কতকাল আর খোলামেলা হাওয়াওড়া দিনগুলো নেই। সময়ের সেই খেলা আর নেই, সকাল দুপুর বিকেল সন্ধে রাত ধরে কাজ-অকাজের ঠাসাঠাসি করে ভরা বাক্সের মধ্যে খেলার অবকাশই বা কোথায়? স্বপ্নের চিপাগলির মধ্যে শরতের হঠাত্ রোদ্দুরের মতন শুধু মাঝে মাঝে স্মৃতির আঁচল উড়ে পড়ে এসে আর গলি অবাক হয়ে ভাবে কি এসব, কোথা থেকে এলো? কিছুই বোঝা গেলো না!
ধূপছায়া রঙের পর্দার আড়ালে এসে দাঁড়ায় সে। তাই ওকে স্পষ্ট করে দেখতে পাই নি কোনোদিন। শুধু ওর সজল চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে অস্তসূর্যের আলোয়। মুখের বাকীটা ভালো করে বোঝা যায় না। কেন জানি মনে হয় ওর অল্প-স্ফীত ঠোঁটে, এলোমেলো হাওয়াওড়া চুলে, করুণ হাতের ছন্দে অচেনা অভিমানের আভাস থাকে। কেজানে! বোঝা যায় না ভালো করে কিছুই। ও যে কে, তাও বুঝতে পারিনা।
আজকে বিকালে মেঘ সরে গিয়ে দেখা দিয়েছে রোদ। আকাশ কোমল নীল, রোদ্দুরে সোনারঙ। সূর্যপিয়াসী প্রাণগুলি আজ হারানো সুর খুঁজে খুঁজে বের করে তোড়া বাঁধে, বেসুরো শুকনোপাতা ফেলে দিয়ে। ভুলে যাওয়া শরতের মতন কাশফুলী মেঘেরা ভাসে আকাশে, ডানামেলা পাখির মতন উড়ে যায় সবুজ অরণ্যের দিকে, ওদের দিগন্তপ্রিয় ডানার নীচে তরল জলের ধারার মতন গলে পড়ে দূরত্বের কাঠিন্য।
টুকরো টুকরো দ্বীপেরা ছড়িয়ে আছে। অসেতুসম্ভব সব দ্বীপেরা। মাঝে বয়ে গেছে বিচ্ছেদের আর বিষাদের নোনাপানি। অবিশ্বাস আর বেদনার নীল সমুদ্র। একদিন এইরকমই এক দ্বীপে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। মাঝে মাঝে গতজন্মস্মৃতির মতন মনে পড়ে বহুদিন আগে আমরা একটা মহাদেশে থাকতাম।
কাকজ্যোৎস্নায় বালিহাঁস ওড়ে, সাগরতীর গর্ভিণী নৈ:শব্দ নিয়ে পড়ে থাকে চুপ। চুপ করে পড়ে পড়ে ভিজতে থাকে গহন রাতের অলীক আলোয়।
মিশরী ওড়নার মতন নেমে আসে শিরশিরে শিশিরকণা, বুঝি বা ঐ নীল চিত্রা তারার কাছ থেকে। ওরই জন্যে বুঝি সমুদ্রঝিনুকেরা ডানা মেলে রাখে? বুকের ভিতর শিরশিরে ব্যথাকে মুক্তা করে ফলাবে বলে?
সময়ের অমোঘ পাহারা উপরে ও নিচে- মাঝে নক্ষত্ররাজি জেগে থাকে চুপচাপ, বিষন্ন নির্জন চাঁদে ফুটে থাকে এলোমেলো চুলের ভুলে যাওয়া মুখ।
নি:শব্দ শিশিরে শিশিরে মিছিমিছি কান্না ঝরে যায়। তন্দ্রাচ্ছন্ন তুন্দ্রার তুষারে সে আজো সাবধানী পায়ে হেঁটে যায়, নীলসবুজ ওড়না দুলে ওঠে আকাশে।
টুকুন, তোকে গল্প বলি আয়
সে ছিলো এক মেঘপরীদের দেশ,
রুমঝুমিয়ে বাজতো তাদের নূপুর
চিকমিকিয়ে উঠতো তাদের কেশ।
টুকুন তোকে বলেছিলাম আগে,
মাটির সে ঘর, নিকোনো উঠান-
আমকাঁঠালের ছায়ায় ছায়ায় পথ
হাওয়ায় দোলে ক্ষেতের সোনার ধান।
টুকুন, তোকে দেখাবো একবার
এবার যখন আমরা যাবো দেশে-
তখন সবাই গাঁয়ের বাড়ী যাবো
দেখিস, এবার যাবোই ঠিক শেষে।
"প্রতিবারেই তুমি বলো যাবে
কোনোবারেই হয় না যাওয়া জানি-
সে এলো অবশেষে। নক্ষত্ররাত্রির রহস্যময় বাতাসের মতন হাল্কা, নরম পায়ে সে এলো। সে এলো উতল কুলহারা ঢেউয়ের মতন, সে এলো উড়ন্ত অলীক পাখির গল্পের মতন.....
চোখ মেললাম তাকে দেখবো বলে।চোখ ঝাপ্সা হয়ে এলো দ্রুত, শুধু দূরাগত বৃষ্টির গন্ধের মতন ঘ্রাণ এসে লাগলো চোখেমুখে....
ঝুঁকে পড়ে সে আলতো গলায় বললো- "চলো, চলো, যাবে না?"
ধূলাপায়ে চলতে চলতে সমুদ্রতীরের বালিতে। সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে সীগাল নিজেদের মতন উড়ছে আর নিজেদের ভাষায় কথা বলছে। আকাশ খুব নীল আজ, সমুদ্র আরো নীল। বালির ঢিবির উপরে দাঁড়িয়ে দেখতে পাই দূর, দূর, কত দূর! সমুদ্রের নীল শরীর মিশে গেছে আকাশের নীল বুকে। অন্তহীন মিলন তাদের।
এইসব ধূলিকণা পদচিহ্নময়
সময়ের রোদ্দুরে অভ্রকুচি ঝলকিয়ে-
কী কথা কয়?
এ পুরানো সিন্ধুনীর ইতিকথাময়
সারাবেলা আনমনে ফেনামাখা ঢেউ দিয়ে
আর্শিতে বৃষ্টিবিন্দু দুলে ওঠে, খুলে যায় ভিতর দরজা। হালকা শব্দ-প্রথমে স্বচ্ছ,বাষ্পময়, তারপরে আস্তে আস্তে ফিরোজা। ভিতরে অল্প আলো শিরশিরে, সন্ধ্যার শঙ্খধ্বনির মতো টলমল, ঠান্ডা ঠান্ডা ভয়, আর তীব্র লালচে কমলা কৌতূহল।
মোহরের গড়িয়ে যওয়ার শব্দ-
সোনালী রুপোলী তামারঙ শব্দ,
চন্দনের গন্ধের মতন স্বাদ
জোছনাগন্ধী বন চুপচাপ,
স্তব্ধ।
বৃষ্টিবিন্দুতে শব্দেরা টলমল
খুলে যায় বর্ষাদিগন্তের সবুজ দরোজা-