শ্রীহট্টে দু'দিনের অন্যশ্রী - ২

সাইফুল আকবর খান এর ছবি
লিখেছেন সাইফুল আকবর খান (তারিখ: মঙ্গল, ২৪/০২/২০০৯ - ৬:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শ্রীহট্টে দু'দিনের অন্যশ্রী - ২

[প্রতিশ্রুত ২য় পর্ব- পরিশ্রুত নয় মোটেই। হাসি
আরো একটা ডিসক্লেইমার এবার আগেই দিয়ে রাখি- এটা তথ্যসমৃদ্ধ ভ্রমণদলিল নয়, এটা সিলেটের পর্যটন-প্রবন্ধ নয়, এটা আমার একটা সিলেট-বেড়ানোর ব্যক্তিগত গল্পমাত্র, যেটা শ্রেফ ভাগ করছি ভাবাত্নীয় সচল-বন্ধুদের জন্য। অসম্পূর্ণতা বা ভুলত্রুটি সবাই ক্ষমা ক'রে নেবেন নিজ নিজ গুণে। বিষ হজমের জন্য সবাইকে অনেক ধন্যবাদ, সকৃতজ্ঞ।]

১০.
বিস্ময় আমার জন্য আরো অপেক্ষা করছিল ‘মায়া’য়। শুনেছিলাম আগেই, সিলেটে সম্প্রতি আর্কিটেক্ট ফার্ম খুলে বসেছে রাজেশের আরেক বন্ধু রমেন, যার সাথে রাজেশের মাধ্যমে আমারও বন্ধুত্ব ছিলই মোটামুটি, আমাদের ঢাবি’র সমসাময়িক ওর সেই বুয়েট আমল থেকে। বুয়েটে রাজেশ-সমেত যা এক-আধটু যাওয়া হ’তো আমার তখন, তা ওই রমেন আর তার সার্কেলের কাছেই, যাদের বুদ্ধিবৃত্তির গতি আর মাত্রার তখনও আমরা যথেষ্ট রসিক ভাগিদার ছিলাম মনে-প্রাণে। সান্ধ্যসফরে রমেনদের সেই ফার্মে ঢুকতে বেলা ‘মায়া’ নাম দেখেও আমার তেমনই ভালো লাগলো আবার সঙ্গে সঙ্গেই। অফিসের ভেতরই একটু একটু ক’রে জমে উঠলো সন্ধ্যা-শীতের আড্ডা। কারো কারো সাথে সেদিনই জীবনের প্রথম দেখা, কারো সাথে হয়তো বা জীবনের শেষ এবং একমাত্রও সেই দেখা। পূর্বপরিচয়ের সুবিধায় বা দায়ে রমেন আর আমার মধ্যে অল্প কিছু ব্যক্তিগত তত্ত্ব-তালাশ কুশল-বিনিময় বাদে সেখানে শব্দাবলী এবং বড় আকারে বিষয়াবলীই ছিল বেশ আন্তর্জাতিক, বরং বৈশ্বিকই। মুম্বাইয়ের তাজ-এর ওপর হামলা এবং আগাপাশতলা বৈশ্বিক রাজনীতি, কুনীতি, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলা, চরমপন্থা, সামরিক শক্তি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ... । ডালপুরি-চানাচুর-ফান্টা’র ভেতর দিয়ে এমুখ ওমুখ এমত সেমতে নানান বাঁক নিয়ে ফাঁক গ’লে শেষকালে নিজেদের দেশের রাজনীতি-দুর্নীতির ভেতর পর্যন্তও খুব সঙ্গত কারণেই পৌঁছে যায় সেই হু হু আলোচনার ঝড়। আড্ডালোচকদের সবারই পূর্বাপর বিশ্বজ্ঞান দেখে আমি কেবল বিস্মিত হচ্ছিলাম, ‘কীভাবে’ আর ‘কী-হবে’ ভাবছিলাম এমুখ ওমুখ চেয়ে চেয়েই। গভীর তথ্যচর্চা আর মতচর্যার ভেতর থেকে একটু একটু ক’রে আবার ছেঁকে ছেঁকে ওপরভাগটায় ওঠার সময় একেবারেই কনসেপ্চুয়াল পর্যায়ে এলো যখন, আমি কেবল তখনই মাথা নাড়ানোর চেয়েও একআধটু বেশি অংশ নিতে পারলাম, যদিও সেই নেয়া-না-নেয়ায়ও নিশ্চয়ই তেমন কিছুই আর এসে যায়নি। উন্মূল অস্থির গরীব মনের ভেতর বেশি ক’রে যেই ভাবনাটা নিয়ে সেই ঘন রাতের বেলায় রাজেশের বাসায় ফিরলাম সেই ‘মায়া’ থেকে, তা মূলত ওই রমেনদের বিষয়েই। রমেন-রাজেশ-উজ্জ্বলেরা কী সুন্দর ক’রে রাজধানীর সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ডিগ্রি পিঠে নিয়ে গিয়েও ঠিকই নিজের মাটিতে একের পর এক শক্ত খুঁটি গাড়ছে, প্রতিষ্ঠা বুঝে নিচ্ছে, জোরেশোরে চালাচ্ছে সাহসী সক্ষম আরো কতো চেষ্টা! ঋণহীন শূন্য জীবনেরই ঋণাত্নক ভাবনারোগী আমি তখন আরো গরীব হই ভিনশহরে ভিন-সফরের সেই প্রতিটি মুহূর্তে, গরীবতর হ’তে থাকি, পুরোনো লালিত দুঃখভারে দলিত হ’তে থাকি, নিজের ভেতর ভাঙতে থাকি, পড়তে থাকি, ...।

