সময়ের উজানে

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: মঙ্গল, ৩১/০৩/২০০৯ - ৭:৫৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


আশ্রমে ভারী শান্ত সুন্দর পরিবেশ৷ নিকোনো উঠানগুলি ঝকঝক করছে, মাঝে অগ্নিগৃহ আর তাকে ঘিরে কন্সেন্ট্রিক রিঙের আকারে নানা আবাসগৃহ৷ একপাশে বিরাট গোশালা৷ ঋষির শিষ্যরা নানা কাজে ব্যস্ত, আশ্রমে অদ্ভুত অতিথি আগমন সংবাদ মুহূর্তে ছড়িয়ে গেলো দাবানল হেন৷

অভ্যর্থনা করতে চলে এলেন ঋষির দুইজন স্ত্রী, দুজনেই ভারী সুন্দরী, তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, ঈষত্ পিঙ্গলকেশা দীঘল তণ্বী রমণী৷ একজনের চুল জটা করে মাথার উপরে তুলে বাঁধা, বাঁধুনি ঘিরে রুদ্রাক্ষের মালা, অন্য কোনো অলঙ্কার বিশেষ নেই, পরণের কাপড়ের উপরে মৌঞ্জী তৃণের মেখলা ধারণ করে আছেন তিনি৷ তীক্ষ্ণ জ্বলজ্বলে বুদ্ধিদীপ্ত এঁর মুখ, সম্ভবত ইনিই সেই ব্রহ্মবাদিনী স্ত্রী৷ অন্যজন ও সুন্দরী তবে এত তীব্রদীপ্তি নন, শান্ত মিষ্টিমুখ মা-মা চেহারা৷ এঁর হাত দুটি ভারী সুন্দর, আঙুলগুলি মায়াময়৷ ইনি যূথীফুলের স্থূল একটি শুভ্র মালা চুলের উপরে দিয়েছেন,খুব ভালো লাগছে৷ ঋষিপত্নী দুজনকেই ভারী ভালো লাগলো আমার৷অল্প ঝুঁকে পড়ে অভিবাদন জানালাম৷ কিন্তু এনাদের তো হেডফোন নেই, তাই সব কথা ঋষি নিজে অনুবাদ করে বুঝিয়ে দিলেন৷

দধি, কদমা, খই, চিপিটক, নারিকেল কোরা, খেজুর, মিষ্টান্নের দ্বারা প্রাতরাশ হলো৷ অতি চমত্কার সেসব খাবার৷ অয়স্কান্ত অবশ্য সেসব খেতে পারলো না, সে চুপ করে একপাশে বসে বসে আমাদের বিচিত্র কার্যকলাপ দেখতে লাগলো৷ এর পর ঋষি আমাদের ওনার অগ্নিগৃহ, গ্রন্থাগার, উদ্যান এইসব ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন৷ সবই খুব সুন্দর৷ (এইসব বানাতো কারা? ভালো ভালো স্থপতিও ছিলো এত? )

উদ্যানে তিনি এসে সবুজ ঘাসের খোলা জমিতে দাঁড়াতেই চার পাঁচটা সেই সাদা তিতির উড়ে এলো৷ উনি ওঁর কাপড়ের খুট থেকে অনেক খই বার করে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন, তিতিরেরা তুরতুর করে ঘুরে ঘুরে টুকিয়ে টুকিয়ে খাচ্ছিলো৷ একের পর এক আশেপাশের গাছপালা ঝোপঝাড় থেকে আরো আরো অনেক তিতির উড়ে আসতে লাগলো৷ আশ্বিনের এই সোনার আলোয়, নীল আকাশের নীচে এই প্রাচীন ঋষিকে যুবক হিসাবে দেখতে দেখতে আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছিলো, সত্যি দেখছি, নাকি স্বপ্নে দেখছি? এই সময়ভ্রমণের আগে বহুবার এই নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছি, এটা সেইরকমই একটা স্বপ্ন নয় তো!

দৈবরাতি আমার দিকে ফিরে হেসে বললেন,"ঋ,তোমাদের সময়ে এমন সব অদ্ভুত অদ্ভুত নাম হয় নাকি? একেক্জনের নাম ঋ বা ৯ বা এ বা ঐ? একাক্ষরী সব নাম?"

