অভিসিঞ্চন

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: সোম, ২২/১২/২০০৮ - ৬:২৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কড়াই থেকে তপ্ত তেল ছিটকে এসে লাগে কব্জির কাছে আর আঙুলে, চড়াৎ‌ করে ওঠে যন্ত্রণার অনুভূতি। কলের ঠান্ডা জলধারার নিচে রাখি হাত, জল কব্জি আর আঙুল ধুয়ে স্নিগ্ধ করে দেয়। তবু জ্বালা করে বেশ, তখন রাঁধছিলাম, হাতের কাছেই আলুর টুকরো ছিলো অনেক, সেগুলোর থেকে একটা তুলে পোড়া জায়গায় বোলাতে থাকি। সঙ্গে সঙ্গে জল পড়েছে, আশা করতে থাকি হয়তো পোড়াদাগ ফুটবে না।

কিন্তু রান্না অর্ধেক হয়ে আছে, সেটা তো শেষ করতেই হবে। জ্বালা একটু কমলেই অর্ধেক হওয়া তরকারিটা শেষ করি, আগে তো রাঁধতেই জানতাম লবডঙ্কা, এখন সেই আমার হাতেই তরকারি, ভাজি, ডাল, দোলমা, মাছ, মাংস, চাটনি হয় দিব্যি। করতে করতেই শিখে ফেলা গেছে। অবশ্য সারাদিনের পাউরুটি ফাউরুটির পরে রাতে যাই রান্না হোক না, খেতে সবই অমৃত। অন্ন যে সঙ্গে থাকে! তাই তো পরমান্ন!

চাইনিজ বন্ধুকে রাঁধতে দেখতাম নানারকম। অ্যাসপারগাস সরু সরু লম্বা লম্বা করে কেটে তা দিয়ে দিয়ে কুচি কুচি করে কাটা বোনলেস চিকেন রাঁধতো।। আমি ওভাবে বানাতে সাহস পাইনি কখনো। অ্যাসপারগাস জিনিসটাই আমার কেমন অচেনা লাগতো। বন্ধুটা কাঁকড়াও রাঁধতো বড় বড় স্টার আনিস আর সয়াসস দিয়ে। খেতে ভালোই হতো বেশ। স্লো কুকারে নানাধরনের মিষ্টি সুপ ও বানাতো শেন।

চৈনিক রুমমেটের নাম ছিলো শেন চং। আমার বাঙালি কানে শোনাতো যেন সিঞ্চন। আমি ওকে শেন বলে ডাকতাম। ফর্সা, কোঁকড়াচুল, নরুনেচেরা চোখ-মিষ্টি মেয়ে ছিলো শেন। সাজগোজ নিয়ে কেন জানি অদ্ভুত উদ্বেগে ভুগতো মেয়েটা। "আরে এমনিতেই তো তোমাকে সুন্দর দেখতে, এত টেনশন করো কেন মেকাপ নিয়ে?" এইসব বললে শুনতো না, বুঝতো ও না বিশেষ।

খুব অল্প ইংরেজী জানতো শেন। বেশীরভাগ কথাই বোঝা যেতো না। ও এসেছিলো মাইক্রোবায়োলজির ল্যাবে, এক চৈনিক অধ্যাপকের কাছে কাজ করতে। সেখানে কিভাবে কমুনিকেট করতো কেজানে। ল্যাব ভরা তো আন্তর্জাতিক ছাত্র ছাত্রী আর গবেষক। সেখানে ইংরেজী ছাড়া কিকরে সে চালাতো? হয়তো ওর প্রফেসর সাহায্য করতেন। জানা হয় নি আর। কতক্ষণই বা দেখা হতো আমাদের? হয়তো কোনোদিন আমাদের রান্নার সময়টা মিলে গেলে দেখা হয়ে যেতো। নইলে সে তার ল্যাবে, আমিও আমারটায়। ক্যাম্পাসের দুইপ্রান্তে।

আমাদের ও কম্যুনিকেট করা খুব শক্ত ছিলো, সে বোঝে না আমার কথা, আমি বুঝি না ওর কথা, শেষে কথাঠথা ছেড়ে দিয়ে আমরা আকারে ইঙ্গিতে কাজের কথাটুকু সেরে নিতাম। মাঝে মাঝে শুনতাম শেন ফোনে কথা বলছে, ঝরঝর ঝরঝর করে নদীর স্রোতের মতন সুরময় চৈনিক ভাষায় কথা, আমার মনে হতো এই মেয়েকে এইভাবে নিজের ভাষা ছেড়ে থাকতে কত কষ্টই না করতে হচ্ছে!

