বহিরঙ্গ ||| ২ |||

শুভাশীষ দাশ এর ছবি
লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: শনি, ১৯/১২/২০০৯ - ১২:৪৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বহিরঙ্গ ||| ১ |||হেরটা মুয়লার (জন্ম ১৭ আগস্ট ১৯৫৩-)হেরটা মুয়লার (জন্ম ১৭ আগস্ট ১৯৫৩-)

হেরটা মুয়লারের নাম শুনি ২০০৯ সালের সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তের নাম ঘোষণার পর। গুগলবুকের কল্যাণে তাঁর নেইডিয়ার্স (নিডারুঙেন) বইয়ের কয়েকটা ছোটগল্প পড়া হয়। পরে হাতে পাই তাঁর একটা উপন্যাস। ‘দা পাসপোর্ট’। ছোট উপন্যাস। বিরানব্বই পৃষ্ঠার। কিন্তু পড়তে খবর আছে। হাজারটা সিম্বোলিজমে ঠাসা। রুমানিয়ার ইতিহাস না জানলে পড়া বেশ কষ্টের। এই ইতিহাস নিয়ে একদম সংক্ষেপে কিছু বলি। রুমানিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কম্যুনিস্টরা ক্ষমতায় আসে। সাবেক সোভিয়েত য়্যুনিয়নের সরাসরি অধীনে রুমানিয়া শাসিত হয় ১৯৫০ সালে পর্যন্ত। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সিক্রেট পুলিশ বাহিনী রাষ্ট্র থেকে শত্রু দূর করতে ব্যাপক ত্রাস চালায়। জেলে ঢোকানো, অত্যাচার, হত্যাকাণ্ড চলতে থাকে। ১৯৬৫ সালে চসেস্কু ক্ষমতা দখলের পর সিক্রেট পুলিশের নির্যাতন না কমে অব্যাহত থাকে। দেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ে।

চসেস্কুর রুমানিয়ায় একটা জার্মান ভাষী গ্রামে ভিন্ডিশ নামের এক লোকের কাহিনী নিয়েই এই উপন্যাস। সে পালাতে চায় তার এলাকা থেকে। কোনমতে একটা পাসপোর্ট ম্যানেজ করাই তার উদ্দেশ্য। সে দেখে তার প্রতিবেশিরা পাসপোর্ট নিয়ে যে যার মতো ভাগছে। কিন্তু তার এই অপেক্ষা আর শেষ হয় না। পাসপোর্ট অফিসের লোকজনকে ঘুষ খাওয়ানোর পর ও কাজ হয় না। মুয়লারের কাব্যিক গদ্যে একটা অন্য বিশ্বে আমরা চলে যাই। তাঁর বাক্য বেশ ছোট। তবে ভীষণ তেরিয়া।

বইটা ছোট ছোট অধ্যায় নিয়ে লেখা। অধ্যায়ের শিরোনামগুলো বেশ চমকে ভরা। মেটে ব্যাঙ। সূচ। সাদা ডালিয়া। সেলাই কল। কালো দাগ। বাক্স। অশ্রু। আপেল গাছ। চিঠি। মাছি। রাজা ঘুমাচ্ছে। পানির শান্তি নেই।জিপসিরা ভাগ্য ফেরায়। এরকম অনেক কয়টা অধ্যায়। শেষ অধ্যায়ের নাম দা পাম বা চুলের ঢেউ।

