সময়ের উজানে

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: মঙ্গল, ৩১/০৩/২০০৯ - ৩:২৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বহুদিন পূর্বে সে এক সময় এসেছিলো! কেমন সব শিশিরশিহরিত সোনালী সকাল, কেমন সব কমলাগোলাপী পালকমেঘের বিকেলবেলা, কেমন সব আকাশীনীল ওড়নাজড়ানো দিন! ইচ্ছেগাছে তখন উড়ে বেড়াতো পরীরা, ঘুমিয়ে যাওয়া সাতপাহাড়ের বনে নামতো আশ্চর্য মধ্যরাতের জ্যোত্‌স্না! তখনই লেখা হয় এই কাহিনি। লেখার প্রথম কিছু অংশ তুলে দিলাম, সুধী পাঠকের ভালো লাগলে বাকীসব আস্তে আস্তে।


প্রোফেসর শঙ্কু যে টাইম মেশিনটা লুইজি রন্ডির কাছ থেকে কনফিসকেট করে এনেছিলেন মানে ওখানের পুলিশ রন্ডি জেলে যাবার পরে শংকুকেই যেটা দিয়ে দিয়ে দেয়, সেটায় চড়ে অতীত ভ্রমণে যাবো বলে আমি ঋতম্ভরা শান্ডিল্য সেজে শংকুর শিষ্যা হয়ে যাই৷

ওনার কোনো সন্দেহ ছিলো না,আমি অবশ্য খুব ভালো করেই ওনার কাছে বিজ্ঞানশিক্ষা করছিলাম,একেবারেই সব প্রিকন্সিভড নোশন ত্যাগ করে মুক্তচিত্তে কাজ করছিলাম, উনি আমার ঋ বলে ডাকতেন, সুবিধাও হতো৷ একাক্ষরী ডাক! "প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া" এই তিন পথের যেকোনো একটায় কাজ করবো ভেবেছিলাম তবে আমার প্রশ্ন বেশী হয়ে যেতে পারে তাতে উনি ক্ষেপে যেতে পারেন, এই ভয়ে তিনের কম্বিনেশান বানিয়ে কাজ করতাম৷ উনি ভালোমনেই নিয়েছিলেন৷

বেশ কবছর কাজ করার পরে যখন ওনার মনটা নরম হয়ে এসেছে,তখন সুযোগ বুঝে বলেই ফেললাম যে যাজ্ঞবল্ক্যের সঙ্গে দেখা করতে চাই (অ্যাই কেউ আবার ভেবে বসবেন না যে আমি অন্য কিছু প্রোপোজ করবো, নেহাত্ প্রশ্ন করতে যেতে চাইছিলাম), টাইম মেশিনে যাবো৷ প্রফেসর শংকু রাজী হয়ে আমায় দুখানা হেডফোন আর দুখানা মাইক্রোফোন দিয়ে দিলেন৷ ওতে ওনার নবতম আবিষ্কার ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রান্সফর্মেশন ডিভাইস সংক্ষেপে LTD লাগানো আছে চিপে ভরে৷নিজে একটা হেডফোন পরে একটা মাইক্রোফোন কামড়ে ধরে গিয়ে নেমেই নাকি যাজ্ঞবল্ক্যকে চেপে ধরে ওনার কানে অন্য হেডফোনটা লাগিয়ে হাতে মাইক্রো ধরিয়ে দিতে হবে, নইলে উনি আমার কথা কিছুই বুঝবেন না আর আমিও ওনার কথা কিছুই বুঝবো না৷

তো সেইমতো গিয়ে সীটে বসে পড়লাম৷ উনি চালাতে শুরু করলেন কন্ট্রোল প্যানেলে গিয়ে৷ গুমগুমগুমাগুম ঝিরঝির কিশকিশ ঝুম্ ম্ ম্ শব্দ হতে লাগতো, সঙ্গে লালনীল কমলা সবুজ আলোর নানা নাচানাচি৷ আমার একটু একটু ভয় যে করেনি তা নয়, যদি সময়ের গোল ফুটা দিয়ে হারিয়েই যাই আর না ফিরতে পারি? তবে সে বেশীক্ষণ না, খানিকক্ষণের মধ্যেই চেতনা হারিয়ে ফেললাম।

