আমার পরিবারের ২ জন মুক্তিযোদ্ধা (১): বাবা

সুমন_সাস্ট এর ছবি
লিখেছেন সুমন_সাস্ট [অতিথি] (তারিখ: রবি, ১৫/১২/২০১৩ - ১:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই গল্প মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গল্প নিয়ে লিখা না; এটা ২ জন মুক্তিযোদ্ধার ব্যক্তিজীবন নিয়ে লিখা, যার একজন আমার বাবা, আরেকজন আমার মামা। আমি সবসময় নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি; জন্মের পরপরই যে ২ জন মানুষ সবার প্রথম রোল মডেল হিসাবে সামনে এসেছেন, তাদের ২ জনই মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে উনারা দেশের জন্যে কতো বড় সাফল্য বয়ে এনেছেন, সেটা নিয়েতো আর আলাদা করে বলার কিছু নাই। আমি বরং বলতে চাই উনারা ব্যক্তিমানুষ হিসাবে কেমন; আর ব্যক্তিজীবনের যুদ্ধে উনারা কি করতে চেয়েছেন; কি পেরেছেন, আর কি পারেননি।

আমার বাবা, আব্দুল হাকিম মাষ্টার, আমার পরিবারের প্রায় সবার কাছে অত্যন্ত ব্যর্থ একজন আধপাগল মানুষ। না হওয়ার কোন কারণ নাই। ৭১ এ কি করেছেন, তা দিয়েতো আর সংসার চলে না। সংসারের কোন দায়িত্ব তিনি জীবনে ঠিকমতো পালন করতে পারেননি। মাছ কিনতে বাজারে গেলে কিনে আনতেন এমন মাছ, যার অর্ধেকই পঁচা থাকতো। মা রেগে গিয়ে ঝগড়া করলে, বলতেন, "আরে দেখো, অর্ধেক মাছ ভালো আছে। মাছটাও সস্তা হয়েছে। অর্ধেক ফেলে দিয়ে, বাকী অর্ধেক রেখে হিসাব করলেও লাভ হয়েছে। আমি হিসাব করেই এনেছি"। বাবার এই হিসাবের কথা কিন্তু মজা হিসাবে হতো না, সিরিয়াসলি হতো। এইটা দেখে মা অতি রাগে পাথর হয়ে যেতেন। শুধু বাজারের মতো বিষয় নিয়ে যে বাবার উপর মায়ের আসল রাগ, তা কিন্তু না।

