দেশবিদেশের উপকথা- কথা বলা পাখি (ইতালি)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: রবি, ২২/০৫/২০১১ - ৩:৫৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ইতালির এই উপকথার সাথে কোথাও কোথাও আমাদের অরুণ বরুণ কিরণমালা কাহিনির খুব মিল আছে। কোন দেশ থেকে কোন কাহিনি কোথায় গেছে তা বার করতে গেলে রীতিমতো রাখালদাসকে ডাকতে হয়। হাসি

সদ্য সিংহাসনে বসেছে এক তরুণ রাজা, তখনও তার রাণী কেউ নাই। রাজার মনে টগবগে আদর্শবাদ, প্রজাদের সুখ সাচ্ছন্দ্যের কথা সরাসরি নিজের চোখে দেখতে নিজের কানে শুনতে চায়। তারা কষ্টে আছে কিনা সে তার খবর নিতে চায়, তাহলে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারবে। 

মন্ত্রীদের কাছে সে পরামর্শ চায় কী করা উচিত। বুড়ো মন্ত্রী পরামর্শ দেয় প্রাচীনকালের রাজাদের মতন ছদ্মবেশ ধরে বেরিয়ে পড়ে সে যেন গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রজাদের কথা নিজকর্ণে শোনে। রাজার খুব পছন্দ হলো কথাটা। সে ছদ্মবেশ ধরে বেরোতে শুরু করলো তার প্রজাদের কথা শুনতে। তারপর থেকে কোথায় কে দু:খে আছে, খেতে পাচ্ছে না, থাকার জায়গা পাচ্ছে না কাজ পাচ্ছে না, রাজা সমাধান করে দেন। এই রাজার রাজ্য যেন সেই স্বর্গরাজ্য যার কথা লোকে কল্পনাই করে। রাজার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে।

এক গ্রামে থাকতো তিন বোন, তাদের বাবামা মরে গেছে। তিন বোন চরকায় সুতা কেটে জীবিকানির্বাহ করে। একদিন ছদ্মবেশী রাজা সন্ধেবেলা তাদের কুটিরের পাশ দিয়ে ফিরছিল, শুনতে পেলো ওরা কথা বলছে।
বড় বোন বলছে, "এই দিনের পর দিন দুটি ভাত আর শাকপাতা খেয়ে থাকা। আর ভালো লাগে না। আহা আমার যদি রাজার বাবুর্চীর সঙ্গে বিয়ে হতো, তাহলে কত ভালো ভালো খাবার খেতে পেতাম।"
মেজোবোন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, "সারাদিন চরকায় সুতা কেটে কী ই বা রোজগার আমাদের? কোনোরকমে দু'বেলা দুটি খাওয়া জোটে। কাপড়ের অবস্থা দ্যাখ দিদি, এখানে ছেঁড়া, ওখানে তাপ্পি মারা। একেকদিন ভালো পোশাক পরতে ইচ্ছে করে, কোথায় পাবো? গরীব বলে কি আমাদের সাধা আহ্লাদ নেই? রাজার দরজির সাথে বিয়ে হলে কী ভালো হতো! কত ভালো ভালো পোশাক পরতে পারতাম।"
তারপরে খানিকক্ষণ চুপচাপ, শেষে বড় বোন বলে, "কী রে ছুটকী, তুই কিছু বললি না?"
ছোটোবোন আস্তে আস্তে বলে, " রাজার সাথে যদি আমার বিয়ে হতো, তাহলে বছর পুরলে আমাদের ঘরে আসতো দুই রাজপুত্র আর এক রাজকন্যা। বড়ছেলের কপালে সূর্যের ছাপ, ছোটোছেলের কপালে চাঁদের ছাপ আর মেয়েটির কপালে তারার ছাপ।"
দুই বড় বোন হো হো করে হেসে বলে,  "ও মা গো! আমাদের ছুটকী একেবারে রাজার রাণী হতে চায়। শুধু তাই না, ছেলেপিলে অবধি ভেবে ফেলেছে। কোথায় যাবো গো!"
ছোটোবোন সঙ্কুচিত গলায় বলে, "আমি বলতে চাই নি, তোমরাই শুনতে চাইলে। খেতে চলো দিদিরা, সেই কখন খাবার তৈরী হয়ে গেছে। "

সেই রাতে ঘরে ফিরতে ফিরতে রাজার কানে লেগে রইলো এই ছোটো বোনটির মিষ্টি নরম গলা আর তার স্বপ্নের মতন কথা। এই দরিদ্র মেয়েটি নিজের জন্য কিছু চায় না? গয়না কাপড় হীরেমোতির কথা তো সে কিছু বললো না? 

