অতীতের সাথে পত্রালাপ (পাঁচ) – দূরদর্শন

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: সোম, ১৭/১২/২০১২ - ৯:৪৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রিয় বন্ধু রতিকান্ত, আজ দবির একটি বিশাল বাক্স কাঁধে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে আসে। আমাকে দেখে একগাল হেসে সেটি টেনেটুনে নিয়ে ঢুকে বসার ঘরে। অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। বসার ঘর থেকে নানা ধরনের ঠুকঠাক শব্দ ভেসে আসে। দবিরের এই ধরনের কাণ্ডকারখানা এতদিনে চেনা হয়ে গেছে। তাই কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে যাই। বিছানায় বসে ডুবে যাই নিজের ভাবনা চিন্তার অতল গভীরে। অনেকক্ষণ পর দবির আসে ঘরে। মুখে রহস্যময় হাসি। আমাকে ধরে নিয়ে যায় বসার ঘরে।

দেখলাম বাক্সটির ভেতরে বসে কথা বলছে দুজন লোক। একটু পর লোক দুজন সরে যেতেই সুন্দর, সাজানো একটি ঘরে একটি মেয়েকে শরীর নাচিয়ে গান গাইতে দেখা গেল। সে ঘর থেকে মেয়েটিকে বেরুতে দেখা যায়না একবারও, কিন্তু কী এক যাদুতে ঘরের বদলে এক নৈসর্গিক প্রকৃতি ঘিরে থাকে মেয়েটিকে। সে প্রকৃতিও বদলায় বারবার। কতক্ষণ পর আবার সেই ঘরই ফিরে আসে। মেয়েটির গানও শেষ হয়। অবাক হলেও আগের মতো নয় আর। এখনকার মানুষের আবিষ্কারের ধরনধারণ অনেকটাই জেনে ফেলেছি। এটিও তেমনি কোনো এক উপভোগের বিষয় হবে। দবির বলে,

এইটা টেলিভিশন। দূরের মানুষ দেখন যায়, কতা শোনা যায়।
দেখে কী হয়? বললাম আমি।
গান বাজনা শুনতে পারবা, খবর শুনতে পারবা। এই দেশে কী হয়, অন্য দেশে কী হয়, ঘরে বইসা দেখতে পারবা।
বাইরে গিয়ে সব দেখতে চাই, ভেতরে বসে দেখে কী লাভ।
যহন বাইরে যাইবা, তহন বাইরে দেখবা। যহন ঘরে আছ, তহন বাইরের দুনিয়া ঘরে বইসা দেখবা।

জিনিসটি কাজেরই মনে হয়। দিনে বাইরে থাকলেও রাতে ঘরে বসে অনেক কিছু দেখা যাবে। একটু পরই নতুন কিছু শুরু হয় বাক্সটির ভেতরে। দবির জানালো, খবর শুরু হয়েছে। খবরে নানা ধরণের মানুষ ও পারিপার্শ্বিকতা দেখিয়ে এই দেশ, অন্য দেশ সম্পর্কে বলা হয়। তার অধিকাংশই বুঝি না। কিন্তু তারপরও তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। যে মেয়েটির কথা শুনছি, তার ভাষাও দবিরের কথার চাইতে অনেকটা স্পষ্ট আর সহজ। বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছি, হঠাৎ চারদিকে অন্ধকার আর আমাদের টেলিভিশনের পর্দাও কালো হয়ে যায়। বাইরের লোকজনও হই হই করে চীৎকার করে উঠে। সান্ত্বনা দিয়ে দবির বলে,

ডরাইও না। লোড শেডিং অইছে।
লোড শেডিং আবার কী?
ইলেকট্রিক না থাকলে লোড শেডিং হয়।
ইলেকট্রিক কী?
তারের মইদ্দে যেই ডা থাকে, এইডাই ইলেকট্রিক।

আমি কিছুই বুঝি না। কিন্তু বেশী প্রশ্ন করতেও ইচ্ছে করে না আর। একটি মোমবাতি জ্বালাল দবির। সেই মোমের আলোতে কাঁপে আমাদের ছায়া। সেই আলোছায়ার খেলার মাঝে দুজনের লক্ষ-হীন বিস্তৃত আলাপের পর হঠাৎ আলোকিত হয়ে উঠে ঘর। টেলিভিশনের পর্দাতেও আবার ছবি ফুটে উঠতে শুরু করে। কিন্তু সেখানে খবরের বদলে টুপি মাথায় দাড়িওয়ালা একজন লোক অপরিচিত এক ভাষায় কী বলে, তার সামান্যও বোধগম্য হয় না আমার।

এই লোকটিকে দেখেই শক্ত হয়ে যায় দবিরের চেহারা। চিন্তার ভাজ ফুটে ওঠে কপালে। কতক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আমার দিকে তাকায় সে। তারপর দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলে,

একটা কথা মনে হইতাছে আমার। তোমার নামডা বদলাইলে বালা হয়।

এবার অবাক হই। নাম বদলাতে হবে, এ আবার কেমন কথা! তার নাম দবির, আমার নাম রামকুমার, এই বস্তুটার নাম টেলিভিশন। অবাক দৃষ্টিতেই দবিরের দিকে তাকিয়ে বলি,

