ইমনকে লেখা চিঠি

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: শনি, ২৮/১১/২০০৯ - ৫:১৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ইমন,

চন্দনকাঠের যে বাক্সটায় তোমার সব চিঠিগুলো রেখেছি, সেই বাক্সটার গন্ধ অপূর্ব! তোমার চিঠির কাগজেও সুন্দর গন্ধ থাকতো! হাল্কা গোলাপী পাতায় গোলাপের গন্ধ! হাল্কা কমলা ছোপ দেওয়া সাদা রঙের পাতায় শিউলির গন্ধ! সব এখনো আছে। পাতাগুলো পুরানো হয়ে এসেছে, লেখাগুলো ম্লান হয়ে এসেছে, গন্ধ ফিকে হয়ে এসেছে, কিন্তু আছে।

ইমন, তুমি যেখানে চলে গেছ, সেখানে বকুলগাছ আছে? বকুলফুলের গন্ধ পাও আজো তুমি? ফুলের সময়ে বকুলফুল রুমালে জড়িয়ে রেখে দিতাম ছোট্টো ব্যাগটার মধ্যে, মাঝে মাঝে মনে হয় সেই সুরভীসার আজো বুঝি রয়ে গেছে সেখানে।

আমাদের বাড়ীর গেটের পাশে দু'খানা কামিনীফুলের গাছ ছিলো। সে ফুলের গন্ধে তুমি কেমন উদাস হয়ে যেতে। আর উঠানের বাঁদিকে কলাবতীঝাড়ের কাছেই ছিলো শিউলি গাছটা। শরতের ভোরের বেলা সে গাছের তলা সাদা হয়ে থাকতো ফুল ঝরে। তুমি শুধু সেই জন্যই আসতে সেইসব শিশিরভেজা সকালে।

ইমন, সুন্দর গন্ধের দিকে তোমার আকর্ষণ ছিলো অপরিসীম! প্রায় অবসেশন! সুন্দর গন্ধের সবকিছু নিয়ে কত কথা বলতে তুমি! তুমি বলতে ফুটন্ত ভাতের গন্ধের মতন সুন্দর গন্ধ আর নেই, কলাপাতায় ধোঁয়াওঠা ভাত উপরে একটু ঘী, এরো গন্ধ সুন্দর। নিবু নিবু গরম মাটির উনুনে এক আঁজলা জল, সেই গন্ধ! হ্যারিকেন লন্ঠনের কেরোসিনের গন্ধ! সেও সুন্দর। শুকনো গরম মাটির উপরে প্রথম বৃষ্টি, সেই সোঁদা গন্ধ! কী অপূর্ব সুন্দর!

গরম তেলে ফোড়ন দেয়ার গন্ধ, তারপরে ডাল ঢেলে দেবার পরে সেই গন্ধ বদলে যেতে থাকা, এর সঙ্গে ছ্যাঁৎ করে ওঠা শব্দটার অদ্ভুত এক সাউন্ড এফেক্ট! নতুন আলুসেদ্ধ তেল দিয়ে মাখা, সর্ষের তেলের ঝাঁঝঝাঁঝ গন্ধ আর একটা তেলমাখা সবুজ লংকা, গরম ভাতের পাশে। সব মিলিয়ে কেমন একটা ঘ্রাণ, খিদে পাইয়ে দেয়। সরু করে কাটা আলুর ঝুরিভাজার গন্ধ আবার আরেকটু অন্যরকম। ফুলের মতন ঝিরি ঝিরি করে করে কেটে ডুবো তেলে ঝিঙাভাজা, তার গন্ধটাও মনে পড়ে।

তোমার সঙ্গে মিশে মিশে আমারও সুন্দর গন্ধের দিকে টান হলো। আমিও অনুভবের সীমায় পেতে থাকলাম তাদের। শরত্কালের ভোরবেলার গন্ধ, বর্ষার সন্ধ্যার গন্ধ, গ্রীষ্মের বিকেলের গন্ধ, হেমন্তের রাত্রির গন্ধ ... পৃথিবী ঋতুতে ঋতুতে প্রহরে প্রহরে নতুন নতুন পারফিউম মাখে, প্রত্যেকদিন নতুন, কত আছে কেজানে ...

কেউ কি হেমন্তের মধ্যরাত্রির গন্ধ পেয়েছে? ধানের গন্ধ, ক্ষীরের গন্ধ, পিঠার গন্ধ মিলেমিশে থাকতো সেটায়। কুয়াশার গন্ধ পেয়েছে কেউ মাঘপঞ্চমীর সকালে? নিমপাতা আর হলুদের গন্ধ ছিলো তাতে। কেউ কি জৈষ্ঠ্যের মধ্যাহ্নের গন্ধ অনুভব করেছে? আমি শুকনো লঙ্কার গন্ধ পেতাম ওসব দুপুরের রোদে। আষাঢ়ের প্রথম মেঘমেদুর হয়ে আসা আকাশের গন্ধ নিয়েছে কেউ?

