অণোরণীয়ান থেকে মহতোমহীয়ান(৬)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: রবি, ২৬/০৪/২০০৯ - ৪:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সাধারণ নক্ষত্রে কি থাকে? গরম জ্বলন্ত গ্যাসরাশি৷ এদের একটা থেকে আরেকটা পরমাণুর মধ্যে বেশ অনেক দূরত্ব থাকে৷ কিন্তু যদি ঐ ভীষণ মহাকর্ষীয় সঙ্কোচনে পড়ে তাহলে এরা কাছাকাছি চলে আসে, খুব কাছে কাছে৷ ঘনত্ব তখন বেড়ে যায় সাংঘাতিক৷ কিন্তু পাউলির এক্সক্লুশন প্রিন্সিপল এদের একেবারে চুপসে ব্ল্যাক হোল হওয়া থেকে আটকাতে পারে যদি এদের ভর ঐ চন্দ্রশেখর লিমিটের কম হয়৷ এইধরনের জ্বালানি ফুরানো ঘন নক্ষত্রকে বলে হোয়াইট ডোয়ার্ফ ৷

আমাদের পৃথিবী থেকে দেখা রাত আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হলো লুব্ধক (sirius) ৷ এই লুব্ধকের একটি সঙ্গী নক্ষত্র আছে, সঙ্গীটি একটি হোয়াইট ডোয়ার্ফ৷ অতটুকু সাইজের মধ্যে অত ভর আছে দেখে (বাইনারি স্টারের একটার ভর জানা থাকলে অন্যটির গতিপথ দেখে সামান্য অংক কষে সেটির ভর জানা যায়) ঘনত্ব বার করে দেখা এছে সেটি হোয়াইট ডোয়ার্ফের তাত্ত্বিক ভরের সঙ্গে মিলে যায়৷ তাই এটি চন্দ্রশেখর লিমিটের পরোক্ষ প্রমাণ৷ এই ধরনের ঘন নক্ষত্রে কোনো নিউক্লীয় সংযোজন চলে না, কিন্তু ইলেকট্রনের ডিজেনারেসি এদের নিজের মহাকর্ষে নিজের চিঁড়েচ্যাপ্টা হওয়া থেকে বাঁচায়৷ এরা আলো বিকিরণ করে ভেতরে থেকে যাওয়া তাপের প্রভাবে, এদের দেখায় উজ্জ্বল সাদা৷ তাপ বিকিরণ করতে করতে আস্তে আস্তে ঠান্ডা হতে হতে একসময় এরা ইয়েলো ডোয়ার্ফ হয়ে তারপরে একসম একদম নিভে যাবে৷ হয়ে যাবে ব্ল্যাক ডোয়ার্ফ৷ তাপহীন আলোহীন নক্ষত্রের মৃতদেহ৷

কিন্তু ভর যদি একটু বেশী হয়, যদি ইলেকট্রনের ডিজেনারেসি যথেষ্ট না হয় এদের মহাকর্ষের প্রবল টানের থেকে বাঁচানোর পক্ষে? চন্দ্রশেখর তো সেটাই তাত্ত্বিক গণনায় দেখান যে এই এক্সক্লুশন প্রিন্সিপলের দ্বারা বস্তুকে বাঁচানোর একটা সীমা আছে, অবস্থান খুব কাছাকাছি হতে থাকলে গতিবেগের যে বিরাট পার্থক্য হবে তার একটা সীমা আছে, স্পেশাল রিলেটিভিটি অনুসারে আমরা জানি যে সেটা আলোর বেগ, c ৷ ভর চন্দ্রশেখর লিমিটের বেশী হলে ঐ মারাত্মক মহাকর্ষের চাপে ইলেকট্রনেরা সব ঢুকে পড়বে নিউক্লিয়াসে আর প্রোটনের সঙ্গে মিলে হয়ে যাবে নিউট্রন৷ তখন ঐ নিউট্রনেদের ডিজেনারেসি যদি যথেষ্ট হয়, তাহলে কোলাপ্স থেকে রক্ষা পাবে অতিঘন নক্ষত্রটি ও এর নাম হবে নিউট্রন স্টার৷ এক টেবিল চামচ নাক্ষত্র বস্তুর ভর তখন হবে কয়েক কোটি টন! সাইজ খুব ছোটো কিন্তু অত্যন্ত ঘন৷