১১.
এত বড় বাড়িতে আমার ঘুমের জন্যও একাশয্যাই মিললো সেই ভিনরাতেও। মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা রেখে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘এল প্যাটার্ন’, সেভাবে পাশাপাশি অন্য খাটে রাজেশ ছিল, ব’সে ছিল আরো বেশ নিশুতিরাত অব্দি। তার ব্যস্ত পেশাদার কোলে সেই সময়টা জুড়ে ছিল কোলের ছোট্ট গণকযন্ত্র। রুম্পার সযত্ন আপ্যায়নে আবারও দ্রুতই দিনের শেষান্নটি নিয়ে নেয়ার পর রাজেশের আর আমার আলাপ সংক্ষিপ্তই ছিল, আমার ঘুমের যুক্তিতে, আর তার কাজের দরকারেও নিশ্চয়। প্রায়-শূন্য বড়বাড়ির নিশূন্য একটি বড়ঘরের লেপ-বিছানায় অনেকক্ষণ চেয়ে ছিলাম আমি- ঘুমহীন, তবে ঘুমের অপেক্ষায় নয়। ভাবছিলাম, আরো অনেক কিছুর সঙ্গে সেই দশ বছর আগেকার দিনগুলোর কথা, সেই দু’দিনে এই বাড়িটিরই অন্যশ্রী’র কথা। এই বাসাটাকে আমার প্রথমে এবং আদতে দেখাই ছিল কয়েক দঙ্গল মানুষসমেত, হিন্দুবিয়ের সেই মহাভারি মহাদীর্ঘ মহাকাব্যিক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে। প্রচুর আনজাম-গ্যাঞ্জাম, প্রখর হৈহল্লা, একোণে ওকোণে নির্বিচার খাওয়া-দাওয়া, কারো কারো দিনের পর দিন একইভাবে নির্বিকার খেটে যাওয়া সেই মহান উপলক্ষে, এখানে সাজসজ্জা তো ওখানে অল্পখণের ক্লান্তিশয্যা, এক ঝোঁকে কচিকাঁচাদের আনন্দ-চিত্কার তো অন্য ফাঁকে মা-জ্যাঠাদের চিন্তা-হুঙ্কার, ... ঝড়ের মতো ছোটা সময়, চাঁদ ছাড়া ছিল না যেন আর কোনো ক্যালেন্ডার, সূর্য ছাড়া আর কোনো ঘড়িও যেন কাজ করছিল না মোটেই ...। সেই বাড়িতে আর একবার যখন পাড়ি জমালাম নিজের কাজের দরকারে, ততোদিনে কতোটাই শূন্য হয়ে খোলা প্রান্তরের মতো আরো কতোই না ভয়ানক বড় হয়ে উঠেছে বাড়িটা!
কাছে-পাশে হ’লেও বড়দি’র বসবাস আগে থেকেই অন্য বাসায়, জামাইবাবু আর দু’টো টুকটুকে মেয়ে নিয়ে। মেঝদি’র বিয়েতেই এখানে কেটেছিল আমার সেই দশ-বছর আগের দু’দিন। সেঝদি’রও বিয়ে হ’লো এর মধ্যে, যাতে নিমন্ত্রণ পেয়েও উপস্থিত হ’তে পারিনি পাল্টে যাওয়া দিনের ব্যস্ততার সঙ্গে পাল্টে যাওয়া মনেরও নিস্পৃহার মিলন হওয়ায়। মা তো ছিলেন না তখনই, আর বাবাও গ্যালেন এরই মধ্যে অন্যপারে। রাজেশ নিজের বিয়ের চিন্তার আগে ঘরে মিস্ত্রি লাগিয়েছে রমেনের নকশায় বাড়িটাকেই ঢেলে সাজানোতে, আর বাইরে অন্য কিছু লোক নিশ্চয়ই লাগিয়েছে রুম্পার বিয়ের জন্য সম্বন্ধ সন্ধানে।
এখন অতএব অতো বড় বাড়িটির স্থায়ী লোকসংখ্যা কেবল ২! দস্যু সময় কী নিষ্ঠুর হাতে কতোকিছুই না ভাঙচুর আর লুটপাট ক’রে নেয় কতো অবলীলায়! এই অস্বস্তি নিয়ে বহুদিন পরে কাটছিল খুব অন্য একটা জাগরণ, কিংবা কাটছিল না খুব কেমন একটা রাত! দিনের ক্লান্তি জানি না শেষে ঠিক কখন লুটে নিয়েছিল ক্ষান্ত রোমন্থনের সেই টিমটিমে জাগরণটুকুও!

