সময়ের উজানে

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বুধ, ০১/০৪/২০০৯ - ৩:৫৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


চারিদিক খুব শান্ত, এখন মাঝরাত৷ আমি শুয়ে আছি দৈবরাতির অতিথিশালার মেঝেতে বিছানো পুরু কোমল আস্তরণের উপরে৷ পাশের সুবর্ণভৃঙ্গারে জল রাখা আছে, রাত্রে যদি তৃষ্ঞা পায়, তাই৷ ঋষির গৃহকর্মনিপুণা স্ত্রীর সবদিকে নিঁখুত নজর৷ অত্যন্ত সুচারুভাবে অতিথিসেবা করেছেন তিনি৷

ঘুম আসে না, অবাক লাগে, কয়েক হাজার বছরের আগের একটি রাত্রি বয়ে যাচ্ছে, কোন্ ভবিষ্যদুনিয়া থেকে এখানে এসে পড়েছি আমরা!!! এ কি যুক্তিগ্রাহ্য কোনো কিছু? আমার জীবনরেখা ধরে পিছিয়ে গেলে উত্পত্তির সময়েই সেটি মিলিয়ে যায়,অয়স্কান্তের ক্ষেত্রেও নির্মাণের সময়েই সেটি মিলিয়ে যায়, কয়েক হাজার বছর আগের দুনিয়ায় আমরা তো ছিলাম না, অথবা হয়তো ছিলাম, অন্যরূপে, কে জানে!

ঘরের ভিতর বন্ধ দরজার কাছে অয়স্কান্ত বসে আছে প্রহরায়৷ ওর ঘুমের দরকার হয় না, কেমন আশ্চর্য জীবন! খিদে নেই ঘুম নেই, ক্লান্তি ও কি নেই? স্মৃতি আছে, স্মৃতিবেদনা আছে কি?

অয়স্কান্তের গলার কাছে দপদপ করে উঠলো সবুজ আলো৷ প্রথমে সবুজ তারপরে বাদামী৷ আমি বুঝতে পেরে উঠলাম শয্যা থেকে৷ ওর কাছে গিয়ে ওখানের বোল্ট ঘুরিয়ে ছোট্টো স্লাইডিং ডোর সরিয়ে ভিতর থেকে বের করে আনলাম ইন্টারটেম্পোরাল কন্ট্যাক্ট মেশিন৷ প্রফেসর কথা বলতে চাইছেন নিশ্চয়৷

কানে দিতেই সেই পরিচিত গলা," হ্যালো হ্যালো ঋ, শুনতে পাচ্ছ? আমি শঙ্কু বলছি,গিরিডি থেকে৷ আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?"

আমি একেবারে মন্ত্রমুগ্ধের মতন বললাম,"হ্যা ঁহ্যা ঁশুনতে পাচ্ছি৷ যদিও নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না৷"

ওনার হাসির শব্দ ভেসে এলো,"কেন, কানকে কেন বিশ্বাস হচ্ছে না ? "

"কয়েক হাজার বছর পার হয়ে আপনার গলা আসছে এই সুপ্রাচীন মধ্যরাত্রে, এ কি প্রথম ধাক্কাতেই বিশ্বাস করে ফেলা যায় নাকি?"

"হা হা, খুব ভালো, তোমার বিস্ময়বোধ নষ্ট হয় নি৷ কিন্তু তোমার ভ্রমণ কেমন চলছে? অয়স্কান্ত ই বা কেমন বুঝছে ব্যাপারটা?"

"ভ্রমণ ভালোই চলছে৷ এ ঋষিকে যতটা জার্ক টাইপের বলে মনে হয়েছিলো কাগজপত্তরের তথ্য থেকে, ইনি একদমই সেরকম না, বেশে সহজ সরল হাসিখুশী ই মনে হচ্ছে এখনো পর্যন্ত৷ কিন্তু ঐ ডিসাইসিভ সভায় কিরকম দেখা যেতো তা অবশ্য স্বাভাবিক সময়ের ঋষিকে দেখে বোঝা নাও যেতে পারে৷ খানিক ব্যাক গিয়ারে দিয়ে ওখানে মানে ঐ সভায় পাঠাতে পারেন?"