স্মৃতিসৌধের চারপাশে গোলাপ। যেন ঝোপ। এতো বাড়ন্ত, সেখানে ঘাস শ্বাস নিতে পারে না। সাদা হয়ে ফোটে। আর কাগজ়ের মতো ঠাসবুনোট। খসখস শব্দ হয়। ভোর হচ্ছে। এখনি দিন শুরু হবে। … উপন্যাস শুরু হয় এভাবে। এভাবে ভিন্ডিশের দিন শুরু হয়। ঝোপের পাশ দিয়ে যেতে যেতে সে দিন গোণে, বছর পাল্টায়। সে মিলে ঢুকে।… মিল চুপচাপ। দেয়াল নিশ্চুপ। ছাদ বোবা। চাকা চুপে। … মিলের পাহারাদার ঘুমিয়ে ছিল। চাবি দিয়ে ভিন্ডিশ মিলে ঢোকামাত্র পাহারাদারের কুকুরটা শব্দ করে ওঠে। পাহারাদার বলে সে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। আরো ব্যাখ্যা করে। আসলে সে ঘুমাতে পারে না। ঘুমালেই একটা স্বপ্ন দেখে। একটা মেটে ব্যাঙ তার বউয়ের নাইটি পড়ে তার বিছানায় উঠে পড়ছে। ভিন্ডিশের সাথে পাহারাদারের কথাবার্তা সুররিয়াল। তারা দুজনে একটা পাখি দেখে। একটা প্যাঁচা। এই প্যাঁচার দেখা মিলে আরো অনেক কয়বার।

ভিন্ডিশ জানতে পারে অন্য প্রতিবেশিরা কেমনে কেমনে যেন পাসপোর্ট পেয়ে যাচ্ছে। ঘরের সব জিনিস বেচে বেচে তারা অফিসারদের দিচ্ছে। দুর্ভাগ্যের প্রতীক প্যাঁচার দেখা মিলে আবার। হয়তো সে কোন ছাদের নিচে আশ্রয় খোঁজে এদিক ওদিক। কাহিনী এভাবেই চলতে থাকে। ভিন্ডিশের বউ রাশানদের জেলে থাকার সময় বেঁচে গিয়েছিল বেশ্যা হতে রাজি হওয়ার কারণে। একসময় ভিন্ডিশ বুঝতে পারে পাসপোর্ট অফিসের অফিসারকে এখনো একটা জিনিস দেয়া বাকি। মেয়ে এমিলির কুমারিত্ব। উপন্যাসে কোথাও কোন আশার আলো নেই। চারপাশে চেপে বসেছে ঘৃণা আর বিবমিষা।

হেরটা মুয়লারের খানিক পরিচয় দিই। তাঁর জন্ম ১৯৫৩ সালে।রুমানিয়ার ট্রান্সিলভেনিয়ায়। রুমানিয়ায় সংখ্যালঘু জার্মান সম্প্রদায়ের লোক ছিল তাঁর পরিবার। সেই সময়কার রাজনৈতিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার কারণে তিনি চাকরি হারান। চসেস্কুর আমলে। তাঁর মা দীর্ঘকাল শ্রমশিবিরে বন্দী ছিলেন। কমিউনিস্টদের চর হতে অস্বীকার করায় মুয়লার পুলিশ কর্তৃক অনেকবার হেনস্থা হন। প্রথম বইয়ের নাম ‘লো ল্যাণ্ডস্’; প্রকাশ পায় ১৯৮২ সালে। সেটা সেন্সরশিপের তোপে পড়ে। তিনি রুমানিয়া থেকে জার্মানি চলে যান ১৯৮৭ সালে।

মুয়লারের লেখায় স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর তীব্রতম ক্ষোভের প্রকাশ স্পষ্ট। অথচ তাঁর বাবা ছিলেন নাৎসী বাহিনীর লোক। এই দ্বৈতসত্তা কাটিয়ে লেখক মুয়লারকে বুঝে নেয়া খানিক কষ্টকর। একটা ভঙ্গুর সময়কালকে তিনি ধরেছেন উপন্যাসটিতে। চসেস্কুর আমলকে ঠিকমতো আমল করাতে মুয়লার সক্ষম। রুমানিয়ার ইতিহাসে দখল না থাকায় অনেক মেটাফরের অর্থ আমি হয়তো ধরতে পারি নি। বুদ্ধিমান পাঠক হয়তো আরো ভালো বুঝবেন।

একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম। দুনিয়ার যত স্বৈরাচারী আর যুদ্ধাপরাধী আছে যুদ্ধ শেষে তারা হয় শাস্তি পেয়েছে নয়তো আত্নগোপন করে বেঁচেছে। কেবল আমাদের জাতি এর ব্যতিক্রম। স্বৈরাচারী এরশাদকে আমরা প্রায় ক্ষমা করে দিয়েছি। চক্ষুলজ্জার কারণে বর্তমান সরকারপ্রধান তাকে রাষ্ট্রপতি করেন নি এই যা। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের আমরা মন্ত্রী পর্যন্ত বানিয়েছিলাম। এখন তারা স্বাধীনতা এনে দিয়েছে বলে দাবী করে ফেলে। একটা নষ্ট জাতি হিসেবে ইতিহাসে আমাদের নাম পাকাপোক্ত করার সব ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি। এর কিছুটা দায় আমাদের কালের লেখকদের উপর ও বর্তায়।

সূত্র

১। The Passport – Herta Müller(Serpent’s Tail, London 1986) [Page 7]
২। [Page 8]

বহি

The Passport – Herta Müller (Serpent’s Tail, London 1986)

ছবির উৎস


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

যে একটা দুটো বাক্য অনুবাদে দিলেন, তা পড়েই তো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ইশ্... পড়তে পারলে ভালো হতো...

অনেক ধন্যবাদ।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

নজরুল ভাই,


ইংরাজিটা পেলে পড়ে ফেলেন। এটা অনুবাদ করতে গেলে খবর আছে। যেহেতু উনি এই বছর নোবেল পেয়েছেন, বইমেলায় 'দা পাসপোর্ট' য়ের অনুবাদ হয়তো পেয়ে যাবেন।জুলফিকার নিউটন না করলেই বাঁচি।

হাসিব এর ছবি

দুনিয়ার যত স্বৈরাচারী আর যুদ্ধাপরাধী আছে যুদ্ধ শেষে তারা হয় শাস্তি পেয়েছে নয়তো আত্নগোপন করে বেঁচেছে।

কথাটা ঠিক না ।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ঠিকাছে। কিন্তু বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোন জায়গায় তাদের আদর করে মন্ত্রী বানানো হয়েছে উদাহরণ দিলে ভাল হয়।

কিছু কিছু জানি। যেমন। আইবিয়েম হেড থমাস ওয়াটসনের নাৎসী সংযোগ।

ব্যতিক্রম অন্য জায়গায় নেই তা নয়। লাইনটা একটু বেশি জেনারালাইজড্‌ হয়ে গেছে।

হাসিব এর ছবি

ঐ জেনারালাইজেশনের দিকেই ইঙ্গিত করলাম । হাতের কাছে এরকম খুঁজলে বেশুমার উদাহরণ পাওয়া যাবে । সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় উদাহরণ - জর্জ ডাব্লিউ বুশ আর তার পুডল রাষ্ট্র প্রধানেরা, এ্যারিয়েল শ্যারন । ভারতের নরেন্দ্র মোদিরেও এ কাতারে ফেলা যায় ।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

বুঝলাম।

আমাদের দেশের সাকাচৌ, গো আ, ম র নি সহ আরো অনেক বরাহ-এরা স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী। এরা একাত্তরে নিজেদের জাতির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল। নিজের জাতির বিরুদ্ধে যারা দাড়িয়েছিল, সেই জাতি যুদ্ধাপরাধীদের পুরস্কৃত করেছে এরকম কোন উদাহরণ কী আছে?

বুশকে কয়জন মার্কিন জনতা যুদ্ধাপরাধী ভাবে? কিংবা শ্যারনকে এসরায়েলের লোকজন?

নরেন্দ্র মোদিকে পুরষ্কৃত করেছে সেখানকার হিন্দুরা।

হাসিব এর ছবি

- আমার ধারনা বেশীরভাগ পাকিস্তানি নিজেদের কাউরে যুদ্ধাপরাধী ভাবে না । এর মানে এই না যে পাকিস্তানের ভুট্টো যুদ্ধাপরাধী নয় ।

আরোও বলা যায় এসব নিয়ে । কিন্তু তর্ক পোস্ট ছেড়ে অন্যদিকে ঘুরবে বলে কথার ইতি এখানেই টানলাম ।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

