মুহম্মদ জুবায়েরের অপ্রকাশিত রচনা: বালকবেলা / ‘আহা কী যে বালখিল্য’ - ০৬

সন্দেশ এর ছবি
লিখেছেন সন্দেশ (তারিখ: মঙ্গল, ২৪/০২/২০০৯ - ১:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৬. নানা রঙের মানুষগুলি - ২

আমার সেই সময়ের আরেক হিরো পাড়ার খোকা ভাই, পোশাকী নাম আবদুর রহমান। তাঁর কনিষ্ঠ সহোদর ফটু এবং মামাতো বা ফুপাতো ভাই মটু আমার সমবয়সী, সে বাড়িতে আমার যাতায়াত অবাধ। খোকা ভাই থাকতেন বাড়ির বাইরের দিকের একটি ঘরে। ফোর এইচ ক্লাবের ফুটবল ছাড়া আর সবকিছুতে প্রধান সংগঠক খোকা ভাই। ক্যারমে তিনি বগুড়া শহরের রানার আপ, চ্যাম্পিয়ন বাদুড়তলার মিন্টু। খোকা ভাই ব্যাডমিন্টনও খেলতেন অসাধারণ। এই দুটি খেলায় আমার কাছে সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন তিনিই, তাঁর খেলা যেন অপরূপ শিল্পের কারুকাজ-খচিত। ইংরেজিতে হয়তো স্টাইলিশ শব্দটি ব্যবহার করা চলে। ব্যাডমিন্টনে আমাদের শহরের দীর্ঘকালের চ্যাম্পিয়ন আইনুলের খেলাও আমার কাছে ততো চমকপ্রদ লাগতো না, যতোটা লাগতো খোকা ভাইয়ের প্রায়-নৃত্যপর মনোহর একেকটি মুভমেন্ট। আজও চোখে লেগে আছে সেইসব।

তিনি যা করেন, তাতে থাকে একটু সৌন্দর্যবোধের স্পর্শ। পোশাকে-আশাকে পরিপাটি, ব্যাকব্রাশ করা নিপাট চুল, ভাসা ভাসা চোখ দুটি মায়াবী। রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীতে আবৃত্তি করেন, নাটক হলে নায়কের ভূমিকা বাঁধা। আযিযুল হক কলেজের ছাত্র তিনি, পড়াশোনায় খুব মেধাবী ছিলেন বলে শুনিনি। কিন্তু আমার হিরো হওয়ার জন্যে তা কোনো বাধা হয়নি।

একবার ঠিক হলো, ক্লাবের দেওয়াল পত্রিকা হবে। নাম ঠিক হয়েছে কাকলি। সম্পাদক খোকা ভাই সাদা পোস্টার বোর্ডে নিজের হাতে লিখলেন, অলংকরণ করলেন। আমার একটি রচনা সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো। উল্লেখ করার মতো কিছু তো নয়ই, মৌলিক রচনাও নয়। আসলে ছিলো বইয়ে পড়া বা মুখে শোনা কিছু ব্যঙ্গ-কৌতুকের সংকলন। ভাষাটি নিজের এই যা। অবশ্য তা কতোটা নিজের, কতোখানি টুকে নেওয়া বা ধার করা, এতোকাল পরে তা আর জানার উপায় নেই, কিন্তু আশংকাটি উল্লিখিত হওয়া দরকার। রচনাটি নয়, আসল কথা সেই প্রথম আমার প্রকাশিত হওয়ার বাসনাটি প্রকাশিত হলো। এক অর্থে খোকা ভাই আমার প্রথম সম্পাদক।

কালাম ভাইদের মাঠে, যেখানে নাটক মঞ্চস্থ হয়, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী হয়, ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট হয় – যা ওই ক'টি দিন বাদে মূলত সারাবছর আমাদের দখলে থাকে। বালিকারা এক কোণে জায়গা করে নিয়ে এক্কা-দোক্কা খেলে। আমরা বালকরা ফুটবল-ক্রিকেট খেলি। বল কিন্তু একই – টেনিস বল। দুটো আধলা ইট দুই দিকে বসিয়ে গোলপোস্ট, গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে খেলা হয়। বৃষ্টিতে ভিজে খেলার সেই হর্ষ-আনন্দ আর কীসে আছে? বৃষ্টির পানিতে ঘাসের ওপর পানি জমে গেছে, বল আটকে যায়। সেই বলের দখল নিতে হুড়োহুড়ি, হয়তো বল ছেড়ে জমে থাকা পানিতেই পা চালাচ্ছি, ছিটকে আসা পানি সামনে কিছু দেখতে দিচ্ছে না। পা পিছলে পড়ে গেলেও হাসি পায়, ব্যথাবোধ বলে পৃথিবীতে তখন কিছু আছে কিনা কে খবর নেয়! ক্রিকেট খেলা হয় শীতকালে। কয়েকটা ইট পরপর সাজিয়ে স্টাম্পের কাজ দিব্যি চলে যায়। টেনিস বলে ফুটবল খেললে তার নাম বল খেলা, ক্রিকেট-সদৃশ হলে ব্যাটবল।

