অণোরণীয়ান থেকে মহতোমহীয়ান(৪)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বুধ, ১৫/০৪/২০০৯ - ৯:৪৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এখন দুকথা সেই কোয়াসার নিয়ে একটু হোক৷ তারপরে আবার আইনস্টাইনে ফিরে আসা হবে৷ আজকে একটু কোয়াসারের প্রথম দিকের কথা বলি,পরে বলবো যে বিশাল ভরের ব্যাপারগুলো কি করে এর সঙ্গে জড়ানো হলো৷

গত শতকের ষাটের দশকে আবিষ্কার হয় কোয়াসার, QUASAR ৷এটা Quasi Stellar Radio Source এর থেকে৷ তখনি বড়ো বড়ো রেডিও টেলিস্কোপগুলো বসানো হচ্ছিলো৷ তো, তাতে ধরা পড়লো এমনি আলোক দূরবীক্ষণে খুব ক্ষীণ তারার মতন দেখতে একরকম উত্‌স, অথচ খুব তীব্র রেডিও তরঙ্গ আসছে ওসব থেকে৷ তাই থেকে নামটা দেয়া হলো৷

তারপরে সেই উত্সগুলোর আলো বর্ণালীবীক্ষণে ফেলে তো লোকে তাজ্জব! সবকটার লোহিত-অপসরণ অনেক বেশী বেশী৷ এরা আমাদের গ্যালাক্সির কিছু নয়, তার চেয়ে অনেক দূরে! হাবল সূত্র লাগিয়ে এদের দূরত্ব মেপে দেখা গেলো গ্যালাক্সি তো বটেই গ্যালাক্সিপুঞ্জের সীমাটিমা ছড়িয়ে আরো বহু দূরে এরা৷ (হাবলের সুত্র হলো খুব সহজ, v = Hd ৷ v দূরে চলে যাবার গতি, d হলো দূরত্ব আর H হলো হাবল কন্সট্যান্ট৷ (বর্তমানে সবচেয়ে বেশী লোহিত-অপসরণওয়ালা কোয়াসারের রেড শিফট ৬.৪, আলোর ৩৭% গতিবেগে দূরে চলে যাচ্ছে)

এখন ঐ অত দূরত্ব মানেই হলো এরা বহু আগের জিনিস, অন্তত দশ বিলিয়ন বছর আগের৷ কাছেপিঠে কোনো কোয়াসার পাওয়া গেলো না, সবই দশ বা তার বেশী৷ এর থেকে বোঝা গেলো অতীতের মহাবিশ্বে ছিলো কোয়াসার, ওগুলো এমন কান্ড যা কিনা বর্তমানে আর ঘটে না, অতীতের প্রচন্ড সক্রিয় মহাবিশ্বে ঘটতো৷ এটা একটা পরোক্ষ প্রমাণ যে অতীতে মহাবিশ্ব আজকের মতন ছিলো না, অন্যরকম ছিলো৷

আর আরেকটা খুব আকর্ষনীয় ব্যাপার হলো এই কোয়াসারেরা আকারে বড়ো না, সাইজে আমাদের সৌরজগতের সঙ্গে তুলনীয়৷ অথচ এরা যে শক্তি বিকিরণ করছে তা একখানা গোটা গ্যালাক্সির বিকিরিত শক্তির সঙ্গে তুলনীয়৷ ঘোর রহস্য! এখন অবশ্য এর একটা উত্তরের ধর্তাই পাওয়া আজকাল যাচ্ছে!

কোয়াসারের সবচেয়ে মারাত্মক রহস্য ছিলো এর বিকিরিত শক্তি৷ সামান্য সৌরজগতের মতন আকারের জায়গা থেকে কিকরে গোটা গ্যালাক্সির বিকিরিত শক্তির প্রায় সমান শক্তি ছুটে আসছে?

