সাংগ্রিলা ( ৫ )

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: রবি, ২৬/০৭/২০০৯ - ২:২৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৫।

"আকাশের চাবি,আকাশের চাবি ... " কোথায় শুনেছিলাম এই আশ্চর্য কথা দুটো? আকাশের কি চাবি হয়? তালার চাবি হয়, কোনো কোনো বাদ্যযন্ত্রের চাবি হয়, কিন্তু আকাশের চাবি? কে বলেছিলো আকাশের চাবির কথা? আরেনুশ বলেনি জানি, তবে কে বলেছিলো? আমার সেই পাহাড়ী গাঁয়ের সেই আধপাগল বন্ধুটা, নিজনি?

প্রদীপের কাঁপা কাঁপা আলোয় আস্তে আস্তে আগুনপাখীর ডানায় কমলা রঙ বুলাতে বুলাতে বারে বারে কেন ফিরে আসছে ফেলে আসা সেই গাঁ, সেইসব ঋতুতে ঋতুতে নতুন নতুন গাছে নতুন নতুন ফুল ফুটে ওঠা সেই প্রিয় জনপদ? আরেনুশ বলেছিলো আমাদের নতুন দেশে নতুন জীবন হবে, আমাদের সামনে খুলে যাবে গোটা দুনিয়া, আমাদের সুযোগ বেড়ে যাবে অনেক৷ অসহায়ের মতন আক্ষেপ করতে হবে না শুধু অর্থাভাবে কতকিছু করা হয়ে উঠছে না, নিজেদের আর বন্দী বলে মনে হবে না৷

আমি আরেনুশের কথায় সায় দিয়েছিলাম, শুধু ওকে খুশী করার জন্য নয়, নিজেরও সেইসময় তাই মনে হয়েছিলো৷ এখন হঠাৎ হঠাৎ মাঝে মাঝে মনে হয় এই জীবন কি চেয়েছিলাম?

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রির ডানায় ঢুকে গেলে ক্লান্ত পাখির মতো যে যার বাসায় ফিরে যাই, আরেনুশ আসে ওর দূর মিনারের প্রান্তর থেকে৷ এত ক্লান্ত যে কথা বলতেও ইচ্ছে করে না, কোনোরকমে ভাগাভাগি করে রান্নাবান্না করে দুটো খেয়েই আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ি, আধোঘুমে আরেনুশ পাশ ফেরে, আমিও ফিরি ... কিন্তু সেই পাহাড়-অধিত্যকায় রেখে আসা জনপদটি আমাদের মাঝখানে এসে দেখা দেয়, আমি ভেঙে পড়লে ও আমাকে সান্ত্বনা দেয়,ও ভেঙে পড়লে আমি ওকে ...সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে ... আমরা এখনো তাজা অনেক, এখনো তাই সতেজ আমাদের আশাবাদ, কিন্তু আস্তে আস্তে তাপ কমে আসবে, তখন কি হবে?

গভীর অতীতের বুক থেকে সেই রহস্যময় গিরিগুহার প্রত্নমানব প্রত্নমানবীরা আমাদের আশা যুগিয়ে চলেন, তোমরা ভয় পেয়ো না তোমরা ভয় পেয়ো না, আমরা তোমাদের পাশে আছি৷

আমরা উঠে পড়ি শেষরাত্রে, সকালের কাজকর্ম আর স্নান-টান তখনি সেরে, অল্প কিছু খাবার বানিয়ে উপবাসভঙ্গ করে তারপরে হোমওয়ার্ক করতে বসি৷ শেষরাত আর ভোর ছাড়া আর সময়ই বা কোথায়? রাত্রে করতে পারি, কিন্তু চেষ্টা করে দেখেছি সারাদিনের ক্লান্তির পরে রাত জেগে কাজ করলে কাজ ভালো হয় না৷ আরেনুশও পারে না রাত জাগতে, তাই আমরা হোমওয়ার্কের জন্য বেছে নিয়েছি শেষরাত আর প্রথম ভোর৷ হোমওয়ার্কে পরস্পরকে সাহায্যও করতে পারি আমরা৷ ঘন্টা তিনেকের নিটোল সময় পাওয়া যায় সকালে, ঐসময় অনেক কাজ হয়, তারপরে কাগজপত্তর পাথরপাটা রঙ তুলি টিফিন সব গুছিয়ে নিয়ে আমরা ক্লাস করতে চলে আসি৷ এইভাবেই নতুন অভ্যেসের ছকে আস্তে আস্তে খাপে খাপে বসে যাচ্ছে আমাদের জীবন৷