১২.
সকালে ঘুমচোখে নাশতা সেরেই, রাজেশকে ঘুমে রেখেই রাজেশের ব’লে-রাখা-মতে উপস্থিত আমজাদ আর গাড়ি নিয়ে আমি গিয়ে উপস্থিত হ’লাম শিমুলের মেস-এ, সেখান থেকে সুপ্তিকে নিয়ে দিয়ে এলাম আম্বরখানা গার্লস হাই স্কুলে। মোটামুটি শহরের এক কোণ থেকে পুরোটা চিরে অন্য কোণ ঘোরা হয়ে গ্যালো যেন! বাসায় এসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম রাজেশকে নিয়ে আবার একবারে বের হবো ব’লে। সে এখানে ওখানে একাজে ওকাজে আটকে থাকতে থাকতে ওদিকে সুপ্তির পরীক্ষা শেষের সময় হয়ে গ্যালো। একা একা বেরিয়ে ও কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারবে না ব’লে আবার গাড়ি চ’ড়েই দৌড়ে চললাম আম্বরখানায়। সেখান থেকে ফেরার পথে আরো এক কোণ ঘোরা হয়ে গ্যালো, কারণ রুম্পা স্কুল থেকে বাসায় ফিরবে তখন। বেশ শান্ত একটা দূর-কোণে বেশ সুনিবিড় মিষ্টি সেই কিন্ডারগার্টেনটিও অনেক ভালো লাগলো আমাদের দু’ভাইবোনের। দু-দু’টো বোনকে তুলে নিয়ে বাসায় ফিরে আমার আরেক প্রস্থ অপেক্ষা শুরু হ’লো রাজেশের জন্য। সেটাও আর ফুরায় না, কারণ সে আবার কাজের দরকারে অপেক্ষায় ছিল আরেক বন্ধুর। পরিকল্পনা ছিল পর্যটনের সেই আমার আগের দেখা স্পটটাই আবার দেখার, এবার সুপ্তির জন্য। যদিও যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা দিতে যাওয়া সেটাই দেখা হ’লো না পরীক্ষার আসন শহরেই ধার্য হওয়ায় এবং আর বেশি সময়ও না থাকায়, অন্তত পর্যটন-টা দেখতে যেতেই হ’তো, নইলে সুপ্তির সিলেট-ঘুরতে-যাওয়া পুরোপুরিই মাটি হয়ে থেকে যেতো। আমি একা হ’লে এবার আমার সার্বিক পরিবর্তিত অবস্থার কারণে যেকোনো নতুন ওইরকম বেড়ানোর জায়গা হ’লেও হয়তো যেতাম না দেখতে, যেতাম না হয়তো বা সেই কারণেই; সেই ইচ্ছেরাই বেঁচে নেই আর। কিন্তু সেটার শাস্তি ছোটবোনের ছোট মনে বড় কষ্ট হয়ে থেকে যেতো ব’লে গেলামই পর্যটনে।
এবার অবশ্য বেশ অন্যরকমই লাগলো ব্যাপারটা। কারণ দশ বছর আগের আমার সেই পর্যটন-পরিদর্শন ছিল রাতে, শ্রেফ গাড়ি-চ’ড়েই উঁচু রাস্তাটা ধ’রে উঠেছিলাম আধো অন্ধকারের বুক চিরে। এবার তাই যেতে যেতে পথের দু’পাশে মালনিচেরা চাবাগানের রোদেলা সৌন্দর্য যেমন বাড়তি হ’লো, তেমন পর্যটন স্পটটার ভিতরে ঢুকেও পরেই বুঝতে পারলাম মূর্খ আমি, যে আগের সেবার তো আমি আসলে কিছুই দেখিনি। কী বিশাল সেই ভেতরকার গোটা ব্যাপারটিই! সেই জায়গাটি দেখা যাদের, তাদের কেউ হয়তো এখানে এসে হোঁচট খাচ্ছেন পড়তে পড়তে, যে এ আর এমন টাশকি খাওয়ার মতো কী একটা জায়গা! কিন্তু, এটাই বোঝার বিষয়, যে- আমি এতই কম প্রাকৃতিক বা পর্যটন সৌন্দর্য দেখেছি জীবনে, যে আমার কাছে এগুলোই রীতিমতো গুরুপাচ্য গুরুতর সুন্দর! যেতে যেতে আবারও মোবাইলে থাকা ক্যামেরা-নামক অজুহাতটাতে ক্লিক ক্লিক করছিলাম, চলন্ত সবকিছুর আঁকাবাঁকা বোকাফাঁকা ছবি দেখে খিক খিকও করছিলাম দু’জনে। রাজেশকে ছাড়াই বেরুতে হয়েছিল এবারও, কারণ ভয় ছিল- ওর অপেক্ষায় থাকার জেরে শেষে শহরে ফিরতে দেরি বাঁধিয়ে অগ্রিম-কাটা ঢাকার গাড়িই মিস ক’রে ফেলি পাছে!

