পূর্ব ইউরোপ-৪ ( রঙ ঝলমলে জামোস্ক আর আলোয় রাঙা ইউক্রেন)

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৮/০৯/২০১৪ - ৪:৫৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

IMG_5703

ভোরে ঘুম ভেঙ্গেছে দেশের রায় জানার জন্য। কী চমৎকার শুরু একটা দিনের!। আচ্ছা মৃত্যুদন্ড ঠিক কী কী কারণে দেয়া হয় বাংলাদেশে?

এর মধ্য সকালে রান্নাঘরে যেয়ে বিশাল কেলেঙ্কারী, আগের রাতের দুই বোতল বুলগেরিয়ান সাদা ওয়াইন কেন হয়েছিল, একটা রাখা হয়েছিল ফ্রিজে! কোন মামুর বুটা জানি একটা উধাও করে দিয়েছে কেউ বেশি আপন মনে করে ! কী আজব মানুষ! অন্য কিছু হাপিস করে দে, তাই বলে ভরা বোতল! সকালেই হোটেলের সামনের জামোস্ক চিড়িয়াখানার সামনে গেছিলাম সেখানের গণ্ডারের ভাস্কর্যের সাথে ছবি তুলতে, একটা ছোট মেসেজ দিতে বন্ধুদের যে – যৌনক্ষমতা বাড়াবার জন্য যারা ৩৫,০০০ ডলার কিলো হিসেবে গণ্ডারের শিঙ কিনে তারা মহা উজবুক এবং ক্ষতিকর ধরনের মানুষ। তাদের জন্যই গন্ডারের মত অসাধারণ একটা প্রাণী নাই হয়ে যাচ্ছে চোখের নিমেষে, জানেন কি বাংলাদেশেও গন্ডার ছিল একশ বছর আগেও!

IMG_5606

এই ছবি তুলতে যেয়েই দেখ হয়ে গেল এক জোড়া বিশালদেহী বাদামী ভালুকের সাথের, যারা ইলেকট্রিক বেড়ায় ঘেরা খাঁচায় আছে বেশ মুক্ত অবস্থায়। এর মাঝেই অপু জানালো তার খিচুড়ি শেষ হতে একটু দেরী হবে, তাই শাহীন ভাই জানালেন এই সুযোগে আমরা চিড়িয়াখানাটা দেখে ফেলতে পারি। কিন্তু চিড়িয়াখানা জিনিসটা ছোটকালে ব্যপক প্রিয় গন্তব্য হলেও এখন খুব অপছন্দ করি। আমি মনে করি ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে চিড়িয়াখানা থাকবে না, মানুষ প্রাণী দেখবে বুনো পরিবেশেই যেয়েই। এখন সাফারির মাধ্যমে যা কিছুটা শুরু হয়েছে।

বেশ পরিপাটি চিড়িয়াখানাটি, প্রত্যেক প্রাণীর জন্য বেশ ছড়ানো জায়গা, খেলার জন্য সরঞ্জামও আছে, দেখা মিলল ভাল্লুক ছাড়াও ক্যাঙ্গারু, দুই কুজের উট, আফ্রিকান সিংহ, শ্রীলঙ্কান চিতাবাঘ আর নানা জাতের পাখির সাথে। তবে বেরোবার আগে দেখা হল দেশী উল্লুক আর মাদাগাস্কার থেকে আনা দুই জাতের লিমার ( উচ্চারণটা লিমার, লেমুর না)-এর সাথে। সেই সাথে তাদের কিছু কার্টুনের সাথেও!

IMG_5661

IMG_5649

চিড়িয়াখানা থেকে বেড়িয়ে মুরগি-খিচুড়ির উপাদেয় নাস্তা শেষে সজান জামেস্ক শহর কেন্দ্রে। প্রাচীন, বর্ণীল কেন্দ্রটি একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। ১৬০৯ সালে যাত্রা শুরু করে বহাল তবিয়তে টিকে থাকা ঔষধের দোকানটি কেন্দ্রের ঠিক সাথেই,

IMG_5383

সেখানে বেশ কিছুক্ষণ থেকে, রঙ বেরঙের ভ্রবনগুলোর সামনের দাঁড়িয়ে কেন সেখানে থাকিনা এই আফসোস নিয়ে সোজা রওনা দিলাম ৭০ কিলোমিটার দূরের ইউক্রেনের সীমান্তে।

