ভার্চুয়াল খাবার!

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৯/০৬/২০০৭ - ১১:৫৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি একটা কথা প্রায়শ বলতাম, এখনও বলি। একেকটা মন্তব্য যেন আমার কাছে একেকটা স্পর্শ। এটা প্রায় মুদ্রাদোষের পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল। অনেকে হাসি গোপন করতেন।
পাবলিক আসলে ছাপার অক্ষর ব্যতীত বিশ্বাসই করতে চায় না- হায়রে পাবলিক!

‘ফিরিয়ে দাও আমার আকাশ’ এই লেখাটি সামহোয়্যারে পোস্ট করেছিলাম। ওটায় হযবরল-এর একটা মন্তব্য ছিল। আমি প্রাসঙ্গিক মনে করায় এখানে দিয়ে দিচ্ছি।
প্রায় ১ বছর আগের মন্তব্য তুলে দেয়া আমার জন্য কঠিন কিছু না। আমার আর কাজই কী- সারাটা দিন অকাজ করে বেড়ানো! প্রিয় মানুষদের ভাষায়, মানুষ আর হলাম না। থাক গে, আমি অনেক কিছু ভুলে যাই কিন্তু কিছু বিষয় বিস্মৃত হই না!

তো, এই মন্তব্যটা আমি হুবহু এখানে তুলে দিচ্ছিঃ
“অ মামা, আমি পরশু রাত তিনটা তক গরুর মাংস রানছি, খাইবা। পরটা আমি বানাইতে পারি না, তয় মামা, সালাত বানাই ভাল, সরিষার তেল আর কাঁচা মরিচ দিয়া ডইলা। তুমি আমার জেনি রে একটু দেইখা রাইখো, মামা।···।”

এরপর হযবরলকে ১৭ ইঞ্চি মনিটরে পেলেই হতো। আমার মন্তব্যে ঘুরেফিরে চলে আসত, জেনী কেমন আছে। মানুষটা বিব্রত হতেন। হা হা হা।
আসলে এই জেনীকে তো আমি আর চিনি না- এর জন্ম আমার মস্তিষ্কের গোপন কুঠরিতে।
হায়, এই ভার্চুয়াল খাবার...স্বাদ কী অতুলনীয় - গরুর মাংস, পরোটা···। আমি ভুলে যাব কিন্তু মস্তিষ্ক ঠিকই মনে রাখবে।
রহস্যময় মস্তিষ্কের অনেক আচরণই আমি ধরতে পারি না। কে জানে, এই আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন, এমন আবেগীয় কর্মকান্ড আমার ক্রমশ যন্ত্রমানব হওয়ার থেকে রক্ষা করে।
জানি না...জানি না আমি।

পুরনো লেখা তবুও লজ্জার মাথা খেয়ে এখানে দিয়ে দিচ্ছি।
“কল্লোল চাপা কষ্ট নিয়ে চিঠিটা পড়ছে। ভাগ্নের চিঠি। অস্ট্রেলিয়ায় আছে। তিন বছর হলো দেশে ফেরার নাম নেই। ওর মন অসম্ভব খারাপ হয়ে যায়। বিশ বছরের যে ছেলেটা পানি ঢেলে খেত না, ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটাচ্ছে পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবহীন, একাকী-নিঃসঙ্গ। কী কুৎসিত একটা জীবন! এ ছেলেটার কথা মনে হলেই বুক কেমন ভারি হয়ে উঠে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

ও কী যে আমুদে ছিল, ছিল ওর কিছু পাগলামিও। এখানে থাকতে ও নিদেনপক্ষে তিনটা আন্ডার গার্মেন্টস পরত। ওদের চোখে পড়ে গেলে কী লজ্জা। প্রথমদিন তো কল্লোল বুঝতেই পারেনি কি হচ্ছে ভেবেছিল নতুন কিনেছে মাপ দেখছে। কিন্তু একটার ওপর আরেকটা, খটকা লাগল।

রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কিরে পাগলু, এইসব কি!’
কুক্কু ভেঙেচুরে একফুট ছোট হয়ে বলেছিল, ‘কিছু না মামা। এমনি-এমনি করছি।’
‘আরে পাগলা, মামার কাছে লজ্জা কি, মামা-ভাগ্নে যেখানে ভূত-প্রেত নাই সেখানে।’
‘ইয়ে মানে মামা, আমি শার্ট ইন করলে ছেলেরা খেপায়। পেছন থেকে আমাকে নাকি দশ বছরের খোকা মনে হয়। এখন একটু হেলদি দেখাবে।’
প্রবাসে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কুক্কু এ অভ্যাস ছাড়তে পারল না।

আজকের চিঠিতে লিখেছেঃ
“মামা বুঝতে পারছি নিয়মিত চিঠি দি’ না বলে তুমি রেগে পটকা মাছ হয়ে আছ। কি করব বলো, কাজ থেকে ফিরে ঘুমুতে ঘুমুতে রাত চারটা হয়ে যায়। সকাল আটটায় স্কুলে যেতে হয়। ব্রেকের সময় ঢুলতে ঢুলতে কিছুক্ষণ ঘুমাই। স্কুল ছুটি হলে কাপড় কাচা, রান্না-বান্না, বাথরুম পরিস্কার কত কাজ!
মামা তোমাকে একটা মজার ঘটনা বলি, ওদিন তাড়াহুড়ো করে স্কুলে যাচ্ছি। ইলেকট্রিক ট্রেনের অটোম্যাটিক দরজা লেগে গেল। আমার স্কুল ব্যাগ বাইরে আমি সরু ফিতা ধরে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছি। যে স্টেশনে নামব এপাশের দরজা খুলল না, খুলল গিয়ে কয়েক স্টেশন পর।
স্কুলে ম্যাডাম জানতে চাইলেন দেরি কেন হলো, আমি বুঝিয়ে বলছি। পুরোটা বলতে পারলাম না। জেনী করল কি, ও তুমি তো ওকে চেনো না, আমার বন্ধু।
চোখমুখ সিরিয়াস করে বললঃ কুক্ক, তুমি গডকে ধন্যবাদ দাও, আজ স্কুলব্যাগ বাইরে তুমি ভেতরে। এমন যদি হতো তুমি বাইরে ব্যাগ ভেতরে হি হি হি, তাহলে কি হতো বলো তো?

মামা জেনীটা না বড়ো ফাজিল। একদিন এমন ক্লান্তি লাগছিল টিফিন আওয়ারে চোখ লেগে গেল। ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলে দেখি টিফিন বক্স খালি। জেনী টিস্যুতে হাত মুছতে মুছতে হাসিমুখে বললঃ সরি, তোমার টিফিন আমি খেয়ে ফেলেছি, আমারটা তুমি খাও।
ওর খাবার চিবুতে চিবুতে বিরক্ত হয়ে আমি বললামঃ জিনিসটা কি, রাবারের মতো মনে হচ্ছে!
জেনী চোখ কপালে তুলে বললঃ কি বলছ, মার কি অসাধারণ রান্নার হাত। এতে কচ্ছপ, কচি শুয়োরের মাংস সবই তো আছে।

মামা তুমি আমার হাতের পরোটা খেলে না পাগল হয়ে যাবে। পরোটা খেতে কি মজা তুমি চিন্তাই করতে পারবে না। তবে মামা বিরাট সমস্যা পরোটা বেলার জন্যে বেলন পাই না। প্রথমদিকে খুব অসুবিধা হতো, পরোটা তিনকোণা চারকোণা হয়ে যেত।
কি করি, কি করি, হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এল মদের বোতল দিয়ে বেলনের কাজ চালালাম। অ মামা, তুমি আবার ভাবছ না তো আমি মদ-টদ খাই। শুধু পরোটা গলায় আটকে গেলে কয়েক ঢোক। গলা আটকে বিধর্মীদের দেশে মারা যাই? এটা কি তুমি চাও, নিশ্চয়ই চাও না? নাকি চাও- পরিষ্কার করে বলো?