সত্যিকারের ফুটবল আমরা ব্যবহার করতে শুরু করেছিলাম ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ার সময়। তখন অবশ্য আমরা আর কালাম ভাইদের মাঠে খেলি না। বড়ো হয়ে গেছি যে! খেলতে যাওয়া হয় পাড়া ছেড়ে সামান্য কিছুদূরে। শেরপুর রোড ঘেঁষে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের ঠিক উত্তরে অল্প উঁচু দেওয়ালঘেরা একটি মাঠ ফাঁকা পড়ে থাকতো। সবাই মেডিক্যালের মাঠ বলতো। এখন সম্ভবত সেখানে মেডিক্যাল কলেজ। খেলোয়াড়রা সবাই মিলে চাঁদা তুলে ফুটবল কিনে আনা হতো। সবার সামর্থ্য সমান নয় বলে চাঁদায় সামান্য কমবেশি হতো, তাতে অবশ্য কিছু এসে যায় না। খেলা নিয়ে কথা, আর সব গৌণ সেখানে। আমরা যে ফুটবল কিনতাম, আজকের ফুটবলের সঙ্গে তার ফারাক অনেক। পুরু চামড়ার খোলসে একটি চেরামতো জায়গা থাকতো। তার ভেতর দিয়ে রাবারের ব্লাডার ঢুকিয়ে পাম্প করে বল ফোলানো হতো। পরিমাণমতো বাতাস ঢোকানো হলে ব্লাডারের মুখটি শক্ত করে বাঁধো, তারপর বস্তুটি সজোরে চেপে রেখে জুতার ফিতা বাঁধার কায়দায় খোলসের চেরা জায়গাটি চেপে বাঁধো। তারপরেও বলটি সম্পূর্ণ গোলাকার করা যেতো না। আরো মুশকিল, আমরা খেলি খালি পায়ে, ফিতা বাঁধা জায়গাটি পায়ে লাগলে ব্যথা করতো খুব। তারপরেও তৃপ্তি, ফুটবল খেলছি।

কালাম ভাইদের মাঠে খেলার সঙ্গী ফটু, মটু, নবাব (আমরা লবাব ডাকতাম), আনোয়ার, হস্তালি (আসল নাম হযরত আলী), খালেক। খালেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কিছু বেশি ছিলো। একদিন বল খেলা হচ্ছে। আমার পা থেকে বল কেড়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে খালেক কনুই দিয়ে পাঁজরে ধাক্কা দেয়। নিমেষে মাথায় রক্ত উঠে আসে, খালেকের শার্টের কলার ধরে ঘুষি বাগিয়ে তুলি। নাক বরাবর বসিয়ে দেবো, এইসময় হঠাৎ মনে হয়, ঘুষিটা দেওয়ামাত্র খালেকের নাকমুখ রক্তাক্ত হয়ে যাবে। দৃশ্যটি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাই। বন্ধুকে কেমন করে মারবো? তার নাক ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসছে, দেখবো কী করে? মুহূর্তে স্থির হয়ে যাই, শূন্যে ঝুলে থাকে আমার উদ্যত মুষ্টি। খালেক অবশ্য থেমে থাকেনি, এলোপাথাড়ি গোটাকয়েক ঘুষি পড়েছিলো আমার চোয়ালে। টের পাই, সবাই খেলা থামিয়ে মারামারি দেখছে। আমি মার খাচ্ছি, হেরে যাচ্ছি। অথচ শূন্যে তোলা পাকানো হাতের মুঠি কিছুতেই নামিয়ে আনতে পারি না খালেকের মুখে। তার সঙ্গে বন্ধুত্বের সেখানেই সমাপ্তি, আর কোনোদিন একটি কথাও আর হয়নি।