" তা পারলে তো ওখানেই প্রথমে টার্গেট করতাম৷ শোনো, এক্সপেরিমেন্ট সাকসেসফুল যখন একরকম হয়েইছে, এইবারে ফিরে এসো৷"

"সেকি? আরেকটু দেখবো না? ঋষি বলেছেন পাশের আশ্রমে নিয়ে যাবেন কাল, সেখানে ওনার গার্লফ্রেন্ড থাকেন৷" কথা শেষ করে হেসে ফেলি৷

"এই, বয়োজ্যেষ্ঠদের নিয়ে ইয়ার্কি করছো ঋ? এটা কি ঠিক ভদ্র ব্যবহার হচ্ছে?"

"না না মাফ করুন, ওনার সামনে তো আর এইসব বলবো না, উনি ক্ষেপেটেপে গেলে কেলেংকারী৷ সাধারণ বয়োজ্যেষ্ঠ্য তো না, কয়েক হাজার বছরের জ্যেষ্ঠ৷ উফ্ফ্ফ৷ ঠিক আছে, কাল আবার কথা বলবেন৷ এইবারে রাখি?"

আইটিসিএম এর সুইচ অফ করে ভাঁজ করে অয়স্কান্তের গলার সকেটে রেখে স্লাইডিং ডোর বন্ধ করে দিয়ে ফের এসে শুয়ে পড়লাম৷ ঘর অন্ধকার কিন্তু অয়সের দুখানা তর্জনীর ডগায় হাল্কা লাল আলো৷ জ্বলে নেভে, জ্বলে জ্বলে নেভে৷ ক্লান্ত অথচ ঘুম আসে না, ঐ জ্বলানেভা আলোর দিকে চেয়ে চুপ চুপ চুপ করে শিথিল হয়ে শুয়ে রইলাম, ছন্দময় সেই আলো একসময় ঘুম পাড়িয়ে দিলো৷

একঘুমে রাত কাবার করে জেগে দেখি বাইরে শিশিরসিক্ত শরত্সকাল ঝলমল করছে, সূর্যোদয় হয়ে গেছে, অয়স্কান্ত পাশে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে বলছে,"নোমোস্কার৷ কেমন আছেন?"

উঠে পড়লাম, আশ্রম জেগে উঠছে আস্তে আস্তে, বেশ কিছু জায়্গায় তো জোরকদমে কাজ শুরুই হয়ে গেছে৷ কিছু কিছু লোক হয়তো ঊষামুহূর্তে বা তারও আগে উঠে পড়ে কাজ লেগে যান,কাজকর্ম তো কম নয় আর! সব কিছু ম্যানুয়ালি করতে হয়, কিছু পশুচালিত সরল যন্ত্র আছে বটে, যেমন গোশকট, গোচালিত লাঙল, সর্ষেদানা থেকে তৈলনিষ্কাশনের জন্য গোচালিত যন্ত্র, কিন্তু সে যত্সামাণ্য৷ বাকী সবই মানুষকে করতে হয়৷ রান্নাবান্না ধোয়ামোছা থেকে শুরু করে হাওয়া করা অবধি৷

কালকে দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে আমরা যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলাম তখন আমার মুখে মেশিনে জামাকাপড় কাচা, ধোয়া শুকানো ইস্ত্রী করা মেশিনে বাসনামাজা মেশিনে পাখা ঘোরা এইসব শুনে ঋষির দুজন স্ত্রীই একেবারে অত্যন্ত অবাক হয়ে গেছিলেন৷ ঋষির হেডফোনটাই এনারা দুজন ভাগাভাগি করে একটু একটু করে শুনছিলেন আর যখন যিনি শুনছেন, তখন তিনি বিস্ময়ে চিত্কার করে উঠে সপত্নীকে অনুবাদ করে বোঝাচ্ছিলেন৷ শুনে অপরজন আরো জোরে চিত্কার করে উঠছিলেন৷ ঋষি ছিলেন না, উনি দ্বিপ্রহরে বিশ্রাম নেন না, উনি পড়াতে চলে গেছিলেন দূরের অন্য কুটিরে৷