আমি ও হেসে বললাম,"তা নয়, সবার নাম এইরকম এত ছোটো না৷ তবে বড়ো নাম হলেই সবাই শর্ট করে ফেলে৷ এই যেমন ধরুন কারু নাম উইলিয়াম জেফারসন, অমনি সবাই তাকে বিল বলে ডাকতে থাকে৷ ধরুন কারুর নাম প্রজ্ঞাপারমিতা, তো তাকে সবাই প্র ডাকতে থাকে৷ এইসব নামগুলো আজকাল ততটা গুরুত্বের নয়, প্রত্যেকের জন্য সংখ্যা আছে, সব নথিপত্রে সেই সংখ্যাটাই আসল৷ "

ঋষির ভুরু আবার কুঁচকে গেছে, বলছেন,"নাম কিছু না, সকলের উপরে সংখ্যার ছাপ মেরে দিয়েছে! কিরকম সেই সমাজ? সেখানে তোমাদের বিশ্বাস সংস্কৃতি মানুষে মানুষে সম্পর্ক এসব কিকরম? বিদ্যাবুদ্ধি বা যন্ত্রপাতিকৌশল তো উন্নত বোঝা যাচ্ছে, নইলে আর সময়ভ্রমণ করছো কিকরে৷"

"সেতো বুঝিয়ে বলতে পারবো না, ব্যাপারটা খুব জটিল৷ আপনার এই সময়ের সমাজের তুলনায় অনেক বদলে গেছে সব কিছু৷ তবে এত দূর থেকে সবই কেমন অলীক লাগছে৷ অনেক ঘুরেছি,এখানে এই ছায়ায় একটু বসি ঋষি."

আমি ওঁর অনুমতি না নিয়েই বসে পড়লাম আম গাছের ছায়ায়, কোথা থেকে একটা দোয়েল ডেকে উঠলো টীকী টুই টোকি টীকি টীঈঈ ! পথ হারানো জঙ্গলে হঠাত্ চেনা চিহ্ন দেখতে পেলে মনটা যেমন আশায় উজল হয়ে ওঠে,তেমনি দোয়েলের এই চেনা সুরেলা শব্দগুলো আমায় সাহস ফিরিয়ে দিলো৷আমি বললাম, "ঋষি, একটুর জন্য আমি আপনাদের ঐ বিরাট বিখ্যাত সভাটি মিস করে গেলাম, জনকের বহুদক্ষিণ যজ্ঞ৷ আসলে অনেক ওয়ার্ল্ড লাইন অনুসরণ করার মতন ভালো টাইম মেশিন তো এখনো তৈরী হয় নি কিনা! ওখানে গেলে আপনাদের সবাইকে দেখতে পেতাম, আপনাদের বিখ্যাত ঝগড়া যা দিয়ে গাব্দা বই লেখা হয়ে গেলো তা শুনতে পেতাম আর বোনাস হিসাবে দেখতাম রাজাকেও৷" আমি হাসতে থাকলাম, অস্থির ভাবটা কেটে যাচ্ছিলো৷

দৈবরাতি কৃত্রিম রাগে চোখ পাকিয়ে কইলেন,""এ ঈ ঈ ঈ ঈ ঈ ! কি হচ্ছে এসব! ঝগড়া করেছি নাকি আমরা! খুব গুরুত্বপূর্ণ তর্কবিতর্ক হচ্ছিলো! মোটেই ঝগড়া নয়৷"

"ওরে বাবা,ঝগড়া নয়! আপনি তো শুনেছি গুন্ডার মতন হুমকীও দিয়েছিলেন! মুন্ডু খসিয়ে দেবেন বলে কাকে যেন৷"

একসঙ্গে দুজনেই এতজোরে হেসে উঠলাম যে সাদা তিতিরগুলি সব ফটফট করে উড়ে গেলো আকাশে৷ আমি বললাম," ঋষি, আপনি যখন বললেন যে এই সোনাবাঁধানো শিঙ-ওলা হাজারটা গরু আপনি আপনার আশ্রমে লাগবে বলে নিয়ে নিয়েছেন, তখন শুনে অন্যরা ক্ষেপে গিয়ে বললো না আরে, লোকটা বলে কি! ওর আশ্রমে গরু লাগবে আর আমাদের আশ্রমে ছাগল দিয়েই কাজ চলে যাবে নাকি! বললো না এরকম!"
আমি হাসি চাপতে পারছি না, ফুরফুর করে ঢাকনি খোলা সোডার বোতলের মতন বেরিয়ে আসছে, উনি আমার মুখের দিকে থতমত খেয়ে তাকিয়ে রইলেন তারপরে উনিও হাসতে হাসতে এসে পাশে বসে পড়লেন৷ আশ্বিনের রোদ্দুর চড়া হয়ে উঠেছে এতক্ষণে৷

