টুকরো টুকরো পাপড়ি

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বুধ, ০৭/০১/২০০৯ - ১০:১২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।
"সময় আমাদের ঘিরে রাখে মৃদু বৃষ্টির মতন/অশেষ সময়/ সুখদুখমন্থন সময়/মেঘপালকের মতন ঘরের মতন উড়ে যায় জীবন----" কথাগুলো গুণ গুণ করতে করতে লাবণি মনে করতে চেষ্টা করে কার লেখা লাইনগুলো। মনে পড়ে, পড়ে, পড়ে না। ছাদের উপরে স্নিগ্ধ ঠান্ডা রাত, ঘুমেলা চোখে এসে লাগে তারাদের বিস্ময়, কতকাল হয়ে গেলো সে দেখছে ওদের, অথচ পুরানো হয় না, একই প্রথমদিনের ঝিমঝিম শিরশিরানি চারিয়ে যায় ওর চোখের ভিতর দিয়ে আরো ঘন গহণে। "বাণী নাহি তবু কানে কানে/কী যে শুনি----" কে গাইতো? লাবণির গলায় সুর নেই, ওকে গেয়ে শোনাতো অন্য কেউ। কে সে? কোথায় সে? কবে গাইতো? তাকে মনে পড়ে না কেন লাবণির? কী অদ্ভুত! সে স্পষ্ট শুনছে সে গাইছে, সুন্দর সুরময় কন্ঠ ছড়িয়ে পড়ছে ওই মেঘপালকের ঘর পর্যন্ত-"আকাশ জুড়ে শুনিনু ঐ বাজে/তোমারি নাম সকল তারার মাঝে/ সে নামখানি নেমে এলো ভুঁয়ে/কখন আমার ললাট গেলো ছুঁয়ে---",অথচ মুখ মনে পড়ে না, চোখ মনে পড়ে না, নাম মনে পড়ে না!সে যেন শুধু সুর, শুধু গান। তারাগুলি যেন ঘিরে এসেছে গান শুনতে।

২।
চারিদিকে ঘোর অন্ধকার। গোলা কালির মতন কালো অন্ধকার। এত ঘন অন্ধকার আগে দেখেনি আশমানি। যেন সূচ দিয়ে ফুটো করে দেওয়া যায়। আকাশ মেঘে ভর্তি, যেকোনো সময় নামবে ঘনবর্ষণ। গুমোট হয়ে আছে, হাওয়া বইছে না। উপরে অন্ধকার আকাশ, নিচে আন্ধার পানি। নৌকায় আছে ওরা সবাই। উত্‌কর্ণ হয়ে আছে অপেক্ষায়। ছোট্টো একটা রেডিও সম্বল। ওরা সবাই কান পেতে আছে, ওদের যেন সুখদুখভালোবাসাঘৃণাহাসিকান্না কিছু নেই, আছে শুধু আকাশব্যাপী উত্‌কন্ঠা। মধ্যরাত্রে অবসান হলো অপেক্ষার, রেডিওতে সংকেত এলো-অন্ধকার ভেদ করে সূচীতীক্ষ্ণ আলো ওদের চোখে বিঁধলো। "আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান/ তার বদলে আমি চাই নি কোনো দান----"

