নীলকলমীলতা

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: মঙ্গল, ০৭/০৯/২০১০ - ৩:২৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বহুদিন পরে কলম দিয়ে লিখতে গিয়ে চমকে উঠি, কলমটা নীল। আমার সেই কলমটাও নীল রঙের ছিলো। ঐ যে যেটা এক অপার্থিব হলুদ আলোয় ধুয়ে যাওয়া বিকালে অনেক চাঁদিয়াল ঘুড়ি ওড়া আকাশের নিচে আমাকে দিয়েছিলো শরণ্য। এইখানেই তো! এই পাথরেই তো বসেছিলাম আমরা।

কলমটা দিয়ে লিখতাম হাবিজাবি যা খুশি তাই। কাঁচামিঠে গল্প, আনকথা বানকথা গোঁজামিলের কবিতা --- সবকিছু তার শোনা চাই। একটা দিন বাদ যেতে পারতো না, বাদ গেলে তার কী অভিমান!

সে আমায় ডাকতো নীলকলমীলতা। কী যে ছিলো সেই ডাকে! কেমন একটা কাছে থাকার কোমল আনন্দের সঙ্গে সুদূরের গাঢ় বিষাদ অঙ্গাঙ্গী হয়ে জড়িয়ে থাকতো সেই ডাকে। ও কি জানতো আগে থেকেই ভবিষ্যতের কথা?

কেটে গেল কতগুলো বছর। বছরগুলো ঘন আঠালো সরের মতন, নজর চলে না বেশীদূর। বিচ্ছেদের সেই জ্বলন্ত তীব্রতা মিলিয়ে গেছে, রয়ে গেছে কেমন এক জ্বরো ক্লান্তি আর শিরশিরে কাঁপা-কাঁপা স্মৃতি।

আ:, এই হবার ছিলো? একদিন বিপুল বন্যার মতন যা মনপ্রাণকে আলোড়িত করেছিলো আজ তার স্মৃতিমাত্র সার? না এ হতে পারে না, আমাদের চেতনা অশূন্য অমৃতপাত্র, কিছুই হারাবে না, হারাবে না, হারাতে পারে না। শুধু লুকিয়ে আছে সে, একদিন প্রকাশিত হবেই।

শেষ বিকালের আলোয় আজও ধুয়ে যাচ্ছে চরাচর, একজোড়া টুনটুনি ওড়াউড়ি করছে শিমগাছে, থোকা থোকা রোদ লেগে আছে মস্ত মস্ত শাল মেহগিনি সেগুনের ডালে পাতায়। এমন সব বিকালেই তো আমার কত কিছু শোনানোর থাকতো ওকে!

নদীটা একই রকম আছে, এর স্রোত, তীরের পাথরবালির কারুকাজ, পাড় থেকে ঝুঁকে পড়া গাছগুলো, ঐ যে আলোছায়ার জাফরির মধ্য দিয়ে দৌড়চ্ছে জলধারা-সব, সব একই আছে। এর সুরেলা ছন্দবাঁধা শব্দ, কান পেতে শোনা গানের মতন, তবু ভাষা স্পস্ট হয় না কখনো। কোথায় যেন একজোড়া পাখি ডাকছে, টী হু টী হু টী হু। একটা ডাকে, ডাকে, চুপ করে আর তখন দূর থেকে অন্যটা সাড়া দিয়ে ওঠে। তখনও তো এরকমই পাখিরা ডাকতো সায় মেলানো ডাক। এরা কি সেই পাখিরাই নাকি তাদের নাতিনাতনিরা? কে জানে ক'বছর বাঁচে বনের এই সুরেলা পাখিরা!