এইভাবে চেপে টেপে ধরে কানে হেডফোন লাগানোর মতন ভায়োলেন্স আমার ব্যক্তিগতভাবে একেবারে না-পসন্দ৷ অথচ কোনো উপায় নেই, আমার এই ইটিকিটিমার্কা কিচিমিচি শব্দ উনি বুঝতে পারবেন না আর ওনার অং বহ অবট্ট মার্কা সমস্কিতো আমি বিন্দুবিসর্গ বুঝবো না, মাঝখান থেকে এই যাওয়া আসাই সার হবে৷ ইদিকে এতখানি বিদ্যুত্ খরচ! তার উপরে আনসার্টেনটি আছে, হয়তো গিয়ে পড়লাম আর্কিমিডিসের সময়ে ও দেশে৷ তখন? গ্রীক ভাষা না মার্শিয়ান ভাষা তফাত্ করতেই তো পারবো না!

আমি প্রফেসরকে বল্লাম ঐ ছ ফুটিয়া ইয়োগা করা লোককে আমি হেডফোন লাগাবো কিকরে? উনি লাগাতে দেবেনই বা কেন? তাই শংকু আমার সঙ্গে ওনার নবতম লোহার রোবট অয়স্কান্তকে দিয়েছেন৷ অয়স্কান্ত সাড়ে ছ ফুট লম্বা, সে প্রথমে নেমে আগে হেডফোন মাইক্রোফোন সেট করে দিলে পরে আমার নামতে হবে, যদি বেগতিক দেখি তাইলে অয়স্কান্তকে বিকল করে দিয়ে সবুজকমলা হাফাহাফি করা এই সুইচটা টিপে দিয়ে আমার ফিরে আসতে হবে৷ এও আমার পছন্দ ছিলো না, এমন শান্ত শিষ্ট চকচকে রোবট অয়স্কান্তকে ফেলে আসতে হবে? ইয়ার্কি নাকি? কি ভালো ছেলে অয়স! অল্প বাংলাও বলতে পারে! বলে,"নোমোসকার৷ ক্যামোন আছেন?" তার উপরে ভালো চা বানায়, ভালো কফি বানায়, যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করতে পারে! যাই হোক, আশা করেছি কোনো ঝামেলা হবে না, তাই সবকিছু নিয়ে চেপে বসেছি৷

ঝিমঝিম শব্দটা মিলিয়ে গেছিলো মানে আমিই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি৷ একসময় আবার শব্দ আলো ইত্যাদি ফিরে এলো, মাথা তুলে খাড়া হয়ে দেখি ভারী সুন্দর একটি নদীতীর, পলিউশন হীন ঝকঝকে নীল শরত্ আকাশ, বিরাট একটি বটগাছ নদীরে তীরে, জলের এত কাছে যে নামিয়ে দেওয়া ঝুরির অনেকগুলি জল ছুঁয়ে লকলক করছে, সূর্যোদয় হয়নি, তবে গোলাপী ঊষার আভা পুবের মেঘে৷
এক ভদ্রলোক মন্ত্র পড়তে পড়তে নদী থেকে স্নান করে উঠে আসছেন, বুঝতে পারছি না কী মন্ত্র, সম্ভবত ঊষার সম্পর্কিত কোনো স্তোত্র৷
অমা, সদ্যস্নাত সেই ভদ্রলোকের কাছে নেমে গিয়ে দেখি অয়স্কান্ত হাতজোড় করে হেসে বলছে,"নোমোসকার৷ ক্যামোন আছেন?"
দেখতে দেখতে চারিদিক আলো হয়ে উঠলো, সূর্য উঠে পড়েছে, আকাশটাও ঝকঝকে নীল একেবারে৷ আমার কেন জানি দুর্গাপূজা মনে পড়ছে, কিন্তু আমরা তো বহু অতীতে চলে এসেছি তখন দুর্গাপূজা ব্যাপারটাই হয়তো জানা ছিলো না মোটে!