মামা, তুমি কি এখনও বর্ষার পানিতে কাগজের নৌকা ভাসাও, আমাদের আকাশটা কি আগের মতোই গাঢ় নীল, আমাদের ছাদের চাঁদটা কি এখনো মায়াবী? তুমি কি এখনও ডাং-গুলি খেল, মামা?

তোমার পূর্বের চিঠি পড়ে জানলাম তুমি খুব হতাশ- টাকা পয়সার খুব সমস্যা যাচ্ছে। এতোটাই ভেঙে পড়েছো ভিক্ষুক দেখে ভাবো তোমার চেয়ে কী সুখী এই লোক। কোলের শিশুকে হিংসা করো। মামাইন্যার ঘরে মামাইন্যা, আমি তো আর মরে যাইনি।

আচ্ছা মামা, আমাদের ওই টিয়াটা কি এখনো আছে? ওই যে ঠুকরে ঠুকরে রক্ত বের করে ফেলত।
তুমি যে চিড়বিড় করে বলতে, বড় পাজি হইছে এইটা। তুমি শেষে লোহার খাঁচা বানিয়ে আনলে। ঐ টিয়াটাকে ভাল করে তাকিয়ে দেখো, দেখবে ওটা আমি। কতদিন, কতদিন তুমি আমাকে পাগলু বলো না, মাথার চুল এলোমেলো করে দাও না!মামা-মামা, অ মামা, বড় কষ্ট’!”


মন্তব্য

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

গল্পটা পড়েছিলাম আগেই। ছোট ছোট শব্দের অনুভূতিগুলো কত জীবন্ত, কত চকচকা!

মস্তিষ্কের ব্যাপারস্যাপার একটু আলাদা। আমরা তো ছাই দু পয়সার সাধারণ মানুষ। এমনকি নিউটন যে নিউটন, তার মস্তিষ্ক কি না মনে রাখতে গেলো একটা আপেলের গাছ থেকে পড়াকে!

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

নজমুল আলবাব এর ছবি

আপনে দেখি খালি পুরান লেখা দেন! ঘটনা কী? আমরা নতুন লেখা পড়ার অযোগ্য নাকী ? মন খারাপ

আরিফ জেবতিক এর ছবি

হুম!

সৌরভ এর ছবি

আগে পড়ার সৌভাগ্য হয় নাই।
এখন পড়লাম।

শব্দের খেলায় বাস্তবতা তুলে আনা।

------ooo0------
বিবর্ণ আকাশ এবং আমি ...


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

ভাস্কর এর ছবি

শুভ ভাইয়ের এই লেখা আমার পড়া হয় নাই আগে..পইড়া আনন্দ পাইলাম...


বরফখচিত দেশ ক্যান এতোদূরে থাকো!


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ড্যাবস!
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

সবুজ বাঘ এর ছবি

নিকারাগুয়া।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

ভায়োলোটা চামেরো।
_________________________________
<স্বাক্ষর দিমুনা, পরে জমিজমা সব লেইখা লইলে!>

হযবরল এর ছবি

জেনি'র জন্ম এই পোস্টেই হয়েছিলো। হাহা আপনিও একটা মানুষ কত কিছু মনে রাখেন। যখন ভুলে যাওয়াটা স্বাভাবিক তখন উল্টোরথে আপনি।

নজমুল আলবাব এর ছবি

বাট্টি নিয়া অনেক অসাধারন ছড়া শুইনা আমি বড় হইছি শুভ ভাই হাসি তাই এইসবে মাইন্ড খাইনা মজাই লাগছে। হাসি

অমিত আহমেদ এর ছবি

ভাল্লাগলো!

************************
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।