দেশবিদেশের উপকথা(৬)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: শনি, ২৩/০৫/২০০৯ - ৫:৪৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চেরোকী উপকথা:
নেটিভ আমেরিকান চেরোকী উপজাতির উপকথায় আছে প্লেইয়াডেস (কৃত্তিকা) তারাপুঞ্জটির গল্প। গল্পটা পড়তে পড়তে অবাক লাগলো কারণ আমাদের বাংলার গ্রামেও এই তারাপুঞ্জকে বলে সাতভাই। চেরোকীরা বলে "ছয়ছেলে"।

ওদের গল্পে আছে অনেক অনেক দিন আগে এক গাঁয়ে সাতটি বাচ্চাছেলে ছিলো, ওরা সারাদিন একসাথে খেলে বেড়াতো, খেলতো ডান্ডাগুলি খেলা। ওদের মায়েরা যত বলে,"ওরে শুধু খেললে হবে? একটু আধটু কাজকর্মও তো শিখতে হয়! যা না, দাদাদের সঙ্গে ভুট্টাক্ষেতে গিয়ে একটু হাতে হাতে সাহায্য কর না।"

কে শোনে কার কথা! ওরা সারাদিন শুধু খেলেই বেড়ায় আর খেলেই বেড়ায়, খেলা শেষ হলে ঘরে ফিরে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ে অথবা নতুন খেলার প্ল্যান আঁটে।

দিনের পরে দিন কেটে যায়, মায়েরা শেষ তিতিবিরক্ত হয়ে পড়েন। একদিন সাত বন্ধু খেলেটেলে খুব ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে বাড়ী এসেছে, ওদের মায়েরা পাতে বেড়ে দিলো ডান্ডাগুলি খেলার গুলিপাথর, কইলো, " তোরা যখন এই গুল্লিখেলাই এত ভালোবাসিস,পাথরের গুল্লিই তাই খা।"

সাতটি ছেলে খুব মর্মাহত হলো, হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে গেলো। সোজা চলে গেলো গাঁয়ের মাঝের মন্দিরের কাছে- নিজেরা নিজেরা বলাবলি করলো," ওরা আমাদের চায় না। কেনই বা ওদের কষ্ট দিতে আমরা থাকি? চল, আমরা সাতজনে মিলে এমন জায়গায় চলে যাবো, যেখানে ওরা আর আমাদের খুঁজে পাবে না।" সাতজন ক্ষুধার্ত ক্লান্ত বালক মন্দির ঘিরে পরিক্রমা আর প্রার্থনা শুরু করলো, যেন দেবতারা ওদের টেনে নেন।

অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, ছেলেরা রাগ করে গেছে, মায়েদের মন কেমন করে উঠেছে এবার। কি জানি কি হলো বাছাদের,কোথা গেলো!
লোকে এসে খবর দিলো ওরা মন্দির ঘিরে মন্ত্র পড়ে নাচছে আর প্রার্থনা করছে।

মায়েরা ছুটে গিয়ে দেখে ছেলেরা ততক্ষণে আকাশের দিকে অনেকটা উঠে গেছে। মায়েরা অনেক কাঁদলো, বিলাপ করলো, ফিরে আসতে কইলো, ওরা নামলো না, চলে গেলো আকাশে। শুধু একজনকে ঝাঁপিয়ে ধরতে পেরেছিলো এক মা, কিন্তু ধরে রাখতে পারলো না, সে ডুবে গেলো পৃথিবীর মাটি ফুঁড়ে।

ছয়টি ছেলে আকাশের তারা হয়ে জ্বলছে একই সঙ্গে, চেরোকীরা ওদের বলে ছয়ছেলে। যার ছেলে মাটিতে ডুবে গেছিলো, সেই মা রোজ এসে সেই জায়গায় কাঁদত সকালে সন্ধ্যায়, সেখানে ক্রমে গজিয়ে উঠলো এক গাছ, সরল দীর্ঘদেহ পাইন গাছ, ওর চূড়া উঠে গেলো আকাশের তারার দিকে। চেরোকীরা বলে পাইনগাছ আর তারাদের মধ্যে অন্তরে অন্তরে মিল-উভয়ের মধ্যেই আগুন আছে।

