আকাশপরী

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: মঙ্গল, ১৪/০৭/২০০৯ - ৬:২০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম ওকে দেখেছিলাম খুব ছোটোবেলা। একদিন যখন দুষ্টামীর শাস্তি দিতে মা গুমগুম করে আমার পিঠে জোরে জোরে কিল মেরে অন্ধকার ঘরে বন্ধ করে রাখলো, তখন ভয়ে আর ব্যথায় ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে আকাশপরীকে ফুটে উঠতে দেখেছিলাম, পরীর আকাশীনীল রঙের পাখা দুখানা কি নরম, আমার কাঁধের কাছে ওর পাখার ছোঁয়া লাগছিলো। পরী আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলো, "এই রিখু, এই বোকা, কেন কাঁদছিস? অন্ধকার বলে ভয় পাচ্ছিস? কই অন্ধকার, এই দ্যাখ কেমন আলো।" আমি তাকিয়ে দেখেছিলাম গভীর দু'খানা কালো চোখ, নরম পাতলা ঠোঁটে স্নিগ্ধ কোমল হাসি-- আমার আকাশপরী।

কান্নাটান্না সব ভুলে চোখ বড়ো বড়ো করে দেখেছিলাম পরীর ডানা দু'খানা থেকে কোমল নীল আলো বেরিয়ে আসছে। পরী বলেছিলো, "কাঁদিস না, আয় আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, তুই ঘুমিয়ে পড়।" আমি সেদিন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম পরীর ঘুমপাড়ানি গানে আর নরম হাতবুলানোয়। পরে মা বলেছিলো আধাঘন্টা পরে দরজা খুলে মা নাকি দেখেছিলো আমি মেঝেতে শুয়ে ঘুমাচ্ছি আরামে। ঐ ঘটনার উল্লেখ করে মা পরে সবাইকে বলতো," রিখুর খুব সাহস, অন্ধকারে ভয় পায় না। একদিন ওকে শাস্তি দিতে অন্ধকার ঘরে ... " বলে সেই গল্প শুরু করতো। আমার কেমন একটা মজা লাগতো,ও গল্পের আসল অংশটাই তো মা জানে না!

আমি কখনো মাকে আকাশপরীর কথা বলিনি, বাবাকেও না, অন্য কাউকে না, এমনকি খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাউকেও না। অবশ্য সেরকম ঘনিষ্ট বন্ধুই বা কোথায় ছিলো আমার! শুধু মোহর ... থাক, মোহরের কথা পরে।

তারপরে যখনি কোনো ভয়ের বা দু:খকষ্টের মুহূর্ত এসেছে, তখনি আকাশপরীকে দেখতাম। পড়া না পেরে বাবার হাতে মার খেয়ে যখন নিজের ঘরে গিয়ে মনখারাপ করে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকতাম, তখন পরী এসে নরম হাত বুলিয়ে দিতো। একবার অঙ্কে খুব কম নম্বর পাওয়ায় বাবা আমায় খুব মেরেছিলো। পিঠে বেতের পর বেত মেরে ডোরা ডোরা করে দিয়েছিলো, সেই রাত্রে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। আমি নিজের ঘরে ব্যথায় আর খিদেয় কাঁদতে কাঁদতে দেখতে পেয়েছিলাম পরী এসে শিয়রের কাছে বসেছে, হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আমার ব্যথাদাগগুলোয়, বলছে,"ঈশ, এমন করে কেউ মারে নাকি? ছি ছি ছি।" আমি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

"ঋজুরেখ বসু"---নাম ঘোষনা হতেই দিবাস্বপ্ন কেটে যায়, এগিয়ে গেলাম, আবৃত্তি প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ হচ্ছে আজ, আমি প্রথম পুরস্কার পাবো। মঞ্চে ওঠার সময় পা কাঁপে আমার, মুখ ফিরিয়ে একবার পিছনে দেখি, পরী হাসছে। হাতের অভয়-ভঙ্গী করে এগিয়ে যেতে বলছে। আবৃত্তি প্রতিযোগিতার দিনও ছিলো পরী, এমনি করেই সাহস দিয়েছিলো।
***