ষাটের দশকে বাবা মেকানিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা করেছিলেন; সেই সময়ে পরীক্ষার মার্কসের কিছু রেকর্ড-টেকর্ডও মনে হয় করেছিলেন। উনার সমসাময়িক যারা ডিপ্লোমা ইন্জিনিয়ার ছিলেন, তারা সবাই স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক বিত্ত-প্রতিপত্তির মালিক হয়েছেন। আর উনি, বাপ-দাদার বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি হারিয়ে নি:স্ব হয়েছিলেন। উনার মেকানিক্যাল বিদ্যাটা যদি জীবনে কোন কাজেই না লাগাবেন, তাহলে সেই বিদ্যাটা কেন নিয়েছিলেন, সেটা একটা বিরাট রহস্য। ইংরেজী জানতেন প্রচুর; উনার সম্পর্কে গল্প চালু আছে যে উনার পুরা ডিকশনারি মুখস্থ আছে। এই ভয়াবহ ব্যাপারের সত্যতা কখনো যাচাই করতে যাইনি, কিন্তু স্কুল কলেজের প্রয়োজনে বিভিন্ন শব্দ উনাকে জিজ্ঞেস করলে সেকেন্ডে উত্তর দিয়ে দেননি এমন ঘটনাও পাইনি। ষাট-সত্তর-আশির দশকে ইংরেজীতে Yes, No, Very Good বলতে পারলেই মানুষ সাফল্যের চুড়ায় উঠে যেতে পারতো। কিন্তু উনি এতো ইংরেজী জানার পরেও কেন তখন ক্যারিয়ার গড়তে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেটাও আরেকটা রহস্য। যাই হোক, উনি সেই আপাত দৃষ্টিতে অসম্ভব কাজটা কোন একভাবে ম্যানেজ করেছেন; কিভাবে সাফল্যের সাথে ক্যারিয়ারে ব্যর্থ হতে হয়, সেটার বেশ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি রেখেছেন।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কাজের কাজ উনি যা কিছু করতে পেরেছেন তা নিজের জন্য বা পরিবারের জন্য না, গ্রামের জন্য। গ্রাম-উন্নয়নের জন্য সরকারের কাছ থেকে বেশ কিছু প্রজেক্ট এনেছিলেন। শুরুর দিকে উনার বেশ কিছু উদ্দ্যোগ সফলও হয়। যেমন, আমাদের গ্রাম, কিশোরগন্জের নিকলি থানার ছাতিরচরে, আশির দশক পর্যন্ত খুব অমানবিক কিছু ব্যাপার হতো। বর্ষাকালে ছাতিরচর গ্রামটা একটা দ্বীপের মতো হয়ে যায়। আশেপাশে অনেক দূর পর্যন্ত কোন গ্রাম না থাকায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ভাবটা বাইরে থেকে দেখলে খুব সুন্দর দেখায়, কিন্তু বহির্বিশ্বের সাথে প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন একটা গ্রামে দিনের পর দিন থাকাটা যে কি কষ্ট, সেটা ভেতরের মানুষ হিসাবে ওখানে না থাকলে বোঝা যাবে না (আমি নিজেও খুব বেশী ওখানে থাকিনি, তাই সেই কষ্টটা ভালোভাবে বুঝি, এমন দাবী করতে পারবো না। আর এখনকার গ্রামের অবস্থার চেয়ে তখন আরো অনেক বেশী খারাপ ছিলো)। এর উপর অল্প একটু জায়গায় কয়েক হাজার মানুষের ঘরবাড়ী। বিল্ডিং হিসাবের বাইরে রেখে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ জায়গা - এই ক্যাটাগরীতে আমার গ্রামটা চ্যাম্পিয়ন হবে, এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত (আমি যে একটুও বাড়িয়ে বলছি না, সেটা কেউ ওখানে একবার গেলেই বুঝতে পারবেন। তবে যেতেই যদি চান ঐ হাওর এলাকায়, ভরা বর্ষায় যাবেন। বেশ দুর্গম ঐ জায়গাটায় তখন যেতে একটু কষ্ট হতে পারে, কিন্তু আমার কথার সত্যতা দেখার পাশাপাশি অন্যরকম সুন্দর একটা জায়গা দেখার অভিজ্ঞতাও নিয়ে আসতে পারবেন। আর গ্রামটাতে গিয়ে বলবেন, হাকিম মাষ্টারের ছেলে সুমনের কথা শুনে গ্রামটা দেখতে এসেছেন; আতিথেয়তা কাকে বলে, তাও দেখার সুযোগ পেয়ে যাবেন আশা করা যায়)। বর্ষাকালে এই গ্রামে অনেক সমস্যা, তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হতো মানুষ মারা গেলে। জীবিত মানুষের জন্যই যথেষ্ঠ জায়গা নাই, মৃত মানুষের জন্য জায়গা আসবে কোথা থেকে। দূর-দূরান্ত পর্যন্তও কোন মাটি পাওয়া সম্ভব ছিল না মৃত মানুষদের জন্য। তাই আশির দশক পর্যন্ত এই গ্রামের মানুষদের এমন একটা কাজ করতে হয়েছে, যেটা ভাবলেও এখন গা শিউরে উঠে। পায়ে ভারী কিছু একটা বেঁধে প্রিয় মানুষগুলোকে পানিতে ভাসিয়ে দিতো; চারপাশে মাটির অভাব ছিল, পানিরতো অভাব ছিলো না, তাই এটাই ছিলো তখন একমাত্র উপায়। যুদ্ধকালীন সময় ছাড়া এমন দৃশ্য কোথাও পাওয়া যাবে কিনা আমার জানা নেই। আমার বাবা এটা সহ্য করতে পারেননি। সেই সময়ের একটা ইংরেজী পত্রিকায় এ নিয়ে লিখেছিলেন। সরকারী অফিসের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন, এই গ্রামে একটা পাকা কবরস্থান করে দেয়ার জন্য। কিন্তু সরকারের কোন বাজেটে নাকি কবরস্থান করে দেয়ার সিস্টেম ছিলো না। বাবা সেই সিস্টেম ভেংগে শেষ পর্যন্ত, এবং সম্ভবত বাংলাদেশের প্রথম ব্যাক্তি হিসাবে একটা গ্রামের কবরস্থানের জন্য বাজেট বের করে এনেছিলেন। ঐ দ্বীপের মতো গ্রামটাতে প্রতি বছর নদী ভাংগনে জীবিত মানুষের ঘরবাড়ী ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু ঐ কবরের মানুষগুলো এখন খুব নিশ্চিন্তে থাকেন। শুরুর দিকে এমন কিছু কাজ করে ফেলতে পারলেও, পরের প্রজেক্টগুলোতে লোকাল নেতাদের চোখ পড়েছিল; তারা আব্বার সরলতার সুযোগ নিয়ে প্রজেক্টের টাকা লুটে পুটে ধনি হয়ে গিয়েছিল; বাবার প্রজেক্ট আসাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