দেশদ্রোহী যুদ্ধাপরাধী বললে একটু কম জেনারেলাইজড্‌ হতো।

আপনার কথা আমি বুঝতে পেরেছি। থ্যাংকস। আমি ও এখানে ইতি টানলাম।

সচল জাহিদ এর ছবি

তুমি এত পড় যে মাঝে মাঝে ঈর্ষা হয়। দারুন লিখেছ।

----------------------------------------------------------------------------
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

লইজ্জা লাগে

আবেদ এর ছবি

বহিরঙ্গ অনেক ভালো হচ্ছে। আরো বেশি বেশি বহিরঙ্গ আসুক। আগে কলকাতার দেশ পত্রিকার বইমেলা সংখ্যাটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। নানা দেশি বিদেশি বই নিয়ে আলোচনা থাকত দেশ- এর বইমেলা সংখ্যায়। পরে বইয়ের দেশ বের হয়। সেটাও ভাল লাগে। ব্লগে বই নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা হয় না। বা খুব কম হয়। আপনি চেষ্টা করেন ছফাগিরির মতো বহিরঙ্গকে সিরিয়াস্লি লেখার টপিক হিসাবে নেয়ার অন্য।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

বইয়ের দেশ শুরুর দিকে ভাল লাগত। পরে আর ভাল লাগে নাই। আমিও অনেক অপেক্ষা করে বসে থাকতাম দেশ-য়ের বইমেলা সংখ্যার জন্য।

রণদীপম বসু এর ছবি

কদিন আগে হার্টা মুলার-এর নোবেল বক্তৃতাটার বাংলা অনুবাদ পড়লাম সমকালের 'কালের খেয়া'য়। দারুণ লেগেছে। একটা রুমালের প্রতীকী শিল্প-ইমেজ যে কেমন শিল্পোত্তীর্ণ অবস্থায় উন্নীত হতে পারে, এই বক্তৃতাটা মুলারের সাহিত্যের সেরকম চমৎকার একটা নমূনা।
এখানে হেরটা মুয়লার না বলে নাম হার্টা মুলার বলার কারণ হলো সেখানে এভাবেই তাঁর নামটা অনুদিত হয়েছে। আসলে কোনটা হবে ?

লেখাটা খুব ভালো লাগলো।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

হেরটা মুয়লার বোধহয় ঠিক উচ্চারণ।আর্টসবিডিতে একটা লেখা ছাপিয়েছিলাম হার্টা ম্যুলার এভাবে বানান লিখে।

নামটা ঠিক করে শুনতে এই ভিডিও দেখতে পারেন।

হাসিব এর ছবি

সঠিক উচ্চারণ হ্যার্টা ম্যুলার ।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ঠিকাছে।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

চমৎকার রিভিউ। আপনিও তো বাক্য গঠনে মুয়লারের পথ অনুসরণ করেন মনে হয়... দেঁতো হাসি

মুয়লার নোবেল পাবার পর এই সচলেই কে যেনো তার কোন একটা বই নিয়ে পোস্ট দিয়েছিলেন- মনে করতে পারছি না।

... বহিরঙ্গ চমৎকার হচ্ছে। আরো আসুক।

_________________________________________

সেরিওজা

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

হ , কইছে তোমারে। সুযোগ পাইয়া চামবাজি .................. দেঁতো হাসি

ঐশী এর ছবি

পড়ে ভালো লাগল।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ঠিকাছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

শেষের অংশটা সবচে বেশী মনে ধরলো ।
আমারো এই রকমই মনে হয় ।
--

বই এর রিভিউটাও ভালো লেগেছে । তবে আগেই বলে দিতে পারি -- এই বই আমার ভোতা মাথায় ঢুকবে না ।
রিভিউতেই ঘ্রানে অদ্দেক ভোজন সেরে নিলাম চোখ টিপি
(এই বই সম্পর্কে কেউ কিছু আলোচনা করতে চাইলে - বেশ ঝাড়ি দিতে পারবো আশা রাখি দেঁতো হাসি {অল্পবিদ্যা মহাউপকারী!} )

----
ইমতিয়াজ মির্জা ।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

দেন দেঁতো হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।