আমার প্রিয় লেখক আমার বাড়ির কাছেই থাকেন। মাঝে মাঝেই ওঁকে দেখি আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে সকালবেলা দৌড়ে যেতে। ওঁর পরনে থাকে লাল রঙের একটা ট্র্যাকসুট আর পায়ে সাদা রঙের কেডস।
প্রায়ই ইচ্ছে হয় ওঁর সাথে একটু কথা বলি। কিন্তু বলা হয়না কেন জানি! ইচ্ছে হয় লেখকের লেখা “বেগুনী ফুল” নামের বইটাতে লেখকের অটোগ্রাফ নিই। উনি হয়ত এই শীতের সকালে কাঁপা কাঁপা হাতে আমার “বেগুনী ফুলের” প্রথম পৃষ্ঠায় লিখে দেবেন-“নীরুকে শুভেচ্ছা, আবিদুল হক”। কিন্তু আমি কখনোই “বেগুনী ফুল” নিয়ে আবিদুল হকের সামনে গিয়ে দাঁড়াই না!
“বেগুনী ফুল” নামের এই বইটা আমার নানারকম সুখ এবং দুঃখের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে। প্রথম যেবার বইটা হাতে পেয়েছিলাম বইয়ের মলাটের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। সাদা রঙের ব্যাকগ্রাউন্ডের উপর আঁকা ক্ষুদে ক্ষুদে বেগুনী ফুলগুলোকে দেখে মনে হয়েছিল ইচ্ছে করলেই ছুঁয়ে দেয়া যাবে। প্রচ্ছদ কার আঁকা সেটা জানতে পাতা ওল্টাতেই দেখি আবিদুল হক নিজেই এঁকেছেন।
আমাদের বাড়ির ছাদের উপর শীতলপাটি বিছিয়ে উপুড় হয়ে, আধশোয়া হয়ে একটানে পড়ে ফেলেছিলাম বইটি। বই যখন শেষ তখন আমার চোখে জল! মা ছাদে কাপড় শুকাতে দিতে এসে দেখেন আমি কাঁদছি। কোথায় মা একটু মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেবেন তা না, বিরক্তি মেশানো গলায় বলে উঠলেন-“কিরে নীরু, তুই আবার গল্পের বই পড়ে কাঁদছিস?এই মেয়েকে নিয়ে আর পারা গেল না!”।
বইয়ের মূল চরিত্র নীরু নামের একটি মেয়ে! আমার নামেই নাম!
নীরুর অনেকগুলো নিজস্ব সুখ এবং দুঃখ আছে। এই একান্ত সুখ এবং দুঃখগুলোর কথা নীরু কাউকে বলেনা। এগুলি গোপন থাকে নীরুর লেখার খাতার ভেতর লুকিয়ে রাখা একটি শুকনো বেগুনী ফুলের মতই!
গল্পের নীরুর মতই আমারো অনেকগুলি সুখ এবং দুঃখ আছে। এগুলি আমি কাউকে বলতে চাইনা। মা, বাবা, দিদি কিংবা আমার প্রাণের বন্ধুদেরকেও না! আমার গোপন সুখ এবং দুঃখগুলি গোপন থেকে যাক নীরুর বেগুনী ফুলের মত।
এই বই আমার এতো প্রিয় কেন? অনেকবার নিজেকে জিজ্ঞেস করেছি। গল্পের মূল চরিত্রের নাম আমার নামে বলে? নাকি গল্পের নীরু আর এই আমি বাস্তবের নীরুর দৈনন্দিন সুখদুঃখ গুলি মিলে যায় বলে। নাকি “বেগুনী ফুল” একটি অসাধারণ বই বলে? আমি জানি না!
বইটি আমি পড়তে দিয়েছিলাম আমার বন্ধু মিলিকে। মিলি একজন পাঁড় পড়ুয়া। সবধরনের বই সে গোগ্রাসে গেলে। যেকোন বই নিয়ে মিলির মন্তব্য আমি মেনে নিই বিনা দ্বিধায়। কিন্তু সেদিন যখন মিলিদের বাসায় “বেগুনী ফুল” ফেরত নিতে গেলাম মিলির উপর রাগে গা জ্বলে গেল আমার। বলে কিনা-“ নীরু বেগম তোমার এই বেগুনী ফুল নামক গ্রন্থখানি একখানি পিওর ট্র্যাশ! বইখানির নাম বেগুনী ফুলের বদলে বেগুনী ভাজা রাখলে ভালো হত”। বলেই ফস করে একখানা ইয়া লম্বা সিগারেট জ্বালিয়ে ভুস ভুস করে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। বলল-“ ফ্রেঞ্চ সিগারেট, বড়মামা নিয়ে আসছে। দিবি নাকি একটান?”
আমি আর কোন কথা না বলে বললাম-“আমার বইটা কোথায়?”
