জীয়নলতা(সম্পূর্ণ)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: শুক্র, ২৮/০৫/২০১০ - ৮:০৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রায়ান্ধকার ঘরে চুপ করে বসে আছি সেই দুপুরের পর থেকে। একদম চুপ। দূরের টেবিলের উপরে হালকা ডোমপরানো লাল আলোটা জ্বলছে, থ্রী-ডি মুভি ক্যামেরা যুক্ত আলট্রা-মাইক্রোস্কোপ সিস্টেমও সেই একইরকম সেট করা আছে। মাইক্রোস্কোপ-স্টেজের উপরে সেই স্লাইড, তাতেই সেই ভয়ানক স্যাম্পেল। সবচেয়ে আধুনিক অ্যানালাইজার যুক্ত আছে সিস্টেমে, স্ক্রীণে ত্রিমাত্রিক প্রোজেকশন করে করে সংখ্যাতালিকা দিয়ে দিয়ে নির্ভুলভাবে দেখিয়ে দিয়েছে সেই অ্যালিয়েন স্ট্রাকচার, সেই অদ্ভুত রেপ্লিকেশন, তার ভয়ানক প্রক্রিয়া। কী ভয়ানক সেই সত্য!

আমার শেষ আশা, অন্য আরো যে তিনজন স্যাম্পেল পরীক্ষা করতে নিয়েছে তারা অন্যরকম ফলাফল পাক, তাদের নিরীক্ষা বলুক এ সত্য নয়! কিন্তু মনের ভিতরে জানি তা হবে না, এ শুধু আমার কুটো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা।

বাইরে নিশ্চয় এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে আসছে। পাখপাখালিরা ঘরে ফিরছে, রাতের আশ্রয়ে শান্ত হয়ে যাবার আগে পাখিরা খুব কিচিরমিচির করে। আমার ইচ্ছে করছে সব সুইচ অফ করে বেরিয়ে যাই ঘরটা থেকে, তারা ফুটতে থাকা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলি, আ:। কিন্তু পারছি না, আমার শরীরমন অবশ হয়ে গেছে যেন।

গলায় ঝোলানো স্ট্রিং এ লকেটের মতন ঝুলে থাকা কমুনিরিংটা টুং টুং করে উঠলো, রওশন কথা বলতে চায়। আমি তাকে সামনের থ্রীডি স্ক্রীনে প্রোজেক্ট করে বললাম," হ্যালো রওশন।" রওশন-আরা সবচেয়ে জুনিয়র ইনভেস্টিগেটর আমাদের গ্রুপে, কিশোরীর মতন নরম মুখচোখের মেয়েটি কাজেকর্মে দারুণ চটপটে। ভালো বলিয়ে-কইয়েও, গ্রুপ মীটিং এর সময় বেশীরভাগ প্রেজেনটেশানই ও দেয়।

আজকে রওশনের চোখমুখ শুকনো, চুল এলোমেলো, চোখের নিচে কালো ছায়া। আমার ভেতরে কোথায় যেন মোচড় লাগে, দ্রুত নিজেকে সামলাতে সামলাতে অল্প হাসির একটা চেষ্টা করে বলি, "বলো রওশন, কী খবর তোমার অ্যানালিসিসের?"

রওশনের ঠোঁট কেঁপে ওঠে, চোখ বড় বড় হয়ে যায়, যেন দুঃস্বপ্নের মধ্য থেকে প্রাণপণে বেরোতে চেষ্টা করছে। দু'বারের চেষ্টায় ওর কথা ফোটে, আমি শুনতে পাই, "পাভেল, পাভেল, আমার ...আমার অ্যনালাইজার খুব অদ্ভুত তথ্য দিচ্ছে। আমি বারে বারে চেক করে দেখলাম একই জিনিস কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।" ওর গলার স্বর শুধু না, সারা শরীর কাঁপছে।

