প্রতিলিপি(৩)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: শনি, ০৯/০১/২০১০ - ১০:০৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এখানে ২য়


নির্জন রিচার্জ-স্টেশনে একজন মাত্র লোক। গাড়ীতে এইচ ফুয়েল ভরে নিয়ে গিবান ফোন করতে ঢুকলো। স্লটে গুনে গুনে কোয়ার্টার ফেলে ওরিয়ানার নম্বরটা ডায়াল করতে গিয়ে একটু ইতস্তত করলো সে। ঘড়িতে রাত দেড়টা।

ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে ওরিয়ানা যদি না গভীর রাতের কোনো মুভি দেখতে দেখতে আটকে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডিজিটগুলো টিপে কানে চেপে ধরলো যন্ত্রটা। ওপাশ থেকে ঘুমজড়ানো গলা, একটু কি অন্যরকম শোনাচ্ছে শেষ যে গলা শুনেছিলো তার চেয়ে? একটু ভারী, একটু দানাদার!! এত ঘুমের মধ্য থেকে হঠাৎ জেগে গেলে মানুষের গলা অন্যরকম শোনাবে না?

ওরিয়ানা অবাক! তারপরে ক্রুদ্ধ। "গিবান, তুমি? এতকাল পরে? কতদিন কত বছর ফোন করোনি? এখন কী মনে করে এই মাঝরাত্তির পার অসময়ে ফোন করেছ?"

গিবান প্রবল চেষ্টায় ঠান্ডা করে ওরিয়ানাকে। মেয়েটা এমনিতেই একটু রাগী, এখন অভিমানে আরো তপতপে অবস্থা। তবে এই কথায় কথায় রাগ বলেই গিবানের ওরিয়ানাকে ভালো লাগে। ও কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে এলোমেলো চুলের মেয়েটাকে, মুখখানা গনগনে। চোখ জ্বলজ্বলে। ওর সঙ্গে তুলনায় বেশীরভাগ মেয়েকে খুব সাদাসিধে লাগে। ও সবসময় এমন দপদপ করে জ্বলে!

গিবান বললো "সকালে পৌঁছচ্ছি, সাররাত ড্রাইভ করে যাবো, সকালে বোকো না কিন্তু। একটু আদর কোরো। প্লীজ প্লীজ প্লীজ।"

ওপাশে হেসে ফেলেছে সদ্য ঘুমভাঙা ওরিয়ানা, বলছে "এখনো পাগলই আছো! কাজপাগল তো আগের মতই আছো জানি, নইলে বছরখানেক ফোন করতে মনে থাকেনা আমাকে! আচ্ছা, যদি ধরো এসে দ্যাখো আমার বিয়ে টিয়ে হয়ে গেছে অন্য কারুর সঙ্গে? "

গিবান হাসলো," তুমি প্রমিস ভাঙবে এ আমি কেমন করে বিশ্বাস করবো? আমায় প্লেনে তুলে দেবার সময় কী বলেছিলে? বলেছিলে সারাজীবন অপেক্ষা করবে, অপেক্ষা করে করে বুড়ো হয়ে মরে গেলেও কোনো আফশোষ থাকবে না তোমার। এজন্মে না হলে পরজন্মে আমাদের দেখা হবে আবার। "

ওরিয়ানা হাসলো," আর তুমি কী বলেছিলে? মনেও রেখেছ কি? "

গিবান লাল হয়ে গেলো, ওর মনে পড়েছে কী বলেছিলো ওরিয়ানাকে।

ফোন রেখে বেরিয়ে আসে সে। গাড়ী চালাতে চালাতে ক্লান্তি ছেয়ে আসে সর্বাঙ্গে গিবানের। নির্জন রাস্তা মরুভূমি চিরে চলে গেছে দূর থেকে দূরে। রিফ্লেকটরগুলো ঝকমক করে তার গাড়ীর আলোতে, পাশের নি:সীম মরুভূমিতে নক্ষত্রালোকে দেখা যায় আঁকাবাঁকা ক্যাকটাসের দীর্ঘ শীর্ণ দেহগুলো। মাঝে মাঝে মরুহ্রদ, তাতে টলটলে নক্ষত্রছবি। এরকম স্মৃতি আগে ছিলো না তার। এইভাবে সারারাত গাড়ী চালিয়ে মরু পার হয় নি সে কোনোদিন আগে। ঘুমঘুম মন নিয়ে শান্তভাবে গাড়ী চালাতে চালাতে মনটা অজানা কিসের একটা ভাবনায় ছেয়ে যায় গিবানের।

মনে হয় সে যদি শত শত কিংবা সহস্র বছর আগে অন্য কোনো জন্মে এই মরুর কোনো গাঁয়ে জীবন কাটিয়ে থাকে, তাহলে কি এখন গেলে চিনতে পারবে সেই গাঁ? সেই পাহাড়ের গুহায় আঁকা পূর্বপুরুষের স্মরণচিহ্ন, সেইসব অদ্ভুত ছবি, সেই আশ্চর্য ভাষা, আশ্চর্য বিশ্বাস!!!