১৩.
পর্যটনের স্পটে গাড়ি ছেড়ে উজান হেঁটে উন্নত ভিতরে ঢুকতে ঢুকতেই বুঝছিলাম আমি, যে আগেরবার সত্যিই আমি এই একমাত্র দেখা জায়গাটারও তেমন কোনোকিছুই দেখিনি! একটু একটু ক’রে উন্মোচন করছিলাম হেঁটে আর চেঁখে দেখে, আর এটাতেই বেশি বিস্মিত হচ্ছিলাম দুই জন্মঘরকুনো ভাইবোনে, যে প্রায় আনপ্রেডিক্টিব্লি একটু পরপর এদিকে ওদিকে যাওয়ার মতো আরো অনেক জায়গা আবিষ্কার হচ্ছিল নতুন নতুন। সবুজ আর ময়দান- দু’টোই বেশ ভালো লাগছিল, ছুঁয়ে যাচ্ছিল, কথা কইছিল আমাদের মতো নাদান অতিথিদের সাথে। পাহাড়ের কাঁধ ঘেঁষে অবলীলায় নেচে নামছে পাতাল-খাদ, কতো পায়ের খলবল ওই মাটির পথ আর পথের মাটিতে! উদাত্ত নীরব প্রকৃতি, বিনীত সরব অল্প কিছু মানুষ বহু দূরে দূরে, আর সরকারী ধরনের কিছু চালের মধ্যে আমি আর সুপ্তি যখন চা-গাছের কাছে নুয়ে ‘দু’টি-পাতা-একটি-কুঁড়ি’ ভাঁজছিলাম হাল্কা আওয়াজে, হঠাত্ আমাদেরকে অবাক ক’রে দিয়ে নাটকের চরিত্রের মতো একজন খাকি-পরা-পাহারাকর্মী আমাদের পেছনের ঘন দূরত্বে দাঁড়িয়ে হঠাত্ ব’লে উঠেছিল- “জ্বি, এটা থেকেই চা হয়, যেটা আপনারা আমরা প্রতিদিন খাই।” সঙ্গত কারণেই আমরা অন্যরকম মজা পেলাম এই নাটকীয়তায়। পুরো জায়গাটায় কাউন্টারম্যান-রা ছাড়া আর কারো সঙ্গে তো বাক্য বা অন্য কোনো বিনিময়ও হচ্ছিল না একেবারেই। ছবির চেষ্টা কিংবা অজুহাত তুলতে তুলতে, কথার ফুল তুলতে তুলতে আমরা পরষ্পরকে শক্তি-সাহস-কারণও দিচ্ছিলাম হাঁটতে হাঁটতেই, হাঁটার জন্য আরো দূর, আরো, একেবারে শেষ অব্দি। অনভ্যাসের দাস হিসেবেও নিজেদেরকে অনেকই ছোট লাগছিল সেই জায়গাটার, তার উন্মুক্ত বৈশিষ্ট্যের আর আধুনিক আমোদায়োজনের তুলনায়। তবু, পুরোটা ঘুরে দেখবোই আমরা- অনভ্যস্ত চারপায়ে, হাভাতের চারচোখে।