আমার ভিতরে ঝড়, তবু আমি ওকে শান্ত হতে বলি, বলি,"রওশন, তুমি শান্ত হয়ে বসো তো চেয়ারে। তারপরে আস্তে আস্তে আমাকে বলো কী দেখেছ। উত্তেজিত হয়ো না, কোনোরকম দুশ্চিন্তা কোরো না, একেবারে নির্মোহ বিজ্ঞানীর মত বলো কী দেখেছ।"

রওশনের ত্রিমাত্রিক চেহারা আস্তে আস্তে বসে পড়লো তার চেয়ারে। গভীর শ্বাস টেনে সে বললো,"পাভেল, তুমিও কি ওরকমই কিছু পেয়েছ?" ওর আশা-আশঙ্কা মেশানো কাঁপা কাপা স্বর শুনে আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো,"না, না, আমি অদ্ভুত কিছু পাই নি, পাই নি, পাই নি।"

দীর্ঘশ্বাস গোপণ করে আমি রওশনকে বলি, "তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি কয়েক মিনিটের মধ্যেই তোমার ল্যাবে আসছি। আমার অ্যানালিসিসের রিপোর্ট আমি ডক্টর জীমানকে ট্রান্সমিট করে দেবো আর কিছুক্ষণ পরে। এতক্ষণ আমি দোটানায় ছিলাম।"

রওশনের চোখ জলে ভরে গেছে, অশ্রুরুদ্ধ গলায় সে বললো, " পাভেল, তুমিও একই তথ্য পেয়েছ, না? আমি ভাবছিলাম...আমি আশা করছিলাম...হয়তো যা দেখেছি ভুল, হয়তো সবটাই দু:স্বপ্ন একটা।"

"রওশন, শান্ত হও। আমি মিনিট দুয়েকের মধ্যে এসে পড়ছি।"

রওশনের ল্যাবে তার থ্রীডি ভিউয়ারে দেখলাম সেই একই দৃশ্য। মানসিকভাবে তৈরীই ছিলাম, তবু মনটা নতুন করে অস্থির হলো। ল্যাব লক করে দু'জনে ক্লান্ত বিধ্বস্তের মতন বেরিয়ে আসি। বাইরে ঝিরিঝিরি হাওয়া, গাছের পাতায় মর্মর, সন্ধ্যার আকাশ ভরে ফুটে উঠছে অগণিত তারা। বুক ভরে শ্বাস নিই, আর কতদিন নিতে পারবো? এই সুন্দর সবুজ জগৎ, এই ফুলপাতাপাখি--সবই ইতিহাস হয়ে যাবে?

কফিশপ থেকে দু'কাপ কফি কিনে দুজনে পার্কের বেঞ্চে গিয়ে গিয়ে বসি। কিছু কথা হয় না, দু'জনের একজনও কথা বলতে পারি না। কিম জিলুং তার কয়েক মাস বয়সের ছেলেকে প্যারামবুলেটরে বসিয়ে প্র্যাম ঠেলতে ঠেলতে ধীর পায়ে ফিরে যাচ্ছে। আমাদের কাছে এসে হাসলো, জিজ্ঞেস করলো আমরা কেমন আছি। আমরা হেসে বললাম ভালো। কিমের ছেলেটা ভারী মিষ্টি দেখতে। খলবল করে হাসে।

কিম জিলুং চলে গেল ছেলে নিয়ে। ও সারাবছর পুরোহাতা পোশাক পরে। যুদ্ধের সময়ে ও ছিলো বাচ্চা মেয়ে, বোমায় ও খুব মারাত্মকভাবে পুড়ে গেছিলো, বাঁচার আশাও ছিলোনা। শত্রুপক্ষীয় ডাক্তারদের যত্নে ও চেষ্টায় সে বাঁচলো, এখন অবশ্য আর তারা শত্রুপক্ষীয় নয়। এখন কিমের সুন্দর সংসার, নতুন মা হয়ে সে পরমানন্দে আছে।

এইসব যুদ্ধ হত্যা মৃত্যু-এত এত ভুল মানবজাতি করেছে, তবু তারও পরে মানুষের ভালোত্ব বেঁচে থেকেছে। তারও পরে আছে ভুল স্বীকার অনুতাপ ক্ষমা চাওয়া ও ক্ষমা করতে পারা, আছে বলেই সংসার সহনীয় আজও। কী হবে এর পরে?