অদ্ভুত একটা ভাবনা হঠাত্ মনে এলো, যদি টাইম মেশিন এখানেই রয়ে যায়,আমি আর অয়স্কান্ত না ফিরি আর? রোদেজলে রাতেদিনে মরচে ধরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে ও মেশিন একদিন ধুলায় মিশে যায়? আমাদের আইডেনটিটি তাহলে কিহবে? ভবিষ্যতের দুনিয়ার দুখানা এনটিটি তিনহাজার বছর অতীতের দুনিয়ায় গিয়ে জীবন কাটালো? কিহবে যদি আমরা অতীতে এমন কোনো পরিবর্তন করে দিই যা কিনা ভবিষ্যতের দুনিয়া পাল্টে দেবে? নাহ, ভাবতে পারছি না, ভাবতে ইচ্ছে করছে না, মাথাব্যথা করছে৷

ঋষি জিগালেন,"কি হলো? হঠাত্ কিসের ভাবনায় পড়ে কথা থামিয়ে দিলে?"

বরুণমন্ত্রটা মনে পড়তেই শিউরে উঠে বললাম," ঋষি সত্যিই আপনাদের সময়ে মানুষ বলি দিতো? শুন:শেপকে সত্যি যুপকাষ্ঠে বেঁধেছিলো বলি দেবে বলে? নাকি ওটা সিম্বলিক গল্প? নিশ্চয় সিম্বলিক৷ আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে৷"

একদম হাসি থামিয়ে আমার মুখের দিকে সটান তাকিয়ে আছেন ঋষি চোখের পাতা না ফেলে৷ উনি কি কোনো কারণে অফেন্ডেড হলেন নাকি? আস্তে আস্তে বলতে থাকলাম, "আমাদের উপরের বাঁধন উপর দিয়ে খুলে দাও, নীচের বাঁধন নীচ দিয়ে খুলে দাও, মধ্যের পাশ খুলে আলগা করে দাও৷ আমাদের মুক্ত হয়ে বাঁচতে দাও৷ অবাধমানি জীবসে৷"

ওঁর শক্ত মুখ শিথিল হয়ে গেলো,উনি বললেন,"কোথায় শুনলে এই মন্ত্র?"

" ঋষি, কত বছর পিছিয়ে গেলে ওঁকে দেখতে পাবো? যুপে বাঁধা বালক শুন:শেপকে? "

খুব সুদূর উদাস গলায় আস্তে আস্তে উনি বললেন," মাত্র এক প্রজন্ম পিছিয়ে গেলেই৷ কিন্তু সত্যি সত্যি কি ঘটেছিলো সেই বিষয়ে নিশ্চিত কেউ নয়৷ হয়তো পুরোটাই সিম্বলিক! হয়তো কেন, সত্যিই৷"


মন্তব্য

মূলত পাঠক এর ছবি

আহা, এত দ্রুত দ্বিতীয় ভাগ পাবো ভাবতে পারি নি। নাকি টাইম মেশিনটাই ধার দিলেন? আজ তারিখ কতো? হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মূলত পাঠক এর ছবি

আপনার ই-মেল আইডি পেলে কিছু ছবি এঁকে পাঠাতাম, অলঙ্করণের জন্য।

তুলিরেখা এর ছবি

আমার ইমেল আইডি?
dhammilla অ্যাট ইয়াহু ডট কম
ছবি আঁইকা পাঠাইবেন? আগাম ধন্যবাদ। হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অভ্রনীল এর ছবি

১.
এই সারিচ্চে! আপ্নে তো পুরাই রকেট গতিতে উপন্যাস লিখিচ্ছেন... ভালো হয়িচ্ছে!

২.
প্রথমে ভাবসিলাম এইটা সাই-ফাই কিছু একটা হইবো... এখন তো মনে হইতাসে আমি ভুল আন্দাজ করসিলাম!!

৩.
চালায়া যান...

_______________

এক ছাগলের দুই কান,
তুই আমার জানের জান।

তুলিরেখা এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
সাইফাই কিনা তাতো পাঠকের বিবেচনা।
আপনার ভাল লাগিছে শুইনা বেজায় খুশী হইলাম। হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মূলত পাঠক এর ছবি

আরেকটাও যোগ হলো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।