পূর্ব ইউরোপ-৩ (পোল্যান্ডের বাইসন)

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: বুধ, ১৭/০৯/২০১৪ - ৪:৩৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

IMG_5387

সকালে ঘুম ভেঙ্গেই শুনি পাশের রুম থেকে ভেসে আসছে বড় ভাইদের দ্বৈত নাসিকাসঙ্গীত ! আর জানালার বাহিরে কুয়াশাময় পৃথিবী! কী বিটকেল শুরু একটি অসাধারণ সম্ভাবনাময় দিনের! ঘন কুয়াশা আর মেঘের মাঝেই হাসি মুখে নাস্তা করে বাস্কেটবলের শহর কাউনাস অল্প ঘুরে হাইওয়ে ধরে চলা শুরু হল অন্য দেশের দিকে, সময় তখন সকাল সাড়ে আটটা! এমন সকালে প্রতিদিন যাত্রা শুরু করতে পারলে তো বেশ হয়, হাতে অনেক সময় থাকে ঘোরাঘুরির।

IMG_5257

ধোঁয়ার মত কুয়াশার চাদর ছিড়ে যখন সূর্য উঁকি দিল ততক্ষণে আমরা পোল্যান্ডের সীমান্তে প্রায় পৌঁছে গেছি। মাঝে ছোট ছোট শহর, মৃত কিছু গ্রাম, গোলাঘরের ভগ্নস্তূপ, গরুর পাল কিন্তু মানুষের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। ক্ষুদে জনপদ খুবই আপন লাগে আমার সবসময়ই, বুকের মধ্যে কেমন যেন রিন রিন করে ওঠে সেখানের জীবনধারা চিন্তা করতে। ঐ যে দাদীমা ঝরা পাতা পালা করছেন আঁকশি দিয়ে উনি কী বিড়বিড় করে হিম বাতাসকে অভিসম্পাত করছেন, নাকি আওড়াচ্ছেন ঝরা পাতা নিয়ে রবার্ট ফ্রস্টের রঙিন কবিতা। ঐ যে দুই কিশোর স্কুলে যাবার পথে অবাক হয়ে তাকাচ্ছিল আমাদের দিক, তারা কি এমনতর বিদেশী আগে দেখে নি? জানালায় করুণ সাদা গোলাপটি কি রেখেছে কোন বিষণ্ণ বধূ? এমন জায়গায় থাকতে পারলে বেশ হয় বলে চিন্তা করি মাঝে মাঝে, কিন্তু আসলেই কি থাকতে পারব এত নিরবিলি, নিশ্চিন্ত জীবন নিয়ে? নাকি, ধুত্তরি বলে বেড়িয়ে পড়ব জীবনের পথে।

অবশেষে পোল্যান্ডের সীমান্ত রেখা অতিক্রম করে অদেখা এক ভূখণ্ডে ঢুকলাম আমরা, অবশ্য দলের বাকী তিনজন আগেই দেশটি দর্শন করে গেছেন, আমিই নতুন আগন্তক বলা চলে। বিশাল দেশ পোল্যান্ড, এবং মূলত সমতল। মাইলের পর মাইলে শস্যক্ষেত নজরে আসছে একেবারে প্রথম থেকেই, আর সুঠাম কিছু ঘোড়া। তাদের পেশীবহুল চকচকে শরীর দেখে অরোক্যানিয়ায় পাবলো নেরুদার দেখা পারচেরন ঘোড়ার কথা কথা মনে আসল। সেই সাথে ছিল কয়েক বার দেখা হাজার হাজার স্টার্লিং-এর ঝাঁক, কী দারুণ ভাবেই না আকাশের ক্যানভাসে ইচ্ছা মতো দিক পরিবর্তন করে দারুণ সব চিত্র সৃষ্টি করছিল তারা।

IMG_5290

পোল্যান্ডের শতকরা ২০ জন মানুষ নিহত হয়েছিলেন ২য় বিশ্বযুদ্ধে, মানে প্রতি পাঁচ জনে একজন ! তারপর চলেছে সোভিয়েতদের নির্লজ্জ দখলদারি। পূর্ণ স্বাধীনতা পাবার পর মিলিয়ন মিলিয়ন পোলাক ( পোল্যান্ডের অধিবাসীদের আমরা পোলিশ বললেই তাঁরা আসলে পোলাক, এটা প্রথম জেনেছিলাম মার্লোন ব্রান্ডোর A Streetcar named Desire ) জন্মভূমি ছেড়ে চলে গেছে অন্য দেশ, জীবনের ভয়ে, জীবিকার তাগিদে। কয়েক কিলোমিটার পরপরই দেখা মিলল গোরস্থানের, ক্রুশে মোড়া স্থানগুলি যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে বারংবার এই মাটিতে মৃত মানুষের স্মৃতি।

মাঝে পোল্যান্ডের একাধিক শহরের ভিতর দিয়ে যাবার সময় ইতিহাস ঘেটে দেখি নাৎসিরা এই শহরের অর্ধেক মানুষই খুন করেছিল। আবার ফিনিক্সের মত জেগে উঠেছে নতুন পোল্যান্ড। আর দেখা মিলল গির্জার, নানা গড়নের , নানা আকৃতির! কোনটা পদ্মের মতো, কোনটা পেয়াজ আকৃতির, কোনটা লম্বা মাস্তুলের ধরনে। পোল্যান্ডেই ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করছে ক্যাথলিক বিশ্বাস। এখনো পোল্যান্ডের বাচ্চারা বাবা-মার সাথে নিয়মিত গির্জার যায় রবিবারে যা ইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে অতীত ইতিহাসে। অবশ্য পোল্যান্ডের এই ধর্মভীতি বা ধর্মপ্রীতির পিছনে অন্যতম বড় অবদান এই ভূমিরই সন্তান পোপ ২য় জন পলের।