পায়ে পায়ে বৃষ্টি এলো, আঁচলে জড়িয়ে গেল নীল
রাঙামাটির পথটি ভেজা, ঐ যেখানে আয়নাঝিল-
সেখানে শালুকবনে কেজানি লুকিয়ে ডাকে
সেখানে পাতার ফাঁকে পানকৌড়ি ঘুমিয়ে থাকে
হঠাৎই বিজলি চোখে বুলিয়ে গেল কী ঝিলমিল!
পায়ে পায়ে বৃষ্টি এলো, আঁচলে জড়িয়ে গেল নীল-


মন্তব্য

স্বপ্নহারা এর ছবি

আপনার লেখা এত্ত সুন্দর এত্ত কাব্যিক...পড়ি আর মুগ্ধ হই! চমৎকার!

-------------------------------------------------------------
স্বপ্ন দিয়ে জীবন গড়া, কেড়ে নিলে যাব মারা!

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ, স্বপ্নহারা।
আপনার নাম স্বপ্নহারা কেন? আপনার কথা শুনে তো স্বপ্নময় বলে মনে হয়। হাসি

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

কারুবাসনা এর ছবি

একটা বাচ্চা রোদ্দুর শাড়িতে; মেয়েটা নাচ করছে, ফুলে ফুলে।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

তুলিরেখা এর ছবি

একপশলা মিহিন বৃষ্টি উঁকি দিয়ে চলে গেল হেসে। হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

শেখ নজরুল : ঈদশুভেচ্ছা

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ শেখ নজরুল।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

জুয়েইরিযাহ মউ এর ছবি

স্কুলে প্রতিবার নতুন ক্লাসে উঠার আনন্দের সাথে মিশে থাকতো নতুন বইয়ের গন্ধ।
কিছু পছন্দের গন্ধের কথা খুঁজে পেলাম এ লেখাতে।
ভালো লাগলো পড়তে।

---------------------------------------------------------
জানতে হলে পথেই এসো, গৃহী হয়ে কে কবে কি পেয়েছে বলো....


-----------------------------------------------------------------------------------------------------

" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি

তুলিরেখা এর ছবি

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মউ।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মানুষ যা চোখে দেখে তার মোটামুটি সঠিক বর্ণনা দিতে পারে। যা শুনতে পায় তার বর্ণনা ঠিকমতো না দিলেও তার পূনরোৎপাদন করে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারে। একই কথা স্বাদের বেলায়ও খাটে। কিন্তু গন্ধগুলো এমন যে সেগুলোর না বর্ণনা দেয়া যায় না পূনরোৎপাদন করা যায়। বর্ণনা যে হবে না সেতো জানা কথা। কিন্তু পূনরোৎপাদন কেন হবে না? কারণ, এক একটা পরিবেশে একটা জিনিষের সাথে আরো দশটা জিনিষের গন্ধ মিলে এক একটা ইউনিক স্মৃতি তৈরি করে। তাই আমার মায়ের বানানো ভাঁপা পিঠার স্বাদ আর আপনার মায়ের বানানো ভাঁপা পিঠার স্বাদ কাছাকাছি। কিন্তু দুই বাড়িতে পিঠা বানানোর গন্ধ - কখনোই এক না। অথচ আপনার মাথায় বা আমার মাথায় সেই পিঠা বানানোর গন্ধ চিরস্থায়ী হয়ে আছে। কখনো কোন গন্ধ তার ধারে-কাছের বলে মনে হলেই সমগ্র সত্ত্বা শিউড়ে ওঠে।

আপনার পদ্য নিয়ে মন্তব্য করা নিষ্প্রয়োজন - যে পড়েছে, সেই বুঝেছে।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তুলিরেখা এর ছবি

একদম ঠিক বলেছেন ষষ্ঠ পান্ডব। ঐ যে আলো, তাপ, রঙ, গন্ধ, মানুষজন, দিনের একটা বিশেষ সময় সবকিছু মিলে একটা আশ্চর্য কোলাজ তৈরী করে, সেটাই বুঝি রয়ে যায় স্মৃতির খাঁজে খাঁজে ভর্তি হয়ে।