পরদিন এই তিন বোনের তলব পড়লো রাজসভায়। ওরা তো ভয়েই অস্থির, কী করেছে তারা? ছোটো বোন বলে, "কোনো অন্যায় তো করিনি আমরা, কেন ভয় পাচ্ছো তোমরা? দেখো আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। আর আমাদের মতন গরীব চরকাকাটা মেয়েকে অকারণে শাস্তি দিয়ে এমন মহান রাজার কোনো মান ও বাড়বে না।"

জাঁকজমকভরা রাজসভা আলো করে বসে আছে রাজা, আশেপাশে মন্ত্রী সান্ত্রীরা। বড় বোনকে রাজা বলে, "তুমি বলেছ কিনা যে রাজবাবুর্চিকে বিয়ে করতে পারলে তুমি খুশী হবে?" বড় বোন কথা কইতে পারার অবস্থায় নেই, সে মাথা নেড়ে জানায় বলেছিলো। রাজা তার সঙ্গে নিজের বাবুর্চির বিয়ের বন্দোবস্তো করে।

এবারে মেজোবোনকে রাজা বলে, "তুমি বলেছ কিনা যে রাজার দর্জিকে বিয়ে করতে পারলে তুমি খুশী হবে?" মেজো বোনও ভয়ে কাঁপছে, কথা কইতে পারার অবস্থায় নেই, সে মাথা নেড়ে জানায় বলেছিলো। রাজা তার সঙ্গে নিজের দর্জির বিয়ের বন্দোবস্তো করে।

তারপরে সিংহাসন থেকে নেমে এসে রাজা এদের ছোটোবোনের সামনে নতজানু হয়ে বসে বলে, "তুমি .... তুমি আমাকে বিয়ে করবে?" মেয়েটি মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ বলামাত্র বেজে ওঠে বাদ্যবাজনা, চারিদিক থেকে ফুল সুগন্ধী ছড়িয়ে পড়তে থাকে, রাজার সাথে এই মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। সে হয় রাণীর মতন রাণী।      

কিছুদিন সুখে দিন যায় রাজারাণীর। এমন রাণী পেয়ে রাজার স্বর্গসুখ। কয়েকমাস গেল, রাণী সন্তানসম্ভবা হলো। এদিকে সেই সময়েই পাশের দেশের সঙ্গে লাগলো যুদ্ধ। রাজা সৈন্যসামন্ত নিয়ে গেল যুদ্ধে আর রাণীর দেখাশোনার জন্য প্রাসাদে এলো রাণীর বড় দুই বোন। ছোটোবোনের সম্পদ গয়না কাপড় হীরেমোতি দেখে তাদের তো চক্ষু চড়কগাছ। হিংসেয় তাদের বুক জ্বলে। কিন্তু সামনে দেখায় যেন বোনের সুখ দেখে তাদের আনন্দের সীমা নাই।

নির্দিষ্ট সময়ে রাণীর সন্তান জন্মালো। তিনটি ফুটফুটে ছেলেমেয়ে। বড় ছেলের কপালে সূর্যের ছাপ, ছোটোছেলের কপালে চাঁদের ছাপ আর মেয়েটির কপালে তারার ছাপ। রাণীর চেতন নাই, রাণীর দুই হিংসুটে দিদি বাচ্চাগুলোকে কাঁথায় মুড়ে বনের ধারে ফেলতে পাঠিয়ে দিলো নিজেদের লোক দিয়ে। আর তিনটে কুকুরছানা তোয়ালে মুড়ে রাণীর পাশে রাখলো। রাজার কাছে খবর পাঠালো রাণীর তিন কুকুরছানা হয়েছে। দেখতে দেখতে দেশময় রটে গেল এই খবর। রাজা যখন শুনলো তখন রেগে হুকুম দিলো রাণীকে কারাগারে বন্দী করে রাখতে। যে কথা সেই কাজ, হুকুম তামিল হয়ে গেল।

এদিকে সেই যে দুই ছেলে আর এক মেয়ে, তারা বনের ধারে পড়ে পড়ে যখন কাঁদছিলো, তখন তিন পরী তাদের রক্ষা করলো। হরিণ মায়ের দুধ খাইয়ে ওরা বাঁচালো এদের।দেখতে দেখতে ওরা সুন্দর তিন বালক বালিকা হয়ে ওঠে বছরে বছরে। পরীরা চলে যাবার আগে ওদের ধনদৌলত দেয় আর দেয় একটা আংটি, তার পাথরটা নীল। পরীরা বলে এ আংটির পাথরে যাদু আছে। তিনজনের একজনও যদি দূরে থাকে তাহলে তার কিছু বিপদআপদ হলো কিনা তা এটা থেকে বোঝা যাবে। পাথর যখন রঙ বদলাবে তখন বুঝতে হবে কিছু বিপদ হয়েছে।

তিন ভাইবোন রাজপ্রাসাদের উলটোদিকে জায়গাজামি কিনে সুন্দর এক বাড়ী আর বাগান বানায়। রাজপ্রাসাদে রাজা নাই সে এখনো যুদ্ধে, রাণী নাই সে তো কারাগারে, এখন ওদের সেই হিংসুটে মাসীরাই প্রাসাদে সর্বেসর্বা। এই তিন ছেলেমেয়ে যদিও তাদের চেনে না কিন্তু মাসীরা ঠিকই চিনতে পেরেছে সূর্য চাঁদ আর তারা ছাপ দেখে। তাহলে মরে নি বাচ্চাগুলো? এখন উপায়?

