ভেসে যাওয়া তুলামেঘ

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: শুক্র, ০৯/০১/২০০৯ - ৩:০৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।
মস্ত সেই পাথরটা এখনও সেইরকমই ভাঙা-পাথরের উপরের সেই লালচে বাদামী আর মরিচা রঙের দাগগুলো আর নেই- কবেই জলে ধুয়ে গেছিলো সেসব। এখানে বৃষ্টি হতো নিয়ম করে, বেশ ঘন ঘন। তারপরে একসময় বৃষ্টি কমে গেল.....

ছোটো গুহাটা ঠিক এইরকমই ছিলো, গুহামুখ অপ্রশস্ত । ঝুঁ‌কে পড়ে ভিতরে ঢুকে সোজা হয়ে দাঁড়ালো অবন্তী। ভেতরে অন্ধকার সেই একইরকম, আগের মতই। তখনও গুহা থাকতো অন্ধকার বেশীরভাগ সময়েই। অন্ধকার আর ....ওই যে ওখানে ছিলো টুকরো টুকরো পাথরে ঘেরা আগুনের কুন্ড। আগুন জ্বলতো ওখানে। স্পষ্ট সব মনে পড়ছে অবন্তীর। কতকালের পুরানো সেই আগুন, কতকাল আগে মরে যাওয়া সেই আগুন! অবন্তী হাতের টর্চ জ্বালায়, কালচে পোড়া দাগ আর কতকালের পুরানো ভস্ম। শিরশির করে ওঠে অবন্তীর ভিতরে কোথাও, সত্যি সত্যি সে এখানে ছিলো?

গুহা থেকে বেরিয়ে আসে সে, সামনের প্রশস্ত চাতালটায় দাঁড়ায়। মহাসাগরের হাওয়া এসে সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে দেয়,তখনও যেমন দিতো। ওই দূরে নীল নীল নীল। আকাশের কোমল নীল এসে সমুদ্রের গাঢ় নীলে মিশে গেছে, পাখা ভাসিয়ে উড়ছে ঝাঁক ঝাঁক সমুদ্রপাখি, তখনো যেমন উড়তো।

অবন্তী বসে পড়ে পাথরের এক খন্ডে, সারা শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসছে তার। আহ, চিরল কোথায় গেল? খুব বেশী দূরে যাবার কথা তো নয়!

২।
পাশে চলতে চলতে মেঘমানুষ প্রশ্ন করে, "তোমার কি ভালো লাগে, বাতাসী?"
বাতাসী উত্তর দেয় না চট করে, বোঝা নামিয়ে একটু দাঁড়ায়, চুলে পরা রাঙা ফুলের মঞ্জরীতে হাত বুলায় আলতো করে। তারপরে কোমল চোখ মেলে তাকায় মেঘমানুষের মুখের দিকে, আস্তে আস্তে বলে,"ভালো লাগে তিরতির করে বয়ে যেতে থাকা জলের শব্দ, খুশী-খুশী সবুজ ঘাস আর রোদপোহানো পাথরের পাশ দিয়ে যা বয়ে যায়। ভালো লাগে শরতের উজ্জ্বল দিনে ফড়িং- প্রজাপতিদের লীলাময় ওড়াউড়ি। ভালো লাগে বসন্তের কিশলয়ে যখন সোনালী রোদ এসে কথা বলে সেকথা শুনতে। ভালো লাগে শীতরাত্রির তারাময় নীল-অন্ধকার। ভালো লাগে স্বপ্নময় নবীন চোখ আর সেই চোখে যখন এসে পড়ে ভোরের আলো।"

মেঘমানুষ হেসে ফেলে, বলে,"এসব কাউকে বলেছ কখনো?"

বাতাসীর চোখে ছায়া পড়ে আসে, সূর্যের উপরে মেঘ এসে পড়লে যেমন আবছায়া হয়, তেমনি। মাথা নেড়ে বোঝায় সে বলেনি কাউকে।

মেঘমানুষ বলে, "কেন? কেন বলোনি?"

