নতুন করে চেনা

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বিষ্যুদ, ১২/০২/২০০৯ - ৮:৫৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জন্ম থেকে বাংলা ভাষা শুনছি, শুনতে শুনতে কথা ফুটেছে মুখে একদিন। অন্যরকম কিছু হতে পারতো বলে মনে হয়নি কোনোদিন। চারিদিকে দেখতাম বেশীরভাগই আমাদের মতন ছিন্নমূল মানুষের ঘরদুয়ার, সব হারিয়ে এসে নতুন করে আবার জীবন শুরু করেছে যারা। পাঠশালেও তাদেরই দেখতাম, তাদেরই সাথে পড়া, খেলাধুলা, একসাথে ভাগবন্টক করে টিফিন খাওয়া।

অনেক পরে অন্যরকম পৃথিবীর সংগে জানাজানি হলো, সুটবুট পরা চিবিয়ে চিবিয়ে কথাবলা মানুষদের দেখলাম যারা অন্যরকম ভাষা বলে, যারা ধুলা মাখে নি, যাদের চেনা যায় না। তার আগে বহুদিন অবধি আমরা ছিলাম মাটিজলসবুজে মানুষ, আকাশের নীল চাঁদোয়া জননীর আঁখির মতন কোমল স্নেহে ঘিরে রেখেছিলো আমাদের।

আমার প্রথমদিকের বুলিফোটায় ঢাকাইয়া টান,কারণ ঠাকুমা কইতেন ঢাকাইয়া ভাষা,তাদের দেশ ছিল শিমূলিয়া। মায়ের দেশ ছিলো ময়মনসিং-কিন্তু মায়ের চলে আসা দশ বছর বয়সে, কিছুই মনে নেই।

দেশটির কথা শুনে আসছি ছোটো থেকে, কিন্তু সে শোনা স্বপ্নের দেশের গল্প শোনার মতন। শীতলক্ষা নদীর গল্প। চীনাদি বিলের ধারের সোনালী আখের ক্ষেত, পানের বরজের গল্প, দূরের হাটে যাবার গল্প। অদ্ভুত নামের এক খাল-ভেউক্যার খালের গল্প। সোনার নৌকা পবনের বৈঠার রূপকথার গল্পের সংগে কোনো তফাত পেতাম না। হারিকেনের আলোর সামনে সন্ধেবেলার পড়া হয়ে যাবার পরে শোনা সেইসব গল্পেরা। বড়রা তাদের ফেলে আসা দেশের গল্প কইতেন, আমরা যারা অনেক পরে জন্মেছি -এতখানি বড় করে চোখ মেলে শুনতাম।

কিন্তু আমাদের ইস্কুলের ইতিহাসে সেসব পেতাম না, কেন? ইতিহাস পড়তে পড়তে মাথাব্যথা, পরীক্ষায় উত্তর লিখতে লিখতে হাতব্যথা। সিন্ধু সভ্যতা থেকে শুরু করে বিম্বিসার অশোক সুলতানি আমল মুঘল আমল থেকে গান্ধীর ডান্ডি অভিযান-কি নেই?অথচ পাশের দেশটি নেই-তার মুক্তিসংগ্রাম নেই। মুজিবর রহমানের কথা প্রথম শুনি মায়ের কাছে , মুক্তিযুদ্ধের কথা খুব সামান্য জানতে পারি নানা গল্পউপন্যাস পড়ে। কেন? কেন আমাদের ইতিহাসে এগুলো জানানো হলো না? আমরা এত কোন্‌ঠাসা ক্ষুদ্র একটা ভাষাভাষী গোষ্ঠী একটি বিরাট দেশের একপ্রান্তে পড়ে আছি?

আরো বড় হয়ে জানতে চেষ্টা করি আত্মীয়স্বজনেরা যারা দেশে রয়ে গেছেন, কে কোথায় আছেন কিভাবে আছেন। খুব বেশী জানতে পারিনা, দেশ ও কাল দুই ই গেছে বদলে। যারা জানাতে পারতো, যতটা অন্তরঙ্গতা থাকলে হৃদয় জানা যায়, সেই অন্তরঙ্গতাই বা কোথায়? খুব কাছের এক বন্ধু তার বাবার সংগে বেড়াতে গেলো পিতৃপিতামহের দেশ দেখতে গেলো, ফিরে এলে তাকে ঘিরে বসে শোনা গেলো গল্প, কিন্তু সেও তো গল্পই!