এখন তত্ত্বগতভাবে তো বলে দেয়া হলো, সাক্ষ্যপ্রমাণ কোথা? পাওয়া গেলো পালসারে৷ পালসার হলো এমন তারা যেখান থেকে নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গের ধারা আসতে থাকে৷ কেমন করে আসতে থাকে? কোনো জ্বালানি ফুরানো তারার রয়ে যাওয়া ভর যদি এতটা হয় যে এটার ইলেকট্রনগুলো সব নিউক্লিয়াসে ঢুকে প্রোটনে মিলে নিউট্রন হয়ে গেছে, ঘনত্ব হয়েছে খুব বেশী, আকৃতি হয়েছে খুব ছোটো আর এটা অত্যন্ত দ্রুত ঘুরছে ( কৌণিক ভরবেগের নিত্যতাসূত্র অনুযায়ী)৷ এর চৌম্বকমেরুর থেকে বিপুল বিকিরণ বেরিয়ে আসবে৷ এখন ভাগ্যক্রমে যদি এর ঘূর্ণন অক্ষটা এমনভাবে থাকে যে মেরুটি ঘুরে ঘুরে আমাদের মুখোমুখি হচ্ছে, তাহলে আমরা নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে দেখবো তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গের ফ্ল্যাশ৷ ঠিক এইরকম জিনিস পর্যবেক্ষণ করা গেলো, প্রথম রেডিও ওয়েভে দেখা গেলো, পরে অপটিকালে৷ এমন নিঁখুত নিয়ম মানা সময় ব্যবধানে আসছিলো সেই রেডিও ওয়েভের ফ্ল্যাশ যে আবিষ্কারক দুজন প্রথমে ভেবেছিলেন কোনো অন্য গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীরা বুঝি যোগাযোগের আশায় সংকেত পাঠায়! পরে ভালো করে সবকিছু দেখেশুনে অংক করে বলা হলো এ হলো গিয়ে নিউট্রন স্টার!

তখন লোকে নড়েচড়ে বসলো, এতখানি ঘনত্বই যদি হতে পারে তাহলে আরো বেশী কেন নয়? কেন নয় সত্যিকার গ্র্যাভিটেশনাল কোলাপ্স? কেন নয় ব্ল্যাক হোল? কেউ কেউ যুক্তি দিতে আরম্ভ করলেন যদি দুইখানা নিউট্রন স্টার কোলাইড করে তাহলে কি হবে? তাহলে তো ওদের মোট ভর ঐ এক্সক্লুশনে বাঁচানো ভরের থেকে যাবে বেড়ে, তখন? তখন কি সত্যি সত্যি ঘটবে গ্র্যাভিটেশনাল কোলাপ্স? তৈরী হবে ব্ল্যাক হোল যা থেকে আলো পর্যন্ত ছুটে বেরোতে পারে না?

পদার্থবিদ্যার জানা সমস্ত তত্ব কাজে লাগিয়ে দেখা গেলো তা হবার কোনো মৌলিক বাধা নেই৷ কিন্তু তখনো লোকে একটুও মানতে চাইছিলো না৷ পরে সিগ্নাস এক্স ওয়ান বলে একটা বাইনারি সিস্টেমে দেখা গেলো একটি তারা বিপুল দৈত্যাকার আর তা থেকে উত্তপ্ত গ্যাসের স্রোত চলেছে একটি না দেখা বিন্দুর দিকে আর সেই দিকে যত যাচ্ছে তত বেশী গতিবেগ প্রাপ্ত হচ্ছে৷ মারাত্মক গরম হয়ে এক্স রশ্মি বিকিরণ করছে অন্যান্য রশ্মির সঙ্গে৷

তো, সবাই তখন বললেন হয়তো ঐ না দেখা বিন্দুটি আসলে ব্ল্যাক হোলে পরিণত হওয়া সঙ্গী তারাটি, যা কিনা আর কোনো আলোকেই আসতে দেয়ে না বলে কিছুই দেখা যায় না, কিন্তু সে স্পেসটাইমে যে মারাত্মক কার্ভেচার তৈরী করেছে সেই কার্ভেচারের রেঞ্জের মধ্যে পড়লেই বস্তুরা ছুটে যায় ওর দিকে৷ আর সেই মরণঝাঁপের সময় বিকিরণ করে এক্স রে! ওটিই ছিলো প্রথম অনুমিত ব্ল্যাক হোলের এভিডেন্স৷ ক্রমে জানা গেলো বড়ো বড়ো সব গ্যালাক্সিদের কেন্দ্রে রয়েছে বিপুল ভরের সব ব্ল্যাক হোল৷ বিলিয়ন সৌরভরের ব্ল্যাক হোল৷ এরাই মূল শক্তিকেন্দ্র, প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ তারা গ্রাস করে চলেছে আর সেই গ্রাস করার আগের সময়ে পতনশীল গ্যাসরাশি থেকে ছুটে আসছে বিপুল শক্তি, সমস্ত রকম তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গের রূপে ৷

আগে আমরা জেনেছি আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুসারে মহাকর্ষ হলো গিয়ে স্পেসটাইমের বিশেষ ধরনের বক্রতার(কার্ভেচার) ফল৷ এইখানে এই চরম ঘনত্বের বস্তুর ক্ষেত্রে কি হলো? একটু অংক কষে দেখা গেলো এই বস্তু স্পেসটাইমে এমন এক কার্ভেচার তৈরী করলো যে সেই কার্ভেচারের মান হলো অসীম৷ মানে স্পেসটাইমের অবিচ্ছিন্ন কন্টিনুয়াম থেকে এটা কাট অফ হয়ে গেলো৷ এপাশ থেকে মানে এই স্পেসটাইম কন্টিনুয়াম থেকে যদি দেখার চেষ্টা করি তাহলে মনে হবে ওখানে সময় শেষ হয়ে গেছে৷ ঠিক যেন টানটান নিঁখুত তলের উপরে একটা গর্ত, যদিও এই কল্পনায় খামতি থাকে যুক্তির, কারণ আমাদের মহাবিশ্ব চারমাত্রার, তিনটে স্থান ব্যপ্তি আর একটা কালব্যপ্তি৷