কাত্যায়নীদেবীর রান্নাবান্না সত্যি লা জওয়াব৷ গতকাল মধ্যাহ্নভোজনে আর সায়মাশে এত ভালো ভালো সব সুস্বাদু রান্না পরিবেশন করেছেন কি বলবো! ভাত, লুচি, রুটি, পঞ্চশাক,পঞ্চব্যঞ্জন, ডাল, মাংসের নানা পদ, দধিমিষ্টান্নাদি, শেষে মুখশুদ্ধি মশলা পর্যন্ত পরিপাটী খাবার! পরিবেশনও কী শৈল্পিক! একেবারে দুইপরত কলাপাতা, এককোণে টুকরো লেবু আর নুন, আচার, লঙ্কাভাজা---কোনো কিছু বাদ পড়ে নি৷ সুগন্ধি পানীয় জল গেলাসে গেলাসে৷ অত্যন্ত তৃপ্তি সহকারে সকলেই আহার গ্রহণ করছিলেন! (ফিরে যাবার পরে প্রফেসর অডিভিডিতে সবই দেখবেন, কিন্তু এনিয়ে বেশী পোশ্নো কল্লেই কৌশলে এড়াতে হবে, নইলে উনি আসতে চাইবেন এই অতীতকালের নেমন্তন্নে)

ঋষি দৈবরাতি লোকটা ভাগ্যবান! এমন সুগৃহিনী এক স্ত্রী আর অমন মেধাবিনী আরেক স্ত্রী! যদিও আমাদের কালে জন্মালে বিপদে পড়ে শ্রীঘরে যেতে হতো একাধিক স্ত্রী রাখার জন্যে, কিন্তু তাঁর আমলে তো ঐরকমই নাকি দস্তুর! ঠিক সময়ে ঠিক ঠিক মানুষের মধ্যে ঠিক ঠিক জায়গায় জন্মানো যে কতদূর প্রয়োজন তা বেশ বোঝা গেলো৷

ঘুমটুম ঝেড়ে ফেলে চোখমুখ ডলে উঠে পড়লাম,হাতমুখ ধুতে হবে৷ দরজা ঠেলা মেরে খুলতেই শব্দে দৌড়ে এসেছেন সদাব্যস্ত কিন্তু হাসিমুখ কাত্যায়নী৷ হাতে রুপোর ভৃঙ্গারে জল আর নিমডাল৷ বললেন নিমডাল দিয়ে দাঁতন করে মুখ ধুয়ে নিতে৷ আমি তো যাকে বলে টরেটম বনে গেছি! এরকম আগে থেকেই প্রয়োজন বুঝে জিনিসপত্র ঠিক করে রাখা তো খুবই সাংঘাতিক ব্যাপার! ইনিও তো দেখা যাচ্ছে কম মেধাবিনী নন!

প্রাতরাশের পরেই ঋষি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে কিছু রিচুয়াল পালনের পরে সাদা তিতিরদের খই খাইয়ে এসে আমাকে কইলেন," ঋ, চলো, গর্গের আশ্রমে৷ বাচক্ণবী থাকেন ঐ আশ্রমে, উনি নারী ঋষিদের সূক্তগুলির সংকলন করছেন ঋগ্বেদ থেকে৷ চলো, কথা বলে তোমার হয়তো ভালো লাগবে৷ চিন্তা নেই, তোমার এই জন্তরমন্তর তখন আমি খুলে ওনাকে দেবো৷ সরাসরি কথা কইতে পারবে, আমাকে থাকতে হবে না৷"

আমি সন্দিগ্ধের মতন ওনার মুখের দিকে তাকালুম, ইয়ার্কি না সিরিয়াস বোঝার জন্য, কিন্তু ওনার মুখে দুর্জয় গাম্ভীর্য৷ দৈবরাতির অদ্ভুত ক্ষমতা, গম্ভীরমুখে দিব্যি ইয়ার্কি ফাজলামো করে যান, কেউ ধরতেও পারে না৷

