও কেউ ভাবেনা। এই অবহেলা নিয়ে কোন অনুশোচনা ও কলঙ্কবোধ আমাদেরকে তাড়িত করেনা। আমরা যথারীতি রসে-বশে থাকি। আমাদের নেতারাও অমন রসে-বশেই থাকেন।
 

 ******************************************************** 

টেলিভিশনে দেখলাম দুদিন আগে নাটোরে একজন উপজেলা চেয়ারম্যানকে দিন-দুপুরে রাস্তায় পিটিয়ে, কুপিয়ে হত্যা করা হলো। হত্যার এমন দৃশ্য টেলিভিশনে দেখে আমরা শিউরে উঠি। ভাবি ২০০৬-এর অক্টোবরের শেষের কয়েকদিন ধরে গুলিস্তানে যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলে তার বিস্তৃতি কি নাটোরেও ঘটলো? সরকার বলছে নাটোরের ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যাকারীদের শনাক্ত করে বিচার করা হবে। আমরা সরকারের কথায় হয়তো ভরসা করতে পারি। ২০০৬-এর ঘটনার ভিডিও ফুটেজও কিন্তু আমরা টেলিভিশনে দেখেছি। কিন্তু সেই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে কাউকে সনাক্ত করা হয়েছে, তারপর তার বিচার করা হয়েছে বা কারো শাস্তি হয়েছে বলে শুনিনি। ঐব্যাপারটা পুরনো হয়ে গেছে বলে আমরা কি চুপচাপ থাকবো? এভাবে চুপ থাকলে আগামীকাল আমার মাথায়ও যদি লাঠির ঘা পড়ে, বা মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী বলে কেউ কোপানো শুরু করে তখনও কি এমন রসে-বশে থাকতে পারবো?


মন্তব্য

মহাস্থবির জাতক এর ছবি

হত্যাকাণ্ডের প্রধান বেনিফিশিয়ারি কে, কার মোটিভ বেশি, সেদিক হিসেব করে তদন্ত করা পুলিশের একটা প্রধান কাজ। কিন্তু, এই বিরাট ঘটনাটার ক্ষেত্রে সেটাও হলো না, কাদের গাফিলতিতে এই দুর্ঘটনা ঘটলো, তা জেনেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। এরই ধারাবাহিকতায় বোধহয় এমপির আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি বেরুলেও তিনি দায়মুক্ত বলে খোদ পুলিশের মাথা সনদ দেন।

হাজারবার এই কথা উচ্চারিত হয়েছে, পেছনের মহাশত্রুদের খবর নিন। জানুন, বুঝুন, কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সাহস পায় খুদে একদল নিম্নপদস্থ সেনাকর্মকর্তা। কিন্তু, কোথায় বা কি, ভূতের ফাঁকি।

আবারও আমরা সেপথে হাঁটার জন্যে ঠিকাদার নিয়োগ করার রাস্তা খুঁড়ে রাখলাম।

রসে থাকবেন কি-না জানি না, তবে বশে থাকলেও থাকতে পারেন। সেক্ষেত্রে এটা ভুলে যান, "নির্ভীক প্রাণের চেয়ে বড় আর কোন সম্পদ নেই।" কে বলেছিলেন, কে বলেছিলেন....????
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!

(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)

_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!

(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)

চতুর্বর্গ এর ছবি

কথাটা মনে হয় কর্ণেল আবু তাহেরের "নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে বড় কোন সম্পদ নেই" হবে।

দুর্দান্ত এর ছবি

এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য কী ছিলো, মূল পরিকল্পনা কী ছিল, কাদের পরিকল্পনায় এটি ঘটেছে

জানতে ইচ্ছা করে মুজিব পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যদের কারো মনে এই প্রশ্ন কখনো জাগে কি না। মাঝে মাঝেই হাসিনার মুখে পিতৃহন্তারকদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে পারার কথা শোনা যায়। কিন্তু তার পিতার পুরুষ সদস্যদের মৃত্যুর বেনেফিশিয়ারির মধ্যে তো তিনি ও তার বকুলফুল খালেদা দুজনেই পড়েন। এসব প্রশ্ন করলে তাদের বেনেফিশিয়ারিগিরি যদি লোপ পায়?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।