ঊষাস্তোত্রপাঠরত ঋষিমশাই হঠাত্ সক্কালবেলা এমন এক কথাবলা লৌহমানবের সামনে পড়ে খুবই বোমকে গেছিলেন, কিন্তু খুব পোড়খাওয়া লোক, ঘাবড়েছেন যে এটা একেবারেই প্রকাশ করেন নাই৷ অয়স্কান্ত একগাল হেসে ওনাকে কানে ইয়ারফোন পরিয়ে হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে ভালো করে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে মাইক্রোটা মুখের সামনে ধরে কথা বলতে হবে আর কানের জিনিসটা যেন খবরদার খুলে না ফেলেন!

অবস্থা অনুকূলে বুঝে আমিও হেডফোন মাইক্রোফোন সজ্জিত হয়ে নেমে পড়লাম, এগিয়ে ওনাকে বাও করে বল্লাম, "নমস্কার৷ আমি ঋ (এসব শংকুর অডিভিডিতে উঠছে, তাই ঋ না বলে তো উপায় নেই!)৷ আপনার সময় থেকে প্রায় তিন সহস্র বত্সর ভবিষ্যত্ থেকে আসছি৷ অনুগ্রহ করে জানাবেন আমি কার সঙ্গে পরিচিত হবার সৌভাগ্য লাভ করছি?"

ভদ্রলোক প্রথমে অত্যন্ত অবাক হয়ে গেলেন, তারপরে রেগে গেলেন, নিজের নামটাম কিচ্ছু না বলে বললেন,"আপনি তিন হাজার বছর ভবিষ্যত্ থেকে আসছেন? ইয়ার্কি মারার আর জায়গা পাননি, না?"

আমি আর অয়স্কান্ত দুজনে মিলে অনেক চেষ্টা করতে লাগলাম ওনার বিশ্বাস উত্পাদন করতে৷ অয়স্কান্ত নিজে তো জলজ্যান্ত একটি প্রমাণ, যন্ত্র-মানুষ, পুরোপুরি যন্ত্র নয় অথচ যন্ত্র৷ ভবিষ্যতের না হলে কিকরে এ জিনিস তৈরী হবে? এ কি অতীতের লোকে বানাতে জানতো? আরে রোবোটিকস তো সেদিনের ব্যাপার, আমাদের পক্ষেও নতুন!

কিন্তু ভবী ভোলবার নয়, ঋষি টলবার নন৷ বলেন, "এসব ভেল্কিবাজী আমরাও জানি, রামায়ণে মহাভারতে এইধরনের যন্ত্রমানবের বর্ণনা অনেক আছে৷" আমাদের গলদঘর্ম অবস্থা, কিকরে বোঝাই ঋষিকে, টাইম মেশিন ঝোপের আড়ালে, সে দেখানো যাবে না, উনি যদি ক্ষেপে টেপে গিয়ে ভেঙেফেঙে দেন! তাইলে সময়ের মধ্যে আটকে পড়ে যাচ্ছেতাই কান্ড হবে, তা আমি বা অয়স্কান্ত কেউই চাই না৷ ভাগ্যিস অয়স্কান্ত কোনো ভাষাই বিশেষ ভালো জানেনা, নইলে ভেল্কিবাজী শুনে খুব দু:খিত হতো৷