হস্তালির সঙ্গে এক বিচিত্র অবস্থায় দেখা হয় বারো-তেরো বছর পর। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ছুটিতে বগুড়া গেছি। পুরনো পাড়ায় কিছুক্ষণ হাঁটলাম এক বিকেলে। একটা খালি রিকশা পেয় উঠে বসি। গন্তব্য জানাই, সাতমাথা। রিকশা চলতে শুরু করলে অকস্মাৎ চালকের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, আরে এটা হস্তালি না! ভালো করে দেখি, ঠিক তাই। সে আমাকে কিছু বলেনি, চিনেছে কি না তা-ও বোঝার উপায় নেই, একমনে রিকশার প্যাডল ঘোরায় সে। আমার অস্বস্তি হয়, বিচিত্র এক অপরাধবোধ আমাকে পেয়ে বসে। আমার বাল্যকালের বন্ধু রিকশাচালক, সেখানে আমার কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু সে চালক এবং আমি আরোহী, এইটুকুই সহ্য করতে পারছিলাম না। গন্তব্যে অনেক আগেই আমি হঠাৎ রিকশা থামাতে বলি এবং দ্রুত একটি পাঁচ টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে উল্টোদিকে হাঁটতে থাকি। হস্তালি যদি আমাকে না চিনে থাকে, আমার মুখ তাকে দেখানোর দরকারই নেই।

তস্করবৃত্তির জন্যে শহরে খ্যাতি ছিলো আমাদের পাড়ার তোতা ভাইয়ের, যদিও পাড়ায় নাকি কখনো তা করতেন না। প্রচলিত ধারণা এইরকম যে নেহাত ছিঁচকে না হলে অপরাধীরা নিজের এলাকায় অপরাধগুলি করে না, করে অন্যত্র। হয়তো তোতা ভাইয়ের ক্ষেত্রেও তা সত্যি। একটা সময় ছিলো শুনেছি যখন শহরে কোথাও চুরির ঘটনা ঘটলে সকালে পুলিশ তোতা ভাইকে ধরে নিয়ে যেতো। বিকেলে আবার তিনি ফিরেও আসতেন দিব্যি। মুখ চিনতাম, সাইকেলে চড়ে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া-আসা করতেন, তাঁকে জানলাম একটু বড়ো হয়ে ফোর এইচ ক্লাবে ক্যারম খেলতে গিয়ে। সেই সময় তিনি বগুড়ার ভাণ্ডারী গ্লাস ফ্যাক্টরিতে রাতের শিফটে কাজ করেন। দুপুরের দিকে আসতেন ক্লাবে। বাঁ-হাতি তোতা ভাই খুব ভালো খেলতেন না, তবে তাঁর উদ্দীপনা আর কেউ ভালো খেললে সে বিষয়ে অকৃত্রিম উচ্ছ্বাস ছিলো দেখার মতো। এই তোতা ভাইকে তাঁর সম্পর্কে প্রচারিত গল্পের সঙ্গে মেলানো যায় না। এইসময় তিনি নির্ভেজাল আমোদপিয়াসী একজন মানুষ। ক্লাবঘরের খুব কাছেই তাঁর বাড়ি, তাঁর ছোট্টো মেয়েটি মাঝেমধ্যে দৌড়ে আসে বাবার কাছে নানান বায়না নিয়ে। তখন খেলা থামিয়ে তিনি বিশুদ্ধ স্নেহময় পিতা।

ক্যারমবোর্ডে ব্যবহার্য বোরিক পাউডার আসতো তোতা ভাইয়ের ঘর থেকে। গ্লাস ফ্যাক্টরিতে নাকি এই পাউডারের ব্যাপক ব্যবহার। তার কিছু তাঁর হাত ধরে চলে আসে, বড়ো বড়ো চাঁই আকারে। সেগুলো ভেঙে বিক্রি করতেন তিনি ফোর এইচ ক্লাবের ক্যারম খেলোয়াড়দের কাছে। দোকান থেকে কেনা বোরিকের তুলনায় এই পাউডারের মান অনেক ভালো ও বিশুদ্ধ, পরিমাণেও অনেক পাওয়া যায়। দুই আনার বোরিকে সারাদিন খেলা যায়।

