রাত্রিনগরী

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বুধ, ০৭/০৪/২০১০ - ৯:৩৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পকোড়ায় কামড় দিয়ে আয়েস করে চায়ে চুমুক দিয়ে জীশান বলছেন, " তখন আমি বছর বাইশ-তেইশের জোয়ান, সবে পাশ করে বেরিয়েছি, সামনে পৃথিবীটা পড়ে আছে যেন এক রহস্যময়ী রাজকুমারী, ধরা দিতে দিতেও দেয় না, জাগনডাঙা ভাঙনডাঙা পার করে জুড়নপুর পার করে কোথায় কোন্ রহস্যময় রাত্রিনগরীর দিকে টেনে নিয়ে যায়, পথের মাঝ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় কোনো ঈশারা না রেখে। এবারে বার করো খুঁজে কতো খুঁজবে। জানি সে আছে কোথাও সেই রহস্যপুরীর মধ্যে, আমার গিয়ে তার ঘুমভাঙাবার অপেক্ষা, কিন্তু সে বড়ো সোজা নয়। তবু কিন্তু আমার তাতে আরো বেশী আনন্দ হতো, দিনগুলো মনে হতো কী আশ্চর্য সব সম্ভাবনায় ভরা, কী যে সম্ভব আর কি যে অসম্ভব তার মধ্যের কোনো ভাগরেখা চোখে পড়তো না। "

আমরা বিস্ময়ে চোখগুলো এতখানি করে ডক্টর জীশানের গল্প শুনছি, এমন কবির মতন করে যে উনি গল্প বলতে পারেন, তা কে জানতো!

"ফিল্ডওয়ার্ক করতে আমাদের দল সেবার গেছে দক্ষিণ মহাদেশের পাহাড়ী অঞ্চলে, সে এক অপূর্ব সুন্দর জায়গা, তোমাদের মধ্যে যারা গেছো তারা তো জানোই। সেসময় যেন আরো সুন্দর ছিলো, তাছাড়া তখন আমাদের নবীন চোখ, যা দেখি তাই এমনির চেয়ে বেশী সুন্দর লাগে। বেশ অনেকগুলো অতি সুন্দর হ্রদ সে অঞ্চলে, নানা উচ্চতায়, একেবারে সমুদ্রসমতল থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে ক্রমোচ্চ উপত্যকায় উপত্যকায় হ্রদগুলো। মাঝামাঝি উচ্চতার এক হ্রদের তীরে অতি সুন্দর বনভূমিতে আমাদের তাঁবু পড়লো।

দলে আমরা নিজেরা দশজন, দুজন বাদে সকলেই আমরা সহপাঠী, ঐ দুজন আমাদের সঙ্গে সদ্য যোগ দিয়েছিল দক্ষিণ মহাদেশ থেকে এসে, ওরাও সদ্য পাশ করে এসেছে সেখান থেকে। আমাদের ভাষা শিখে নিতে একটু অসুবিধে ওদের হচ্ছিলো, আমরা যথাসাধ্য সাহায্য করছিলাম, ভাষার প্রতিবন্ধক সত্বেও সুন্দর একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো।

তাঁবুটাবু গাঁড়া হয়ে গেলে পরেরদিনের কাজ শুরুর জন্য আমরা জিনিসপত্র গুছিয়ে গাছিয়ে রাখছি, সেই দুজন বললো এই অঞ্চলে একটি পরিত্যক্ত নগরী আছে, গভীর বনের ভিতর লুকানো। খুব কম লোকে জানে তার কথা। তবে কেউই জানেনা সেই নগরী কাদের ছিলো, কেন পরিত্যক্ত হলো আর কবে পরিত্যক্ত হলো। আমরা তো শুনে লাফিয়ে উঠি, বলো কী? তোমরা জানো নাকি সেই রহস্যনগরী কোথায়?

তারা আমাদের উত্তেজনা দেখে হাসে, ওরা জানে, গেছেও দু'দুবার। ওদের খুব অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে দুইবারেই। তবে সেসব বেশ কিছুকাল আগের কথা, তখন ওরা বছর সতেরোর ছোকরাছুকরি, সে বয়েসে অজানার প্রতি টান থাকে তাই সামান্য সামান্য যোগসূত্র অনুসরন করে করেই গিয়ে পৌঁছেছিলো সেখানে, রাত্রি হয়ে যাওয়ায় থেকেও গেছিলো, পরদিন ফিরে আসে। বলতে বলতে লিও আর ইরিনা হাসছিলো, ওখানে যাওয়া আর রাত কাটানো ওদের জীবনের মধ্যে ও যোগসূত্র তৈরী করে দিয়েছিলো। বিয়ের পরেও ওরা তাই ওখানে আবার গেছিলো, এক রাত্রি আবার থাকতে। ওদের কাছে আমরা এসব শুনে অধীর, সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হলো যে আমরা পরদিন সকালেই রওনা হবো সেই জনহীন পরিত্যক্ত নগরী দেখতে। "

আমাদের চোখ ইয়া বড় করে খোলা, জোরে জোরে শ্বাস নিই, উৎকর্ণ হয়ে বলি, "তারপর কী হলো?"

ড: জীশান হাসেন, কফির কাপে চুমুক দেন, একটা পকোড়া তুলে নিয়ে আয়েস করে পকোড়ায় কামড় দেন। আমরা কৌতূহলে প্রায় ফেটে পড়ছি ততক্ষণে। পকোড়া খাওয়া শেষ করে উনি আবার বলতে থাকেন, " তারপরে যা ভাবা সেই কাজ। আমরা তাঁবুতাঁবা গুটিয়ে জিনিসপত্র বেঁধেছেদে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি সেই রহস্যনগরীর দিকে। ভেবে দ্যাখো, সেই দুজন বন্ধু ছাড়া আর কারুর কোনো ধারণাই নেই কোথায় সেই নগরী বা আদৌ আছে কিনা এমন কিছু। তারা দু'জন যে আমাদের টোপ দিয়ে বিপদের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে না তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? তবু আমাদের কারুর মনেই কোনো বাধোবাধো ঠেকলো না, অনায়াসে আমরা চললাম। আহা, কী সব দিন ছিল!" উনি থেমে আবার কফির কাপে চুমুক দেন।

আমি থাকতে পারি না, " তারপর?"