ডক্টর জীমান ফোন করে জানান কাল সকালে জরুরী মীটিং। রওশন নিজের ঘরের দিকে চলে যায়, আমি টলতে টলতে যাই নিজের বাড়ীর দিকে। রাতটুকু বিশ্রাম করে নিতে হবে, নাহলে কালকে সকালে আরো গন্ডগোল করে ফেলবো।

এক গেলাস দুধ আর আধখানা পাঁউরুটি খেয়ে ঢকঢক করে আধবোতল জল পান করে শুয়ে পড়লাম। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে সারারাত অদ্ভুত অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম ঝলমলে পাথরের গাছপালা লতাপাতা পশুপাখি সব চুপ করে আছে, সেই পাথরপুরীর মধ্যে একা একা ঘুরতে ঘুরতে অপার্থিব এক ভয়ঙ্কর হাসি শুনছি আমি। কাউকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না, হঠাৎ হঠাৎ কোথা থেকে আর্ত চিৎকার ভেসে আসছে শুধু।

শুকনো গলা ভরা তৃষ্ণা নিয়ে জেগে উঠে জল খাই, বাইরে তখন সুন্দর ভোর ফুটেছে।

সকালের মীটিংএ আমি যখন পৌঁছলাম তখন ঝিনঝিয়াং আর লী এসে গেছে। ওদের শুকনো চিন্তিত মুখ দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে ওরাও একই জিনিস পেয়েছে ওদের পর্যবেক্ষণে।

ডক্টর জীমান নিজের ল্যাবেই ছিলেন, মনে হয় সারারাতই কাজ করছিলেন, তার সাদা ল্যাবকোটের এখানে ওখানে দাগ, চুল এলোমেলো, চোখের নিচে বিনিদ্র রাতের ক্লান্তির ছাপ। তবু মনের স্থৈর্য হারান নি সেটা শান্ত হাসি দেখে বোঝা যায়। এই প্রৌঢ় মানুষটির ভিতরে ভরসা জাগাবার মতন কী যেন আছে! দেখলে মনে হয় হয়তো বিপদ থেকে রক্ষা পাবার একটা কোনো উপায় হবেই।

রওশন এসে পড়তেই আমাদের মীটিং শুরু হলো। ছোটো কনফারেন্স রুমে প্রোজেকশনের স্ক্রীণ ভয়েস কমান্ডে সক্রিয় করে ডক্টর জীমান বলতে আর দেখাতে শুরু করলেন।

স্ক্রীণে স্যাম্পেলের আণবিক চেহারা ফুটে উঠেছে ত্রিমাত্রিক আকারে। পাঁচটি তন্তু পরস্পরের সঙ্গে জটিলভাবে জড়িয়ে অপরিচিত জ্যামিতি তৈরী হয়েছে। সেই জটিল অণু ঘুরে চলেছে অনবরত, জটিল কৌণিক ঘূর্ণন। ঘূর্ণনটা পুরো বোঝাও যায় না, বাইরের অংশ আর ভিতরের অংশ আর তার আরো ভিতরে অন্য অংশ সব নিজের মতন করে ঘুরছে, তবে ছন্দ ভেঙে যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে জড়ানো চেহারা খানিকটা আলগা হয়ে যাচ্ছে, ছোটো ছোটো লুপের মতন বদ্ধতন্তু বেরিয়ে আসছে। অপার্থিব অজাগতিক ভয়ে শিরশির করে ওঠে মন।