একদিন এক বিশাল কলরবে পাড়া জাগ্রত হয়। পাড়াময় রটে যায়, ময়না খুন হয়েছে। ময়না কে? সে এই পাড়ারই এক নবীন যুবক, তোতা ভাইয়ের ছোটো ভাই। ঘটনাস্থল ঠনঠনিয়া মসজিদের পেছনে মানুষ গিজগিজ করে। তার ফাঁক দিয়ে নিজের অকিঞ্চৎকর শরীরটি গলিয়ে দিই। সামনে এসে দেখি, প্রায় পত্রশূন্য একটি বৃক্ষের তলায় চিৎ হয়ে পড়ে থাকা একটি শরীর। এই তাহলে ময়না। আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কালচে রক্ত জমাট বেঁধে আছে বুকের ওপর। আমার বোঝার কথা নয়, বলাবলি শুনে বুঝি ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়েছে তাকে। শরীরটি ঠিক শায়িত নয়, দুই পা পেছনের দিকে মোড়ানো। যেন সেজদায় বসে সামনে উবু না হয়ে পেছনে শরীর চিতিয়ে বুকে ছুরি নিয়েছে, শুধু ছুরিটি এখন উধাও। ঝাঁকড়া চুলে ভরা মাথাটি একপাশে ফেরানো, চেখ দুটি খোলা। যেন কিছু বলে উঠবে এখনি। ভালো করে দেখলে বোঝা যায় তা প্রকৃতপক্ষে মৃত মাছের চোখের মতো স্থির ও ভাবলেশশূন্য। পাথরের চোখ বলেও ভ্রম হতে পারে।

বিস্ময় লাগে, এইভাবে মানুষ খুন হয়? এর আগে কোনো মৃতদেহ দেখিনি। আজও দেখা হতো না যদি এই ভিড়ে মিশে আসা বাড়ির কারো জ্ঞাতসারে ঘটতো। এক পাড়ায় বাস করেও ময়নাকে আগে কখনো দেখিনি। গাছতলায় হাঁটু মুড়ে পড়ে থাকা নিস্পন্দ প্রাণহীন ময়নাকে কোনোকালে ভুলে যাওয়া হয়নি। এটি সেই সময়ের কথা যখন আমোদপ্রিয় তোতা ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখাশোনা ঘটেনি।

তোতা ভাইয়ের আরেক ভাই ছিলো, হারুন। কোঁকড়া চুলের স্বাস্থ্যবান যুবক হারুনকে গম্ভীর মুখে যাতায়াত করতে দেখতাম। উত্তরা সিনেমা হলে শোয়ের আগে টিকেট ব্ল্যাক করে সে। রাগী চেহারার হারুনকে আমরা ছোটোরা ভয় পেতাম কিছুটা, যদিও কোনোদিন কাউকে কিছু বলেনি সে।

একাত্তরে রোজার সময় সেহরি খেয়ে ভোরের নামাজ-পূর্ব ঘুমে মগ্ন আমাদের পাড়াটি ঘেরাও করে পাকিস্তানী সেনারা। সঙ্গে পাড়ার দুই রাজাকার – আনিসার ও তার যুবাবয়সী পুত্র। সেই ভোরে বেছে বেছে পাড়ার যুবকদের তুলে নেওয়া হয়। ধৃত চোদ্দোজনের মধ্যে একজন মাত্র মহিলা, তিনি তোতা ভাইয়ের স্ত্রী, ফোর এইচ ক্লাবে যাওয়া-আসার কালে দুয়েকবার তাঁদের বাড়ির দরজায় দেখেছি। ঠিক কোন অপরাধে তাঁকে ধরা হয়েছিলো কেউ জানে না। এদের সবাইকে দূরবর্তী এক গ্রামের পুকুরপাড়ে গুলি করে মারা হয়।

তোতা ভাইয়ের নিজের পরিণতিও প্রায় কাছাকাছি, যদিও তা বিদেশী দখলদার সেনাদের হাতে ঘটেনি। তা ঘটেছিলো স্বাধীনতার বছর আড়াই পরে। তখন বগুড়া শহর শাসিত হচ্ছে খসরু-রানা-শাহেদ নামের যুবলীগের তিন স্বেচ্ছাচারীর হাতে, তারাই শহরের যে কারো দণ্ডমুণ্ডের মালিক তখন। যতোদূর শোনা যায়, রানার দলবল একদিন তোতা ভাইকে তুলে নিয়ে যায়, যা রাজনীতিসংশ্লিষ্ট বলে ধারণা করার কোনো উপায়ই নেই। তোতা ভাই আর কোনোদিন ফেরেননি।


(চলবে)

পর্ব - ০১, পর্ব - ০২, পর্ব - ০৩, পর্ব - ০৪, পর্ব - ০৫


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।