IMG_5358

বিশাল দেশ পোল্যান্ডের একটা জিনিস, যে হাজার হাজার বাড়ী আমাদের যাত্রা পথে ছিল তাদের প্রত্যেকটিই দৃষ্টিনন্দন, বোঝা যায় মালিকের
রুচি অনেক উন্নত, আর দেশটা অনেক পরিষ্কার। ইউক্রেনের সীমান্তে টানা কয়েকবার পাসপোর্ট চেক, গাড়ীর কাগজপত্র চেক, গাড়ীর ইঞ্জিনের চেসিসের নাম্বার মেলানো ইত্যাদি করতে যেয়ে ঘণ্টা দেড়েক লাগিয়ে মেজাজ আগুন গরম করে দিয়েছিল বটে কিন্তু পথে পথে ঘোড়ার গাড়ী, কিষাণীর পেয়াজের দোকান, সরল ঠেলাওয়ালা, আর দিগন্ত ছোঁয়া ফসলের ক্ষেত দেখে ক্ষমা করে দিলাম সন্দেহপ্রবণ ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের।

বিশাল দেশ ইউক্রেনের ইতিহাস দখলদারিত্বের, শোষণের, বঞ্চনার, যুদ্ধের, দুর্ভিক্ষের। সারা বিশ্বে তাঁর দুই কৃতি সন্তান নিকোলাই গোগল আর সেরগেই বুবকাকে কে চেনে, কিন্তু জানে রাশিয়ান হিসেবে। ইউক্রেন যেন একটা অস্পৃশ্য দেশ রাশিয়ার কাছে, পাশ্চাত্যের কাছেও। এই দেশের সবচেয়ে অসোভিয়েতিও শহরের নামে লিভিভ। আমাদের প্রথম গন্তব্য সেখানেই।
সেখানেই পৌঁছেই মাথা আউলে গেল সবার, বিশ্বের কোন শহরে যাবার সাথে সাথে এত প্রিয়দর্শিনী, ফ্যাশন সচেতন তরুণীদের দেখিনি আগে, তাঁরা আছে সবখানেই!

IMG_5433

ডানাকাটা পরীরা যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে লিভিভের রাস্তায় দল বেঁধে। অন্তত দুই হাজার তরুণী ছিল সেখানেই যারা বাংলাদেশে জন্ম নিলে পাড়ায় পাড়ায়, স্কুলে স্কুলে মারামারি হত সেই মেয়ের সাথে প্রেম করার দাবী পেশ করা নিয়ে ! তাদের থেকে চোখ বাঁচিয়ে আমাদের হোস্টেল খুঁজে বাহির করে তাতে মালসামান রেখে উদরপূর্তি করে শহরের পুরনো কেন্দ্র ঘুরতে আমরা তখন বাহিরে।

ইন্না আমার অনেক বছরের পুরনো বন্ধু, ইউক্রেনেরই মেয়ে। এখন প্রবাসী। তাকে বলতেই সে ভেরোনিকার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, ভেরোনিকাও ড্যাং ড্যাং করে রাজী হয়ে গেল আমাদের একবেলা লিভিভ ঘুরিয়ে দেখাতে। ব্যস, তাঁর সাথে দেখা হল সন্ধ্যা সাতটায়। দেখা হবার দশ মিনিটের মাথাতেই সে আমাদের নিয়ে গলে লিভিভ টাউন হলের (এটাও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) মাথায়, ৩৬০টা সিঁড়ি বাওয়ার পরে!

IMG_5949

তখন সূর্যাস্তের কিরণ ছুঁয়ে দিচ্ছিল দেড় হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন নগরীকে। যা এখন ইউক্রেনের ৫ম বৃহত্তম শহর।

IMG_5469

৩৬০টা সিঁড়ি বেয়ে ফেরা নামার পর ভেরোনিকা আরও একাধিক ক্যাথেড্রালে নিয়ে যাবার পর

IMG_5481

অদ্ভুত কিছু জায়গা ছুঁয়ে-

IMG_5980

IMG_5488

জানতে চাইলেম ইউক্রেনের সবচেয়ে অদ্ভুত রেস্তোরাঁ ম্যাসন রেস্তোরাঁ সম্পর্কে, এবং সবাইকে খুশী করে সে জানালো ঐ রেস্তোরাঁর সদস্যপদ আছে তাঁর , ফলে আমরা ব্যয়বহুল রেস্তোরাঁতে যাইই খাই না কেন ৯০% ডিসকাউন্ট পাব! এটা এক অদ্ভুত খাবার জায়গা, প্রথম গেলে বঝায় যায় না যে খাবারের স্থান কোথায়, কারণ দরজা খোলে ক্লিন সেভড এক লোক, যার ঘরটা নির্দেশ করে আপনি প্রবেশ করেছেন সোভিয়েত সময়ের এক জগতে!

IMG_5507

IMG_5508

কাজেই ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া খুব স্বাভাবিক! যদিও তারপরও মানুষটি মৃদু হেসে অন্য দরজা খুলে আপনাকে প্রবেশ করাবে ম্যাসন রেস্তোরাঁয় যার দেয়ালে দেয়ালে আসতে অদ্ভুত সব ম্যাসনিক কারুকার্য। এবং কোনার ঘরে এক দারুণ ক্ল্যাসিকাল গাড়ী। ভেরোনিকা আব্দার জুড়ল সেই গাড়ী চেপে ছবি তোলার-

IMG_6016

আসলেই অদ্ভুত এক রেস্তোরাঁ, একবার টয়লেটে কেয়ে অপু আমাদের প্রত্যেককে জোর করল সেই সিংহাসনের মতো টয়লেটের একবারের জন্য হলেও বসার জন্য!

