প্রতিলিপি(৭)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বুধ, ১৩/০১/২০১০ - ৯:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এখানে ৬ষ্ঠ


তখনি ক্লোন গিবান গাড়ী চালাতে চালাতে মরুভূমি পার হয়ে উল্টোদিকে আসছিলো আবার। হানিমুন থেকে ফিরে সে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলো এই ওরিয়ানাকে সে নিজে চেনেনা। ওরিয়ানার স্মৃতি অন্য কারুর স্মৃতি, কেমন করে যেন ওর নিজের স্মৃতির মধ্যে জড়িয়ে গেছে।

ঐ ঝড়ের রাত্রি, ঐ নিকষ কালো অন্ধকার, ঐ চিকমিকে বিদ্যুত্ফলা ঐ ধারাজলে স্নান, ঐ তার জন্মরাত্রি, তার আগের জীবন তার নয়, যদিও স্মৃতিতে সব দগদগে কিন্তু সে তার স্মৃতি নয়, অন্য কারুর জীবনের ঘটনা সমূহ কপি করে ভরে দেওয়া হয়েছে। সে বুঝতে পারছে, স্পষ্ট বুঝতে পারছে। কীকরে বুঝতে পারছে বলতে পারবে না, প্রমাণও করতে পারবে না, কিন্তু অদ্ভুত তীব্র যন্ত্রণা, ঈর্ষা আর অসহায় আকুতিভরা মন নিয়ে সে বুঝতে পেরেছে সে একটা ভুল, একটা গোঁজামিল একটা জলছাপ মাত্র!

অথচ বিয়ের দিনে ওরিয়ানার পাশে নিজেকে ধন্য মনে হয়েছিলো, ওরিয়ানাকে বিয়ের কনের সাজে কী আশ্চর্য সুন্দরী লেগেছিলো। ঝলমলে কনের পোশাকে অপরূপা। ধাতু ক্রিস্টাল আর ফুলের গয়নায় তাকে সাজিয়েছিলো তার সখীরা। গিবানকে বরের সাজে সাজিয়েছিলো ছেলেদের পার্লারের কর্মীরা।

ওরিয়ানার বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন মিলে অনেকজন ছিলো। একসাথে তারা প্রার্থনাভবনে যাচ্ছিলো, গিবানের নিজের আত্মীয়বন্ধুরা যোগ দিতে পারছে না বলে কেউ কেউ গিবানের হাতে চাপ দিয়ে সমবেদনা জানিয়ে যাচ্ছিলো। সব মিলিয়ে একটা অনাস্বাদিত অনুভব, কেমন একটা বিহ্বলতার মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলো গিবান।

শান্ত সমাহিত মুখ বৃদ্ধ মানুষটি, প্রার্থনাভবনে যিনি তাদের বিবাহ দিলেন, তাঁর আশীর্বাদ গ্রহণের সময়, ওরিয়ানার সঙ্গে একসাথে দীপ জ্বালানোর সময়, পরস্পরকে মিষ্টি খাইয়ে দেবার সময়- পুরোটাই গিবানের কাছে ছিলো যেন একটা দীর্ঘ স্বপ্ন! আর সেই রাত, তাদের বিয়ের রাত, সেই আশ্চর্য জ্যোৎস্না রাত- ওহ, সে মনে করতে চায় না, চায় না, চায় না।

ওরিয়ানার সেই গান, সেই অতলান্ত সুর, সে মনে করতে চায় না, তবু কেন তার ইহলোক পরলোক তছনছ করে দিতে ফিরে ফিরে আসে সেই স্মৃতি?

হানিমুনে যাবার সময় এত সুখী আর কেউ ছিলো না দুনিয়ায়। সমুদ্রতীরের ছোটো শহরে গেছিলো তারা। নীল সাগরের সামনে সোনালি বালুবেলা, কাছে সবুজ নারিকেলকুঞ্জ, ছোটো নৌকায় করে একটুখানি গেলে পাখিদের কলকূজনে মুখরিত একটি সবুজ দ্বীপ- খুব সুন্দর ছিলো সবকিছু।

অথচ....অথচ কোথায় যেন একটা গরমিল! প্রতিবার মিলনমুহূর্তে ফিরে এসেছে সেই অসহায় অন্ধকার, ধারালো ছুরির ফলা দিয়ে পৃথক করে দেওয়া অতীত ও বর্তমান, সেই ভয়ংকর অতল খাদ।