নাম বদলালে ভালো হয়। কেন?
তোমার নাম রামকুমার, তুমি যেমনে কথা কও শুনলে তোমারে ভাদা কইয়া পিডাইয়া মাইরা ফালাইব হারামজাদা মোল্লারা।
ভাদা কি। আমি যদি তাদের কিছু না করি, তারা আমাকে মারবে কেন?
ভাদা অইল ভারতের দালাল। হেগরে কিছু করন লাগেনা। হেরা যারে খুশী তারে ভাদা কয়, পিডাইয়া মারে। মইদ্যে মইদ্যে ক্ষুর দিয়া গলাও কাটে।

শুনে খুব ভয় পেলাম। এরা আবার কেমন দেশের কেমন মানুষ? অকারণ সন্দেহে অন্য মানুষ খুন করে! জ্ঞান বিজ্ঞানে এতোটা এগিয়ে যাবার পরও কেন তাদের এই মনোবৃত্তি? আমার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে আরও বেশি চিন্তিত হয় দবির। বলে,

খৎনা কইরা নিলো বেশী নিচ্যিত হওন যায়।
খৎনা কী? চমকে উঠে জানতে চাইলাম।
নুনুর আগার চামড়া কাইটটা ফলান লাগবো। মুসলমান গোর লাগি ফরজ।

কাটাকাটির কথা শুনে ভয় আরও বাড়ে। আমাদের সেই আগের সময়েও শুনেছি, অনেক ধর্মের লোকেরাই এটি করে। কিন্তু আমাকে কেন করতে হবে? আমার শুকনো মুখ দেখে দবির বলে,

ডরাইও না ভাতিজা। এই দেশের রীতিনীতি জানতে চাইলে এই দেশের মানুষের লগে চলতে অইব তোমারে। চলনের মইদ্দে সন্দেহ থাকলে বিপদ অইতে পারে। বিপদ যত কম, ততই ভালা। আমার পরিচিত এক মৌলবি সাব আছে। হেগ মতো হারামজাদা না। খৎনার কামডাও ভালা করে। তোমারে হের কাছে লইয়া যামু।

নাম বদলানো, খৎনা, কোনোটাই পছন্দ হয় না আমার, হবার কথাও নয়। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এতোটা সময়-পথ পাড়ি দিলাম, তার বাস্তবায়ন আর দবিরের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের উপর ভরসা করে তার দুটো প্রস্তাবেই রাজি হয়ে যাই।

দবিরের সাথে বসে বসে আজ যে সব সিদ্ধান্ত নিই, সেগুলো তোমাকে সংক্ষেপে জানাচ্ছি রতিকান্ত। এখন থেকে আমার নাম সোহেল মিয়া। বাইরের পৃথিবীতে দবির আমাকে তার ভাতিজা বলে পরিচয় দেবে। খৎনার কাজটি তিন দিন পর করা হবে। আমাকে একবার দাড়ি রাখার প্রস্তাবও দিয়েও সে প্রস্তাব নিজেই নাকচ করে দবির। তুমি কী ভাবছ, বুঝতে পারছি। এতোটা সময়ে অতীতে থেকে হয়তো আমাদের এ সব সিদ্ধান্তের অনেক কিছুই অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে তোমার। এখানকার কিছু কিছু মানুষের চোখের চাউনি, তাদের চলাফেরার মাঝে অসুস্থ উন্মাদনা আমার মনের পর্দায় ভয়াবহ বিপর্যয়ের ছবি আঁকে প্রতিদিন। সে ছবি দেখে আমার এই সিদ্ধান্তই নিতান্তই জরুরী। আনন্দের কথাও বলি। আরেকটি ছবি আমার নিজের ভেতরে অনেক আগেই আঁকা হয়ে গিয়েছে। দবির কখনোই কোনো ক্ষতি চাইবে না আমার। মাঝে মাঝে মনে হয়, তুমিই দবিরের রূপ ধরেই আমার সাথে।

তাপরও রাতে ভালো ঘুম হয়নি। নতুন এই পৃথিবীর নানা বিষয়ের সাথে আমার বাহ্যিক চেনাজানা ধীরে ধীরে বেড়ে চললেও আত্মিক চেনাজানা এখনও অনেক দূর। এই দূরত্বের কতটা কতদিনে অতিক্রম করতে সক্ষম হব, এই ভাবনা একটি বলয় হয়ে আমার বুকের ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে আকৃতিতে বড়ো হতে থাকে। একসময় সে বলয়ের চাপে বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করি। বিছানায় উঠে বসার পর সে ব্যথার কিছুটা উপশম হয়। এভাবেই শোওয়া আর বসা আর নিজের ঘরেই পায়চারীর কোনো এক ফাঁকে জানলা বেয়ে সকালের আলো প্রবেশ করে ঘরে। সে আলোতে বলয়টির আকৃতি অনেকটাই ছোটো হয়ে যায়।

তোমার কুশল কামনা করি।
ইতি
তোমার বন্ধু রামকুমার

চলবে ....

আগের পর্বগুলোর লিংক:

অতীতের সাথে পত্রালাপ (এক) - অবতরণ
অতীতের সাথে পত্রালাপ (দুই) – দবির মিয়া
অতীতের সাথে পত্রালাপ (তিন) – পথ আর ঘর
অতীতের সাথে পত্রালাপ (চার) – গাণিতিক সময়


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম, লিখতে থাকুন।

''দিবাকর''

অতিথি লেখক এর ছবি

ছোট হয়ে গেছে বেশী এই পর্বটি। চলুক।

ফারাসাত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।