নদীর আয়নায় ঝুঁকে পড়ি, আঁজলা ভরে তুলে নিই-
জীবন জীবন আহা জীবন---
দু'দিনের তৃষ্ণা, দু'দিনের ক্ষুধা
দু'দিনের ধূলাখেলা মেলামাঠ নাগরদোলার
দু'পাশে গভীর ঘুমের কবিতা।

এ মাটির কলসে পূর্ণ থেকে পূর্ণ তুলে নিই, পূর্ণ পূর্ণই থেকে যায়। এ যে সেই আশ্চর্য, একই সঙ্গে খুব কাছে আবার খুব দূরে, চলেও আবার চলেও না। সে একই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন আবার অবিচ্ছিন্ন। সে চিরসংলগ্ন হয়ে আছে ঐ নীহারিকাপার দূরত্বের বাধা পার হয়ে। এই রহস্যরোমাঞ্চময় গভীর জটিল ধাঁধার মধ্যে জন্মে সামান্য নিজের চেনাটুকু হারানো নিয়ে অভিযোগ করা কি শোভা পায়?

রক্তসন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে, আঁধার ঘনিয়ে এসেছে, আকাশভর্তি তারা ঝমঝম করে বেজে উঠছে। ঐ কোটি কোটি অর্বুদ অর্বুদ বছরের আদরের তারাগুলি আমার। আকাশের বাগানে থোকা থোকা নতুন মুকুলের মতন, কত পুরানো ওরা, তবু কত নতুন! "শান্ত হে মুক্ত হে হে অনন্ত পুণ্য / করুণাঘন ধরণীতল কর কলঙ্কশূন্য। "


মন্তব্য

অনিকেত এর ছবি

বছরগুলো ঘন আঠালো সরের মতন, নজর চলে না বেশীদূর। বিচ্ছেদের সেই জ্বলন্ত তীব্রতা মিলিয়ে গেছে, রয়ে গেছে কেমন এক জ্বরো ক্লান্তি আর শিরশিরে কাঁপা-কাঁপা স্মৃতি

রক্তসন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে, আঁধার ঘনিয়ে এসেছে, আকাশভর্তি তারা ঝমঝম করে বেজে উঠছে।

এমন বাক্যবন্ধ কেবল আপনিই লিখতে পারেন

অনেক হিংসা করে গেলাম।

তুলিরেখা এর ছবি

অনিকেত, ভালো থাকুন।
নিরন্তর শুভেচ্ছা।
আপনার কাজ কী সম্পূর্ণ হতে চলেছে শীঘ্রই ?

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

প্রখর-রোদ্দুর এর ছবি

স্বপ্ন আমার কবিতা
অমাবস্যার দেয়ালি
ধুম্রলোচন নিদ্রাহীন
মাঘরজনীর সবিতা ।

স্তব্ধ গানের ক্ষিপ্র স্রোতের রাতদিন .............

তুলিরেখা এর ছবি

ভারী সুন্দর আপনার লাইন গুলো।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

আপনার লেখায় আসি। মাঝে মাঝে দুইএকটা শব্দ খেয়ে বাদুড়ের মতো উড়ে চলে যাই। আমি এই গদ্যপাঠের উপযুক্ত না ... কী আশ্চর্য শান্তি !
_________________________________
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

তুলিরেখা এর ছবি

বাদুড়ের মত উড়ে চলে যান ??????
কোন বাদুড়? কলাবাদুড়? নাকি ভ্যাম্পায়ার বাদুড়?
হাসি

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নাজনীন খলিল এর ছবি

বিচ্ছেদের সেই জ্বলন্ত তীব্রতা মিলিয়ে গেছে, রয়ে গেছে কেমন এক জ্বরো ক্লান্তি আর শিরশিরে কাঁপা-কাঁপা স্মৃতি।

খুব ভাল লাগলো । শুভেচ্ছা।

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ নাজনীন।
ভালো থাকবেন।

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ওডিন এর ছবি

আকাশভর্তি তারা ঝমঝম করে বেজে উঠছে

আবারো জিজ্ঞেস করছি- আপনি কোন ব্রান্ডের কিবোর্ড ব্যবহার করেন। নাকি কাস্টম মেইড?
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না

তুলিরেখা এর ছবি

হাসি
তবে? সে কী যে সে কীবোর্ড? একেবারে অর্ডার দিয়ে বানানো। লাল নীল সবুজ হলুদ গোলাপী কমলা নানারঙের সব কী, ঝলমল করছে যেন রেইনবো! হাসি

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।