গ্রামের জন্য অনেক কিছু করতে চেয়েছেন, সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পেরেছেন করেছেনও। কিন্তু পরিবারের লোকজনের এত ক্ষোভ থাকবে কেন? পেশা হিসাবে প্রথমে বেছে নিয়েছিলেন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকতা; চাকরীটা খুব বেশীদিন করেননি, অহেতুকই ছেড়ে দিয়েছিলেন; কিন্তু পরিচিত সবাই শ্রদ্ধা নিয়ে নামের পাশের মাষ্টার শব্দটা স্থায়ীভাবে বসিয়ে দিয়েছিলেন। মাঝখানে করলেন গ্রামের প্রজেক্ট। ওটা শেষ হওয়ার পর ধরলেন বাপ-দাদার পেশা, কৃষি। না, গতানুগতিক কৃষিকাজে ওনার চলেনা। উনি করবেন এমন কাজ যেটা আশেপাশে আর কেউ করেন না। একবছর খোঁজ পেলেন যে তরমুজ চাষ করে কৃষকরা অনেক লাভ পাচ্ছেন। উনি পরেরবার তরমুজ চাষের বিশাল প্রজেক্ট হাতে নিয়ে নিলেন; ঠিক সে বছরই তরমুজের দাম ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেল। বাজারে প্রচুর তরমুজ, উনার তরমুজ বিক্রি হয়না, পড়ে থেকে থেকে পঁচে; তখন মানুষকে দাওয়াত দিয়ে ক্ষেতে নিয়ে ফ্রিতে তরমুজ খাওয়াতেন, এগুলো অন্তত শেষ যেন হয় সেজন্য। আমি তখন অনেক ছোট, কিন্তু আমার এখনো মনে আছে, আব্বার ক্ষেতে গিয়ে তরমুজ খাওয়ার আনন্দ; তখনতো আর বুঝতে পারিনি যে ওটা আব্বার অর্থনৈতিক সর্বনাশের কফিনের শেষ পেরেক ছিল। বাপ-দাদার অনেক জমি ছিল; উনার বিভিন্ন উদ্দ্যোগে আস্তে আস্তে কমতে কমতে ঐ তরমুজের ব্যর্থতা দিয়ে সব শেষ হয়। কোন বোনবিহীন ৫ ভাইয়ের আমাদের সংসারের খাওয়া-পড়ার দায়িত্ব উনি কখনোই খুব বেশী নিতে পারেননি। আমাদের বেড়ে উঠার বড় অংশই কেটেছে মামার বাড়ী, খালার বাড়িতে। ৫ জনের মধ্যে আমি সবচেয়ে ছোট। আপন দাদা-দাদী, নানা-নানী কাউকে জীবনে দেখিনি, আমার জন্মের আগেই উনারা সবাই মারা গিয়েছিলেন; শৈশবে বাবাকেও দেখতাম মাঝে মাঝে, যখন উনি মামার বাড়ীতে আমাদেরকে দেখার জন্য আসতেন। এমন একজন বাবা থাকলে মায়ের কপালে যে দুর্ভোগ থাকে সেটা আমার মা জীবনের বেশিরভাগই ভোগ করেছেন; যতদিন না ভাইয়ারা বড় হয়ে সংসারের দায়িত্ব নিয়েছেন এবং বাজিতপুরে আমাদের থাকার স্থায়ী ব্যাবস্থা করেছেন। মা এবং ভাইয়াদের যদি উনার প্রতি ক্ষোভ থাকে, খুব একটা দোষতো আর দেয়া যায়না!