আমি, ঋষি আর অয়স্কান্ত বেরিয়ে পড়ার পর চলছি তো চলছিই,পথ আর ফুরায় না! মাঠের পর মাঠ, টিলা ... তারপরে আবার মাঠ ...
ঘেমেঘুমে একাকার হয়ে যতবার জিগাই আর কদ্দুর? উনি মিহি হেসে বলে যান, এই তো আরেকটু৷ আমার দিল্লি দুরস্ত্ মনে পড়ছে, আদৌ গিয়ে পৌঁছাবো তো?

দৈবরাতির ভ্রূক্ষেপ নেই,ওনার বোধহয় এসব পায়চারী করার সামিল৷ এদিকে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত৷ যন্ত্র-সভ্যতা আমাদের যাতা করে ছেড়ে দিয়েছে৷ মাথার উপরে রোদ্দুর চড়ে উঠেছে, ওড়না মাথায় দিয়ে এবারে হাঁটতে হাঁটতে তেড়িয়া হয়ে কইলাম," শুনুন ঋষি, আমি এখন একটু ঐ গাছতলায় বসবো৷ এত টানা হাঁটতে পারছি না৷"

উনি খুব অপ্রস্তুতমুখে হাসলেন,বললেন,"হ্যা ঁহ্যা ঁঅবশ্যই৷"

আমি গিয়ে জারুলফুলের মতন দেখতে ফুলফোটানো গাছটার গাঢ় ছায়ায় ক্লান্তভাবে বসে পড়লাম৷ অয়স্কান্ত নীরবে এসে আমার পাশে বসে পড়লো৷ ঋষি দৈবরাতি আস্তে আস্তে এসে বসে পড়ে মাফ চাইতে লাগলেন, এতটা হাঁটতে আমার কষ্ট হবে বুঝতে পারেন নি বলে৷

আমি তড়িঘড়ি ওনাকে থামিয়ে কইলাম," তাতে কি আছে? হাঁটা ভালো,অনেক এক্সারসাইজ হয়৷ আমার নেহাত্ অভ্যেস নেই, তাই৷ তাবলে আমাদের আমলে সবাই আমার মতন এমন ঠুনকোপানা না ঋষি৷ এই তো আমার এক বন্ধু ছিলো, দুই ঘন্টায় ছাব্বিশ মাইল দৌড়াতো৷"

দৈবরাতি হাসছেন, মাফ চাওয়ার সময় ওনার মুখ কালছে লাগছিলো, এখন ফের রোদ্দুর রোদ্দুর লাগছে৷ আমি ওনার সঙ্গে গল্প জুড়লাম, "ঋষি, আপনি প্রায়ই যান বুঝি গর্গের আশ্রমে?"

"হ্যা,ঁনানা কাজে যেতে তো হয়ই৷"

"একা যান, নাকি সঙ্গে শিষ্যেরা থাকে?"

উনি সতর্ক হয়ে গেছেন, আমাকে একবার ভালো করে জরীপ করে কইলেন," মাঝে মাঝে শিষ্যরা থাকে, মাঝে মাঝে একা৷ কিন্তু,একথা কেন জিজ্ঞাসা করছো?"

আমি গলা ছেড়ে হেসে উঠে বললাম,"অমনি৷ জানতে ইচ্ছে হলো৷" উঠে পড়লাম, বিশ্রাম নেয়া হয়ে গেছে৷

আরো অনেকটা হেঁটে দুপুরবেলা গিয়ে পৌঁছানো গেলো গর্গের আশ্রমে৷ এটা দৈবরাতির বিশাল সেই আশ্রমের মতন অত বড়ো না,তবে সুন্দর খুব৷ গাছগাছালির ছায়ায় ছায়ায় কুটিরগুলি সুন্দর মানিয়েছে, সুন্দর সুন্দর ফুলফলের গাছপালা,পোষা ময়ূর ঘুরে বেড়াচ্ছে ফুলের ঝাড়ের কাছে, কাজলজলের একটি স্নিগ্ধ দিঘি বটের ছায়ায়৷