মাঝের ছুটিতে আমাদের সাথে কয়েকদিনের জন্য থাকতে এলো লি। লি শেনের বন্ধু, সে তার ল্যাবেই গবেষণা করে। লি ও চাইনিজ মেয়ে কিন্তু লি র ইংরেজি পরিষ্কার, ঝরঝরে। বুঝতে কোনোই অসুবিধা হতো না। ভাষার বাধা না থাকায় আর ছুটির সময়ের অবসর থাকায় লি য়ের সঙ্গে প্রচুর গল্প হতো। লি চিনে ডাক্তারি পাশ করে সেখানে প্র্যাকটিসও করছিলো, তারপরে বিদেশে সুযোগ পাওয়ায় চলে আসে গবেষণা করতে। লি আপ্লুত হয়ে বলতো সেই বিদেশী পরিবারটির কথা যারা অপ্রত্যাশিত সাহায্য করেছে তাকে বিদেশ বিভুঁইয়ে। সে বলতো দেশে তার বাবা কিছুদিন আগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, সে টাকা পাঠিয়েছে কিন্তু কাছে তো থাকতে পারে নি। যাইহোক এখন তিনি ভালো আছেন। এইসব টুকরো টাকরা গল্পের মধ্য দিয়ে পরবাসের সুখদুঃখ ভাগ হয়ে যেতো আমাদের।

আরো কত কথা হতো আমাদের! সামান্য সাধারণ সব কথা, লোকে শুনলে হাসবে। পৃথিবীর কোন্‌ প্রান্তে বসে দুটি ভিন্ন দেশের মানুষ নিজের জীবনের সুখদুঃখ শক্তি ও অসহায়তার কথা ভাগ করে নিচ্ছে! ভাবলেও অবাক লাগে। লি বলতো তার ঠাকুমার কথা, তার আটটি সন্তান ছিলো। এখন তো সম্ভবই না, এখন সেদেশে একসন্তানের নীতি। আমিও মিলিয়ে নি আমাদের ঠাকুমাদের আমলের সাথে, তখন কি সবদেশেই ওরকমই ছিলো? তাই হবে। দেশেগাঁয়ে যার যত বেশী ছেলেমেয়ে তাঁর তত বেশী সম্মান ছিল। আমাদের মায়েদের আমলেই অবশ্য সব গেলো উল্টে। জনসংখ্যার চাপ তো সহজ কথা নয়!

লি হাসতে হাসতে বলতো তার বাবামা খুব টেনশনে আছেন সে এখনো বিয়ে করে নি বলে। তারা নাকি বলছেন এর পরে বয়স বেড়ে গেলে খুব অসুবিধে, বেশী বয়সে সন্তান জন্ম দেওয়া খুব কষ্ট, মানুষ করতেও কষ্ট কম না। কান্ড দ্যাখো! ডাক্তার মেয়ে লি যেন জানে না!

লি হাসতে হাসতে বলতো যেন মেয়েদের জীবন শুধু সমাজসম্মত অবস্থায় সন্তান জন্মের জন্যই! এই যে মাইক্রোবায়োলজি গবেষণা, এই যে আরো নানা দেশের মেয়েরা উজ্জল গবেষণা করছে রসায়ণে, পদার্থবিদ্যায়, কসমোলজিতে, জ্যোতির্বিদ্যায় এমনকি স্ট্রিং থিওরিতেও-এসব যেন পুরুষের রাজ্য, মেয়েরা জোরজার করে ঢুকে পড়ে এসব করছে ভালো, কিন্তু মানবজাতির প্রতি তাদের মূল দায়িত্ব যেন তারা না ভোলে। কী অবস্থা!

দেশকাল বদলে গেছে, শুধু বদলায় নি মেয়েদের অসহায়তা। অন্য আঙ্গিকে ঠিক টিঁকে আছে। কত কত বিপ্লব ঘটে গেল লি র দেশে, আমার দেশে, গোটা দুনিয়ায়। কত ওলোটপালোট ঘটে গেলো সমাজে সমাজে। কিন্তু মেয়েদের অবস্থা কি সেভাবে বদলালো? বাহিরে বাহিরে বদলালো হয়তো কিন্তু ভিতরে ভিতরে? সেই একই রয়ে গেলো কি? কেজানে! আমরা হয়তো লক্ষ বছরের জিনে ধারণ করে আছি কোনো কারুণ্যমাখা ভয়, ক্ষুদ্র মনুষ্যজীবনকে কাল পেরিয়ে ভবিষ্যতের দিকে প্রসারিত করে দেবার দায় তো কম দায় না! এইটুকু ক্ষণভঙ্গুর জীবন আর চারিদিকে থাবা উঁচিয়ে থাকে অসুখ মহামারী খরা বন্যা দুর্ঘটনা রাগ নিষ্ঠুরতা যুদ্ধ ......দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত মৃত্যু আর তারই মাঝখানে মোচার খোলার মতন জীবনের নৌকায় ত্রস্তা জননী সন্তান বুকে চেপে করুণা ভিক্ষা করে কেজানে কার কাছে! যার কাছে করুণা চায়, সে কি শোনে? প্রকৃতি তো অন্ধ বধির নিরাসক্ত-সিলেকশানের পাথুরে যন্ত্রে সে তো শুধু হিসাব কষে কাকে রাখবে আর কাকে রাখবে না।

খবর আসে ভয়াবহ ঝড়ের, খবর আসে নিযুত মানুষের মৃত্যুর। আরো বেশী মানুষ ঘরছাড়া। খবর আসে ভূমিকম্পের। আরো অনেক মৃত্যু। খবর আসে মানুষ মানুষকে মারছে....খবর আসে খবর আসে ..... খবর আসে যুদ্ধের, দেশদখলের.... অন্ধ নিরাসক্ত প্রকৃতি যখন মানুষ মারে তখন তো কিছু করার থাকে না, কিন্তু মানুষ যখন মানুষ মারে, তখন? মানুষ তো নিরাসক্ত নয়, অন্ধ নয়, বধির নয়! তবু কি তীব্র নিষ্ঠুরতায় মানুষ মানুষকে বেদনা দেয়, পীড়ন করে, ধ্বংস করে!