কিন্তু গতকাল মাঝরাতে আরেনুশ ঘুম ভেঙে আমায় আস্তে আস্তে ধাক্কা দিয়ে ডাকে," ওরিয়ানা, ওরিয়ানা, ওঠো ওঠো৷ "

আমি জেগে গিয়ে অবাক হয়ে যায়, এতরাত্রে ডাকলো কেন, কোনো সাংঘাতিক কিছু ঘটলো নাকি? আরেনুশ উঠে বসেছিলো, চিন্তিতভাবে তাকিয়ে ছিলো জানালার দিকে, জানালার বাইরে নিকষকালো আকাশ, অসংখ্য তারা তাতে৷ শন্‌শন্‌ করে রাত্রি বয়ে যাচ্ছে৷ আমি উঠে বসে আরেনুশকে বললাম," কি হলো, হঠাৎ ডেকে তুললে কেন এই মাঝরাত্রে? কোনো জরুরী কিছু?"

আরেনুশ কথা না বলে বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গেলো, খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো বাইরে চেয়ে, তারপরে মুখ ফেরালো, আমিও গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম ওর কাছেই, ও বললো, " ওরিয়ানা, আমার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে, প্রথম থেকেই হচ্ছে, এতদিন গ্রাহ্য করিনি, এখন মনে হচ্ছে কিছু করা দরকার৷"

আমি চমকে উঠলাম, ওরও অস্বস্তি হচ্ছে! আমারই শুধু না তবে? জিজ্ঞেস করলাম, " কি অস্বস্তি? এখানে ভালো লাগছে না? ফিরে যেতে চাও?"

ও বললো," ঠিক তা নয়, ক্লাস করতে ভালো লাগে, কাজ শিখতে আর কাজ করতেও, কিন্তু .... কিন্তু কোথায় যেন তীক্ষ্ণ কাঁটার মতন একটা অস্বস্তি, মনে হয় ... কিজানি হয়তো আমার মনের ভুল৷"

আমি বললাম," আমারও অস্বস্তি হয় মাঝে মাঝে, আমার মনে হয় কেউ আমাদের যেন লক্ষ্য করছে, যেন ছাঁচে ফেলে দেবার চেষ্টা করছে, যেন একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে ... কিন্তু হয়তো মনের ভুল, হয়তো তা না৷ কিন্তু তোমার ও ওরকম মনে হয়?"

আরেনুশের চোখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করে উঠলো মনে হলো, "একদম তাই৷ আমারও মনে হয় যেন একটা ঘোরের মধ্যে ফেলে দেবার চেষ্টা করছে কেউ, জোর করে বেরিয়ে আসছি বারে বারে, কিন্তু ভয় হয় একদিন হয়তো আর পারবো না৷"

আমি আরেনুশের হাত ধরলাম, হাতে অল্প চাপ দিয়ে বললাম," ভয় করে কি লাভ আরেনুশ? যদি সত্যি ই কিছু ব্যাপার থাকে, কিই বা করতে পারবো? কতটুকুই বা শক্তি আমাদের? কিন্তু আমরা পাশাপাশি থাকবো, পরস্পরকে সাহায্য করবো৷ তেমন তেমন বুঝলে দেশে চলে যাবো, সেই পথ তো বন্ধ নয়! সেখানে যা করতাম, তাই করবো আবার, দুজন মানুষের সহজসরল জীবন কোনোভাবে চলে যাবে৷ ভয় করে লাভ নেই আরেনুশ৷ এভাবে রাত জেগে নিজেদের ক্লান্ত করেও লাভ নেই৷ এসো ঘুমাই৷"

ও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো৷ আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম৷

(চলবে)


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মূলত পাঠক এর ছবি

খাসা।

মুস্তাফিজ এর ছবি

জটিল

...........................
Every Picture Tells a Story

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।