আশ্রমের গেটে আমাদের অভ্যর্থনা করে কয়েকজন সঙ্গে করে নিয়ে চললেন অগ্নিগৃহের দিকে৷ ওরা অয়স্কান্তকে দেখে হকচকিয়ে গেছে৷ যেতে যেতে ঋষি ওদের কাছে আমার আর অয়স্কান্তের পরিচয় দিচ্ছিলেন৷ এত স্বাভাবিক স্বরে এমন "এতো কিছুই না" ভঙ্গীতে বলছিলেন হয়তো ওদের ভয় বিস্ময় ইত্যাদি কাটিয়ে দিতে, কিন্তু ওদের বিস্ময় উত্তরোত্তর বেড়েই চলছিলো৷

আশ্রমে আমরা আরো ভেতরে ঢুকতে ঢুকতেই খবর ছড়িয়ে গেলো৷ যোগাযোগের ব্যাপারে মানুষের উত্সুক কান ও মুখের মতন যন্ত্র খুব কমই আছে বলে হঠাত্ মনে হলো৷ খবর ছড়িয়ে যেতে তিন সহস্র বত্সর ভবিষ্যতের পর্যটকদ্বয়, তাদের মধ্যে আবার একজন মানবাকার যন্ত্রমানব, এদের দেখবার জন্য ভীড় বাড়তে লাগলো, তবে কিনা এরা সব ব্রহ্মচর্যব্রতধারণকারী শিক্ষার্থী, তাই সংযত ভদ্র আচরণ, মাত্রাছাড়া ব্যবহার দেখাচ্ছে না৷ বিস্ময় সীমা অতিক্রম করলেও তা প্রকাশ করছে না৷

নিজেকে বেশ সেলিব্রিটি সেলিব্রিটি লাগছিলো,অয়স্কান্তের নিশ্চয় এইসব অসুবিধা নেই৷ আর ঋষি দৈবরাতি তো নিজেই ততদিনে সেলিব্রিটি, ওনার এসব সয়ে গেছে৷ তাছাড়া পোড়খাওয়া লোক, সামান্য ব্যাপারে বিচলিতই বা হবেন কেন?

অগ্নিগৃহের ভিতরে কোনো রিচুয়াল চলছিলো,সেখানেই বাচকণবী ছিলেন৷খবর পেয়ে বেরিয়ে এলেন৷ এনার বেশবাস সন্ন্যাসিনীর মতন, কালচে বাদামী চুলগুলি জটা করে মাথার উপরে তুলে বাঁধা,গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, গৈরিকবসনের উপরে মৌঞ্জীতৃণের মেখলা৷স্বর্ণাভ ঘৃতের মতন উজ্জল দেহবর্ণ, ছেনিকাটা সুগঠন মুখ, তীক্ষ্ণ নাসা, একজোড়া চোখ নীলকান্তমণির মতন জ্বলজ্বলে৷ একেই এত রোদ্দুরে এত হেঁটে এসে আমার অবস্থা কাহিল, তার উপরে এই সেলিব্রিটি অভ্যর্থনা,এরপরে এই অগ্নিময়ী সন্ন্যাসিনীকে দেখে আমার চোখে ধাঁধা লেগে গেলো৷ সাময়িক দৃষ্টিবিভ্রমের মতন, মনে হলো বেদীর শুভ্র হোমশিখা চলমান হয়ে অগ্নিগৃহের থেকে বেরিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো৷

ঋষি দৈবরাতি আমাদের পরস্পরের পরিচয় করিয়ে দিলেন৷ আমার চোখ ততক্ষণে সয়ে এসেছিলো, তখন আর ধাঁধা লাগছিলো না,অল্প নীচু হয়ে বাও করে বললাম, "পরিচিত হয়ে ধন্য হলাম৷"

উনি যেন কি বললেন, আমার বোধগম্য হলো না, ঋষি দৈবরাতি অনুবাদ করে দিলেন,"ইনি বলছেন, ইনিও তোমার সঙ্গে পরিচিত হবার সৌভাগ্য লাভ করতে পেরে ধন্য৷"