সে বড়ো গরম দেশ, আমাদের দেশের বাড়ীর গাঁ। রোদ্দুর চড়ে উঠতো ফাল্গুনের শেষেই, মাঘের শেষ থেকেই রাগী হয়ে উঠতো, তারপরে চৈত্র বৈশাখে একেবারে তপতপে অবস্থা। গ্রীষ্ম কত দীর্ঘ হয়ে গেছিলো, বর্ষা গড়িয়ে যেতো শরতের বুকের উপর দিয়ে হেমন্ত ছেয়ে। তারপরে খুব সংক্ষিপ্ত শীত আর বসন্তের এক ঝলক শেষেই আবার চড়া গ্রীষ্ম।

শীতে মোড়া বিভুঁইয়ে এখনো কত ঠান্ডা, কত বরফ, তুলোর মতন তুষার ঝরে ঠান্ডা ধূসর আকাশ থেকে, আমাদের বিস্মৃত শ্বেতপ্রভুদের দ্বীপে বিষন্ন সকাল সন্ধ্যা বয়ে যায়,এখন উল্টোযাত্রায় আমরাই সেখানে গিয়ে থাকি, কাজ করি, সুতো জড়াই আর সুতো খুলি আর ভুলে যাওয়া শিশুকালের কথায় দু:খবিলাস করি।

এই তো যেন সেদিনের কথা। শুকিয়ে আসা খালের পারে ক্ষীর-কাঁঠালের গুঁড়িতে বাঁধা নৌকার কাছি খুলে ফেলি, পার থেকে লাফ দিয়ে নৌকার খোলে নামে মোহর, খিল খিল করে হাসে। বলে,"রিখু, আজকে বংশীকাকা জানতে পারলে তোর রক্ষা থাকবে না।" কাকার মুখ মনে পড়ে, রাগী রাগী চোয়াড়ে মুখ, শক্ত শক্ত হাত, কালকে চড় খেয়ে ঘুরে পড়ে গেছিলো নুটুদা, কাকার ছেলে। গালে কাকার পাঁচ আঙুলের ছাপ পড়ে গেছিলো নুটুদার। অথচ একটু পরেই কাকা বেরিয়ে যেতে দিব্যি গিয়ে পেয়ারা গাছে চড়লো, এরকম মারধোর খাওয়া নাকি অভ্যেস আছে এদের।

কাকার কথায় কেন জানি বাবার মুখ মনে পড়ে, এমনি সময়ের মুখ না, শুক্কুরবারের সন্ধ্যেবেলার গুমোট মুখ, লাল লাল চোখ, উস্কো চুল, ভয় লাগে ঐরকম মুখ দেখলে। সেদিন ওদের ঘরে যাই না আমি, শুধু একদিন মায়ের কান্না শুনে ছুটে গিয়ে বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেছিলাম ... থাক, সে না বলাই ভালো।

মোহরের দিকে চেয়ে হাসি, তারপরে শক্ত গলায় বলি,"কিছু হবে না, চল। মোহর, তুই যে বলেছিলি আমায় ইন্দিরবিলের কচুরিপানাফুল দেখাবি?"

মোহর লগি নিয়ে জলে টান দেয়, নৌকা দুলে ওঠে, জলের উপর দিয়ে এই ছোট্টো ডিঙি এগিয়ে চলে। ডিঙা বায় মোহর, ওর চুলে খেলা করে হাওয়া, ওর চোখের তারায় পশ্চিমের রাঙামেঘগুলোর ছায়া পড়ে, ওর গলায় অচেনা মোচড় লাগে যখন ও বলে, "রিখু, কদিনের জন্য দেশের বাড়ী বেড়াতে আসিস, আবার চলে যাস, অনেক বড়ো হয়ে গেলে হয়তো আর আসবিই না, নারে?"

আমার বুকের ভিতরে কেমন মোচড় লাগে, মনটা কেমন আনচান করে ওঠে, কেজানে কি হবে ভবিষ্যতে। ভাসা-ভাসা আলগা আলগা মেঘের ছায়ার মতন দূর দূর দূর কোনো দেশের গল্প মনে পড়ে, বাড়ী থেকে পালিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে, ওখানে পরিচিত কেউ নেই, কোনো শাসন নেই, অত্যাচার নেই, ওখানে খুব মিঠা হাওয়া, ওখানে খুব নরম অমলতাসের ফুলের মতন দিন, ওখানে আমি আর মোহর ...