আমার বাবা নিজের জন্য এবং নিজের সংসারের জন্য কখনোই তেমন কিছু করতে পারেননি; যখনই যা চেষ্টা করেছেন, সোজাসাপ্টা ব্যর্থ হয়েছেন। উনার সাংসারিক ব্যর্থতার সব গল্প ভালো করে লিখতে গেলে একটা উপন্যাস হয়ে যাবে। শেষ বয়সের বেশিরভাগ কাটিয়েছেন লেখালেখি করে। বৃটিশ আমলে জন্ম হওয়া মানুষ, লেখার মাঝে বঙ্কিমীয় ভাব বেশ প্রকট ছিল। হাওরবাসীর বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে অনেক চমৎকার কিছু বক্তব্য উপস্থাপন করলেও, ভাষার কারণে পত্রিকায় প্রকাশ হওয়া লিখাগুলো দিয়ে মানুষের খুব একটা কাছে পৌঁছাতে পারেননি। মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পত্রিকায় কিছু কলাম লিখেছেন; কিছু বইও লিখেছেন; কিন্তু লেখক হিসাবে উনার পরিচিতিটা এলাকার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো। আর অর্থনৈতিক সাফল্য যে উনি কখনোই পাবেন না, সেটাতো বিধির অপরিবর্তনীয় সত্য; লেখালেখির মাধ্যমে সেই চেষ্টা করেও ব্যর্থই হয়েছেন। উনার অনেক ব্যর্থতার মাঝে উল্লেখযোগ্য আরেকটি হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট আদায় করতে ব্যার্থ হওয়া। সরকারী অফিস থেকে পাবলিকের জন্য কঠিন কঠিন জিনিশ আদায় করে ফেলতে পারার ব্যাপারে উনার প্রচুর খ্যাতি থাকলেও, নিজের জন্য সার্টিফিকেটটা আদায় করতে পারেননি। যেসব মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন অফিসে ঘুরে ঘুরে টায়ার্ড হয়ে সার্টিফিকেট নেওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন, আমার বাবাও তাদের একজন হয়েই রয়ে গিয়েছিলেন। কয়েকবছর আগে উনি একটা জাতীয় পত্রিকায় এই বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে উনার কিছু আক্ষেপ লিখেছিলেন। শেষের দিকে উনি এটাও লিখেছিলেন, উনার জীবনতো শেষ; উনার ছেলেরাও সবাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে; ছোট যে ছেলেটা আছে সেও কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে গেছে; উনি খুবই গর্বিত যে উনার কোন ছেলেকেই কখনো মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটের জন্য পেছনে তাকাতে হয়নি। কোন এক কারণে উনার খুব ইচ্ছা ছিলো, একটা ছেলে অন্তত পিএইচডি করবে। শাবিপ্রবিতে জয়েন করার পর থেকে, কথা হলেই জানতে চাইতেন কবে পিএইচডি করবো; এপ্লাই করতে দেরী করছি কেন? তাই এই বছরের মার্চের শেষে উনাকে যখন জানালাম যে পিএইচডির জন্য ফান্ডিংসহ ২টা অফার পেয়েছি এবং ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা থেকে রিসার্চ এসিস্ট্যান্টশিপের সাথে একটা ফেলোশীপের অফার দিচ্ছে বলে ওখানেই যাচ্ছি, উনার আনন্দটা ছিলো দেখার মতো; একেবারে বাচ্চাদের মতো সব পেয়ে যাওয়ার আনন্দ। বারবার পিএইচডি, ফান্ডিং এসব নিয়ে এটা ওটা কথা বলেন; এক প্রশ্নই বারবার জিজ্ঞেস করেন। ভাব দেখে মনে হচ্ছিল উনি ভাবছেন, "আমার জীবনে আর সার্টিফিকেট-টার্টিফিকেট এসব স্বীকৃতি দিয়ে কি হবে, আমিতো এম্নিতেই সব পেয়ে গেছি।"