অমা, এমন সময় কথা নেই বার্তা নেই অয়স্কান্ত এগিয়ে এসে রীতিমত বাও করে মহিলাকে বললো কিনা, "নোমোসকার, ক্যামোন আছেন?"
আর একটুও অবাক টবাক বা বিরক্ত কিছু না হয়ে দিব্যি ঋষিও কথাটা অনুবাদ করে বুঝিয়ে দিলেন মহিলাকে৷

বাচক্ণবী মৃদু হেসে আমাদের কি যেন অনুরোধ জানালেন৷ ঋষি বুঝিয়ে দিলেন ইনি ওনার পাঠকক্ষে আমাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন৷

সম্মত হয়ে আমরা ওনার সঙ্গে সঙ্গে চলাম অগ্নিগৃহের সামান্য দূরে অবস্থিত সুন্দর ছিমছাম কুটিরটির দিকে৷একটি চিত্রল হরিণশিশু ছুটে এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালো, বাচক্ণবী নীচু হয়ে হরিণটার ঘাড়ে হাত বুলিয়ে কি যেন বলে দিলেন ওর কানে কানে অস্ফুটস্বরে, হরিণটা দৌড়ে চলে গেলো৷ কুটীরের বারান্দায় একটা বাচ্চা সিংহ বসে ছিলো, আমাদের দেখে দাঁড়িয়ে উঠলো৷ একদম ছোটো, বাচকণবী নীচু হয়ে ওকে কোলে তুলে নিলেন৷

ঋষি দৈবরাতি আমাদের কইলেন,"সিংহের বাচ্চাটা একদম ছোটো থেকে আছে, ওর মা ফেলে চলে গেছিলো, আর খোঁজ নেয় নি৷ বাচকণবী তুলার পলতেয় করে দুধ খাইয়ে বাঁচিয়েছে৷ একটু বড়ো হলে বনে দিয়ে দেবে৷ এরকম প্রায়ই হয়৷ অনেক সিংহশাবককেই ওদের মা ফেলে যায় কমজোর দেখলে৷"

আমি একেবারে যাকে বলে থ, এসব আমার সময়েও আমি কখনো চোখের সামনে দেখিনি, জেনে গুডাল ডায়ান ফসী এদের কথা পড়েছি মাত্র, তাও দূর স্বপ্নদেশের ছবির মতন কাহিনি সেসব৷ এখন এখানে ...

বাচকণবী আমাদের ঘরে বসতে আসন দিয়ে কি যেন অনুমতি প্রার্থনা করলেন, অনুবাদে বোঝা গেলো সিংহাশাবকটিকে সরমার কাছে পৌঁছে দিয়েই তিনি আসছেন৷ সরমা নাকি আশ্রমের একটি পোষা মহিলা কুকুর৷ মা-হারা বিভিন্ন পশুশাবকদের নাকি সে দেখভাল করে৷

বাচক্ণবীর পাঠকক্ষখানি খুব সুন্দর, না-গরম না-ঠান্ডা, নাতিশীতোষ্ঞ৷ মাঝে মাঝে হাল্কা হাওয়া আসছে পাশের উদ্যান থেকে,তাতে অতি হাল্কা অতি মধুর পুষ্পসৌরভ৷ শীতলপাটি বিছিয়ে বসে আমরা কথা কইছিলাম, দৈবরাতি ওনার মাইক্রোফোন হেডফোন বাচকণবীকে দিয়ে দিয়েছেন, আমরা মানে আমি আর অয়স্কান্ত সারাদিন ও রাত্রির আতিথ্য স্বীকার করেছি,পরদিন সকালে আমাদের ফের নিতে আসবেন দৈবরাতি৷
বাচকণবী ওনাকেও থাকতে বলছিলেন,কিন্তু ভদ্রলোক একেবারে আঁতকে উঠে কইলেন,"বলো কি? আমার পড়ানো নাই? সকালের পড়ানো টড়ানো কিছুই হয়নি, দুপুরের পরও আমি না গেলে একেবারে দক্ষযজ্ঞ হয়ে যাবে ঐখানে৷ গিয়ে হয়তো দেখবো .... কি দেখবো ভগবান জানেন ... কিছু মনে কোরো না বাচক্ণবী, কিছু মনে কোরোনা ঋ, আলোচনার জন্য থাকতে পারলে আমার খুব ভালো লাগতো, কিন্তু নিরুপায়৷ ফিরতেই হবে৷ ঠিক আছে, আমি আসি তাহলে৷"