জোর করে দিবাস্বপ্ন থেকে মন ছাড়িয়ে আনি, মোহরের কালো চোখের তারায় আকাশের বিচিত্র আলো ... গরম রক্ত আমার মুখচোখকান হাত ভরিয়ে তোলে, ডিঙা এসেছে হিজলের ছায়ায়, আমি মোহরের দিকে তাকাই, দেখতে পাই আকাশপরীকে, ওর দু'খানা ডানা থেকে নীল আলো বেরিয়ে আসছে, ওর ঠোঁটে অভয়হাসি, সেই হাসিতে কাছে যাবার আহ্বান, আমি এগিয়ে যাই, ঝুঁকে পড়ি পরীর দিকে, আমার দুখানা বাহু পরীর শরীর ঘিরে ধরে নিবিড় করে, আমার মুখ নেমে আসে পরীর হাসির উপরে ...

কতক্ষণ কেটেছিলো জানিনা, সম্বিত ফিরে পাই মোহরের ফুঁপিয়ে কান্নায়, পোশাক গোছাতে গোছাতে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মোহর , কিছু বলছে না। পরী কোথায় গেলো, আমার আকাশপরী? উত্তরে দক্ষিণে পুবে পশ্চিমে তাকাই অস্থির হয়ে, নেই, নেই, আকাশপরী নেই। কোত্থাও নেই, কোথাও না। দূরে দূরে যতদূর পারি দূরে চেয়ে দেখি, নেই কেউ কোথাও নেই, নেই সেই আকাশীনীল ডানার আলো, নেই সেই স্বপ্নভরা চোখের সস্নেহ প্রশ্রয়, পরী উড়ে গেছে আমাকে কাদায় ফেলে রেখে।

এলোমেলো চুল, এলোমেলো ওড়না ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদা মোহরের দিকে তাকাই, ঝড়বৃষ্টির পরের ফুলবাগানের মতন বিধস্ত লাগে ওকে। কখন এমন হলো? কেন হলো? কেমন করে হলো?

আমরা ফিরে আসি, সন্ধ্যে হয়ে গেছিলো বেশ, ভয়ে ভয়ে বাড়ী ফিরি। খুড়তুতো দাদা নুটুর সঙ্গে দেখা, সে পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে নিয়ে গেলো, বললো সামলে দেবে। সামলে দিলো সত্যি, রাতের খাওয়াদাওয়া নির্বিঘ্নে হয়ে যাবার পরে নুটুদার ঘরেই শুয়ে পড়লাম যেমন শুতাম। ক্লান্তি চোখের পাতা আঠার মতন জুড়ে দেয় কিন্তু কেন জানি ভালো করে ঘুম আসে না। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম, ছেঁড়া ছেঁড়া জাগরণ। একবার উঠে কলসী থেকে গেলাসে জল গড়িয়ে খাই, ভিতরে কী যে বালি বালি তৃষ্ণা!

অবশ করা বেদনা শরীরে, ঘুমের তৃষ্ণা চোখেমুখে। মনে হলো জলের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি, নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হলো যেন আকাশ দিয়ে শত শত কালো কালো ডানা উড়ে যাচ্ছে, আলো ঢেকে যাচ্ছে। অচেনা একটা ভয়ের ছমছমি আমাকে আমূল কাঁপিয়ে তুলছে। গলা চিরে চিৎকার করতে চাইছি কিন্তু কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না গলা দিয়ে।

"কি হয়েছে রিখু, কি হয়েছে? বোবায় ধরলো নাকি? উঠে বস রিখু, উঠে বস।" চোখ মেলি, নুটুদা আমার হাতে নাড়া দিয়ে ডাকছে। স্বপ্ন ছিলো সব।
আমি উঠে বসি, ঘামে মাথা গলা পিঠ বালিশ বিছানা ভিজে গেছে।

বিছানা থেকে নামি, নুটুদা গামছা এগিয়ে দেয়। ঘাম মুছে ফেলি। জলভরা গেলাস দেয়, জল খাই। তারপরে দরজা খুলে বাইরে খোলা হাওয়ায় দাড়াই দু'জনে।

"কি হয়েছে তোর, রিখু?" নরম গলায় জিজ্ঞেস করে নুটুদা।

আমি দু'দিকে নাড়াই মাথা, না কিছু তো হয় নি!