তারপরে বিশ্বায়নের গোলে হরিবোলে দুনিয়ার অন্যপ্রান্তে এসে পড়া। পূর্বজের প্রাণের দেশটি, যে দেশটির সাথে গভীর শিকড়ে আমার অস্তিত্ব জড়িত, তাকে ভালো করে জানা শুরু হলো দুনিয়ার অন্য পিঠ থেকে। নেট এর কল্যাণে আর ভাষাটি এক হওয়ায় পরিচয় হলো সেদেশের নানা মানুষের সাথে। ক্রমে আরো আরো জানা আরো আরো বুঝতে পারা স্পন্দিত দেশটি, তার শিরায় শিরায় সঞ্চালিত প্রাণরস। তাই দেশ বাপ মা বন্ধুবান্ধব সব ছেড়ে থাকার বালিবালি তৃষা এই এক অঞ্জলি জলে কিছুটা মিটে যায়। মাঝে মাঝে ভয় হয়, হারিয়ে ফেলার ভয়, ভালোবাসার মধ্যে ভয় তো থাকেই!

দেশটি জীবন্ত হয়ে মূর্তি ধরতে থাকে একটু একটু করে, তার মিঠা-তিতা আলো- আঁধার উঁচা-নিচা কলরব-নীরবতা ভালোবাসা-ঘৃণা জল-পানি মা-আম্মু আপা-দিদি সব নিয়ে। আমি খুঁজি খুঁজি, আজও খুঁজি। একদিন হয়তো খুঁজে পাবো অদৃশ্য যোগসূত্রগুলি। হয়তো খুঁজে পাবো কেন সেই বাচ্চা ছেলেটি গাইতে গাইতে যেতো- "বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে" আর "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।" হয়তো খুঁজে পাবো তোরণের ধারে বসে সেই মানুষটি কেন গাইছিলো-"মুক্তির মন্দির সোপানতলে---" হয়তো খুঁজে পাবো "নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে"র সেই ছেলেটি হারানো জ্যেঠামশায়ের জন্য কেন কিছু লিখে রেখে এসেছিলো গাছের গায়ে।

হয়তো ভরা নদীর উপর দিয়ে সবুজ ফসলক্ষেতের পাশ দিয়ে একদিন আমারও যাওয়া হবে সেখানে! কেজানে!

"ভুলে যাওয়া বর্ষা থেকে টুপিয়ে পড়ে কবিতাজল
মেঘকালো আশমানিতে আলোছায়ার মায়াকাজল-
গহীন নদী কূল ভাসিয়ে ডাকছে ওকে কোন্‌ বেলায়?


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

রেজওয়ান এর ছবি

দাত থাকতে দাতের মর্ম আমরা যেমন বুঝিনা দেশে থাকলেও দেশকে প্রাণ ভরে উপভোগ করার সাধারণ ইচ্ছাটি থাকে না অনেক সময়। দেশের বাইরে আসলে দেশের টান অনুভব করা যায়। এই প্রেমটি যেন চিরদিন জিইয়ে রাখতে পারি।

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

তুলিরেখা এর ছবি

ঠিক বলেছেন রেজওয়ান।
দূরত্বে যেন টান আরো বেড়ে যায়।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তানবীরা এর ছবি

একমত।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

এনকিদু এর ছবি

চলুক


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ এনকিদু।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তানিয়া এর ছবি

গুরু গুরু গুরু গুরু

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ তানিয়া।
আপনার ইমো তো দারুণ! পেলেন কোথায়?
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তুলিরেখা এর ছবি

আসলে লিখতে শুরু করেছিলাম আরো খোলামেলা সব কইবো বলে,সংখ্যালঘুর অনুভব, সংখ্যাগুরুরাই বা কিভাবে ভাবে, কিভাবে একই মানুষ দেশেকালের তফাতে একইসাথে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সংঘাত ও সংযোগ,সাধারণ আশেপাশের মানুষেরা কিভাবে ভাবতো আর এখন যাদের সাথে পরিচয় তারা কিভাবে ভাবে-এইসব সবকিছু। শিরোনাম দেবো ভেবেছিলাম স্বীকারোক্তি, কিন্তু নদীর আপন খেয়ালে বয়ে যাবার মতন লেখা বয়ে গেলো নিজের মতন। পরে কখনো হয়তো স্বীকারোক্তি ও আসবে নিজের মতন।
সকলে ভালো থাকবেন, শুভেচ্ছা রইলো।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

এনকিদু এর ছবি

ওগুলাও লিখেন, পড়তে মঞ্চায় ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

রানা মেহের এর ছবি

খুব সুন্দর লিখেছেন
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ, রানা মেহের।

-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

চলুক
আর, স্যাল্যুট! (এটার ইমোটিকন জানা নাই)
আর, আর, আসুন না একবার! হাসি

০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

তুলিরেখা এর ছবি

যাবো, যাবো, একদিন নিশ্চয় যাবো।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।