বই পড়া উনার সারাজীবনের অভ্যাস। আমাদের বাজিতপুরের পাবলিক লাইব্রেরীর একমাত্র একনিষ্ঠ পাঠক হিসাবে উনাকে সবাই চেনে। ঐ লাইব্রেরীতে এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার অনেকগুলো কপি যে দুই যুগ ধরে আছে, উনি ছাড়া ওগুলো আর কেউ কখনো উল্টেও দেখেছেন কিনা সন্দেহ আছে। সারাদিন পড়া, আর পয়েন্ট টুকে নেয়া; এটাই উনার শেষ বয়সের একমাত্র পেশা এবং নেশা হয়ে গিয়েছিল। উনার ব্যাক্তিগত ডায়েরীর একটাতে আমি দেখেছি পাশাপাশি কোরান, বাইবেল, গীতার বিভিন্ন উক্তি লিখা আছে। আবার পাশের পৃষ্ঠাতেই জীবন সৃষ্টির জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা আছে। আবার একই ডায়েরীর অন্য পৃষ্ঠায় লিখা আছে, ধর্ম বিষয়ক কোরানের দাবী, আর জামাতের দাবীর কনফ্লিক্ট নিয়ে উনার পর্যবেক্ষণ। সবকিছুই খুব বিচ্ছিন্নভাবে লিখা, পয়েন্ট আকারে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে বড় কিছু লিখার পূর্ব প্রিপারেশান, নাকি শুধুই নিজের মনের শান্তির জন্য লিখে যাওয়া, সেটা বলা মুশকিল; আধপাগল মানুষতো, উদ্দেশ্য বোঝা কঠিন। উনি দেখেছিলেন উনার ছেলে ৫ই ফেব্রুয়ারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে শাবিপ্রবির ক্যাম্পাস থেকে আন্দোলন শুরু করেছে। এবিষয়ে মুখ ফুটে খুব বেশী কিছু বলেননি, বলার কথাও না। ৪২ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দিয়েতো কোন উদ্দ্যোগইতো শেষ পর্যন্ত সফল করা যায়নি, মুখ ফুটে কি আর বলবেন। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছিলাম, ভালো ফলাফলের আশা খুব একটা না থাকলেও, উনি আবারো গর্বিত হচ্ছেন ছেলেদের চেষ্টা দেখে।

বাবা আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন ১৬ এপ্রিল, ২০১৩ তে। মানুষের জন্য অনেক কিছু করার চেষ্টা করেও ব্যক্তিজীবনের সাফল্যের অভাবের জন্য, ব্যর্থতার দায়ভারই বেশী বয়ে বেড়িয়েছেন সারাজীবন। কিন্তু উনার মৃত্যুর পর অভূতপূর্ব সম্মান পেয়েছেন মানুষের কাছ থেকে। ছাতিরচরের একমাত্র পাবলিক কবরস্থানটাতে কারো কবর স্থায়ী করার নিয়ম নাই, কারো কবর পাকা করারতো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু গ্রামের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যে উনার কবরটা হবে কবরস্থানের ভেতরে স্থায়ী কবর; এবং সেটা হবে গেট দিয়ে ঢুকেই প্রথম কবর। গ্রামের মানুষেরা সবাই মিলে এটাও সিদ্ধান্ত নেয় যে, এটাই হবে এই করবস্থানের একমাত্র স্থায়ী কবর; আগেও কখনো কোন কবর স্থায়ী হ‌য়নি, ভবিষ্যতেও অন্য কারো জন্য স্থায়ী কবর করার দাবী কেউ করবে না। বাবার মৃত্যুদিবসে উনার স্মৃতিতে বাজিতপুরের ছাত্রছাত্রীদেরকে শ্রেষ্ঠ পাঠক বৃত্তি দেয়া হবে, এমন একটা উদ্দ্যোগ নেই আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে। ঐ সময়টাতে আমরা দেখলাম, বাজিতপুরের সব স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা আব্বাকে কতটা শ্রদ্ধা করেন। উনারা সবাই জান দিয়ে আমাদেরকে সাহায্য করেছেন এই বৃত্তিটা চালু করার, এবং ছাত্রছাত্রীদেরকে এই ব্যপারে উৎসাহী করার জন্য। যার কাছেই গিয়েছি বাবার জন্য প্রচন্ড আবেগ দেখিয়েছেন। এমনকি জমিজমা সব হারিয়ে বাবার নি:স্ব হয়ে যাওয়াটাকেও অনেকে একটা মহান কাজ হিসাবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলেন; এর ফলেই নাকি আমরা কৃষিকাজ থেকে সরে গিয়ে পড়ালেখা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। এত আবেগের মুখে আমরা আর ঐটা মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করিনি যে, আমাদের মহান মামাটা আমাদের সব দায়িত্ব না নিয়ে নিলে এই পরিবারের কি অবস্থা হতো। বাজিতপুর-ছাতিরচরের মানুষের আমার বাবার জন্য এত আবেগ দেখে কৃতজ্ঞতায় বুক ভরে গিয়েছিল। উনার জীবনের বিভিন্ন আক্ষেপ নিয়ে আমাদের যে দু:খ ছিল, উনার জন্য মানুষের শ্রদ্ধা দেখে সেটাও কমে গিয়েছিল।

কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে নতুন করে আমার কিছুটা আক্ষেপ হচ্ছে। ব্যক্তিজীবনে সবসময়ের ব্যর্থ আমার বাবা, অল্পের জন্য অসাধারণ একটা ব্যক্তিগত অনুভুতি পেতেও ব্যর্থ হলেন। উনি যদি আর কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারতেন, কত কিছু দেখে আনন্দিত হতে পারতেন। দেখতে পারতেন, ৪২ বছরে প্রথমবারের মতো বাংলার মানুষ ১৪ ডিসেম্বরে শুধুই দু:খ করছে না; কিছুটা প্রতিদান দেয়ার সুক্ষ্ণ আনন্দও অনুভব করছে। দেখতে পারতেন ১৬ ডিসেম্বর আসার অনেক আগে থেকেই সবার মাঝে কি উত্তাল বিজয়ের উত্তেজনা। গর্ব নিয়ে দেখতে পারতেন, উনাদের কাছে যা প্রায় অসম্ভব মনে হচ্ছিল এতোদিন, উনার ছেলের মতো হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে রাস্তায় নেমে আজ সেটাকেও সম্ভব করে ফেলছে।


বাবার কাছ থেকে পাওয়া উনার ১৯৬৯ সালের ১টা ছবি


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

শ্রদ্ধা শ্রদ্ধা

বিদ্রঃ দ্বিতীয় ছবিটা কি কোনও কারনে আসেনি? ক্যাপশন দেখতে পাচ্ছি।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

Haripad এর ছবি

সুমন তোমার বাবা ও মামার জন্য রইল গভীর শ্রদ্ধা............।

অতিথি লেখক এর ছবি

মত্যি, আর কটা দিন বাঁচলেই পারতেন। অনেক ভালো লাগলো। আপনার বাবার জন্য শ্রদ্ধা। মামার গল্পটা আরেকদিন শুনবো। বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা থাকলো।

স্বয়ম

সুমন_সাস্ট এর ছবি

হুমম, গত কয়েকদিন ধরে চারপাশে এত আনন্দ দেখে বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। আর মামার গল্পটা লিখছি।

--
মাগো তুমি রেখো জেনে, এই আমরাই দেব এনে,
আঁধারের বাধা ভেঙে রাঙা ভোর, রোদ্দুর মাখা দিন।

http://www.youtube.com/watch?v=8OB_uPY4i4M

হিমু এর ছবি

আপনি কি জানেন, আপনি একজন বাঘের বাচ্চা?

সুমন_সাস্ট এর ছবি

আগের চেয়ে এখন একটু বেশী জানি।

--
মাগো তুমি রেখো জেনে, এই আমরাই দেব এনে,
আঁধারের বাধা ভেঙে রাঙা ভোর, রোদ্দুর মাখা দিন।

http://www.youtube.com/watch?v=8OB_uPY4i4M

বনি এর ছবি

সুমন ভাই আপনার বাবা ও মামার জন্য রইল শ্রদ্ধা।
শ্রদ্ধা

মারুফ এর ছবি

তোমার বাবা আসলেই অনেক সুখে আছেন এখন। আল্লাহ উনাকে ভালো রাখুক এই দোয়া করি।

সুমন_সাস্ট এর ছবি

আসলেই সুখে আছেন। নিজের গ্রামে নিজের বিদ্রোহে করা কবরস্থানের গেটে শুয়ে, নিজের দেশের ছেলেমেয়েদের এত উচ্ছাস দেখার চেয়ে বড় সুখ আর কি হতে পারে?