পরদিন ওবাড়ী থেকে চলে আসি, যদিও গ্রীষ্মের ছুটি তখনো অনেকদিন বাকী ছিলো। বিদায় নেবার সময় মোহরের সঙ্গেও দেখা হয় নি আর। তারপর কেটে গেছে কতকাল, সে যে কতকাল ...

আকাশপরীকে আর দেখতে পাই নি। আর কোনোদিন না। কাউকে কিছুই বলা হয় নি কোনোদিন, দেশের বাড়ীতে আর যাওয়াও হয়নি। পরের বছর থেকে পড়াশোনার চাপ বেড়ে গেলো যে! মাধ্যমিক কাছিয়ে এলো। বাবামায়ের সঙ্গেও দূরত্ব বেড়েই চললো, কিসের যে এক না বলতে পারা অভিমান ছিল! কোনোদিন আর ঘুচলো না আমাদের ব্যবধান!

যে দিন ভিন দেশে চলে আসতে হলো , সেদিন ও তেমন কোনো বেদনা ছিল না আমার নিজের দিক থেকে। এক চাবড়া ঘাস যেমন সহজে উঠে আসে, তেমনি সহজ সাবলীল চলে যাওয়া আমার। যেন কিছুদিন অতিথি ছিলাম, ফিরে যাচ্ছি। আগের রাতে আমার ঘরে একলা এসে অপ্রত্যাশিত কোমল গলায় বাবা বলেছিলো, "রিখু, তোর উপরে হয়তো অনেক অন্যায় করেছি, যদি পারিস, মাফ করে দিস। আর .. আর যদি কোনোদিন ইচ্ছে করে কোনো সুখদু:খের কথা শেয়ার করতে, বলিস আমায় খোকা। আমায় বলিস। "

আগে কোনোদিন খোকা বলে নি, সেদিন বললো, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলো, আমার একেবার ইচ্ছে হচ্ছিলো ওঁর কোলে মুখ গুঁজে দিয়ে খুব কাঁদি, অনেক কেঁদে বুকের পাথর সবটুকু গলে গেলে তারপরে বলে দিই সব। আমার সমস্ত দু:খকষ্ট আমার ভুল ঠিক, আমার সমস্ত পাপপুণ্য সব। আকাশপরীর কথাও, আকাশপরী যে আর আসে না, সে কথাও। কিন্তু পারলাম না। কঠিন অভিমান আমার দু:খকে আগলে দাঁড়িয়ে রইলো প্রহরীর মতন।

***

ঠান্ডা ধূসর আকাশ থেকে অদ্ভুত বিষন্ন বৃষ্টি পড়ছে, অবিচ্ছিন্ন অশ্রুর মতন, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে আসে, জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আমি দেখতে থাকি পথবাতিগুলির জ্বলে ওঠা, একের পর এক। এইখানে কয়েক মাস হলো এসেছি, এই দ্বীপরাজ্যের আবহাওয়া নাকি প্রায় সারাবছরই এমন ছিঁচকাদুনে বৃষ্টি আর বৃষ্টি। বন্ধুবান্ধব যারা থেকেছে সকলেই এই নিয়ে বিতৃষ্ণ। কী জানি আমার থাকতে হয় কতবছর।

মনে পড়ে রৌদ্রতপ্ত দিনের শেষে কালবৈশাখী, জটামেলা মেঘেভরা আশ্চর্য আকাশ, সেখান থেকে নেমে আসা ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি।আমি আর মোহর ... মোহর..... এখন কোথায় সে? কোনো খোঁজ আর রাখা হয় নি, দেশের বাড়ীতেই তো আর যাই নি সেই ক্লাস এইটের পরে।

তারপরে কোথা দিয়ে কেটে গেছে কত কত বছর-সময়ের ঘূর্ণীজল সরিয়ে দেখতে চাই, মোহরকে। দেখতে চাই সেই কবে যেন চিরকালের মতন হারিয়ে ফেলা আমার সেই আকাশপরীকে!ওর সেই দুখানা আকাশীনীল রঙের নরম ডানা ... আর কি কোনোদিন সে আসবে না? কোনো রূপবতী বৃষ্টির বিকেলে আমি আর মোহর যদি একসঙ্গে ভিজতে পারি ...