-“টেবিলের উপর রাখা আছে দেখ”।
দেখি টেবিলের উপর “বেগুনী ফুল” একটা কফি মগের ঢাকনা হিসেবে কাজ করছে। সাদা রঙের মলাটের উপর গোল করে কফির দাগ লেগে গেছে। আমি আর কোন কথা না বাড়িয়ে চলে এসেছিলাম মিলিদের বাসা থেকে।
সেদিন দেখি বাবা একতলার বারান্দায় বসে “বেগুনী ফুল” পড়ছেন। আমি জানালার ফাঁক দিয়ে দেখলাম বাবা বইটা পড়ছেন আম মাঝে মাঝে মুচকি মুচকি হাসছেন। একসময় বাবা আমাকে ডাক দিলেন-“নীরু, একটু এদিকে এসো তো”। আমি কাছে যেতেই বাবা বললেন-“ এই বইটা পড়েছ, নীরু?”
আমি বল্লাম-“হ্যাঁ”
-“তোমার নামেই নাম গল্পের মেয়েটির। কিন্তু গল্পের মাথা মুণ্ডু তো কিছুই বুঝলাম না। বইয়ের চরিত্রগুলো কেমন যেন খাপছাড়া। ইদানীং কি যে সব লেখা হচ্ছে!”
আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বল্লেন-“সবসময় ক্লাসিক পড়বে। তাহলে এই সব ট্র্যাশ পড়ে আর সময় নষ্ট হবেনা। যাওতো মা, আমার টেবিলের উপর থেকে তলস্তয়ের আন্না কারেনিনা টা নিয়ে এসো। ওইটা পড়ে কেমন লাগল আমাকে জানাবে”।
আমি বাধ্য মেয়ের মত বাবার টেবিল থেকে আন্না কারেনিনা উঠিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছি এই সময় বারান্দায় বসে থাকা দিদি তার মুখের সামনে থেকে “হিস্ট্রি অব মানি” নামের বই থেকে মুখ উঠিয়ে বলল-“ বইয়ের নাম বেগুনী ফুল? ইশ কি মেলোড্রামাটিক নাম। তুই বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও ওইসব পড়িস কী করে। ওইসব পিওর ট্র্যাশ পড়া বাদ দিয়ে একটু পিওর সায়েন্স পড়”।
আমি মুখ কালো করে দুদ্দাড় সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে গেলাম। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে বালিশে মুখ লুকোলাম।
একদিন মা এসে বললেন-“নীরু একটা বই ফই কিছু দে তো পড়ি। সময় কাটছে না”।
আমি মাকে বললাম টেবিলের উপর থেকে নিয়ে নিতে।
-“হুম “বেগুনী ফুল”? নারে এইসব ফুল নিয়ে লেখা বই নিয়ে আমি কি করবো? একটা রান্না টান্নার বই থাকলে দে তো”। আমি বিরক্ত হয়ে উঠে গিয়ে মায়ের হাতে সিদ্দিকা কবিরের রেসিপি ধরিয়ে দিলাম।
এরপর থেকে বেগুনী ফুল বইটা আমি আর কাউকে পড়তে দেইনি। ওটা আমার কলেজ ব্যাগে বন্দী থাকে অধিকাংশ সময়। মাঝে মাঝে বের করে পড়ি।
আজকে কলেজ থেকে ফেরার পথে দেখি একটা ছোটখাটো একটা বইমেলা শুরু হয়েছে আমাদের এই ছোট্ট শহরের একচিলতে পার্কে। সেদিকে এগুতে দেখি ভীষণ ভিড়।
ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেলাম। দেখি আমাদের পাড়ার ছোট্ট মেয়ে মধুরিমা হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে।
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম-“কিরে মধু এতো ভিড় কেন রে?”