--
মাগো তুমি রেখো জেনে, এই আমরাই দেব এনে,
আঁধারের বাধা ভেঙে রাঙা ভোর, রোদ্দুর মাখা দিন।

http://www.youtube.com/watch?v=8OB_uPY4i4M

পৃথ্বী এর ছবি

শ্রদ্ধা


Big Brother is watching you.

Goodreads shelf

স্পর্শ এর ছবি

আপনার বাবার জন্য অশেষ শ্রদ্ধা।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

তানিম এহসান এর ছবি

শ্রদ্ধা!

মন মাঝি এর ছবি

গুরু গুরু

****************************************

আয়নামতি এর ছবি

দুঃখ করবেন না ভাইয়া, আপনার বাবা আনন্দের খবরটা ঠিকই পেয়ে গেছেন!
তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। আপনার জন্য শুভকামনা।

সুমন_সাস্ট এর ছবি

নাহ, খুব দু:খ নেই। আমার সাথে শেষ সময়ের স্মৃতিগুলো খুব ভাল; আমার পিএইচডির স্কলারশীপ পাওয়া নিয়ে ওনার শেষ ২ টা সপ্তাহ খুব আনন্দে কেটেছে, এই কথাটা মনে পড়লে মনটা ভালো হয়ে যায়।

--
মাগো তুমি রেখো জেনে, এই আমরাই দেব এনে,
আঁধারের বাধা ভেঙে রাঙা ভোর, রোদ্দুর মাখা দিন।

http://www.youtube.com/watch?v=8OB_uPY4i4M

সাকিন উল আলম ইভান  এর ছবি

স্যার , বিনম্র শ্রদ্ধা আপনার বাবার জন্য । শ্রদ্ধা

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার বাবার প্রতি শ্রদ্ধা।

শব্দ পথিক

কায়সার এর ছবি

সুমন ভাই,
আপনার লেখা পড়ছিলাম আর চোখের সামনে ভেসে উঠছিল খ্যাপাটে একজন লোকের ছবি, দিনের পর দিন মানুষের জন্য কিছু করার আশায় নিরন্তর ছুটে চলেছে। অসীম শ্রদ্ধা ওনার জন্য।

--কায়সার

কড়িকাঠুরে এর ছবি

বিনম্র শ্রদ্ধা...

স্যাম এর ছবি

দারুণ একটা চলচ্চিত্র হতে পারে । হওয়া উচিত।
শ্রদ্ধা জানাই এরকম 'আধাপাগল ' মানুষদের।
লেখার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

সুমন_সাস্ট এর ছবি

এই গল্প থেকে মুভি হতে পারে আইডিয়াটা ইন্টারেসটিং।

--
মাগো তুমি রেখো জেনে, এই আমরাই দেব এনে,
আঁধারের বাধা ভেঙে রাঙা ভোর, রোদ্দুর মাখা দিন।

http://www.youtube.com/watch?v=8OB_uPY4i4M

এক লহমা এর ছবি

সুমন, আপনার আগের লেখাটি পড়েছিলাম। মুগ্ধ হয়েছিলাম। আজ পেলাম গাছের শিকড়ের পরিচয়। অন্তরের অভিবাদন সেই অসামান্য মানুষটিকে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সুমন_সাস্ট এর ছবি

গাছের শিকড়ের পরিচয়; ভালো বলেছেন।

--
মাগো তুমি রেখো জেনে, এই আমরাই দেব এনে,
আঁধারের বাধা ভেঙে রাঙা ভোর, রোদ্দুর মাখা দিন।

http://www.youtube.com/watch?v=8OB_uPY4i4M

তিথীডোর এর ছবি

আপনার বাবার জন্য শ্রদ্ধা।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

আপনার বাবার মত মানুষদের জন্যই টিকে আছে প্রিয় স্বদেশ। বিনম্র শ্রদ্ধা

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার বাবাদের মতো মানুষদের গল্পই আমাদের অনপ্রেরণা। শ্রদ্ধা থাকলো আপনার বাবার প্রতি।

মাসুদ সজীব

Tareq-Uz-Zaman এর ছবি

বাংলার সকল আধা-পাগলা মুক্তিযোদ্ধা বাবারা চিরদিন শান্তিতে থাকুক, আর তাদের পাগলামী ছড়িয়ে পড়ুক আমাদের মাঝে ও । আপনার বাবার প্রতি রইল অশেষ শ্রদ্ধা ।

তারেক-উজ-জামান

সুবোধ অবোধ এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।