চোখ বন্ধ করে ধূসর আকাশের বিষন্ন বৃষ্টি থেকে আলাদা হয়ে যাই, মনে পড়ে দীর্ঘ এক উড়ান। হাওয়াই জাহাজ রানওয়ে দিয়ে ছুটছে আর ছুটছে ... একসময় মাটি ছেড়ে উঠে পড়লো। পাশের সীটে মোহর, মোহরের নরম হাতখানা শ্বেতকপোতীর মতন আমার কোলে আশ্রয় নিলো ...
চোখ মেলে দীর্ঘশ্বাস মুক্ত করে দিই। কোথায় বা মোহর ? হয়তো দূরে কোনো শান্ত জনপদে একটি সুলক্ষণ সুন্দর ঘরকন্যা পেতেছে-হয়তো উঠোনে খেলা করে বেড়ায় চুন্নিমণি শিশুরা।
ক্যারোলিন এসে কাঁধে টোকা দেয়, "রিখু, কি হলো ডিনারে যাবে না? নাকি আজকে বাড়ী যাবে?"

আমি বলি, "চলো তবে যাই। বাড়ীতে তো যাবো সেই মাঝরাতে।"

ক্যারোলিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়াটাও বেশ আশ্চর্য। আমার মতন স্বল্পভাষী, অন্তর্মুখী, লাজুক মানুষের এত তাড়াতাড়ি বিদেশিনী বান্ধবী হয়ে যাবার কথা নয়, ক্যারোলিন নিজে উদ্যোগী হয়েই বলা যায় বন্ধুত্বটার সূচনা ও প্রস্ফুটন দুইই করে চলেছে।

একদিনের কথা মনে হয়। তখন আমি নতুনই বলতে গেলে। ক্যারোলিনের সঙ্গে ক্লাসে আলাপ হয়েছে, কিছুদিন কথাবার্তাও হয়েছে। একদিন ওকে দেখলাম বাইরে পাথরের বেদীতে বসে আছে। ওর কোমল তরুণীমুখের পাশে লতিয়ে আছে ভেলভেট ফুলের লতাটি, নরম সুখস্পর্শ ফুলগুলি ওর গালের ওপরে এসে পড়ছে হাওয়ায়। হাওয়ায় ওর সোনালী চুলের গোছাও উড়ছে আলতো আলতো করে।

ক্যারোলিনকে ছেঁড়া পুরানো পোশাকে এলোমেলো চুলে কল্পনা করতে চেষ্টা করি, কিন্তু তাতেও ওর রূপ এতটুকু কমে না। এমন সাদাতে গোলাপীতে মেশানো মুখের রঙ! এমন নিঁখুত করে গড়া নাক মুখ চোখ! নীল চোখের ভিতরে আলো জ্বলছে। ওকে ক্লান্ত ক্ষুধার্ত তৃষ্ঞার্ত কল্পনা করি, তাতেও রূপ কমে না ওর।

ও বলেছিলো একসময় নাকি খুব কঠিন অবস্থা গেছে ওর, রোজ খেতে পেতো না, ছেঁড়া পোশাক পরতে হোতো। কিন্তু এই আকাশচ্যুত বিদ্যুতের মতন সুন্দরী কি তাতে ম্লান হয়? আমার দু:স্বপ্ন যত দূর যেতে পারে, চেষ্টা করি ততদূর খারাপ অবস্থায় ওকে কল্পনা করতে, কিন্তু সামনে ফুলে ছাওয়া শ্বেতপাথরের বেদীটিতে এলিয়ে বসা হাসিমুখ তরুণীটির চেয়ে কোনো মতেই বেশী ম্লান হয় না আমার কষ্টকল্পনার ক্যারোলিন। এত সৌন্দর্য দর্শকের বুকের ভিতরে একধরনের কষ্ট তৈরী করে। অচেনা কষ্ট। পৌষের ফিনিক ফোটা জ্যোৎস্নায় জেগে উঠে পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ি পড়ি করেও যখন পড়ে না, তখনকার মতন কষ্ট। আমরা চলতে থাকি, ক্যারোলিন কথা বলতে থাকে, আমি চুপ করে শুনতে থাকি। বুকের ভিতরের কষ্টপাথরটা নড়ি নড়ি করে ওঠে যেন।