যাই হোক এই ব্ল্যাকহোলের একটি পরিসীমা আছে যাকে এনারা নাম দিয়েছেন ইভেন্ট হরাইজন--ঘটনাদিগন্ত৷ সংকোচনশীল নক্ষত্র ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবার ঠিক আগের মুহূর্তে যে আলো বা অন্য তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ ছুটে বেরোতে চেষ্টা করেছিলো কিন্তু পারেনি, বাঁধা পড়ে চিরকাল বৃত্তপথে ঘুরে চলেছে, সেই ধরা পড়া আলোদের দিয়ে তৈরী স্ফিয়ারকে বলে ব্ল্যাক হোলের ইভেন্ট হরাইজন৷ আগে সবাই নিশ্চিত ছিলো ব্ল্যাক হোল থেকে কিছুই বিকিরণ আসতে পারে না, ঐ সর্বগ্রাসী টানে সবকিছুই তলিয়ে যায় ঐ গ্রাভিটেশনাল ওয়েলে৷ কিন্তু বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং কোয়ান্টাম ধারণা প্রয়োগ করে দেখান ক্ষীণ বিকিরণ আসতে পারে, ব্ল্যাক হোল এর ঘটনা দিগন্তের পাশ থেকে৷ একে বলে হকিং রেডিয়েশন৷

কোয়াসারের শক্তির উত্স আজকাল মনে করা হচ্ছে বিলিয়ন সৌরভরের সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল৷ (আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও নাকি একটি অত সুপারম্যাসিভ না হলেও তুলনীয় ভরের বিশাল ব্ল্যাক হোল আছে৷) সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের তীব্র গ্র্যাভিটি কার্ভেচারে পড়ে কাছাকাছি সমস্ত বস্তু ক্রমত্বরিত গতিতে সর্পিল পথে এগিয়ে যেতে থকে সেই ইভেন্ট হরাইজনের দিকে৷ যত কাছে যায় তত বেগ বাড়ে আর তত প্রচন্ড তপ্ত হয়ে ওঠে৷ এক্স রে থেকে শুরু করে অন্য সব তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গ বিকিরণ করতে থাকে৷ ঐ বিপুল বিকিরণই দেখতে পাই কোয়াসার থেকে৷ অবশেষে বস্তু
ব্ল্যাকহোল পড়ে যায়, আর তার কোনো হদিশ থাকে না৷ নতুন বস্তু আসতে থাকে ব্ল্যাকহোলে পড়ার জন্য৷

***


মন্তব্য

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

ঐটাই কি কেয়ামত? মাইগড! এই বস্তু এর আগে একবার পড়েছিলাম, তখন এতো সুন্দর করে বুঝিনাই।
ফাটাফাটি লাগলো!
___________________________
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ

তুলিরেখা এর ছবি

ভালো লাগলো?
অনেক ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

জিজ্ঞাসু এর ছবি

সাবলীল লেখা। আমার মনে হয় কিছু বুঝতে পেরেছি। কোয়েইজার তাহলে ব্ল্যাকহোলের মতই কোন কিছু যা থেকে তারার মত আলো এবং শক্তিশালী রেডিও ওয়েভ পাওয়া যায়। ভুল হলে বলবেন।

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

তুলিরেখা এর ছবি

ঠিক। কোয়েজার থেকে প্রায় গোটা গ্যালাক্সির সমান শক্তি পাওয়া যায়। এদের কেন্দ্রে আছে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নীড় সন্ধানী এর ছবি

‍‌কঠিন একটা বিষয়কে এত সুন্দর করে লিখলেন, অসাধারন!!! চমৎকৃত হলাম।

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

তুলিরেখা এর ছবি

চমত্‌কৃত হলেন? বলেন কি? হাসি
জোকস অ্যাপার্ট , অনেক ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

শিক্ষানবিস এর ছবি

নিউট্রন তারা আর কৃষ্ণ বিবরের সবকিছুই খুব কম কথায় খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। অনেক ভাল লাগল।
তাড়াতাড়ি পরের পর্ব চাই।

তুলিরেখা এর ছবি

কেয়ামতের আবার পর কি? সব তো ব্ল্যাক-হোলে পড়ে গেলো! হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সিরাত এর ছবি

বেশ কিছুদিন আগে পরে ভাল লেগেছিল। চালিয়ে যান।

আমার অনুরোধ আপনি মাল্টিভার্স নিয়ে লেখেন।

আরো চাই ইন্টেলিজেন্ট সিভিলাইজেশনের থাকার সম্ভাবনা নিয়েও। আমরা কি ভাবে মহাবিশ্বে একা হতে পারি? ড্রেক ইকুয়েশন দেখলেও তো লাখ লাখ থাকার কথা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।