৩।
এখানে শীত,তুষারপ্রান্তরে জনমনিষ্যি নেই। পুরু বরফে সব সাদা হয়ে আছে। গাছপালা পাতাহীন বৈরাগী, শুধু একদল পাইনে এখনো জেগে আছে সবুজ। ঝুরো বরফে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে গর্তগুলো, সকালে যারা এসেছিলো তারা খুঁড়ে গেছিলো-তিনটি গর্ত। এখন নতুন করে তুষারপাত হচ্ছে, ভরে যাচ্ছে গর্তগুলো। দূরে চলমান বিন্দুরা বড় হতে থাকে, তারা আসছে। তারা তিনজন। তাদের সঙ্গে অস্ত্রধারী আরো অনেকে। মুখহীন অসংখ্য জল্লাদ। স্পষ্ট হয় শুধু প্রায়কিশোর মৃত্যুঞ্জয়ের মুখ, তার দুই সাথী তাকে জড়িয়ে ধরে কি যেন বলছেন-সে শুনতে পায় না, সে শোনে দূরাগত প্লুতস্বর-"মিতু-উঊঊঊঊঊন, কোথায় তুই!" সে সাড়া দেয়, "নইনী-ই-ই ই,আমি আসছি-ই-ই, এই তো এলাম বলে।তুই একটুখানি অপেক্ষা কর।"
তিনটে শব্দ, তারপরে দেহগুলো গড়িয়ে পড়ে গেলো। ঝুরোবরফওয়ালা মাটি দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে। মাটি মাটি মাটি! এই মাটি থেকেই তারা এসেছিলো, ধুলামাটি নিয়ে খেলেই বড় হয়েছে, মাটিতেই তারা ফিরে গেলো। কোনোদিন এই দুইদলে দেখা হবে আবার, মাটির গভীরে?

৪।
চারিদিকে জল, ছলছল জল। এই দ্বীপ খুব ছোটো। যেকোনো দিকে একটুখানি গেলেই নীল সমুদ্র। অথৈ সমুদ্র। গোলমরিচের লতাজড়ানো নারিকেলকান্ডে ঠেস দিয়ে বসে থাকে সে। তার কিযেন একটা করার ছিলো, কিছুতেই মনে পড়ে না। কি তার নাম সেও মনে নেই। সে কোথা থেকে এলো এখানে সেও সে জানে না। আনমনে সে লতায় হাত রাখে, ভাবে কি যেন একটা করার ছিলো! মনে পড়ে না কেন? সে ভাবে কি নাম না খুঁজে নিজেই নিজেকে একটা নাম দিয়ে দিলে কেমন হয়? মনে হতেই উঠে দাঁড়ায় সে, চলতে থাকে, জলরেখার একদম কাছে এসে থামে। হেসে ওঠে অকারণে।
দূরে আকাশ যেখানে নত হয়ে পড়েছে জলে, সেইখান থেকে বেরিয়ে আসে লাল সূর্য, লাল হৃত্‌পিন্ডের মত, স্পন্দিত আলো ছড়িয়ে পড়ে চরাচরে। প্রথম মানবীর মতন একলা মেয়েটি আবার হেসে ওঠে, আবরণমুক্ত হয়ে এগিয়ে যায় জলের দিকে, অবগাহণপ্রত্যাশায়। ওর খোলা চুলের ঢালে জড়িয়ে যায় সাদা ফেনা, চিকচিক করে ওঠে ভোরের আলো। স্নান করতে করতে সে হাসছে, তার কিচ্ছু মনে নেই সে কে, অথচ মনে আছে আকাশ,জল, সূর্য, আগুন, মাটি, বালি, ঝিনুক। দু'হাতের মুঠায় নোনাপানি নিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিতে দিতে সে চেঁচিয়ে বলে, "শোনো শোনো তোমরা শোনো, আমি আমার নাম দিলাম আকাশ।"


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

মুগ্ধ, মুগ্ধ, মুগ্ধ!!!

তুলিরেখা [অতিথি] এর ছবি

আমি ধন্যতা জানিয়ে যাই। সর্বপ্রিয় লেখকের কমেন্ট খুবই বড় ব্যাপার। হাসি
ভালো থাকবেন।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আপনার এই লেখাগুলি আমি জমিয়ে রাখবো গ্রীষ্মের প্রখর গরমে পড়ার জন্য। আমি নিশ্চিত, লেখাগুলো মৃদু ঠান্ডা হাওয়ার মতো পরশ বুলিয়ে যাবে।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

তুলিরেখা [অতিথি] এর ছবি

শুনে খুবই খুশী হলাম।
এইসব সামান্য লেখা জমিয়ে রাখবেন ও বিশেষ সময়ে পড়বেন শুনে চমকিত হলাম।
আর, দুই শিমুলের কমেন্ট একসাথে পেয়ে চমত্‌কার লাগলো। হাসি

রানা মেহের এর ছবি

সুন্দর
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ রানা মেহের।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।