হঠাত্ মাথায় বিদ্যুত্ খেলে গেলো, মনে পড়ে গেলো রাজা রৈবত ও রাজকন্যা রেবতীর উপাখ্যান, এনারা টাইম ট্রাভেল করেছিলেন৷ এইবারে বাপধন ঋষি, তুমি যাবে কোথা? তোমার অস্ত্রেই তোমায় করিব কাত!মনে পড়ামাত্র বীরবিক্রমে আমি রেবতী উপাখ্যান শুরু করে দিলাম৷ শুনতে শুনতে ঋষির কোঁচকানো ভুরু আস্তে আস্তে আলগা হয়ে আসছিলো,শেষে টুকরো হাসিও ফুটলো মুখে৷ গল্পটা হলো এইরকম:
সুদৃঢ় পুরী কুশস্থলীর রাজা রৈবতের একটি সুন্দরী মিষ্টি কন্যে ছিলেন,নাম রেবতী৷ এই কন্যা বড়ো হলে রাজা ভারী চিন্তায় পড়েছিলেন কার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন৷ অনেক চিন্তাভাবনা করে রাজা মেয়েকে নিয়ে একাদিন সোজা পিতামহ ব্রহ্মার সঙ্গে দেখা করতে চলে গেলেন,গিয়ে দেখেন ব্রহ্মলোকে ঝলমলে সভায় হাহা আর হুহু বলে দুই গন্ধর্ব অতি সুন্দর গান গাইছে৷ গানের মধ্যে তো আর ইন্টারাপ্ট করে বিয়ের কনসাল্টেশান চাওয়া যায় না, তাই রাজা ও রাজকন্যা আসন গ্রহণ করে গান শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে বুঁদ হয়ে গেলেন, সে অতি সুন্দর গান৷ গানটান শেষ হয়ে গেলে তাদের মনে হলো আহা এত সুন্দর গান এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো! এইবারে পিতামহ ব্রহ্মার সঙ্গে রেবতীর বিয়ে নিয়ে পরামর্শ চাইতেই সেখানে সকলে হেসে ফেললেন, পিতামহ বললেন এই ব্রহ্মলোকে আর ঐ পৃথিবীতে সময়ের গতি আলাদা৷ যতক্ষণ রৈবত আর রেবতী এখানে গান শুনেছেন পৃথিবীতে ততক্ষণে বহুযুগ অতিক্রান্ত, ফিরে গেলে তারা ভবিষ্যতের দুনিয়ায় গিয়ে পড়বেন৷ সেখানে মানুষের মাপ পজ্জন্ত বদলে গেছে, আগে ছিলো একুশ হাত লম্বা,এখন হয়েছে সাড়ে তিন হাত! শুনেটুনে রাজা রৈবত মাথায় হাত, এবারে কি হবে? একুশ হাত রেবতীর জন্য কোথায় উনি পাত্র পাবেন সাড়ে তিন হাত মানুষের দুনিয়ায়? কি বিপদ! ফিরে এলেন দুজনে নিজরাজ্যে, কুশস্থলী তখন দ্বারকা, সেখানে পাওয়া গেলো বলরামকে৷ বলরাম হলধর, তিনি রেবতীকে বেঁটে বানিয়ে সাড়ে তিন হাত করে বিয়ে করে ফেললেন আর রাজ রৈবত তপিস্যে করতে চলে গেলেন৷ ভালোয় ভালোয় গল্প শেষ হলো৷

গল্পটা রুদ্ধশ্বাসে শুনিয়ে বললাম,"এখন বলুন আপনাদের কল্পনায় যদি এরকম অতীতের মানুষ ভবিষ্যতে চলে যেতে পারে তাহলে উল্টোবাগে গিয়ে কেন আমরা অতীতে আসতে পারবো না ভবিষ্যত থেকে? একটা যদি আপনার কল্পনায় হলেও মানতে পারেন, তাহলে অন্যটা কেন নয়? কল্পনাতেই তো প্রথমে আসে ঘটনা,পরে না সেটা বাস্তবে তৈরী হয়! আপনি এতবড়ো দ্রষ্টা ঋষির, আপনাকে আর কি বলবো বলুন! "

উনি হেসে ফেললেন,"বুঝেছি৷ ফাজিল মেয়ে কোথাকার! আর তেল দিতে হবে না৷ চলো আমার আশ্রমে নেমন্তন্ন৷ চলো৷ তোমার লৌহমানবটিকেও সঙ্গে নাও৷ এই সেরেছে তুমি বলে ফেলেছি, মাফ করুন৷"

"আরে না না, "তুমি" ই বলুন৷ তুই ও বলতে পারেন৷ আমি কালের হিসাবে তো অনেক ছোটো৷ কিন্তু আপনার পরিচয় যে দিলেন না! আপনি কে?"
উনি দাঁড়িয়ে পড়ে খানিকক্ষণ দাড়ি চুমড়িয়ে বললেন,"এই তো মুশকিল! আমি কে! এইটা বলা খুব কঠিন৷শাস্ত্রে তো এই নিয়েই হুলুস্থূলু কান্ড৷ আত্মানং বিদ্ধি৷ নিজেকে জানো, জানো কে তুমি৷ আরে জানো বললেই কি জানা যায়! এতই সোজা৷"