ডক্টর জীমানের গলা শোনা যাচ্ছে, "এতক্ষণে তোমাদের চারজনের কাছেই এটা পরিষ্কার যে এই স্যাম্পলে যে জীবনের চিহ্ন পাওয়া গেছে তা ভিন্ন ধরনের জীবন। খুব অদ্ভুত। ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড ভিত্তিক যে জীবন আমরা চিনি, এ তা নয়। এতে ডিএনে নেই, এমনকি আমাদের চেনা প্রোটীনও নেই। এতে আছে সম্পূর্ণ অন্যধরনের মলিকিউল। কিন্তু জীবনের সব চিহ্ন বিদ্যমান, এ পুষ্টিতরল থেকে বস্তু সংগ্রহ করে বেড়ে উঠছে আর প্রতিলিপি বানাচ্ছে ঠিক যেমন ডিএনে নিজের প্রতিলিপি বানায়। তফাৎ হলো যে এই রেপ্লিকেটিং করতে গিয়ে সে--" উনি এখানে থামলেন একটু।

শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্ত। যা আশঙ্কা করছি তাই কি উনি বলবেন?

ডক্টর জীমানের গলা আবার শোনা গেল, "পুষ্টিতরলে প্রচুর ডিএনে আর প্রোটীন, স্যাম্পলের এই জীবন্ত অণুগুলোর রেপ্লিকেটিং করার প্রক্রিয়া হলো আশেপাশের থেকে ডিএনে আর প্রোটীন সংগ্রহ করে তা টুকরো টুকরো করে ফেলে তারপরে নতুন করে জুড়ে নিজের উপযোগী দীর্ঘ অণুতে বদলে ফেলা। ডিএনে তে থাকে দু'খানা স্ট্র্যান্ড, এদের পাঁচখানা। আমি সন্দেহ করছি এদের জ্যামিতি উচ্চমাত্রার মোবিয়াস স্ট্রিপের মতন। আমাদের পরিচিত জৈব অণুগুলোকে তাদের দর্পণ প্রতিবিম্বে বদলে দিতে সক্ষম। এরা যদি জীবদেহে সংক্রমণ করে তবে আমাদের পরিচিত জীবজগতের চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে যাবে অতি দ্রুত। ডিএনে বলে আর কিছু থাকবে না। জীবন থাকবে, তবে তা হবে এই অদ্ভুত নতুন ধরনের জীবন, অ্যালিয়েন অণুভিত্তিক জীবন।"

উনি কিছুক্ষণের জন্য চুপ করলেন। আমরা চারটি প্রাণী নির্বাক হয়ে স্ক্রীণের দিকে চেয়ে আছি। রওশন প্রথম কথা বললো,"কোথা থেকে এ জিনিস এলো আমাদের কাছে? "

ডক্টর জীমান চেয়ারে বসে জলের গেলাসে চুমুক দিলেন। তারপরে বললেন," আজ থেকে ঠিক পঁচিশ দিন আগে উল্কাপাত হয় উত্তরের পাহাড়ী এক গ্রামের কাছে। অবজার্ভেটরি থেকে কনফার্ম করা হয়েছিলো অন্তত ১০-১২ টি মিটিওরাইট পড়েছে। অঞ্চলটি জনবিরল, কাছের গ্রামটিতে আছে মাত্র কয়েকজন মানুষ আর পালিত পশু। এটা পশুপালকদের অস্থায়ী গ্রাম। ওরাই প্রথম উল্কাপাতের মাঠের আশেপাশের গাছপালায় পরিবর্তন আর যে পশুগুলো ঐ মাঠের ঘাস খেয়েছে তাদের মধ্যে অদ্ভুত অসুস্থতা লক্ষ করে। ডক্টর হফমান ফিল্ড ওয়ার্কে গেছিলেন একদল সহকর্মী আর ছাত্র নিয়ে। ওরা কয়েকটি মিটিওরাইট সংগ্রহ করে এনেছেন। তার ভিতরে জৈব অণুর অস্তিত্ব তারা সন্দেহ করেছিলেন কারণ এরকম পাওয়া গেছে আগে। কিছু স্যাম্পল আমাদের ল্যাবে তারা পাঠিয়েছেন। এরকম ভয়ানক রকমের জৈব অণু যে পাওয়া যাবে তা আগে কে জানতো! তার চেয়েও সাংঘাতিক ব্যাপার হলো এতদিনে সেই অঞ্চলে কী অবস্থা হয়েছে কেজানে। আমি আজকে বিকালে সেদিকে রওনা হবো। "