বাতাসী উত্তর দেয় না, চুপ করে চেয়ে থাকে পশ্চিমের দিকে, ঐ যেখানে আরেকটু পরেই সূর্যাস্তের অপরূপ রঙের খেলা শুরু হবে। তারপরে একটা দীর্ঘশ্বাস মুক্ত করে দিয়ে বোঝা তুলে নিয়ে ফের চলতে শুরু করে।

৩।
এখানে মরুভূমি, আদিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি। এখানে ওখানে কিছু বাদামী পাহাড় এলোমেলোভাবে ছড়ানো। গাছপালা বলতে বেশীরভাগই ক্যাকটাসজাতীয়, মাঝে মাঝে একেকটা এত উঁচু যে দেখলে ভয় লাগে।

তীব্র প্রখর গ্রীষ্ম এখন,এমনিতে তাপমাত্রা অনেক বেশী থাকার কথা। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হওয়ায় গরম কিছু কম।

গাড়ীর পর গাড়ী চলেছে কয়েকদিন, ওই দূরের দিকে। তারটার পাতা হয়ে গেছে সব। এখানে এই ক্যাম্পে এখন অপেক্ষায় আছে তারা। বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঋক, সে হঠাত্‌ সব কিছুর মানে হারিয়ে ফেলেছে। সে কে? সে কোথায়? সে এদের সঙ্গে কেন? তার কি এখানে থাকার কথা ছিলো? ওরা যায়, ওরা ফিরে আসে, ওরা কথা বলে, ওরা শোনে, ওরা .....

সবাই জটলা করে কথাবার্তা বলছে, রেডিওতে কিসব সম্প্রচার হচ্ছে, অসহ্য টেনশনে সবাই আধসেঁকা হয়ে আছে,কিন্তু হঠাত্‌ করে ঋকের কাছে সব অর্থহীন হয়ে গেছে, সে জটলার বাইরে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সে কে? সে কেউ না। যে তার সব ছিলো, সে যে তাকে ফেলে গেলো! নিষ্ঠুর! এই তো এখনো ঋক অনুভব করতে পারছে তার হাতদুটি নিজের করতলে, তার গাঢ় কালো উজল চোখ দুটি.....আস্তে আস্তে কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে সেই চোখ। ও চলে যাচ্ছে! "আমাকে ফেলে কেন তুই কেন তুই কেন তুই চলে যাচ্ছিস লীনা ? কেন ? কেন?" মনে মনে বলেছিলো ঋক, লীনা শুনতে পায় নি। লীনা জানতো ওকে চলে যেতে হবে, তাই গভীর মায়ায় শেষ মুহূর্ত অবধি ছুঁয়ে ছিলো ঋককে। আবার কি দেখা হবে কোনোদিন? কোনো সময়হীন স্বপ্নলোকে যেখানে নশ্বরতা নেই? যেখানে অনন্ত মধুচন্দ্রিমা ?

৪।
"তুরা-আ-আ-আ" দূর থেকে ভেসে আসে ডাক। চেনা গলা। খুব চেনা। পাহাড় সে ডাকের শত শত প্রতিধ্বনি ফিরিয়ে ফিরিয়ে দেয়। আ-আ-আ-আ। আর তুরা হারিয়ে যেতে থাকে আরো আরো দূর। ওকে খুঁজছে অদীন, কিন্তু তুরা ধরা দেবে না। খুঁজুক, আরো খুঁজুক অদীন।

মাঝে মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় তুরার, এমন জায়গায় হারিয়ে যেতে যেখান থেকে কেউ আর তাকে খুঁজে আনতে পারবে না। এমনকি অদীনও না।

"তুরা-আ-আ-আ, তুমি কোথা-আ-আ-য়? " আবার ডাক। পাহাড় সহস্র প্রতিধ্বনি তুলে বলতে থাকে, কোথা-আ-আ-আ-য়?

আকাশ আজকে মাজঘষা নীল, দূরে চিল পাক খাচ্ছে ধীরগতিতে। নাকি ওগুলো বাজপাখি? তুরা জানে না। এক টুকরো মেঘ কোথাও নেই আজ। ঝকঝকে রোদ চিকমিক করছে পাইনের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পাতার গোছায়, ঝকঝক করছে ওই তুষারচূড়ায়, ওই নীল হৃদে ঝিলমিল করছে। আজকেই সবকিছু এত সুন্দর হতে হলো?

পায়ে পায়ে তুরা আরো দূরে সরে যেতে থাকে, অরণ্যের গভীরে হারিয়ে যেতে থাকে আরো।

"তুরা-আ-আ-আ, আমার কিছু বলার ছিলো। শুনবে না? একটিবার সাড়া দাও। তুরা-আ-আ-আ" বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে অদীনের ব্যাকুল ডাক, তুরা শুনবে না,সে আরো দূরে চলে যাবে।

মাঝে মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, অনেক অনেক দূরে, যেখান থেকে কেউ খুঁজে আনতে পারবে না তাকে।