১৪.
ফিরতে হ’লো, কারণ ফিরতে হবে আরো দূর। অদ্ভুত একটা বিরিয়ানি রেঁধে রেখেছিল রুম্পা। রাজেশকে বাইরে রেখেই, বাসের তাড়া সহযোগে আমরা ঝটপট খেয়ে নিলাম। জার্নির আগে বেশিই যেন খেয়ে ফেললাম একটু। ‘আলোর মিছিল’র মায়াবতী ববিতা’র প্রতিরূপী রুম্পা আগেরদিনই খোঁজখবর করছিল আমি বিয়েথা করেছি কি না, কবে করবো। তখনও খেতে খেতে শেষধর্মী আলাপ-সালাপ হচ্ছিল টুকটাক। আবার কবে আসবো- প্রশ্নের উত্তরে ভনিতা ছাড়াই, মিন ক’রেই এবং বিশ্বাস ক’রেই বললাম- “তোমার বিয়ের সময় ঠিক চ’লে আসবো”। মিষ্টি একটু অবিশ্বাস ছিল ওর মুচকি হাসিতে। অল্পালাপে গল্পহীন পরিচিত সুপ্তির সাথেও ওর গোটা গোটা কথা চলছিল খাওয়ার অবকাশেই। জড়াজড়ি ছাড়াই কী এক অদৃশ্য মায়া মায়া যেন! শেষের উদ্দিশে মেলা করার প্রস্তুতির সঙ্গে মাখামাখি হ’লো একই কারণে উদ্ভুত ওই আন্তরিক মায়ামায়া সব সম্মান-সম্ভ্রম-কৃতজ্ঞতাও। রাজেশ এলো আমাদের খাওয়া-শেষের মুহূর্তটি ঘেঁষে। সমুদ্রতটের সূর্য ডোবার (গল্পে শোনা) মতোন শেষটা যেন তবুও হুঁটহাট হঠাত্ করেই হ’লো। অতৃপ্ত মনে ব্যাগভারি কাঁধে বেরিয়ে পড়লাম আমরা, একেবারেই হঠাত্ ক’রে! দু’ভাইবোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অন্য দু’ভাইবোন আবার গিয়ে ঢুকলাম আমজাদের পেছন-আসনে। মনে হ’লো এক মিনিটের মধ্যেই যেন পৌঁছে গেলাম বাসস্ট্যান্ডে। আর দু’মিনিটের মধ্যেই যেন ছেড়ে দিল তিরিশ-ঘণ্টার ব্যবধানে দ্বিতীয়বার চড়া সেই ভিনশহুরে বাস-টা! পিছনে প’ড়ে থাকে আমার উচক্কা ছুটির ছোট্ট মহাশহর, হালকা নদী, পল্কা বাতাস, ... পিছু ছোটে আরো কতোকিছু!