নাভাহো উপকথা:
এইবারে নাভাহো গল্প। নাভাহোরা নেটিভ আমেরিকান উপজাতি, চেরোকীদের মতন। কর্ন মানে ভুট্টা এদের কাছে খুব পবিত্র (সমস্ত নেটিভ আমেরিকান উপকথায় ভুট্টাগাছ নিয়ে কিছু না কিছু ইম্পোর্ট্যান্ট গল্প আছেই ), নাভাহো কাঁথায় থাকে সাদা ভুট্টা পুরুষ আর হলদে ভুট্টা নারী-এরা আদিপিতামাতা, পবিত্র ভুট্টাশীষ উপহার দিচ্ছেন মরমানুষকে।

যাই হোক, এবারে আসল গল্পে চলে যাওয়া যাক। নাভাহোরা বলে এটা হলো পঞ্চম জগৎ, মানুষের পূর্বজরা থাকতো চতুর্থ জগতে, এক বিরাট বন্যায় সব ধুয়ে মুছে গেলো সেখানে, কিছু মানুষ কোনোমতে পথ খুঁজে এই দুনিয়ায় এসে পড়লো, তারপর থেকে মানুষ এই পঞ্চম দুনিয়ায় আছে।

দিন যায়, দিন যায়, সুখেদুখে। একদিন মানুষ শোনে হু উ উ উ উ উ উ হু হু হু হু। কে জানি কি কয় আকাশ থেকে, ওরা কান পেতে শোনে সেই দৈববাণী। ক্রমে সে শব্দ জোরে হলো, দৈববাণীর দেবতা প্রকট হলেন মানুষের সামনে। রঙীন পাথর থেকে তিনি বানালেন এক নারী, যে কিনা সদা পরিবর্তিত হয়। ভুট্টার শেষ থেকে বানালেন সাদা ভুট্টা ছেলে আর হলদে ভুট্টা মেয়ে।

সেই যে সদা-রূপবদল কন্যা, সেই কন্যা বিবাহ করলেন সূর্যকে, সূর্য তাকে বানিয়ে দিলেন এক সুন্দর বাড়ী, ও ও ঐ পশ্চিমে, সে এখন সেখানেই থাকে। ঐখান থেকেই বসন্তের মিঠা হাওয়া আসে, গ্রীষ্মের পরে মধুর বৃষ্টি আসে নাভাহোদের দেশে, সেও আসে সেই পশ্চিম-নারীর ঘর খানি হতে।

সেই পশ্চিমবাসিনী সূর্যপত্নীর ঘরে দুটি ফুটফুটে ছেলে হলো-শত্রুঞ্জয় আর নীরজ। কিন্তু কেন জানি ওদের বাবা সূর্য ওদের দিকে ফিরেও চাইলেন না, দেখতেও এলেন না, খোঁজখবরও করলেন না। এই দুই ভাই বড়ো হলো মায়ের কাছেই, দেখতে দেখতে শৌর্যে বীর্যে অতুলনীয় দুই কিশোর হয়ে উঠল।

এবারে দুই ভাই সিদ্ধান্ত নিলো, বাবার কাছে যাবে আর বাবার কাছ থেকে জেনে আসবে নানা অশুভ আত্মাকে শান্ত করার কৌশল-ঐসব অশুভ আত্মারা মানুষকে কষ্ট দেয় দেখে এই দুই সূর্যপুত্রের প্রাণে বাজে।

যাবে তো, কিন্তু যায় কিভাবে? দুই ভাই অনেক ভাবে, অনেক ভাবে। তারপরে পাহাড়ের গুহায় যেখানে খুব জ্ঞানী আর কৌশলী মাকড়াসাবুড়ী থাকে, সেইখানে গিয়ে হাজির। বলে," ঠাম্মা গো, তোর পায়ে পড়ি / পথ বলে দে দয়া করি' / মোরা দুজন যাবো সুজ্জি-বাড়ী / বলে দে পথ দয়া করি'।" ঠাম্মা গলে জল, পথ বলে দেন আর দেন মন্ত্রপাতি যাতে কিনা নাতিদের কোনো অমঙ্গল না হয়। তাদের আরো দেন মন্ত্রপূত কিছু ঈগলের পালক।

দুই ভাই এইবারে মহা উত্সাহে যাত্রা করে, পথ চলে আর চলে, দীর্ঘ পথ পার হয়ে অবশেষে এক হদের কিনারে সূর্যপ্রাসাদে হাজির হয়। সূর্য তখন বাড়ী ছিলেন না, দুয়ারে পাহারা দিচ্ছিলো ভীষণ দর্শন দুই বন্য বরাহ, দুই ভাই ওদের বুড়ীর মন্ত্র পড়ে অচল করে দিলো। এইবারে ওদের পাশ দিয়ে ঢুকে পড়লো প্রাসাদে।