বাচক্নবী রেগে গেলেন, মুখ গনগনে করে কি যেন বললেন, বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে দৈবরাতি আমার দিকে ফিরে আক্ষরিক অনুবাদ করে দিতে লাগলেন, "ঋ, উনি কইছেন "অতিথি হয়ে এসে শুধু মুখে ফিরে যাবে ঋষি? আমার অধোগতি না ঘটালে তোমার মনের শান্তি হবে না, না? ঠিক আছে যাও, বয়েই গেছে তোমাকে কিছু খেতে দিতে আমার৷" তারপরে দেখি উনি মহিলার দিকে ফিরে কইলেন," সম্মানিত ভবিষ্যকালের অতিথির সামনে এসব বোলো না আমায়৷ উনি কি মনে করবেন? দাও,কি দেবে দাও, সরবত্ টরবত্ হলে ভালো হয়, বড্ড তৃষ্ঞার্ত৷ ঋকেও দেবে, উনি এতটা হেঁটে অত্যন্ত পরিশ্রান্ত৷ সরবত্ খেয়েই আমি বিদায় নেবো, দেরি করে বাড়ীতে গেলে ফেরামাত্র ডবল সাঁড়াশী আক্রমণে আমি একেবারে বৃন্দাবন দেখবো৷" উনি হাসছেন কইতে কইতে৷ সরবত্ আনতে যেতে যেতে চোখ বাঁকা করে কিযেন বলে গেলেন বাচকণবী৷ এটা একটুও অনুবাদ করলেন না ঋষি৷ কিজানি বাবা, কিসের মধ্যে এসে পড়লাম হে!

সরবত্ খুব ভালো ছিলো, দধিশর্করা সহযোগে শীতল জলের সরবত্, অমৃতহেন স্বাদ৷ সরবত্ খেয়েই দৈবরাতি উঠে পড়লেন৷ বিদায় নেবেন৷ আমরা একটু এগিয়ে ওনাকে গেটের কাছ অবধি পৌঁছে দিয়ে এলাম, উনি চলে যেতে যেতে একবার ফিরে তাকিয়ে হেসে কিযেন বললেন৷ ফিরে এসে পাঠকক্ষে আমরা আলোচনায় বসলাম৷


মন্তব্য

মূলত পাঠক এর ছবি

আহা আপনি লিখে ফেললেন যে পরেরটাও, ছবি পাঠানোর আগেই। পরে জুড়তে পারা যাবে?

মূলত পাঠক এর ছবি

চমৎকার লাগছে গল্প !

একটা কথা, আপনার লেখাটা আমার যন্তরে দেখছি যখন, তখন যেখানেই য়-এ এ-কার ও-কার ইত্যাদি আছে, সেখানে ঘঁেটে যাচ্ছে। এটা আমার যন্তরের দোষ, নাকি সবাই-ই এই রকম দেখছেন? পাঠকেরা কেউ জানাবেন একটু?

তুলিরেখা এর ছবি

আমি তো য়া য়ো য়ে ঠিকই দেখছি!
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মূলত পাঠক এর ছবি

তবে এ আপেল-সমস্যা । অভ্র কী-বোর্ডের আবার আপেল-সংস্করণও হয় না । মহা মুশকিল !

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

চলুক
***************
শাহেনশাহ সিমন

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

কীর্তিনাশা এর ছবি

চলুক, সাথে আছি হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

তীরন্দাজ এর ছবি

বেশ ভালো লাগছে। তবে আগের পর্বগুলোও পড়তে হবে!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।