আমি ফাঁপড়ে পড়ে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে ফেললাম৷ লোকটা ইয়ার্কি করছে নাকি? যদি করে থাকে তাহলে খুব দক্ষ বলতে হবে, মুখ একেবারে সিরিয়াস টাইপের গম্ভীর! কিন্তু দাঁড়িগোঁফের জঙ্গলের ফাঁকে অল্প একটু হাসি যেন দেখতে পেলাম৷ প্রাণে সাহস এনে বললম,"ঠিক আছে আপনি কে তা নাই বা জানলাম, শুধু বলুন আপনার নাম কি? লোকে আপনাকে কি নামে চেনে?"

উনি এবারে হেসে ফেললেন,বললেন "নামও তো অনেক৷ আমাদের সময়ে নিজের নাম ছাড়াও পিতামাতার নামের সঙ্গে ষ্ঞিক গোছের প্রত্যয় জুড়ে ছেলেমেয়েদের অনেক নাম হতো, জানো তো! মহাভারতে দেখো নি? গঙ্গাপুত্র গাঙ্গেয় শান্তনুপুত্র শান্তনব,কুন্তীপুত্র কৌন্তেয় পৃথাপুত্র পার্থ.. "

আমি যদিও থতমত খেয়ে আছি কিন্তু প্রকাশ করিনি, লোকটা যদি লেগপুলই করতে চায় তবে তৈরী আছি আমিও৷ হু!ঁ
বললাম,"একটা দুটো নাম যদি দয়া করে বলেন,দেখি যদি বাই চান্স চিনে ফেলতে পারি৷"

"বাই চান্স কেন? এত হিসেব নিকেশ করে অতীতভ্রমণে এসেছ, স্থানকালপাত্র ঠিকঠাক করে কি আর আসো নি? তাহলে এই প্রশ্নের মানেই বা কি? নিশ্চিত হতে জিজ্ঞেস করছো কি?"

ও হরি! এ ভাবছে আমি জানি, ঢং করছি!

খুলে বললাম,"দেখুন আমাদের এই প্রোজেক্ট এখনো বলতে গেলে পরীক্ষামূলক স্তরে৷ মোটামুটি একটা লক্ষ্য স্থির করে প্রোজেক্টাইল ছুঁড়ে দেওয়া হয়, যেখানে গিয়ে পড়ে, কাছাকাছি হলেও অনেক৷তাছাড়া ফান্ডামেন্টাল আনসার্টেনটি ও তো আছে! সেটা তো শত টেকনিকাল উন্নতিতেও থাকবে৷ তাই জিজ্ঞেস করছি কোথায় কার কাছে এসে পড়লাম৷"

খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে উনি আস্তে আস্তে বললেন,"আমার একটা নাম দৈবরাতি, বাবার নাম দেবরাত ছিলো বলে৷"

আমি আত্মবিস্তৃত হয়ে দুই হাতের মুঠা আকাশে ছুঁড়ে দিয়ে "ইয়া আ আ হু" বলে লাফিয়ে উঠলাম মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি৷ শংকু বুলস আই হিট করেছেন!
মাইক্রোফোন ছিটকে গেছে,হেডফোন খুলে পড়ে গেছে, ভদ্রলোক দ্রুতগতিতে সমস্কিতে কি বলছেন বিন্দুবিসর্গ বুঝছি না,আমার ইয়াহু শব্দটা কি অনুবাদে কি বস্তু হয়ে ঋষির কানে গেছে খোদায় মালুম, দেখলাম অয়স্কান্ত তাড়াতাড়ি যন্ত্রপাতি কুড়িয়ে আমার কানে হাতে সেট করে দিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে বলছে,"নোমোসকার৷ ক্যামন আছেন?" বেচারার এই শব্দ কয়টি ছাড়া সম্বল নেই,এদিকে মানুষের অনুভূতির অনেকটাই আছে!

