সচলচারণ ৭

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বিষ্যুদ, ৩০/১০/২০০৮ - ৫:৫৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজকের লেখাটা লিখতে গিয়ে বারে বারে ঠেকে ঠেকে যাচ্ছে, সেলাই করতে বসে সুতা জড়িয়েমড়িয়ে গেলে যেমন হয়, তেমনি। বারে বারে থেমে পাকিয়ে যাওয়া সুতা খুলতে হচ্ছে। বারে বারে থেমে থেমে ভাবতে হচ্ছে, মুছে দিতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যা বলতে চাই তা ঠিক করে বলা হচ্ছে না। সেই হিসাবে হয়তো ব্লগরব্লগর বলাও ঠিক হচ্ছে না।

আজকের কথাটা কইতে চেষ্টা করছি অনেকদিন থেকে, কিন্তু বলি বলি করে বলা হয় না। মানুষের সব সাধ্য-সাধনা কোনো এক জায়গায় এসে থমকে যায়, কিছু করার থাকে না। খুব অসহায় লাগে।

তখন আমি সচলে নতুনই বলা যায়। নীরব পর্যায়েও নতুন। একদিন অলসভাবে ঘোরাঘুরি করছি, এদিক ওদিক। ছোটো ছোটো মাঝারি মাঝারি বা কোনোটা বেশ বড় -ছড়িয়ে থাকা মণিমুক্তা তুলে তুলে ওড়নায় বাঁধছি। এইসব সময়ে নিজেকে বেশ স্যর আইজাক নিউটন স্যর আইজাক নিউটন লাগে, কলার না থাকায় তোলা হয় না। উনি সমুদ্রতীরে নুড়ি কুড়াতেন, আমি সচলের তীরে মণিকণা কুড়াই। সেই হিসাবে স্যর এর থেকেও কয়েক কাঠি সরেস বলা যায়। হাসি

সেই ভাবে ঘোরাঘুরি করতে করতেই লেখাটায় গিয়ে পড়া। একটা নির্বাচিত লিস্টে ছিলো লেখাটা। "হেলথ রিপোর্ট, মেয়ের হাতে।" একটা ইংরেজী রচনা, মেয়ে লিখেছে বাবা সম্পর্কে। বাবা ব্লগে তুলেছেন আগে পরে নিজের কিছু লেখা সংযোজন করে। সচলে কত লেখাই তো পড়ি, ভালো ভালো লেখা, এই লেখাটায় কিযেন একটা ছিলো, মনে রয়ে গেলো। লেখাটা আর পরবর্তী অনেক অনেক কমেন্ট পড়ে জিনিসটা মনে যে কেন এমনভাবে রয়ে গেলো, কি যে তার রসায়ন কিছুই বুঝলাম না নিজেই। মনে আছে তো তখন আমি একদম নতুন? কাউকেই চিনিনা?

রচনার বাঁধুনি খুব ভালো, পড়ে ভালো লাগলো, কিন্তু সেজন্য না, লেখাটার মধ্য থেকে কি যেন একটা উঁকি দিচ্ছিল, এক স্নেহময় অভিমানী বাবা আর তার প্রাণপ্রিয় কন্যার কথা, যে বাবা বহুদিন ধরে কাশিতে ভুগছে কিন্তু পাত্তা দিতে চায় না নিজের অসুখকে। মন্তব্যে বহু লোক উদ্বেগের সংগে বলছেন আপনি শিগগীর ডাক্তার দেখান, সিগারেট ছেড়ে দিন। পড়ি আর পড়ি আর মনে হয় কে এই লোক? আমি যা ভাবছি সত্যই কি তাই? সত্যই কি এই মানুষ অভিমানী আর স্নেহময়? নাকি সব আমার কল্পনা?