IMG_5292

ইউরোপিয়ান বাইসন হচ্ছে ফিনল্যান্ডের বৃহত্তম স্থলচর স্তন্যপায়ী প্রাণী। একসময় প্রায় বিলুপ্ত হয়েই গেছিল মানুষের লোভের আর বোকামির কারণে, এখন কিছু ফেরত আনা গেছে, রক্ষা করা গেছে আপাতত স্রেফ স্মৃতি হবার হাত থেকে। পোল্যান্ডের অতি বিখ্যাত ভদকার নাম বাইসনের ঘাস। সেইটা ছাড়াও বাইসনের প্রতিকৃতি রাখা হয়েছে প্রায় সবখানেই। এমন একটার সাথেই সবাই মিলে ছবি তোলা হল স্মৃতি রক্ষার জন্য—

IMG_5391

চমৎকার ডেকোরেশনের এক রেস্তোরাঁয় সারা হয়েছিল দুপুরের খাওয়া, বিখ্যাত পোলিশ বিয়ার সহযোগে -

IMG_5308

রাস্তায় একটু তাড়া ছিল পরবর্তী গন্তব্যের জন্য, পথি মধ্যে ঠিক হল আজ ইউক্রেনে যাওয়া বাদ থাক, আমরা বরং কাল সকালে পোল্যান্ডের ইউনিক একটি শহর, ঐতিহাসিক সৌন্দর্যমন্ডিত শহর জামস্কে এক রাত থেকে যেতে।

সেখানেই অনেক ঝামেলা করে নতুন থাকার হোটেল খুঁজে ফিরতে বেঁকে গেল রাত নয়টা। যাও বা আজকের রোজনামচা লিখতেই হাত দিয়েছি এর মাঝে যেতে হল সুপার মার্কেটে, অপুর রান্নার সব সরঞ্জাম কিনতে। সেখান থেকে ফিরতেই এক পাক্কা ঘণ্টা, কারণ পোল্যান্ডের এই অঞ্চলে ইংরেজির চল নেই বললেই চলে! অনেক সময় লাগল যে কোন কিছু বোঝাতে, যেমন এক হোটেলে যেয়ে বললাম – Can i please see the rooms?

সেই মহিলা আবার কাকে জানি ফোন করে দুইবার বলল see the rooms? see the rooms? তারপর এক চওড়া হাসি দিয়ে বললে, Off cousre ! বোঝা গেল উনি ফোনে কোন ইংরেজি জানা বন্ধুর কাছে জেনে নিচ্ছিলেন see the rooms? মানে কী?

কতসব মজার ঘটনা ঘটল আজকে, ব্যবহৃত পেট্রোল পাম্পের নজলের উপর মাকড়সার বোনা জাল দেখলাম, দারুণ সূর্যাস্ত দেখা হল, লুবলিন শহরের স্থাপত্য উপভোগ, সবচেয়ে মিষ্টি এক পোলাক তরুণীর বিস্ময় মাখা হাসি---

IMG_5259

কিন্তু এখন খাবারের ডাক পড়েছে, কাল আবার দেখা হবে। আর হ্যাঁ, কাল বিরিয়ানি হবে ইউক্রেনে না হয় শ্যাম্পেন। রায়ের আপিলের রায়ের পরে---

গতকালের গল্প এইখানে


মন্তব্য

সত্যপীর এর ছবি

এইটা কোন কথা, মিষ্টি পোলাক তরুণীর ফটুক্কই?

..................................................................
#Banshibir.

তারেক অণু এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

ফটোজেনিক বাইসন।

গোঁসাইবাবু

তারেক অণু এর ছবি
আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

সবচেয়ে মিষ্টি এক পোলাক তরুণীর বিস্ময় মাখা হাসি--

ইয়ে, মানে... কই?

কাল বিরিয়ানি হবে ইউক্রেনে না হয় শ্যাম্পেন। রায়ের আপিলের রায়ের পরে---

রেগে টং

তারেক অণু এর ছবি

সব ছবি তুললেই দিতে হবে তা কে বলেছে !

অতিথি লেখক এর ছবি

জার্নি করে টায়ার্ড হয়েও অনেক সুন্দর লিখেছেন চলুক
কিছুদিন আগে আপনিই বলছিলেন যে প্রথম পাতা থেকে লেখা না সরলে লিখতে পারছেন না। তাহলে এখন গতকালের লেখা প্রথম পাতা থেকে সরল কিভাবে চিন্তিত

ফাহিমা দিলশাদ

তারেক অণু এর ছবি

সিস্টেমে, প্রতিদিনই তাই করার ইচ্ছা আছে-

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ঘুরতে থাকুন, লিখতে থাকুন। সাথেই আছি। পানের সময় আমার নামে একটা পানপাত্র উপুড় করে রাখবেন! হা হা হা। হাসি

তারেক অণু এর ছবি

দিলাম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।