শুকনো গলা থেকে কয়েকটা শব্দ কোনোরকমে বার করে বললাম, "স্যর, আমরা?"

"তোমাদের মধ্যে স্বেচ্ছায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যদি কেউ যেতে চাও যেতে পারো কিন্তু আমি তোমাদের তা রেকমেন্ড করি না। তোমাদের বয়স কম, এখনো অনেককিছু করার আছে তোমাদের। "

দু'দিন পরে জীবজগৎ টিঁকে থাকে কিনা সন্দেহ আর তার মধ্যে ইনি বলছেন কিনা অনেক কিছু করার আছে ভবিষ্যতে? আরে, মুন্ডু গেলে খাবোটা কী?

রওশন উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে বলে,"আমি আপনার সঙ্গে যেতে চাই। আপনি না নিতে চাইলেও আমার যেতেই হবে, না গিয়ে উপায় নেই।" কাল রাতে রওশনকে একেবারে বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত লাগছিলো, আজকে সকালে একেবারে শান্ত ঠান্ডামাথা দৃঢ়চিত্ত!

আমি, ঝিনঝিয়াং আর লী উঠে দাঁড়িয়েছি তখন। তিনজনের একজনও কিছু বললাম না কিন্তু আমাদের তিনজনের মুখের দিকে চেয়েই ডক্টর জীমান বুঝতে পারলেন আমাদের আটকাতে তিনিও পারবেন না।

বিকাল থেকে চলা শুরু, অনবরত গাড়ী চলছে। খুব তাড়াতাড়ি আবশ্যকীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বেরুতে হয়েছে আমাদের। জায়গাটা বেশ দূরে, সারারাত গাড়ী চালিয়ে নিকটতম শহরে পৌঁছানো যাবে। সেখানে কোনো সরাইয়ে চেক ইন করে জিনিসপত্র আর গাড়ী রেখে পরীক্ষানিরীক্ষার যন্ত্রপাতি নিয়ে পায়ে হেঁটে যেতে হবে সেই পশুপালকদের অস্থায়ী গ্রামে। যদি এখনও সেখানে কেউ থেকে থাকে তাদের সাহায্য আশা করা যায়, তবে ডক্টর জীমান সেখানে এখনও কেউ আছে সেই আশা করেন না।

ডক্টর জীমানের মতন এমন নিস্পৃহ নিরাসক্ত ভাবে জীবন ও মৃত্যুকে প্রায় একই দৃষ্টিতে দেখতে পারা বহুকালের সাধনার ব্যাপার। উনি যে সেই সাধনায় সিদ্ধ সে আমরা বুঝতে পারি আর ভেতরে ভেতরে কেমন একটা দুঃখে ভিজে যাই।

বেশ শান্তভাবেই উনি বলছিলেন, "দ্যাখো হে, আমাদের ডিএনে ভিত্তিক প্রাণও হয়তো একদিন এভাবেই জবরদখল করেছিলো পৃথিবীকে। আজ যদি জায়গা ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হয়, হবে। চিরদিন তো আর সমান যায় না। "

ঝিনঝিয়াং খুব কম কথা বলে, এখন সে বললো, " সত্যিই কি কোনো আশা নেই? কোনো উপায় নেই?"