১৫.
রওনাই প্রায়-বিকেলে হওয়ায় বেশ তাড়াতাড়িই অদৃশ্য হয়ে গ্যালো বাইরের দৃশ্য। তার আরো অনেক পরে চাঁদ যখন ভাসলো জান্লা-হিসেবে বেতালা এক কোণে, তখন হঠাত্-লোভী বুড়োচোখে সেটা দেখতে বেশ কষ্ট-কসরতই করছিলাম আমি সুপ্তিকে ডিঙিয়ে। ঘুমানো হ’লো না আমার, যদিও সচরাচর বাড়ির দূরপথে গাড়ি চড়তেই আমার অনভ্যস্ত আরামাবকাশে কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখ বুজে আসে আমার। হাঁটাক্লান্ত সুপ্তি চেষ্টা চালালো, কিছু হয়তো পারলোও। আঁধার নেমে এলে গতিজড়তায় মোবিক্যামে সুপ্তির বেশকিছু ছবি তুললাম ফল্স কালার এফেক্ট দিয়ে। নীল-ভূত বা কালিমূর্তির মতো সেই ছবিগুলো নিয়ে হাতাহাতি মজাও হ’লো আমাদের। হঠাত্ বোধ হয় এটাও মনে পড়লো আমার একবার, যে- ঢাকায় ফিরেই সুপ্তিকে সংসারী বড়ভাইয়ের বাসায় রেখে আবার আমি চ’লে যাবো আমার একলা বসবাসে, হঠাত্ ক’রে অন্যরকম কাটা এক টুকরো অন্য সময়ের এই ছোট্ট সঙ্গ আদর-বোনটাও আবার থাকবে না সাথে। একই এই একা হওয়া, তা-ও কতোবার কতো বিচিত্রভাবে!
সারাপথ চ’লে এসে মারাত্নক একটা যানজটে আমরা প্যাকেটজাত হয়ে গেলাম সায়দাবাদের মুখে। বিরক্ত অপেক্ষার অস্বাভাবিক দীর্ঘ ওই নষ্ট সময়টা হয়েই অনেক বিক্ষিপ্ততা নিয়ে আবার ঢুকে যেতে হ’লো, ঢুকে গেলাম শ্রী-রহিত এই কষ্ট-জটের শহরে।