পরিচয়ের ইচ্ছে জাগে কেজানে কেন, তখন তো অসম্ভব ই একরকম! তবু মনে হয় একবার চেনা হলে মিলিয়ে নিতাম। আমার নিজের বাবার সংগে কি এনার মিল আছে? আমার বাবাও খুব নরম মনের মানুষ, এতদিন ভারী বিরক্ত লাগতো তার জন্য। পুরুষমানুষ আবার এত নরম কিসের? পুরুষ হবে ঘোড়সওয়ার যোদ্ধার মতন, দুর্গম মরুপ্রান্তর পার হয়ে যাবে অবলীলায়। "আমি বেদুইন, আমি চেংগিজ/ আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ"-সেইরকম হবে পুরুষ! তবে না!

সেই প্রথম ধারণা টলে উঠলো, মনে হলো বাইরে থেকে বিচার করে বোঝা যায় বীরত্ব? যোদ্ধার অন্তরে কি কোমলতা থাকে না? বাইরে থেকে নরমসরম মনে হলেই কি পৌরুষ কমে যায়?

ওই লেখার আয়নায় নতুন করে দেখতে পেলাম নিজের বাবাকে, ধারনা বদলাতে থাকলো। সেকথা সেই কোমলহৃদয় অভিমানী ব্লগারকে জানানো হলো না। আজ আফসোস শুধু, এখন কিকরে কৃতজ্ঞতা জানাই, আজ তো সে সবকিছু ছাড়িয়ে কোন্‌ মহাজাগতিক দূরত্বে!

সেই আমার প্রথম মুহম্মদ জুবায়ের এর ব্লগ পড়া। তারপরে যতবার পড়েছি, আমার কল্পনার সংগে মিলে গেছে। মেয়ের কিছুটা দূরের শহরের ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চলে যাওয়া, মেয়েকে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে খুব চেনা রাস্তায় ও রাস্তা হারিয়ে ফেলা-বারে বারে দেখা দিয়েছেন সেই স্নেহময় বাবা তার প্রাণপ্রিয় মেয়ের কথা নিয়ে। সম্পূর্ণ বহিরাগত আমার কেমন জানি লাগত,খুব চেনা লাগতো মানুষটাকে, লেখাগুলো মনে পড়াত আমাকে এয়ারপোর্টে বিদায় দিতে আসা নিজের বাবাকে, পুরুষমানুষের চোখে জল! ইশ! তখন কিছুতেই কেন বুঝতে পারিনি! ঘোড়সওয়ার সিংহহৃদয় শক্ত পুরুষ এর সংগে মেলেনি বলে বিরক্ত হয়েছি!

আস্তে আস্তে জানতে পারলাম আরো, পড়লাম উপন্যাস-"চুপকথা" আর "পৌরুষ"। চুপকথা বার বার পড়লাম, পড়ে ভাবলাম, আর আমার ধারনার কারুকাজে বদল আসতে থাকলো। হয়, হয়, যোদ্ধা ও কোমলহৃদয় হয়, প্রকৃত যোদ্ধাই তো কোমল হয়, নইলে কেন সে নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে এগিয়ে যায় সুন্দরকে রক্ষায়? মনে পড়ে "মুক্তধারা"র কুমার অভিজিত‌কে, নিজের জীবন দিয়ে যে ভুলের বাঁধ খুলে দিয়েছিলো। সেও এমন কিছু একটা বলতো না?

দেরি হয়ে গেলো, পরিচয় হোলো না। সে আফসোস রয়ে গেলো আমার। অনেক কথা কওয়ার ছিলো, অনেক কথা শোনার ছিলো, অনেক কৃতজ্ঞতা জানানোর ছিলো। আর হলো না। আমার অপটু কলমে তাই এক অঞ্জলি শ্রদ্ধা রেখে যাই।

(চলবে)


মন্তব্য

সুমন সুপান্থ এর ছবি

লা-জবাব তুলিরেখা !
বিষয় আর গদ্য এমনই কাতর করে তুললো, মন্তব্যে আর কিছু লেখাই যাচ্ছে না !