-“ও নীরু আপা তুমি জানো না? মেলায় আজকে আবিদুল হক এসেছে। বেগুনী ফুলের লেখক। এই দেখো আমিও একটা বেগুনী ফুল কিনেছি। সাথে উনার অটোগ্রাফ” খুশিতে ঝলমল করতে করতে মধুরিমা ওর বেগুনী ফুলে আবিদুল হকের অটোগ্রাফ দেখালো। সেখানে লেখা-“মধুরিমাকে শুভেচ্ছাসহ, আবিদুল হক”।
মধুরিমার সাথে কথা বলে সামনে এগিয়ে গেলাম। দেখি একটা স্টলের সামনে বিরাট লাইন। আবিদুল হক অটোগ্রাফ দিচ্ছেন তাঁর “বেগুনী ফুলে”। আমারও কেন জানি লাইনে দাঁড়িয়ে অটোগ্রাফ নিতে ইচ্ছে হল।
লম্বা লাইনটার দিকে এগুতেই বিস্ময়ে আমার মুখ হা হয়ে গেল। দেখি লাইনের একদম সামনে দাঁড়িয়ে মিলি! হাতে বেগুনী ফুলের চকচকে নতুন সংস্করণ।
আমার অবাক হবার আরো বাকি ছিল। দেখি অটোগ্রাফের লাইনে দাঁড়ানো আমার বাবা, মা আর দিদি। সবার হাতেই “বেগুনী ফুল”।
হঠাৎ করে ওই ভিড়ের ভেতর দাঁড়িয়েই আমার মনটা কেমন বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। কেন যে গেল তা বুঝতে পারলাম না। আমি ওই সমস্ত ভিড় আর কোলাহল ছাড়িয়ে চলে এলাম বেশ খানিকটা দূরে, পার্কের নির্জন এক কোণে।
পার্কের ইট বিছানো রাস্তার ধারে একটা সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে “বেগুনী ফুল” বইটা বের করলাম ব্যাগ থেকে। বইয়ের মলাটে বেগুনী ফুলগুলি দেখে আমার সেই প্রথম দিনের মত অনুভূতি হল। যেন ইচ্ছে করলেই ছুঁয়ে দেয়া যাবে ফুলগুলি!
বইয়ের শুরুর পৃষ্ঠা বের করে কয়েকটা লাইন আমি পড়ে গেলাম যন্ত্রের মত। তারপর বইটি পার্কের বেঞ্চিতে রেখেই আমি হাঁটতে থাকলাম বাড়ির দিকে।
ওই বইয়ের আমার আর প্রয়োজন নেই। কারণ আমি এখন জানি গল্পের নীরু আর কেউ নয়, আমি। আমিই বেগুনী ফুলের নীরু। যার নিজস্ব সুখ এবং দুঃখগুলির গল্প কেউ কখনো জানবে না। খাতার ভেতর রাখা বেগুনী ফুলের মতই গোপন থেকে যাবে চিরকাল।
______________________________________________________________________________________________
অনেকদিন আগে "Purple Bloom" নামে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটার নামটাই শুধু মনে আছে। কে লিখেছেন মনে নেই। আর গল্পের আবছা একটা ছায়া মনে আছে। সেই আবছা ছায়া থেকে গল্পটি লিখলাম।
মন্তব্য
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
রাসিক রেজা নাহিয়েন
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
বাহ, চমৎকার গল্প তো।
অনেক অনেক ধন্যবাদ, প্রিয় চরম উদাস
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
বেশ ভালো লাগলো! আপনার অন্য গল্পগুলোও পড়ে ফেলতে হবে
----------------------------------------------------------------------------
একশজন খাঁটি মানুষ দিয়ে একটা দেশ পাল্টে দেয়া যায়।তাই কখনো বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করতে হয় না--চেষ্টা করতে হয় খাঁটি হওয়ার!!
পঠনে কৃতজ্ঞতা, রাজিব মোস্তাফিজ
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
খুব ভালো লাগলো।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুব অনুপ্রাণিত বোধ করছি।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
বাহ! খুব সুন্দর!
অনেক অনেক ধন্যবাদ, রংতুলি।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
চমৎকার।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
থ্যাঙ্কু, তিথী আপু
অনেক শুভকামনা
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
ভাল্লাগছে গল্প
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
অনেক ধন্যবাদ, ত্রিমাত্রিক কবি
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
স্বার্থক ছোট গল্প
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
থ্যাঙ্কু, মাসুদ ভাই
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
ভাল লাগল।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
ধন্যবাদ, শাব্দিক।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
সুখপাঠ্য!!!!!!
মজিবুর রহমান
ধন্যবাদ, মজিবুর রহমান।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
অনেক সময়ই এমন হয় যে কোন একটা বই আমার খুব ভালো লেগেছে, কিন্তু সেটা অন্য কারও ভালো লাগছে না। সেটা এক অদ্ভুত অভিমানের জন্ম দেয় ভেতর ভেতর।
ভালো লেগেছে গল্পটা।
শুভেচ্ছা
ধন্যবাদ, মেঘলা মানুষ।
শুভকামনা
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
ভিন্ন স্বাদের গল্প। ভাল লেগেছে।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
থ্যাঙ্কু, সুলতানা সাদিয়া
আপনার লেখাগুলি খুব ভালো লাগে।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
পড়লাম বেগুনী ফুল। আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না আমার কেমন লেগেছে। ছোট পরিসরে গুছিয়ে লেখার ধরণটা এখন রপ্ত করে উঠতে পারলাম না। অনেক পড়তে হবে আমাকে।
ওঁকে আর ওঁর -- এই বানানগুলো কি অসাবধানতাতেই এমন রয়ে গিয়েছে?
শুভকামনা রইলো।
অপর্ণা মিতু।
নতুন মন্তব্য করুন