বিজয়ার সন্ধ্যাবেলা, লোডশেডিং হয়ে গেছে, হারিকেন লন্ঠনের আলো দুলছে, তিনচূড়া উনানে বসানো লোহার কড়াই, তাতে তেল গরম হচ্ছে, একদিকে কয়েক ছিটে কালোজিরে ছড়ানো ময়দার লেচি থেকে চৌকোনা চৌকোনা ছোটো ছোটো নিমকী কাটা হচ্ছে, ঝরঝর করে তেলে ফেলা হচ্ছে, সোনালী বাদামী হয়ে নিমকী ভাজা হয়ে উঠছে, সবটা মিলিয়ে যে আবহ, গন্ধের সাথে জড়িয়ে সবটাই রয়ে গেছে।

আবার নারকেল সন্দেশ, নাড়ুর আর খইয়ের মোয়ার স্মৃতিতে বাতাসাফুট গুড়জ্বালের গন্ধ, হাতে তেল মেখে নাড়ু বা মোয়া পাকানোর অনুভূতি, ছাঁচের উপরে পাতলা কাপড়কুচি তার উপরে গরম নারকোল সন্দেশের হয়ে ওঠা, জিনিসটা শক্ত হয়ে গেলে আর সন্দেশ ওঠে না, নাড়ুও পাকানো যায় না, ঝুরোঝুরো হয়ে পড়ে যায়, আবার উনানে বসাতে হয়-সমস্তটা মিলিয়ে মনের কোন্‌ খাঁজে রয়ে গেছে।

আমাদের পরের জেনারেশন আর হয়তো এসব দেখবে না, গল্পকথার দেশে চলে যাবে এসব ঘরে বানানো খাবারদাবাড়ের কথা। অথচ বেশীদিন আগের কথা ও কিন্তু না।

ভালো থাকবেন।

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- হেমন্তের মধ্যরাত্তিরের গন্ধটা আমি জানি কেমন! আসলেই জানি। আমাকে বোধহয় বিধাতা অন্ধ করে তৈরী করতে গিয়ে ভুলে চোখ দুটো বসিয়ে দিয়েছিলেন। আমি সবকিছুকেই চিনি গন্ধ দিয়ে, সবকিছু। সকালের গন্ধ একরকম, দুপুর, বিকেল না সন্ধ্যার গন্ধও আলাদা। বৃষ্টি, রোদ কিংবা মন খারাপ করে থাকা আকাশ- সবকিছুরই স্বতন্ত্র গন্ধ হয়। চোখের জ্যোতি কনে যাচ্ছে, কিন্তু ঘ্রাণের শক্তি কমছে না। এখনও চোখ বুজে মাথাটা একটু উপরের দিকে তুলে নাকভরে টান দিলে একে একে সবগুলো সময়ের গন্ধ চলে আসে নাকে...
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

তুলিরেখা এর ছবি

আপনে ধূ গো, খালি ধূগোগিরি করেন। এইসব ভালো ভালো অনুভূতিগুলো নিয়া কিছু লিখেন না! আমাদের বেশীরভাগ লেখাই চোখে দেখা জিনিস নিয়ে, কানে শোনা নিয়ে সামান্য কিছু তবু দেখি, কিন্তু গন্ধ নিয়ে লেখা পাওয়াই যায় না। রূপরসশব্দস্পর্শগন্ধের এই বিচিত্র জগৎ পুরোটা ধরা পড়ে না কিছুতেই। আপনি লিখবেন কিন্তু।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর হয়েছে লেখাটা ।

অমাবস্যা

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ অমাবস্যা।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

পায়ে পায়ে বৃষ্টি এলো, আঁচলে জড়িয়ে গেল নীল
মনে মনে সোঁদা ঘ্রাণে আচানক হ'লো অন্ত্যমিল!

রাঙামাটির পথটি ভেজা, ঐ যেখানে আয়নাঝিল-
কার যেন আজ দোসর খোঁজা- শেষ হ'লো, দ্বারে পড়লো খিল!

সেখানে শালুকবনে কেজানি লুকিয়ে ডাকে
গোপনে ডাকুক মনে, অযথা জোর কে হাঁকে!

সেখানে পাতার ফাঁকে পানকৌড়ি ঘুমিয়ে থাকে
সে ঘুমায় ঘুমাক চুপে, হাওয়া যারে শোওয়ায় বুকে!

হঠাৎই বিজলি চোখে বুলিয়ে গেল কী ঝিলমিল!
ওই একটুকু শব্দ শুধু, বাকি চুপে চাপা খিলখিল!

মনে মনে সোঁদা ঘ্রাণে আচানক হ'লো অন্ত্যমিল-
পায়ে পায়ে বৃষ্টি এলো, আঁচলে জড়িয়ে গেল নীল!

___________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

তুলিরেখা এর ছবি

হাসি

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।