ভোর হয়ে আসে পূর্বদিগন্তে। একটা অতি হাল্কা সাদা আলোর চাদর এসে পড়ে মাটিতে, সেই ক্ষীণ নীহারশুভ্র আলোয় ঢেকে যায় নক্ষত্রাবলী, হারিয়ে যায় সেই টলটলে নিবিড় রাত্রিনীল যার মধ্যে মণিকণার মতন টলমল দুলছিলো নক্ষত্রেরা, নীহারিকাসমূহ ছড়িয়ে ছিলো শুভ্র উর্ণাতন্তুর মতন! এখন শুধু দেখা যাচ্ছে দুয়েকটা অতি উজ্জ্বল তারা আর গ্রহেরা দপদপ করে জ্বলছে আকাশে, গ্রহেরা সবাই এক্লিপটিক বলে একটা কাল্পনিক লাইনের কাছাকাছি থাকে, একটু উপরে বা নীচে, খুব দূরে নয়।

পুব আকাশে গোলাপী রঙ জেগে উঠলো এইবার। ঊষা। সূর্য উঠতে দেরি নেই আর। সব তারা মিলিয়ে গেছে, গ্রহেরাও যায় যায়। কিসের একটা অজানা টানে পথের পাশে ক্যাকটাসতলায় গাড়ী থামিয়ে লক করে পাশের নামাল হয়ে এলিয়ে পড়া জমিতে নেমে এলো গিবান। ওর মনে হচ্ছিলো আরেকটু গেলেই পাওয়া যাবে কোনো গাঁ, সেই গাঁয়ে হয়তো এখনো পাওয়া যায় সেইসব পাহাড়ের গুহা, সেইসব ছবির অদ্ভুত ভাষা।

আহ, ঐ তো দেখা যাচ্ছে রুখুরুখু লালচে রঙের একটা পাহাড়,গায়ে খাঁজ কাটা, যেন নিপুণ ভাস্কর্য! অথচ শুধু বালিওড়ানো বাতাসের আঘাতে আঘাতে ঐরকম তৈরী হয়েছে, মানুষের ছেনি হাতুড়ীতে নয়, জানে সে।

হাঁটতে হাঁটতে পথ ফুরায় না, কিন্তু হঠাৎ ক্যাকটাসঝাড়ের আড়ালে দেখা দেয় ছোট্টো একটা গাঁ, পাথরের উপর পাথর সাজিয়ে তৈরী কুটির, তরমুজের ক্ষেতে মিহি সবুজ চোখ জুড়ানো, বড়ো বড়ো তরমুজও ফলে আছে,ওধারে বাজরার ক্ষেত দেখা যায়। একটি মস্ত কুয়ো, সে গিয়ে উঁকি দিলো। জল বেশ নীচে। টলটলে সেই গোল আয়্নায় অস্পষ্ট দেখতে পেলো নিজের মুখ। উফ্ফ কি তেষ্টা পেয়েছে! পাশের পাথরে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। কেউ জল নিতে আসলে জল চাইবে। কেউ কি আসবে না? চাইলে জল দেবে না?

একটি তরুণী এলো খানিকক্ষণ বাদে, চূড়া করে চুলগুলো মাথার উপরে তুলে বাঁধা, পরণে একটি খাটো খয়েরী রঙের ঘাগড়া আর গায়ে আঁটো আকাশীরঙ ছোটো ব্লাউজ। হাতে দড়িবাঁধা ছোটোবালতি আর কাঁখে একটি কলসী। সবল তেজী বাদামী পা দুটো খুশী হয়ে উঠছিলো কুয়োর দিকে যেতে যেতে।

কুয়োর জলে বালতি পড়ার মিষ্টি গভীর শব্দটা খুব ভালো লাগলো গিবানের। পাথরের পাশ থেকে উঠে মেয়েটির কাছে গিয়ে সে ঈশারায় জানালো তৃষার্ত, জল চায়। মেয়েটি অবাক হয়ে গেছিলো প্রথমে, তারপরে জলে ভরা বালতি তুলে গিবানের অঞ্জলিতে ঢেলে দিলো ঠান্ডা স্নিগ্ধ জল, পান করতে করতে অননুভূত একটা শিরশিরে ভাব সর্বশরীর ভরিয়ে তুলছিলো গিবানের। জলপান করে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে সে ফিরে চললো বড়ো রাস্তার দিকে, সেই ক্যাকটাসতলায় যেখানে ওর গাড়ীটি রয়েছে সেইদিকে। ওরিয়ানার কাছে যেতে হবে, সে অপেক্ষা করে আছে।

(চলবে)


মন্তব্য

লাবন্য [অতিথি] এর ছবি

আপনি এত সুন্দর করে কিভাবে লিখেন?