ধাতস্থ হয়ে শুনি ঋষি দৈবরাতি বলছেন, "হঠাত্ এত উত্তেজিত কেন? এইরকম আকস্মিক উত্তেজনা ভালো নয়, এরকম তিড়িংবিড়িং লাফও ভালো নয়৷ এতে গুরুমস্তিষ্কে ও হত্পিন্ডে সমস্যা দেখা দিতে পারে, আঘাত লাগতে পারে৷ এগুলো খুব ফাইন টিউনিং করে রাখা যন্ত্রপাতি, বিগড়ালে সাংঘাতিক ব্যাপার! "

আমি অপ্রস্তুত খানিকটা, অবস্থা সামাল দিতে তাড়াতাড়ি বললাম, "মাফ করুন, আমি একটু বেশী উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলাম৷ আসলে দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তির ও উদ্বেগের পরে যখন প্রত্যাশিত গন্তব্যটি দেখা দেয়, সেখানে নিজেকে অবিষ্কার করে চিরকালই বিস্ময়ে আমি উদ্বেল হয়ে যাই৷ প্রথমে তো বিশ্বাসই হয় না নিজের চোখকানকে!"

ঋষি হাসলেন, বললেন, "একেবারেই অসিদ্ধ দেখছি৷ কাঁচা মন৷ পোড় খায় নি৷ আস্তে আস্তে হবে, বহুদিনের ব্যাপার৷ ঠিক আছে, এবারে তোমরা চলো আমার আশ্রমে৷ আজকের দিনটা অতিথি থাকো৷ তোমার লৌহ মানবটি তো দেখছি খুবই ভালো ঋ! সদাতত্পর আর হুঁশিয়ার!"

সিরিয়াস হয়ে খানিকটা আরোপিত দু:খী-দু:খী গভীর গলায় বললাম, "প্লীজ ওকে লৌহমানব বলবেন না স্যর, ওর নাম অয়স্কান্ত৷ মানব অনুভূতির অনেকগুলিই ওর আছে৷ লৌহমানব বললে ওর ভারী অভিমান হয়৷ অয়স্কান্ত শুনলে ও খুশী হয়ে ওঠে৷"

"বা: সুন্দর নাম৷ অয়স্কান্ত৷ কে দিয়েছেন এই নাম? "

"দিয়েছেন ওর নির্মাতা, ওর স্রষ্টা৷ তিনি আমার ও শিক্ষক৷ এই টাইম মেশিন ও অতীত ভ্রমণের প্রজেক্ট সবই তাঁর ব্রেইন চাইল্ড৷ এমনকি এই যে আমরা কথা বলছি যে যার নিজের ভাষায় অথচ কমুনিকেশনে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না সেই ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রানস্ফর্মেশন ডিভাইসও তাঁরই আবিষ্কার৷" এখানেও গলা আরোপিত সম্ভ্রমে ভারী করতে হলো যদিও শংকুকে আমি সত্যি সত্যিই শ্রদ্ধা করি৷ কিন্তু শ্রদ্ধা গলার স্বরে ফোটানো সোজা ব্যাপার না,ওটা স্পন্টেনিয়াসলি হয় না৷

আস্তে আস্তে আমরা তিনজন ওনার অশ্রমের দিকে অগ্রসর হচ্ছি৷ চারি দিকে গাছগাছালি শরতের সোনার আলোয় ছলছল করছে৷
একঝাঁক ছোটো পাখি উড়ে আমাদের সামনে দিয়ে ডানপাশের আমবাগানে চলে গেলো৷ তিতির৷ মনে হলো ঋষির ভারী সাধের পাখী৷ উনি ওদের ওড়ার দিকে মুগ্ধ বালকের মতন তাকিয়ে ছিলেন৷ আমি দীর্ঘশ্বাস গোপণ করলাম একটা৷ এ পাখী আমাদের সময়ে লুপ্ত হয়ে গেছে৷ এখান থেকে কয়েক জোড়া টাইম মেশিনে তুলে নিয়ে যাওয়া কি উচিত্ না অনুচিত? কিন্তু এই দূষনহীন হাওয়া, ঐ নীল ধূলিহীন আকাশ,ঐ পবিত্র জলধারা! এসব তো নেওয়া যাবে না! আমরা যে যুগ যুগ ধরে বিষিয়েছি সবকিছু! অর্বাচীন অহংকারী আমরা!সাধনাহীন সিদ্ধির লোভে!
ঋষি কিছু একটা অনুভব করলেন, আমার দিকে ফিরে বললেন," কি হলো?"