[* গত ডিসেম্বরের শেষ থেকে নিয়ে চলতি ফেব্রুয়ারির শেষদিক পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মধ্যে তিল তিল ক’রে লেখা হয়েছে ইতিহাস-প্রয়াসী এই উপহাস, কিংবা হাসের ছোট হাস পাতিহাস।
আগেও বলেছিলাম- সব নামবাচক বিশেষ্য (জায়গার নাম বাদে) ইচ্ছে ক'রেই অন্য নামে বলা হয়েছে এই গল্পে।]


মন্তব্য

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- খান ভাই, রুম্পার হাতের বিরিয়ানি খাইতে মঞ্চায়, তাও মায়াতে বইসা, সুপ্তিকে না ডিঙায়াই। আপনে এতো কমকম লেখেন ক্যান খান ভাই?
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

রুম্পার বিয়াতে যামু তো আমি, তহন লৈয়েন আমার সাথে। চোখ টিপি
তয় ভাইডি, আমার সুদ্দর (সহোদর) বৈনের দিকে আউগায়েন্না সিরাম ক'রে! জানেনই তো, জগতের সব ভাই-ই অন্যের বৈনের দিক তাকায়, না পাইরাই, তয় নিজের বৈন-রে অন্যগো ভাইগো থেইক্যা প্রটেকশন দিবার্চায়। এইটা দুইন্যা'র নিউম। হাসি
ভাই, বলতে লজ্জা লাগে, কিন্তু ঘটনা সত্যি- আমি কম লিখি প্রধানত সময়ের অভাবে। মন খারাপ
অনেক ধন্যবাদ ধুগো। আপনার স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্যগুলা ভাল্লাগে। হাসি

০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- খান ভাই, খালি মিশটেক খানগো! মন খারাপ
আমি তো বইনের কথা কই নাই, আমি না খালি বিরিয়ানি'র কথা কইলাম। ঈমানে কই।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

হাসি

০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

এনকিদু এর ছবি

আগে জিগান নিজ হাতে বিরিয়ানি খাইতে চায় নাকি অন্যের হাতে চোখ টিপি


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

হাসি

০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

মুস্তাফিজ এর ছবি

ভালো লাগছে

...........................
Every Picture Tells a Story

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই, পড়ার এবং ভালোলাগা জানিয়ে যাওয়ার জন্য। হাসি

০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

তীরন্দাজ এর ছবি

খুবই ভালো লেগেছে আপনার ভ্রমণকাহিনী!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

হাসি

অনেক ধন্যবাদ, তীরুদা।

০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

রমেন-রাজেশ-উজ্জ্বলেরা রাজধানীর সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ডিগ্রি পিঠে নিয়ে গিয়েও ঠিকই নিজের মাটিতে একের পর এক শক্ত খুঁটি গাড়ছে, প্রতিষ্ঠা বুঝে নিচ্ছে দেখে ভালো লাগলো। তাদের অজস্র শ্রদ্ধা ও শুভকামনা। আমার বালকসুলভ শ্রদ্ধা ও শুভকামনাটুকু পৌঁছিয়ে দিয়েন।

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

আচ্ছা। হাসি

০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

মূর্তালা রামাত এর ছবি

ভাই আপনার কপি খুব সহজেই পড়তে পারি কিন্তু প্রবন্ধে আরাম পাই না......

মূর্তালা রামাত

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

কপি তো না-ই। তাই ব'লে- লিখতে চাইছি গল্প, একেবারে প্রবন্ধ হইয়া গ্যাছে?! অ্যাঁ

তাইলে বুঝতেছি- আমার তো তাইলে শুধু কপিরাইটারি-ই করা উচিত, আর সব চেষ্টা তওবা কইরা ছাইড়া দেয়ার টাইম হৈছে বোধ হয়। হাসি

অনেক ধন্যবাদ মূর্তালা, বে-আরাম পাঠের জন্য এবং খোলা মন্তব্যের জন্য।

০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।