তুলিরেখা এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ লাবণ্য।

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

চমৎকার বর্ণনা..

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ অনিন্দিতা।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আবার বলতেছি... চলুক...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তুলিরেখা এর ছবি

চলবে।
অনেক ধন্যবাদ। হাসি

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- তিন খণ্ডই পড়লাম। কাহিনী পুরাই স্লো মোশনে এগুচ্ছে। কাঁচ ভেঙে বেরিয়ে আসার পর থে কূয়োর পাড়ে বসে জল পান পর্যন্ত খুব বেশিদূর কিন্তু গড়াতে পারেনি কাহিনী। তবে-

ওরিয়ানার কাছে পরে পৌঁছিয়ে আপাতত কূয়োর পাড়ে তরুণীর সাথে একটা বৃষ্টিভেজা গান বা নাচ হলে কাহিনীর নিচে চাকা লেগে যেতো। দেঁতো হাসি

আচ্ছা, এবার প্রশ্ন করি। ক্লোন গিবানের ব্যবহারে মনে হচ্ছে সে নিজেকে আসল গিবানই ভাবছে। এখানে একটা খটকা লাগে, সে যখন "ঘুম ভেঙে", নিজের গায়ে চটচট করা তরলের অস্তিত্ব টের পেলো, সে কেনো ভাবান্তরিত হলো না! যখন দেখলো তার স্মৃতিতে থাকা ল্যাব ভেঙে আছে ঝড়ের তাণ্ডবে, সে কীভাবে তখনও খুব অভিব্যক্তিহীন থেকে গেলো! সে অচেতন নিজেকেই ডিঙিয়ে এলো, অথচ একজন মানুষ পড়ে আছে, সে কি আদৌ জীবিত কীনা, সেটাও খেয়াল করলো না!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

তুলিরেখা এর ছবি

তা ঠিকই বলেছেন, একটা নাচগান হলে জমে যেত। হাসি
তবে হতাশ হবেন না, পরে অনেক কাহিনি আছে কুয়োর পাড়ে। হাসি
ক্লোন গিবান "ঘুম ভেঙে" যখন উঠলো, তখন কিন্তু তার নতুন জীবনের প্রথম মুহূর্ত, সেই সময়ে সে খুব স্টেবলও ছিলো না। আর পাওয়ার নেই, অন্ধকার, প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, সে যে বেরিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে স্নান করে ঘরে ঢুকে জামাকাপড় পরতে পেরেছে এই তো অনেক! আসল গিবান যে তখন অজ্ঞান, তাতে শাপে বর হয়েছে, নইলে নিজের বিবেকের সামনে দাঁড়ানোর কেস হতো যে! চিন্তিত
জোকস অ্যাপার্ট, আসলে ক্লোন রোপণের সময় পর্যন্ত গিবানের স্মৃতি ম্যাপ করে দেওয়া হয়েছে, তার পর থেকে তো আলাদা হয়ে গেছে দুই গিবানের স্মৃতিধারা। জেগে উঠে ক্লোন গিবান ভেবেছে সেই আসল লোক, কোনো কারণে ঘুমিয়ে ছিলো-কেউ যে সামনে পড়ে আছে, সে হয়তো দেখেছিলো, কিন্তু সেই আনস্টেবল অবস্থায় সে বিষয়ে কোনো চিন্তাই করতে পারে নি। তার তখন নিজের অসুবিধা থেকে মুক্তি পাবার ব্যাপারটাই প্রায়োরিটি! ম্যাপড স্মৃতিতে ল্যাবের ব্যাপারটাও খুব বেশী ছিলো না, পুরানো ব্যাপারগুলো বরং বেশী ইনটেন্সিটিতে এসেছে, যেটা আমরা আরেকটু পরেই দেখবো ওরিয়ানার সঙ্গে দেখা হবার পরের অংশে।

আপনার গঠনমূলক সমালোচনায় খুব আনন্দিত হলাম। প্লীজ, পরবর্তীতে ও এরকম করবেন।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নৈষাদ এর ছবি

পড়ছ...। মন্তব্য শেষে করব।

তুলিরেখা এর ছবি

পড়ছেন বলে ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মণিকা রশিদ এর ছবি

আপনার লেখায় এত মায়া...সত্যি!
____________________________
শান্তিও যদি সিংহের মত গর্জায়, তাকে ডরাই।
--নরেশ গুহ

----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ মণিকা।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।