ভালো কথা, জানা গেলো কিকরে ওরা অত ছোটো সাইজের? হয়তো আসলে অনেক বড়ো, দূরের জন্য ছোটো দেখায়? কিন্তু কোনো কোনো কোয়াসারের খুব নিয়ম মেনে ঔজ্জ্বল্যের পরিবর্তন হয়, এরা টিপটিপ করে, ঔজ্জ্বল্য একবার বাড়ে একবার কমে৷ তো, এই কমাবাড়ার সময় পর্থক্য হিসাব করে দেখা গেলো এটা ঘন্টার তফাত্ বা বড়ো জোর একদিন দেড়দিন৷ এই কোয়াসার খুব বড়ো হলে সীমিত গতির আলো এত তাড়াতাড়ি পরিবর্তনের খবর এনে দিতে পারতো না৷ তাই যুক্তি পাওয়া গেলো এদের সাইজ লাইট-আওয়ার বা লাইট-ডের চেয়ে বেশী নয়৷

এখানে এই লাইট-আওয়ার বা লাইট-ডে নিয়ে একটু বলি। আলো এক সেকেনডে যায় তিন লাখ কিমি বা এক লাখ ছিয়াশি হাজার মাইল। তাই এই দূরত্বকে বলে এক লাইট-সেকেন্ড। আমাদের সূর্য থেকে প্লুটোতে আলো পৌঁছতে সময় লাগে সাড়ে পাঁচ ঘন্টার মতন৷ তাই বলা যায় প্লুটো আছে সূর্য থেকে সাড়ে পাঁচ লাইট-আওয়ার দূরে৷ সৌরজগতের সীমা অবশ্য প্লুটো ছাড়িয়ে আরো বহু দূরে৷ প্লুটো আছে ঠান্ডা বরফগোলার জগত কুইপার বেল্টে৷ সেখানে প্লুটোর মতন আরো অনেক বস্তু ভেসে বেড়াচ্ছে৷ সেই বেল্টাকৃতি জায়গা ছড়িয়ে আরো আরো দূরে চলে গেলে আছে ওর্ট ক্লাউড বলে ধুলো গ্যাসের স্ফেরিকাল অঞ্চল, সেখান থেকে ধুমকেতুরা আসে৷ তাও ছড়িয়ে একসময় হেলিওপজ৷ এখানে এসেই সূর্যের গ্রাভিটির প্রভাব শেষ হয়েছে৷ এটা লাইটডের বেশী না, মানে আলো একদিনেই এই সাইজ কভার করে যায়৷ কিন্তু সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী তারাটির দূরত্ব সাড়ে চার আলোকবর্ষ৷ প্রক্সিমা সেন্টরিতে সুর্যের আলো সুর্য থেকে রওনা হবার সাড়ে চার বছর পরে গিয়ে পৌঁছয়৷

সৌরজগতের সাইজের কোনো আলোক উ‌তসে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে কোনো পরিবর্তন হতে থাকলে সেটা যে আলোক-দূতেরা নিয়ে যাবে তারা একদিনেই পার হবে এই সাইজ৷ পরের পরিবর্তিত সারিরা একদিন তফাতে থাকবে তার৷ এইভাবেই জানা গেলো ও নিশ্চিত হওয়া গেলো কোয়াসারের সাইজ সৌরজগতের সঙ্গে তুলনীয়৷ কিন্তু শক্তি? সে মারাত্মক!!!

আমাদের গ্যালাক্সি হলো মিল্কি ওয়ে৷ এতে আছে কয়েক বিলিয়ন নক্ষত্র৷ সুর্য এর একটি মাঝারি আকারের তারা মাত্র৷ ছানাপোনা নিয়ে মানে গোটা সৌরজগতখানি আছে গ্যালাক্সির একটি ঘূর্ণীবাহুর ভেতরের দিকে অপেক্ষাকৃত শান্ত অঞ্চলে৷ এই গোটা গ্যালাক্সি যত শক্তি বিকিরণ করে একটি কোয়াসার প্রায় তাই করে৷