"পাগলি মেয়ে, আশা নেই কেন? যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। আগে গিয়ে দেখি কী অবস্থা! আরে এখনো তো রাস্তাই ফুরায় নি।" অপ্রত্যাশিত কোমলতা ডক্টর জীমানের গলায়। ঝিনঝিয়াং তার পালিতা কন্যা।

কুড়ি বছর আগে এক বিমান দুর্ঘটনায় মাত্র দুজন সার্ভাইভার ছিল, চল্লিশ বছর বয়সের ডক্টর জীমান আর নয় বছর বয়সের বালিকা ঝিনঝিয়াং। ডক্টর জীমানের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সবাই মারা যায় সেই দুর্ঘটনায়, ঝিনঝিয়াং এর মা-বাবাও। জীমান ঝিনঝিয়াংকে নিজের কন্যা হিসাবে গ্রহণ করে পালন করেন, এসব আমরা পরে জানতে পারবো ওর কাছে।

শেষরাতে চেকইন করলাম আমরা। তারপরে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে সামান্য কিছু খেয়েই রওনা। সরাইওয়ালার সহায়তায় স্থানীয় একজনকে গাইড হিসাবে পাওয়া গেল। যতই এগোই ততই দেখা যায় গাছপালা জীর্ণ হয়ে গেছে, পশুপাখি দেখা যায় না। আমাদের গাইডের মুখ দেখে কিছু বোঝা যায় না, শুধু চোখে ভয় দেখা যায়। সে বলে অভিশাপ লেগেছে সেইখানে, যেখানে আকাশের দেবতারা আগুনবৃষ্টি করেছিলেন।

গাইডসমেত সবাই সর্বাঙ্গঢাকা বিশেষ পোশাক, জুতো আর হেলমেট পরে নিলাম আরো এগিয়ে। পশুপালকদের গ্রামটি পর্যন্ত এসে লোকটি আর এগোতে চাইলো না। সে ওখানেই অপেক্ষা করবে।

গ্রামটি এখন পরিত্যক্ত। কুটিরগুলি পড়ে আছে ভাঙাচোরা। গাছপালা শুকিয়ে খড় হয়ে গেছে, ঘাস মরে গেছে, পড়ে আছে পাথুরে মাটি। গ্রাম থেকে কিছু দূরেই সেই উল্কাপাতের মাঠ, দেখে মনে হচ্ছে সেখানে যেন স্থানীয় প্রলয় হয়েছে, সমস্ত জীবনচিহ্ন বিলুপ্ত। গাছপালা ঘাস কীটপতঙ্গ সব নি:শেষ হয়ে গেছে, যেন একেবারে মারাত্মক স্টেরিলাইজেশন।

গ্লাভসমোড়া হাতে সাবধানে যন্ত্রপাতি দিয়ে ধুলোমাটি সংগ্রহ করি আমরা একেকজন একেকদিকে। খুব সম্ভবত বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে না এই অণুজীবন, অন্য জীবদেহ ধরে ধরেই এগোয়। প্রাণী উদ্ভিদ ও জীবাণু কিছুই কি এর করালগ্রাস থেকে মুক্ত? কত দ্রুতহারে এ ছড়াতে পারে? কোনো অ্যান্টিডোট কি তৈরী করা সম্ভব? শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন, কোনো উত্তর নেই। সম্ভবত উত্তর বার করার সময়ও নেই।

ধুলোমাটি সংগ্রহ করা হলে জীমানের তাঁবুতে এসে জমা দিই সব। সকলের শেষে ফিরলো ঝিনঝিয়াং। তার হাতের জীপলক প্যাকেটে একটি কালচে-লাল রঙের ডাঁটা ও পাতাওয়ালা লতার কিছু অংশ। ঝিনঝিয়াং এর মুখে আবেগের চিহ্ন এমনিতে খুব কম ফোটে, সে কখনো আমাদের সামনে আবেগ প্রকাশ করে না, আসবার পথে ওর প্রশ্নটা তাই আমাদের অবাক করেছিলো।