ভালোবাসার নীল আলো একদিন আকাশভরে ফুটে উঠবে, ঐ আকাশপরীর ডানা দু'খানির মতন। ততদিন শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। আমরা মানুষেরা অপেক্ষা করতে চাই না, তবু অপেক্ষা করতে হয় কেবলই অপেক্ষা করতে হয়। আরোগ্যের অপেক্ষা, শান্তির অপেক্ষা, ভালোবাসার অপেক্ষা ...

*** (শেষ)


মন্তব্য

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

চলুক

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

তুলিরেখা এর ছবি

থ্যাংকু শাহেনশাহ সিমন।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

স্নিগ্ধা এর ছবি

তুলিরেখা, এই লেখাটিকে আমার পড়া আপনার লেখাগুলোর মধ্যে নির্দ্বিধায় প্রথম স্থানটা ছেড়ে দিলাম! অসম্ভব ভালো লাগলো!

তুলিরেখা এর ছবি

থ্যাংকু স্নিগ্ধা।
আপনি উদার হৃদয় বলে এমন বললেন,ভালো লাগলো শুনে।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মূলত পাঠক এর ছবি

ক্লান্ত হয়ে গেছি আপনার লেখার প্রশংসা করে করে। হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

তেড়েঝেড়ে নিন্দা করতে পারেন না? তাহলে দেখবেন একটা কেমন স্পোর্টিং স্পিরিট এসে যাবে, একেবারেই ক্লান্ত লাগবে না।;-)
সমালোচনায় একটা আগুনঝাল শুকনা মরিচের মতন স্পিরিট থাকে, খুবই উপভোগ্য। দেঁতো হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মূলত পাঠক এর ছবি

সে কি আমার দোষ? আপনি মাঝে মাঝে বাজে লেখা লিখলেই আগুনঝাল মরিচ খাওয়াতে পারি, সুযোগই তো দেন না। আজ আবার আরেকটা জঘন্য লেখা লিখেছেন দেখলাম।

তুলিরেখা এর ছবি

উদার হৃদয় বলে এমনই উদার হলেন যে মরিচ দেওয়া ভুলে গেলেন? হায়, কে আর আপনার রান্না খাবে? ঝালের প্রস্তুতি নিয়ে খেতে বসে দেখবে চিনি দেওয়া চিকেন! মন খারাপ
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তানবীরা এর ছবি

শেষ কেনো করছো তুলিদি, ক্যারোলিনকে নিয়ে আর একটা পর্ব হয়ে যাক

---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

তুলিরেখা এর ছবি

আসবে আসবে সবই আসবে। হাসি
ক্যারোলিন মেরিলিন আর্লিন সবাই লাইন দিয়ে আসবে। একটাই ভয়, ধূ গো র অবস্থা কি হবে, শেষে কি ছেলেটার মাথাটা যাবে?
ভেবে দ্যাখো, এরা তো সকলেই কারুর না কারুর নিজের বা কাজিনতুতো শ্যালিকা বা ননদ তো বটে! চোখ টিপি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

রানা মেহের এর ছবি

এতো স্নিগ্ধ একটা লেখা
খুব ভালো লাগলো পড়ে
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ রানা মেহের।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

জাহিদ হোসেন এর ছবি

একটি অসম্ভব মন কেমন করা লেখা। ভারী ভালো লাগলো। আগে দৃ্ষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল কি করে যেন।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ জাহিদ।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

আয়নামতি এর ছবি

মনের মুকুরে আজ তোমার দুটো লেখা এসেছে দিদি হাসি এটা পড়া ছিল না।
নরম আলোর মত কোমল আর সিগ্ধ লেখা রে দিদি! কিভাবে লিখো জান্তে ইচ্ছে হয় চিন্তিত

তুলিরেখা এর ছবি

এই গল্পটার কথা ভুলেই গেছিলাম। হাসি
পড়ার জন্য ধন্যবাদ তোমাকে।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।