কিকরে সম্ভব? অতটুকু জায়গায় কোন্ উপায়ে ঐ বিপুল শক্তি উত্পাদিত হচ্ছে? নক্ষত্রে শক্তি উত্পাদিত হয় কেন্দ্রকীয় সংযোজনে৷ হাল্কা মৌলের কেন্দ্রক প্রচন্ড তাপে চাপে জুড়ে গিয়ে ভারী মৌলের কেন্দ্রক বানায় আর অল্প ভর মুক্ত হয় শক্তি হিসাবে, আইনস্টাইনের E=mc^2 সূত্র মেনে৷ কিন্তু কোয়াসারের বিপুল শক্তি ওভাবে আসতে পারবে না, ওখানে চলছে অন্য কোনো প্রক্রিয়া!
(চলবে)


মন্তব্য

শিক্ষানবিস এর ছবি

কোয়েজার নিয়েই এই মুহূর্তে চিন্তা করছিলাম। z=6 এবং এর পরের দূরত্ব নিয়ে ভাবতে হচ্ছিল কসমিক রিআয়োনাইজেশন যুগের কথা ভাবতে গিয়ে। ইন্টারগ্যালাক্টিক মাধ্যমের হাইড্রোজেনকে পুনরায় আয়নিত করার পেছনে তো এই কোয়েজাররাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল, নাকি? এই ক্ষেত্রে কোয়েজারদের অবদান নিয়ে ভাবতে গিয়ে আবার গান-পিটারসন ট্রাউ এর সন্ধান পেলাম। কোয়েজার কিভাবে এত শক্তি উৎপন্ন করে সেটা বলার পাশাপাশি কোয়েজার থেকে পৃথিবীতে আসা তরঙ্গে গান পিটারসন ট্রাউ থাকার বিষয়টাও ব্যাখ্যা কইরেন পরের পর্বে। অপেক্ষায় থাকলাম।

-------------------------------------------------------------------------
আমার এখনও জন্ম হয়নি। খুব চেষ্টা করছি জন্মাতে। কিন্তু পৃথিবী বলছে, সে আমাকে নেবে না।

তুলিরেখা এর ছবি

পরের পর্বে লিখবো সেসব।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সিরাত এর ছবি

খাসা লাগলো! এরকম আরো লেখেন!

একসময় না একটা কনফিউশন ছিল যে একটা কোয়াসার ১৫ বিলিয়ন লাইট ইয়ার দূরে, মহাবিশ্বের চেয়ে বুড়া! ওটা মনে হয় এখন সলভড হয়ে গেছে। চোখ টিপি

তুলিরেখা এর ছবি

সিরাত, ধন্যবাদ। বয়সের সে রহস্য সমাধান হয়ে গেছে।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

আহ্ লেখাটা পড়ে মনটা তৃপ্তিতে ভরে গেল!
আরেকটু লম্বা করে যদি ছাড়তেন!
___________________________
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।
বেশী লম্বা লিখতে পারি না, ভয় হয় লোকে যদি ক্লান্ত হয়। -----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

খুব ভাল্লাগলো। আগের পর্বগুলো পড়িনি, তারপরও মজা লাগল। লেখার আকার ঠিকাছে।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

তুলিরেখা এর ছবি

পরের পর্ব দিতে গেলাম, হাওয়া হয়ে গেলো, এরার দেখালো পেজ নট অ্যাভেলেবল।
এই নিয়ে ক্য়দিনে আমার এরকম হলো চারবার। মন খারাপ
তবে কপি না রেখে এখন আর কিছু দিই না, বুদ্ধি বেড়েছে চোর পালানোর পরে। হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মূলত পাঠক এর ছবি

আমারও সেই দশা, কোন্ ভূতে যে ধরেছে কে জানে, মাঝে মাঝেই লেখা গায়েব হয়ে যায়!

তুলিরেখা এর ছবি

এই অংশও একটু এডিট করে ইংরেজী শব্দ কমালাম।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।