এখন সে এতটা উত্তেজিত যে কিছুতেই লুকাতে পারছে না, হাঁফাতে হাঁফাতে সে কোনোরকমে বললো যে এই লতাটা সে মাঠে একটা পাথরের পাশে পেয়েছে, এ লতা মরে যায় নি, কোনো অচিন্তনীয় উপায়ে নিজেকে বাঁচিয়েছে।

ডক্টর জীমান অদ্ভুত চোখে চেয়ে ছিলেন সেটার দিকে, এখন বিড়বিড় করে বলেন," হয়তো এই আমাদের শেষ আশা।"

ফিরে এসে দিনরাত আমরা কাজ করি সবাই মিলে। লতার এনজাইমগুলো আলাদা করা আর বিশ্লেষণ করা হয়, অ্যালিয়েন অণুর রেপ্লিকেশন মেকানিজম হেরে গেছে এ লতার ডিফেন্স মেকানিজমের কাছে। এর এনজাইম দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে উপযোগী হয়েছে অ্যালিয়েন অণুর জটিল সজ্জা মোক্ষম কয়েক জায়গায় কেটে দিতে। তাতেই তারা পিছিয়ে গেছে।

ঝিনঝিয়াং আর লী সিমুলেট করলো এনজাইমের পরিব্যক্তি। আমরা বাকীরা দিনরাত তাদের সাহায্য করলাম। অবশেষে তৈরী হলো অ্যন্টিডোট। সফল প্রয়োগও হয়ে গেল।

যেখান যেখান থেকে অদ্ভুত অসুস্থতার খবর আসছিলো যার লক্ষণ মিলে যায় মিটিওরাইটের অঞ্চলের অসুস্থতার সঙ্গে, সেখানে সেখানে ওষুধ পাঠিয়ে দেওয়া হলো জরুরী ভিত্তিতে। ডক্টর জীমান আর হপকিনস নিজেরাও একটা ট্রাভেলিং মেডিকেল ইউনিটের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন। আমাদের কাছে কিছুদিনের মধ্যেই ভালো খবর আসতে শুরু করলো।

পৃথিবীর চেনা প্রাণ গুলি রক্ষা পেয়ে গেল আরেকবারের জন্য।

ঝিনঝিয়াং আর লী য়ের এনগেজমেন্টের দিন আমাদের চমৎকার পার্টি হলো, নিরাসক্ত গবেষকের মুখোশ খুলে রেখে এসে সবচেয়ে বেশী হৈহুল্লোড় করছিলেন ডক্টর জীমান।

*******


মন্তব্য

আশা এর ছবি

দারুণ !

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ আশা।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অগ্নিবীণা এর ছবি

অনেক ভালো লাগলো! হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

শুনে খুশি হলাম অগ্নিবীণা, ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

একদম রিসেন্টলি আপডেটেড সায়েন্স ফিকশন মনে হইতেসে। ভালো হইসে।
_________________________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

তুলিরেখা এর ছবি

রিসেন্টলি আপডেটেড তো বটেই। হাসি
ভালো আছেন?
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তাজিন এর ছবি

সুন্দর.......।।

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ তাজিন।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