কেউ কোথাও নেই, খোঁজে খোঁজে কাউকে পায় না। তবে বাবা বাড়ী নেই, পরে আসবে, সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে। এই ভেবে দুই ভাই এইবারে লুকিয়ে পড়লো কম্বলের তলায়।

সূর্য ফিরলেন, ফিরেই বুঝলেন কিছু হয়েছে, কেউ এসেছে। প্রথমে ঝাড়া দিলেন সাদা সকাল কম্বল-তারপরে নীল আকাশ কম্বল-তারপরে হলদে বিকাল কম্বল-একদম শেষে কালো রাত্রি কম্বল।

আর যায় কোথা, দুই ভাই গড়িয়ে পড়ে গেলো। সূর্য চিনতে পারেন নি কিনা, এই রকম চোরের মতন লুকিয়ে থাকতে দেখে ভেবেছেন এরা সত্যি চোর--শাস্তি দিতে ধরে আছাড় দিলেন পাথরে, কিন্তু মন্ত্রপূত ঈগলের পালক থাকায় তেমন কিছুই হলো না দুভায়ের। এট্টু ছড়ে গেলো আর নুনছাল উঠে গেলো মাত্র।

তারপরে রাগ পড়ে গেলে সূর্য দেখেন আহা বাচ্চা বাচ্চা দুটো ছেলে, হাতে টাতে কেমন ছড়ে গেছে, কিজানি কার ছেলে, কেন এসেছিলো। কিছু তো নেয় নি, কি দেখেই বা তিনি চোর ভাবলেন!

ওরা জল চাইছিলো, জলটল দিলেন, কাটাছড়াগুলোতে ওষুধ দিলেন-তারপরে জিগালেন পরিচয় ইত্যাদি। ওরা প্রথমে ভয়ে বলতে চায় না, চলে যেতে চায়, বলে," এমনি এসেছিলাম, আপনার অসুবিধা করলাম, মাফ করুন।"

কিন্তু সূর্য কিছুতেই না জেনে ছাড়বেন না। অবশেষে ওরা বললো। তারপরে- তারপরে কি হলো সে আর বলে কি হবে? অমন আবেগঘন পিতাপুত্র মিলনকাহিনি অমনি অমনি বলে দেওয়া যায় নাকি? ইয়ার্কি?

যাই হোক, এরপরে অশুভ আত্মাদের সঙ্গে লড়ার জন্য যাদু তীরধনুক এইসব সূর্য দিলেন দুই ছেলেকে। সেসব নিয়ে বাবাকে প্রণাম করে দুই ছেলে ফিরে এলো। সকলের সঙ্গে সুখেশান্তিতে বাস করতে লাগল। শুভক্ষণে তাদের বিবাহাদি হলো, আহা সে যা হলো, যেমন হতে হয়। হাসি

পরেরদিন বলবো পশ্চিম আফ্রিকার আনান্সির গল্প।


মন্তব্য

ধুসর গোধূলি এর ছবি
তুলিরেখা এর ছবি

কঠিন লাগলো দ্বিতীয়টা? কন কি? এক্কেরে তো বাংলা সিনেমা। শেষে গিয়ে গান গেয়ে পিতা ও পুত্রগণের মিলন। হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ভুতুম এর ছবি

আপনার এহেন কর্মকাণ্ডের জন্য উত্তম জাঝা!। বলতে থাকুন, শ্রোতারা অপেক্ষায় আছে।

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

তুলিরেখা এর ছবি

ভুতুম, ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মূলত পাঠক এর ছবি

সুন্দর গল্প। পরেরটার আশায় রইলাম।

তুলিরেখা এর ছবি

আশায় রইলেন? ঠিক আছে পরের গল্প কমুনে।
কিন্তু আপনার গল্পটা? তার কি হবে?
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মূলত পাঠক এর ছবি

আমার আবার কী গল্প?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আপনার কল্যাণে অনেকগুলো রূপকথা পড়া হচ্ছে

না হলে এই কুত্তাদৌড়ের জীবনে আর কোনো রূপকথার গল্প পড়ার জন্য কেনা হতো কি না জানি না

তুলিরেখা এর ছবি

রূপকথা পড়ছেন জেনে ভালো লাগছে।
কিন্তু আপনার কাছে যে সিলেটী "কচ দেবযানী " কত দিন থেকে শুনতে চাচ্ছি, সেটা দিবেন কবে?
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

চলুক

তুলিরেখা এর ছবি

হাসি
বুইড়া আঙুল দেখান ক্যা?
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।