IMG_5498

অনেক দিন পর টি-বোন স্টেক খাওয়া হল,

IMG_6007

IMG_6004

একেবারে ডিপ ফ্রিজ থেকে আনা গ্লাসে ইউক্রেনিয়ান ভদকা আনা হল, কারণ নিকার বক্তব্য ইউক্রেনের এসে এখানকার জিনিস খাবে, রাশান জিনিসের প্রতি আগ্রহ কেন দেখাবে! কথা সত্য-

IMG_5499

IMG_5501

অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা হল রেস্তরাঁটিতে এসে এবং লিভিভে সময় কাটিয়ে। বিকেলে একজনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম একটা বিশেষ গির্জা কোন দিকে, তাঁরা দলেবলে এসে পৌঁছে দিয়ে গেছিল আমাদের—

মানুষই পারে কোন অপরিচিত জায়গাকে মুহূর্তের মাঝে এত আপনা করে তুলতে। লাভ ইউ ইউক্রেন

IMG_5878

দলের বাকীরা ঘুমিয়ে রীতিমত জানা দিচ্ছে নাসিকার মাধ্যমে, কাজেই বন্ধুরা- কাল আবার দেখা হবে।

গতকালের গল্প


মন্তব্য

Sohel Lehos এর ছবি

চলুক পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল হাসি

তারেক অণু এর ছবি
Sohel Lehos এর ছবি

আপনেগো বোতল যে ব্যাটা চুরি করছে তার পাছায় গন্ডারের শিং দিয়া একটা গুঁতা দেওন দরকার দেঁতো হাসি

সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল হাসি

তারেক অণু এর ছবি

অতিথি লেখক এর ছবি

জানেন কি বাংলাদেশেও গন্ডার ছিল একশ বছর আগেও

এখনও আছে। খালি নাম চেঞ্জ হয়ে বাঙ্গালী হয়ে গেছে। সাইদীর রায়ের পরের অনুভূতি এইটা।

লাট্টু ঘোরাঘুরি চলুক।

ফারাসাত

তারেক অণু এর ছবি

হুম

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দরীদের ছবি দিয়েছেন এই পোস্টটারেই সবচেয়ে ভালু পাইলাম হাসি । এইরকম সুন্দরীসমেত পোস্ট আরো চাই।

গোঁসাইবাবু

তারেক অণু এর ছবি

উদ্দেশ্য খ্রাপ দেখি গোসাই বাবুর !

অতিথি লেখক এর ছবি

লিভিভের এই মেয়েটার ড্রেসটা আমারও খুব পছন্দ হয়েছে চলুক

ডানাকাটা পরীরা যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে লিভিভের রাস্তায় দল বেঁধে। অন্তত দুই হাজার তরুণী ছিল সেখানেই যারা বাংলাদেশে জন্ম নিলে পাড়ায় পাড়ায়, স্কুলে স্কুলে মারামারি হত সেই মেয়ের সাথে প্রেম করার দাবী পেশ করা নিয়ে

এর মানে কি আপনি বলতে চান বাংলাদেশে ডানাকাটা পরী নেই চিন্তিত ? আমার তো মনে হয় ডানাওয়ালা এবং ডানাকাটা দুই ধরণের পরীই বাংলাদেশে পাওয়া যায় খাইছে
কিন্তু চিড়িয়াখানার ছবি কোথায় ভাইয়া?

ফাহিমা দিলশাদ

তারেক অণু এর ছবি

তা তো আছেই, থাকবেই পৃথিবীর সব অঞ্চলের মতই। কিন্তু গ্রেটার রাশিয়া অন্য ব্যাপার, এখানে মডেল প্রায় সবাইই

এক লহমা এর ছবি

জমজমাট পোস্ট। চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তারেক অণু এর ছবি

গলিয়ে দিচ্ছি-

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আপনার ভ্রমণ আনন্দময় হোক। তবে, আমি একটু সমস্যায় আছি। আমার বড় ছেলেটা বলেছে,"আব্বু, লটারির টিকিট কেনা শুরু করেছি, একটা বেঁধে গেলেই হয়, পুরাই তারেক অণু হয়ে যাব!" তা, আমার নামে উপুড় করে রাখা পানপাত্রের ছবি কই? হাসি

তারেক অণু এর ছবি

ছবি নাইই দিলেম! পাত্র আছে-

মেঘলা মানুষ এর ছবি

খেয়ে পান করে বেশ ভালোই দিন কাটছে দেখি খাইছে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।