" তারপরে আমরা সারাদিন পথ চলি, কোথাও বড় বড় গাছের নিচ দিয়ে শুঁড়িপথ, বড় বড় শক্ত শক্ত লতা ঝুলছে গাছ থেকে, দড়ির মতন মোটা। কখনো ঝোপঝাড় এত ঘন যে একপা এগোবার সাধ্য নেই, যন্ত্র দিয়ে ঝোপঝাড় কেটে ফেলে তবে এগোনো যায়। তারপর আছে সাপের ভয়, বুনো জন্তুজানোয়ারের ভয়। বেশ কয়েকজনের উৎসাহ তখন কমে আসতে শুরু করেছে, এমনকি নিজেদের মধ্যে তারা সন্দেহও প্রকাশ করতে শুরু করেছে যে ব্যাপারটা ধোঁকাবাজি ও হতে পারে। আমারও তখন কেমন কেমন লাগতে শুরু করেছে। কেবল লিও আর ইরিনা নির্বিকার, একইরকম হাসিখুশী। ওরা বলে যে জায়গাটা বেশ দূর, গিয়ে পৌঁছাতে বিকাল পার হয়ে সন্ধ্যা হবে। দুপুরে লাঞ্চের জন্য থামা হলো। ছোটো এক নদীর ধারে মস্ত এক গাছের ছায়ায় বসে খাবারদাবারের বাক্সগুলো খোলা হলো। গরম করতে গেলে আগুনটাগুন জ্বালার হ্যাপা আছে, তাই ঠান্ডা খাবারই খাওয়া শুরু হলো, এত পরিশ্রমে সকলের খিদে যা পেয়েছিল সে আর বলার না! সেই খিদের গুণেই সব খাবার খুব ভালো লাগলো।

(চলবে?)


মন্তব্য

বালক এর ছবি

চলুক।
অপেক্ষায় আগামী অংশের।

*************************************************************************
ভবিষ্যতে কি হবে তা ভেবে বর্তমানকে উপেক্ষা করবো কেনো?

____________________________________________________________________
"জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক;
আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো
এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ বালক। আমি ও অপেক্ষায়। হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নাশতারান এর ছবি

ভালো লাগছে। চলুক।

[ প্রতিবন্ধক > প্রতিবন্ধকতা, অনুসরন > অনুসরণ, মধ্যে ও > মধ্যেও, পকোড়া'র ব্যাপারে নিশ্চিত নই। আমি জানতাম পাকোড়া ]

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

তুলিরেখা এর ছবি

আচ্ছা তাহলে তো চলতেই হবে।
বানান গুলো ঠিক করার জন্য ধন্যবাদ।
আমি তো পকোড়া ই জানতাম। কেউ কেউ পকৌড়াও বলতেন।

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মৃত্তিকা এর ছবি

ভালো লাগছে।

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ মঋত্তিকা।

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তুলিরেখা এর ছবি

হায় চা! কী যে কন!
কাল থেকে শুধু নুডল আর ক্র্যাকার খেয়ে আছি। মন খারাপ
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

naina এর ছবি

তারপর ........?

তুলিরেখা এর ছবি

তাই তো! তারপরে কী? জীশান কে খবর দিতে হয়! হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

শেখ নজরুল এর ছবি

ক্ষিদের গুণে খাবার ভালো লাগে। বেশ বলেছেন!
শেখ নজরুল

শেখ নজরুল

তুলিরেখা এর ছবি

কথাটা নিয্যস সত্যি। খিদের গুণে মিয়ানো মুড়ি অবধি সুধাহেন লাগে!
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সাবিহ ওমর এর ছবি

ভাল হচ্ছে। খালি শ্রোতাদের একটু বেশি উৎসাহী দেখাচ্ছে খাইছে

তুলিরেখা এর ছবি

শ্রোতারা কী আর সাধে উৎসাহী? এতকাল জীশান কিছুই কাউকে বলেন নি, বলতেন গেছি আর ফিরে এসেছি, আজকে যখন মুখ খুলেছেন তখন কী আর শ্রোতারা শান্ত থাকতে পারে?
----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

বইখাতা এর ছবি

তারপর কী হলো ? চলবে অবশ্যই।

তুলিরেখা এর ছবি

আচ্ছা, পাঠকেরা যদি বলেন, তাহলে তো চলতেই হবে।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আপনার লেখা একেবারে ভিন্ন স্বাদের একটা গল্প পড়ছি। চলুক অবশ্যই...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তুলিরেখা এর ছবি

এই গল্পটা একটু অন্যরকমই। দেখা যাক কী হয়। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

হরফ এর ছবি

বাঃ চলুক। জানি অন্যদিকে ঘুরে যাবে ঘটনা কিন্তু আপাতত "হেঁসোরাম হুঁসিয়ারের ডায়রি"র মতো লাগছে।

----------------------------------------
"ছুটলে কথা থামায় কে/আজকে ঠেকায় আমায় কে"

ছুটলে কথা থামায় কে/আজকে ঠেকায় আমায় কে

তুলিরেখা এর ছবি

হরফ, ধন্যবাদ।
সুকুমার রায়ের লেখা আমার চিরকালের প্রিয়।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।