৫।
রাত এসেছে, চাঁদনী রাত। সেই বনজ্যোত্‌স্নার মাদকতা বর্ণনার অতীত।
"ও চাঁদ, চোখের জলের লাগলো জোয়ার দুখের পারাবারে/ হলো কানায় কানায় কানাকানি এইপারে ওইপারে/ আমার তরী ছিলো চেনার কুলে/ বাঁধন যে তার গেলো খুলে/তারে হাওয়ায় হাওয়ায় নিয়ে গেলো কোন অচেনার তীরে/ ও চাঁদ......"
তারা ভেসে উঠছে, ডুবে যাচ্ছে, আবার ভেসে উঠছে,আবার ডুবে যাচ্ছে। অচেনা হাওয়া অচেনা সুরভি মেখে হঠাত্‌ হঠাত্‌ ছুটে আসছে, ছুঁয়ে যাচ্ছে ওদের মুখ, ছুঁয়ে যাচ্ছে ওদের চুলের গোছা, ঢেউ খেলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। দিব্যলোকের ঝর্ণার মতন জ্যোত্‌স্না ওদের স্নান করিয়ে দিচ্ছে। এত তীব্র অনুভব কি ভঙ্গুর মৃত্তিকাহৃদয়ে সহ্য হয়?ওরা টলটল অশ্রুভরা চোখ মেলে চেয়ে আছে-"ও চাঁদ, চোখের জলের লাগলো জোয়ার....."


মন্তব্য

অভ্রনীল এর ছবি

ইদানিং কি জানি হইসে আমার... সচলায়তনের অনেক লেখাই মাথায় ঢুকেনা... হয় আমি ভ্যাবলা হয়া গেসি নাইলে বাকী সব সচল বিনা নোটিশে আমার চেয়ে জ্ঞানী হয়া গেসে... এই লেখাটাও আমার মাথায় ঢুকলোনা...

_______________

এক ছাগলের দুই কান,
তুই আমার জানের জান।

তুলিরেখা এর ছবি

হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তুলিরেখা এর ছবি

এই লেখার ঠিক আগের লেখাটা (টুকরো টুকরো পাপড়ি) ও তো এইরকমই! সেইটা বুঝছিলেন? হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সুমন সুপান্থ এর ছবি

আটকে গেলে যেমন হয়, সব সময়ই- রবীন্দ্রনাথে মুক্তি ! এখনো দেখি তাই-
বুঝেছি কী, বুঝি নাই
সেই তর্কে কাজ নাই
ভালো আমার লেগেছে যে
রইলো সে কথাই

আপনার কব্জির শক্তি অন্যখানে, তুলিরেখা ! অনতিক্রম্য এক বিহ্বলতায় !
( কালই এক সচলের সঙ্গে আপনার গদ্যভাষা নিয়ে কথা বলছিলাম )

গল্প বলছেন না কেন লেখাটা কে ? সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে তো খুশীই হতেন ... তার উত্তরসূরী তৈরী হলো বলে !

শুভ কামনা থাকলো ।

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

তুলিরেখা এর ছবি

সুপান্থ, অনেক ধন্যবাদ।
এটাকে "গল্প" বলি সে সাহস নেই, গল্পের গাঁথুনি বাঁধুনি সবই আরো বেশী শক্তি মনোযোগ আর সময় দাবী করে। গল্প হলো উল বা কুরুশের বুনুনির মতন, শুরু থাকে, শেষ থাকে, মাঝে থাকে যত্নের কারুকার্য। শেষ হয়ে হইলো না শেষ থাকে।
এগুলো কল্পনা বা ঘটনার কোলাজমাত্র।
আর উত্তরসূরী টুরী না ভাই, আমি সামান্য লোক।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

রানা মেহের এর ছবি

গল্প কোলাজ যাই হোক
পড়তে ভালো লাগলো
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

তুলিরেখা এর ছবি

রানা মেহের,
ধন্যবাদ রইলো। পাঠকের ভালোলাগা লেখকের পরম পাওয়া।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

অদ্ভুত !
নতুন করে আর কি বলি?

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

তুলিরেখা এর ছবি

আমি বলি, ধন্যবাদ।
অনেকদিন দেরি হয়ে গেলো বলে ক্ষমাপ্রার্থী। নানা গিয়াঞ্জামে আটকে গেছিলাম।
ভালো থাকবেন, লিখবেন অনেক।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

যথারীতি এ-ও "মাদকতা বর্ণনার অতীত"।
অধরা অধরের মতোই যেন সুদূর সুন্দর।
না, ছুঁতে পাই না আমি। :-|

-----------------------------------
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

তুলিরেখা এর ছবি

কেন, আপনার অন্যপুরে সে নাই? হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।