ওরিয়ানা বারে বারে জিজ্ঞেস করেছে- কী হলো? কেন গিবান এত অন্যমনস্ক, ওর কি কোনো কারণে খারাপ লাগছে? ওরিয়ানা অভিমানও করেছে কয়েকবার। যথাসাধ্য ওকে বুঝিয়েছে গিবান, কিন্তু আসল কথাটা বলতে পারে নি। সে গিবান নয়, সে অন্য কেউ, সে একটা ভুল, সে একটা ব্যঙ্গচিত্র।

মধুচন্দ্রিমা শেষে ফিরে এসে আর সে পারেনি ঐ বোঝা টানতে, চিঠি লিখে রেখে পালিয়ে এসেছে চেনাপথ ধরে। জন্মরাত্রে যে পথ দিয়ে এসেছিলো সে। এবারে গিয়ে সে দাঁড়াবে সেই নিষ্ঠুরের সামনে যে তাকে তৈরী করেছে নিজের প্রতিলিপি করে, নিজের হাতেই সে শেষ করে দিক তাকে। শুধু মরে যাবার আগে সে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চায়, এত কষ্ট দেবার কী অধিকার ছিলো তার? কেন সে এইরকম কাউকে বানাতে গেলো পদে পদে যার বুকের মধ্যে ছুরির ফলা ঢুকে ফালাফালা করে দেবে জীবন! কেন? কী অপরাধ তার?

নির্মল মরু-আকাশের তারার আলোয় বালিকণা জ্বলজ্বল করে, কৃষ্ণা একাদশীর চাঁদ ওঠে ঐ দূরে, অপার্থিব বিষন্ন হাসির মতন ঝুলে থাকে আকাশের গায়ে, দূরে ঢেউ খেলানো বালির উপরে ফণীমনসার ঝাড়ের কাছে সেই অদ্ভুত অন্যলোকের ঈশারা! কেউ কি কোথাও আছে যে তাকে এই টানাপোড়েন থেকে বাঁচাতে পারে? সে নিরপরাধ, কেন তাকে এই বোঝা টানতে হবে?

আবার ঝড়ের সমুদ্রের ক্ষমাহীন ঢেউয়ের মতন ঝাঁপিয়ে পড়ে আঘাত, রক্তাক্ত করে দেয় তার ভিতরটা। সেই সব তীব্র অনুভূতির স্মৃতি। কোনো অধিকার তার যেখানে ছিলো না সে সেখানে প্রবেশ করেছিলো। সে তস্কর! কিন্তু সে তো জানতো না! আহ, কেন কেন কেন হলো এমন? ওরিয়ানা, ঐ অসাধারণ মেয়েটি-ওকে সে নিজের অজান্তে এ কোন্‌ অন্ধকুঠুরিতে ঠেলে দিলো? আজ হোক, কাল হোক, সত্য সে জানতে পারবে। তখন? তখন কি সে এই মানুষটাকে, মানুষের এই ব্যঙ্গচিত্রকে ক্ষমা করতে পারবে?

সে ক্ষমা চাইতে চায়, অথচ জানে এর কোনো ক্ষমা নেই। একমাত্র মৃত্যু ছাড়া তার জন্য আর কিছু পুরস্কার অপেক্ষা করে নেই পৃথিবীতে। সে নিজে কোনো অপরাধ না করেও এই অবস্থায় পড়েছে বলে প্রতিশোধ নিতে চায়, কিন্তু কার উপরে সে প্রতিশোধ নেবে? সে তো আজো নিশ্চিত করে জানেই না কী থেকে কী হয়েছে! সবই হয়তো তার অনুমান, তার কল্পনা, তার মনের ভুল!

কোথা থেকে এত কুয়াশা আসছে, কোথা থেকে এত ঠান্ডা আসছে? আহ আহ, কী ঠান্ডা! কুঁকড়ে যাচ্ছিলো গিবান। শরীরে নীচে ঢালু জমির অনুভব হচ্ছিলো, গড়িয়ে যেন সে পড়ে যাচ্ছে সেই নততলের উপরে দিয়ে, আরো আরো কুয়াশা এসে ঢেকে দিচ্ছে সব, কুয়াশার মধ্য দিয়ে সবুজ দেখাচ্ছে চাঁদকে! কী অদ্ভুত!

(চা-সামোসার বিরতি হাসি )


মন্তব্য

ফকির ইলিয়াস এর ছবি

আপনার লেখায় একটা প্রাকৃতিক প্রতিধ্বনি আছে। সিরিজগুলো পড়ে আমার তাই
মনে হলো।

এটা কী নড় কোনো লেখার ক্যানভাস ?

শুভেচ্ছা ।

ফকির ইলিয়াস এর ছবি

এটা কী বড় কোনো লেখার ক্যানভাস ?