জি.এম.তানিম এর ছবি

সুন্দর গল্প। বর্ণনাটা বিশেষ করে।

৩ এর ৬ নং প্যারার শেষ লাইনটা বুঝতে সমস্যা হচ্ছে, কোন টাইপো?
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ তানিম।
টাইপো না ওটা, পালিতা কন্যা বলে জানতো তারা কিন্তু কীভাবে কী হলো সেই পুরো ঘটনাটা পাভেল রওশনদের জানা ছিলো না, পরে ঝিনঝিয়াং তাদের বলেছিল।
মনে হয় আরেকটু বিস্তারিত করা উচিত ছিলো। জীয়নলতা তো শুধু লতাটাই না, কোনো না কোনোভাবে তারা সকলেই। বিমান দুর্ঘটনার থেকে বেঁচে যাওয়া ঝিনঝিয়াং আর জীমান, যুদ্ধে পুড়ে যাওয়া কিম জিলুং -সকলেই। পাভেল রওশন লী সকলেই তো পার হয়ে এসেছে অনেক ক্রসরোড যেখানে একটু এদিক ওদিক হলেই আর তারা থাকতো না। মানুষ যে বাঁচে সেটাই তো এক আশ্চর্য ব্যাপার! তাই নয়?

ভালো থাকবেন।

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

জি.এম.তানিম এর ছবি

আমার মনে হয় বুঝতে ভুল হচ্ছে কোথাও।

"জীমান ঝিনঝিয়াংকে নিজের কন্যা হিসাবে গ্রহণ করে পালন করেন, এসব আমরা পরে জানতে পারবো ওর কাছে।"

"পারবো"র জায়গাতে "পেরেছি" হবে বলে মনে হচ্ছে। কারণ গল্পে এর পরে আর এই বিষয়ের কোন উল্লেখ পাই নি। আমার ভুল হতে পারে।

শেষ অধ্যায়টা আরেকটু বিস্তারিত করা যেত বলে মনে হচ্ছে।
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

তুলিরেখা এর ছবি

ঠিক, পরে আর উল্লেখ নেই। থাকবেই বা কেন? হাসি
ওটা তো ওভাবেই বলা হয়ে গেল কিনা! হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

বইখাতা এর ছবি

ভালো লাগলো। তবে অ্যন্টিডোট তৈরী, সফল প্রয়োগ, শেষে পার্টি সবকিছু যেন একটানে হুট করে হয়ে গেল। একটু কেমন কেমন লাগল।তবে আরো বিস্তারিত লিখলে গল্পের আকার বেশি বড় হয়ে যেত এটাও বুঝতে পারছি। হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ বইখাতা।
গল্প শেষের দিকে জোরে দৌড় দিয়েছে, আসলে পুরো তাল রেখে বলতে গেলে খুবই বড়ো হয়ে যেত। হাসি

এমনকি টেনে টেনে বেশ উপন্যাসও করে ফেলা যায়। ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো যায় বেচারা লী বসের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করা নিষেধ জেনে প্রাণপণে সামলে থাকে, এদিকে সে আর ঝিনঝিয়াং আসলেই বিনা কথাতেই পরস্পরকে মর্মান্তিক ভালোবাসে, বেচারা লীয়ের দেশের বাড়ী থেকে তার ট্র্যাডিশনাল বাপমা তার জন্য পাত্রী ঠিক করবে বলে তাগাদা দেয়। এইসবের মাঝখানে বেচারা ছেলেটার জিন গবেষণা মাঝে মাঝেই উল্টাপালটা রেজাল্ট দেয় আর জীমানসায়েব রেগে যান।

এদিকে রওশন-আরা আর পাভেলের হয়েছে আরেক জ্বালা, তারাও জানে তারা পরস্পরের অনুরক্ত, কিন্তু এক ল্যাবে কাজ করলেও তাদের দেশের বাড়ী দু'খানা এমন দেশে যারা প্রথম সুযোগেই যুদ্ধং দেহি বলে বসবে। এর মাঝখানে তাদের গবেষণায় হামেশা ভুলভাল রেজালট আসে আর জীমানসায়েব অবাক হয়ে বলেন- তোমাদের সমস্যাটা কোথায়?

এইরকম সব উপগল্প ঢুকে পড়লে তবে তো মহাগল্প হয়ে যাবে। হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

পাঠক এর ছবি

কস্কি মমিন!

তুলিরেখা এর ছবি

কেন পাঠক? চিন্তিত
এটা কি গল্পটা পড়ে নাকি উপরের কমেন্টটা পড়ে? হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।