এইসব অনন্ত সংবাদমালা আছড়ে পড়ে আমাদের সামনে, টিভি থেকে রেডিও থেকে কম্পুটার স্ক্রীন থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে পড়তে থাকে আমাদের চোখে কানে অনুভূতিতে -অনন্যোপায় আমরা চলতে থাকি আমাদের দিনগত পাপক্ষয়ে, সকাল থেক সন্ধ্যা,সন্ধ্যা থেকে পরের সকাল। দিন দিন করতে করতে একদিন কি সত্যি সব পাপ ক্ষয় হবে? কেজানে!

মাঝে মাঝে মনে হয় সব অনর্থক। লক্ষ বছরের মানবসভ্যতা আমাদের এতটুকুও এগিয়ে দেয় নি আলোর দিকে, শুধু আরো আরো বেশী ধ্বংসের ক্ষমতা দিয়েছে। অনুপরমাণুর রহস্য উদ্ধার করে বানালাম কি? না, বোমা! আহাম্মকি আর কাকে বলে? আর মহাকাশের মহাবিশ্বের রহস্য উদ্ধার করতে গিয়ে বেশীটাই দাঁড়ালো হাতিয়ারের প্রতিযোগিতায়! কি লাভ? অনন্ত এই রক্তপাত কিসের জন্য?

সাদাচুল সাদাদাড়ি একমুখ হাসি নিয়ে আবার দেখা দেয় সেই বৃদ্ধ, সেই মেঘমানুষ। বুঝতে পারি বহুদিন আগে একেই স্বপ্নে দেখেছিলাম। চিনতে পারি তাকে। সে হেসে বলে, "কিগো মেয়ে, মনখারাপ?"

আমি অবাক হয়ে বলি, "মনখারাপ তা বুঝলে কী করে?"

সে আশ্চর্য হাসি হাসে, সেই হাসি কেবল তারাই হাসতে পারে যারা হৃদয় ধুয়ে ফেলেছে শুদ্ধ অশ্রুতে। বুড়া হেসে আমার মাথায় হাত রেখে বলে," দূর বোকা মেয়ে, এইটুকুতেই এত অধৈর্য হলে চলবে? যাদের ভাই-পাহাড়, বোন-নদী, কথাবলা-ঝোপঝাড়, সবুজ আর সোনালী পাখিরা--সব হারিয়ে গেছিলো? তারা তো মনখারাপ করেনি এত? তারা তো ধৈর্য হারায় নি? যাদের ভালোবাসার ঠাকুর "আসবো আবার" কথা দিয়ে চলে গেলো আর এলো না আজও? "

"কারা? কারা? কাদের ভাইবোন হারিয়ে গেলো? কাদের ভালোবাসার ঠাকুর....." চমকে জেগে উঠি, কেউ নেই। সব স্বপ্ন। স্বপ্ন ভেঙে গেছে। মেঘমানুষ চলে গেছে।

জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাই। দেখি মাটি ভিজে যাচ্ছে মৃদু বৃষ্টিতে। মেঘমানুষ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে পৃথিবীর সন্তাপ জুড়িয়ে দিতে। বাইরে গিয়ে দাঁড়াই, সেই আশীর্বাদে অভিসিঞ্চিত হতে।
" জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো....."

***


মন্তব্য

কীর্তিনাশা এর ছবি

এত ভালো লেখেন আপনি একবার পড়া শুরু করলে শেষ না করে আর উপায় থাকে না। আজকের বিষন্ন লেখাটাও তার ব্যাতক্রম নয়।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

তুলিরেখা এর ছবি

আমার সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ, কীর্তিনাশা।
ভালো থাকবেন।
( লেখাটার সাইজ কি একটু বেশী বড় হয়ে গেলো? কালকে পাঠিয়ে দিয়ে চলে গেছি, এখন এসে পড়তে গিয়ে দেখি কয়েকটা টাইপো রয়ে গেছে। ক্ষমাপ্রার্থী।)
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

লেখায় আমার মুগ্ধতাটুকু জানিয়ে গেলাম।

তুলিরেখা এর ছবি

আমার ধন্যবাদ রইলো।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

একজন [অতিথি] এর ছবি

অন্যরকম সুন্দর।

তুলিরেখা এর ছবি

তাই?
আমার ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

বেশ।

-----------------------------------
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ সাইফুল।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।