আমি দ্রুত মাথা নেড়ে বললাম,"না কিছু হয় নি৷ আমাদের সময়ের পৃথিবী অনেক অন্যরকম কিনা, তাই খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করছি, মাঝে মাঝে বেমানান হচ্ছে৷ ঠিক হয়ে যাবে, ভাববেন না৷"

(cont.)


মন্তব্য

অভ্রনীল এর ছবি

উপন্যাসখানির বাকী খন্ডগুলির উপরভরন মন্থর বেগে না করিয়া কিয়ৎ ত্বড়িৎ বেগে করিলে বড়ই পুলকিত হইবো...

বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি... লিখাখানি বড়ই সৌন্দর্য লাগিলো... পরবর্তী খন্ডের অপেক্ষায় রহিলাম...

_______________

এক ছাগলের দুই কান,
তুই আমার জানের জান।

তুলিরেখা এর ছবি

দিয়া দিছি কালকেই। হাসি
এখন দুইদিন রইয়াবইসা পড়েন।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মূলত পাঠক এর ছবি

আমাদের এট্টু ধার দিন ওই যন্তরটা, ভবিষ্যতে ট্রাভেল করে পরের পর্বগুলো পড়তে পাই তা'লে এক্ষুনি।

ভারি ভালো লেখার হাত আপনার, আর তেমন সরস স্টাইল। সোনার কলম হোক আপনার।

তুলিরেখা এর ছবি

দুই তুলে দিয়েছি কালকেই। হাসি
এখন দুইদিন রয়েবসে পড়েন।
আপনাকে ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

কীর্তিনাশা এর ছবি

পোস্টাইতে থাকেন, পড়তে থাকি দেঁতো হাসি

মন্তব্য করুমনে সব শেষ পর্বে হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

তুলিরেখা এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
কিন্তু প্রতি পর্বে না মন্তব্য করলে বুঝবো কি করে লেখা দেওয়া উচিত হচ্ছে কিনা?

-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

তুলিদির নিক থেকে যে "অতিথি" ল্যাজটা খসে পড়েছে খেয়াল করিনি। এখনি দেখলাম। অভিনন্দন আপনাকে দিদি।
উপন্যাসটা দারুন হচ্ছে। পরের পর্বগুলোও অনেক মজার হবে আশা রাখি।
---------------------------------------------

--------------------------------------------------------

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ পিচ্চি ভুত।
পরেরগুলো মজার হবে কিনা কেজানে। হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মূলত পাঠক এর ছবি

নিন, প্রথম ছবিটা সঁেটে দিলাম।

তুলিরেখা এর ছবি

সাহায্য করুন সাহায্য করুন। মডারেটাররা কেউ সাহায্য করুন।
দুইখানা ছবি, অয়স্কান্তের আর যাজ্ঞবল্ক্যের-মূলত পাঠক এঁকে দিয়েছেন। আমি আপলোড করেছি, সময়ের উজানে প্রথম পোস্টের শুরুর দিকে আর মাঝামাঝি যেখানে চরিত্রদুটো কথাগুলো বলছে সেখানে সেখানে ছবি সেঁটে দেবেন প্লীজ?
আগাম ধন্যবাদ রইলো।
-------------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মূলত পাঠক এর ছবি

একটা ভুল করেছি, আমিও ইতিমধ্যে এই ছবি দুটো তুলিরেখার লেখায় কমেন্ট হিসেবে পোস্ট করেছি। এখনো প্রকাশিত হয় নি যদিও।

মডারেটরেরা যদি ছবি দুটো লেখার মধ্যে সঁেটে দেন তাহলে আমার সচিত্র কমেন্ট দুটো মুছে দেবেন দয়া করে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।