হায় জুবায়ের ভাই - বড় বেদনার মতো বাজো যে তুমি !

---------------------------------------------------------

'...এইসব লিখি আর নাই লিখি অধিক
পাতার তবু তো প্রবাহেরই প্রতিক...'

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

তুলিরেখা [অতিথি] এর ছবি

সুমন সুপান্থ, ধন্যবাদ।
আমার খুব দেরি হয়ে গেলো, আর কিছুদিন আগে থেকে যদি সরব হতাম, হয়তো পরিচয় হতো।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

জুবায়ের ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল আবার। সাথে সেই লেখাটাও। অসামান্য একটা লেখা ছিল। অনেক অন্তর দিয়ে লেখা।

সবজান্তা এর ছবি

আমি তো এমনিতেই সচলে লেখতে অসম্ভব সংকোচ বোধ করি। খারাপ লাগে, এত চমৎকার লেখার মধ্যে আমার লেখা নীড়পাতার সৌন্দর্য নষ্ট করে কি না !

আপনি সেই সংকোচ বোধ বাড়িয়ে দিচ্ছেন আরো, এত চমৎকার আপনার লেখার হাত, এত স্নিগ্ধ আপনার বলার ভঙ্গি !

আমি চাই, আমার এই সংকোচ উত্তরোত্তর বেড়ে চলুক, আপনি এমনি চমৎকার সব লেখা লিখতে থাকিন।

ভালো থাকবেন।


অলমিতি বিস্তারেণ

রণদীপম বসু এর ছবি

খুব সুন্দর লেখা...

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

তুলিরেখা [অতিথি] এর ছবি

সবাইকে ধন্যবাদ।
সবজান্তা,
এইসব কি বলেন? আপনার সংকোচ?
আরে আপনার বিজ্ঞান, যুক্তি, তথ্য, তত্ব ভরা লেখাগুলোর জন্য তো আসি। আপনি, শিক্ষানবিস, অনিকেত-আপনাদের লেখা যে স্পেশাল!!!

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- এই প্রথম, হ্যাঁ এই প্রথম বারের মতো তাঁকে নিয়ে কোনো লেখায় মন্তব্য করছি, তাঁর প্রস্থানের পর। বুকের ভেতরের কষ্টটা দলা পাকিয়ে উঠতে চায়, কান্না বাঁধ ভেঙে উপচে পড়তে চায়। না নিজেকে ধরে রাখিনি তখন। ভেতর থেকে আপনার উপমার মতো 'শক্ত' হওয়া সত্বেও পারিনি। জালাল ভাইয়ের সঙ্গে কথা হলো, সব হুড়মুড় করে বেড়িয়ে পড়লো। সব যোদ্ধাসদৃশ বীর্য্য ধুয়ে মুছে গেলো নোনাজলের তোড়ে!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

তুলিরেখা [অতিথি] এর ছবি

আবার পড়লাম তার উপন্যাস-"পৌরুষ"। একটু একটু করে জায়গায় জায়গায় থেমে থেমে পড়ছি। অপরূপ একটা হৃদয়ছোঁয়া লেখা। ছোট মেয়েটা যখন স্নোহোয়াইটের গল্পের সেই অংশে এসে "না না মারবে না" বলে ফুঁপিয়ে ওঠে, সেইখানে এসে থামছি বারবার।
কিছুই হারায় না, যা সুন্দর যা পবিত্র তা ঠিক বেঁচে থাকে মানুষের মনে।

শামীম এর ছবি

লোকটাকে চিনতাম না ... নেটেই যা একটু হাই হ্যালো ...

তারপরেও চোখ মুছতে হলো ......
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

উনার লেখা বড্ড ভাল লাগত।
ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায় সেসব হৃদয়ছোঁয়া লেখাগুলো আর পাবোনা আমরা।

--------------------------------------------------------

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।