তুলিরেখা এর ছবি

আসলে কি জানেন, এ এক ধরনের চেষ্টা। রঙ রেখা বুলিয়ে যাওয়া। শেষ পর্যন্ত হয়তো কোনো ছবি হয়, কখনো হয়তো হয় না। কখনো কারুর হয়তো ভালো লাগে, কারুর হয়তো লাগে না।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

বইখাতা এর ছবি

গিবান কীভাবে বুঝতে পারলো সে আসলে একটা প্রতিলিপি ? কিছু ঘটনা বা কোনো কিছুতে কোনো গরমিল দেখালে ভালো লাগতো। একটা ব্যাখ্যা চাইছে মন।

একবারে সব পর্ব পড়লাম। ভালো লেগেছে, তবে আরো ভালো হতে পারতো মনে হয়। আপনি তো আরো ভালো লিখেন। প্রথম ১/২ পর্বের পর একটু তাড়াহুড়া করে লিখেছেন কি ? শেষ করার তাগিদ ছিল বেশি ? আমি আসলে আপনার 'সাংগ্রিলা'র কথা ভুলতে পারিনি। হাসি 'সাংগ্রিলা'র তুলনায় এই লেখাটা কেমন নীরস লাগলো। বর্ণনা, বিশেষ করে এর আগের পর্বে গিবানের ভালো হয়ে ওঠা, ভেনা আর রাউলের কী হলো - এসব যেন দায়সারা ভাবে বলে দেয়া হলো। অথচ, 'সাংগ্রিলা'র বর্ণনা, সংলাপ সবকিছুই ছিল মনোযোগ-ধরে-রাখা'র, এরপর কী হবে এমন একটা কৌতুহল জাগিয়ে দেয়ার মতো। অন্তত আমার কাছে সেরকমই লেগেছে।

বারবার আপনার দুইটা লেখার তুলনা করছি, খুব বিরক্ত হয়েছেন হয়তো। দুটো প্রায় একই গোত্রের লেখা আর আগেরটা অনেক বেশি পছন্দ হযেছিল তো, তাই এমন করে ফেললাম। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, অনুরোধ করছি। হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ বইখাতা। আপনি যে পড়ছেন আর মনের কথাগুলো বলছেন, সে আমার অনেক বড় পাওয়া। সাংগ্রিলা কেউ পড়ছিলো না বলে বন্ধ করে দিয়েছি।

আপনি ঠিকই বলেছেন, ১/২ পর্বের পরে কাহিনিতে গতি এসেছে, গল্পের গাড়ীতে চাক্কা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে আরকি। হাসি

ভেনা রাউল এরা তো সব পার্শ্বচরিত্র কিনা! এদের কথা বিতং করে বললে নায়ক নায়িকা গোসা হবে না? হাসি

ধন্যবাদ আবারও।

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- গিবান তাইলে আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করেছে যে সে আসলে 'প্রকৃত' গিবান না!
কিন্তু আমার তো সমস্যা যাচ্ছে না। গিবান বিয়ে করলো তার প্রেয়সীকে, এতে কি তার বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী- যাদের সাথে সে অতো বড় একটা প্রজেক্ট শুরু করতে যাচ্ছিলো, তাদেরকে জানানোর কথা না নিদেনপক্ষে? তার বন্ধুবান্ধবের স্মৃতি তো নিশ্চই ক্লোনের মাথায় সাঁটিয়ে দেয়া আছে। কিন্তু হালায় তারপরেও একা একা বিয়ে করলো কেনো বুঝলাম না।

ভালো কথা, গিবানের কোনো শালি টালি নাই? এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম আরকি! দেঁতো হাসি
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

তুলিরেখা এর ছবি

গিবানের অজস্র শালি! মামাতো মৌসাতো পিসাতো খুড়াতো পাড়াতুতো শালিতে শালিতে ছয়লাব। হাসি

তবে গিবান বন্ধুবান্ধবদের বিয়ের খবর দেয় নি কেন সেই জানে! হয়তো বৌ চুরি যাবার ভয়ে! হাসি

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

সব এলোঝেলে হয়ে যাচ্ছে। আবার প্রথম থেকে পড়া শুরু করতে হবে মনে হচ্ছে!
হঠাৎ এখানে, হঠাৎ সেখানে.. কাহিনী গড়াইতে শুরু করলে 'চা-সমোসার ব্রেক'!
খুব খ্রাপ। মন খারাপ

- মুক্ত বয়ান।

তুলিরেখা এর ছবি

কাহিনিতে নানা মোড় ঘোরাঘুরি আছে। একসাথে করে আবার নাহয় পড়বেন সব শেষ হলে।
আর চা- সামোসার ব্রেক না নিলে লোকে ঠ্যাঙা হাতে তাড়া করবে যে! হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।