একদিন সদয় প্রতিবেশী হিসাবে বাড়ী বাগান দেখতে আসে তারা। খুব বাহবা দেয় সবকিছুর। তারপরে তারাকুমারীকে বলে, " সবই তো আছে, ঝলমলে বাড়ী, এমন সুন্দর বাগান কিন্তু মাত্র তিনটি জিনিসের অভাবে সর্বাঙ্গসুন্দর হচ্ছে না। "
তারাকুমারী জানতে চায়, "কী সেই তিনটে জিনিস?"
বড়মাসী বলে, "এমন জলধারা যা নাচে, এমন আপেলগাছ যা গান গায় আর এমন পাখি যে কথা কয়। এই তিনটি জিনিস আনতে পারলেই সর্বাঙ্গসুন্দর হতো।তোমার ভাইরা যদি সত্যি তোমায় ভালোবাসে, নিশ্চয় ওরা এনে দেবে। "

বড় ভাই যখন শুনলো তখনই সে চললো নৃত্যশীল জল আনতে। পথে দেখা তিন বুড়োর সাথে, সে জানতো না এরা তিনজন ছদ্মবেশী সেই তিন পরী যারা ওদের রক্ষা করেছিলো। সূর্যকুমারের কাছে সব শুনে তিন বুড়ো পরামর্শ দেয়, এই যে সামনে পাহাড়, পাহাড় বেয়ে উঠলে দেখবে এক আলিশান প্রাসাদ। প্রাসাদের বাগানে আছে নৃত্যশীল জলধারা। কিন্তু তার চারপাশে কড়া পাহারা। চারকোণে চার দৈত্য পাহারা দেয়। ওদের চোখ খোলা থাকলে খবরদার এগিও না, লুকিয়ে থেকো। যখন ঘুমে ওদের চোখ বুজে যাবে তখন এগিয়ে যেও। তারপরে জলধারার চারপাশে আছে চার সিংহ, ওরা জেগে থাকলে খবরদার এগিও না, যখন ওরা ঘুমাবে তখন এগিয়ে গিয়ে জল ভরে নিও ঘড়ায়, ঘড়ার মুখ ঢাকনা বন্ধ করে দৌড়ে ফিরে এসো।

তো যা শোনা ঠিক সেই মত কাজ করে সূর্যকুমার। নির্বিঘ্নে জল নিয়ে সে ফিরলো। নিজেদের বাগানে দুটি কুন্ডে এই জল ঢেলে দিলো সে, এক কুন্ড থেকে আরেক কুন্ডে লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে চললো জল, তার বাঁকানো ধনুকের মতন ধারায় ফুটে উঠলো রঙধনুর সাত রঙ।

এবারে মেজোভাইয়ের পালা, সে চললো গান গাওয়া আপেল গাছ আনতে। তারও পথে দেখা তিন বুড়োর সাথে, সে জানতো না এরা তিনজন ছদ্মবেশী সেই তিন পরী যারা ওদের রক্ষা করেছিলো। চন্দ্রকুমারের কাছে সব শুনে তিন বুড়ো পরামর্শ দেয়, এই যে সামনে পাহাড়, পাহাড় বেয়ে উঠলে দেখবে এক আলিশান প্রাসাদ। প্রাসাদের বাগানে আছে গান গাওয়া আপেলগাছ। আপেল গাছ কেবল নড়েচড়ে, বাতাসে একবার ডাইনে হেলে একবার বামে হেলে। গাছ নড়লেচড়লে খবরদার এগিও না, লুকিয়ে থেকো। যখন গাছ নড়বে না চড়বে না, থেমে থাকবে, তখন এগিয়ে যেও। ডাল ভেঙে নিয়ে দৌড়ে ফিরে এসো।

তো যা শোনা ঠিক সেই মত কাজ করে চন্দ্রকুমার। নির্বিঘ্নে আপেলের ডাল নিয়ে সে ফিরলো। নিজেদের বাগানে পুঁতে দিলো সেই ডাল, জল দিলো। কদিনের মধ্যে তরতাজা হয়ে উঠলো গাছ। সারাদিন সে গাছ গান গায় বাতাসে।

এখন বাকী রইলো শুধু কথাবলা পাখি। পাখি আনতে প্রথমে চললো সূর্যকুমার। পথে আবার দেখা সেই তিন বুড়োর সাথে। সব শুনে ওরা বললো, এ কাজ আগের দু'বারের কাজ থেকে কঠিন। এই যে সামনে পাহাড়, পাহাড় বেয়ে উঠলে দেখবে এক আলিশান প্রাসাদ। প্রাসাদের বাগানে আছে একটা পাথরের বেদী, তার উপরে বসে আছে কথাবলা পাখি। তার চারপাশে কত মানুষের পাথরের মূর্তি। আগে আগে যারা আনতে গেছে তাকে, পাথর হয়ে গেছে। তুমি খুব সাবধান হয়ে এগোবে, দেখবে পাখির ডানায় একটা বড় লাল পালক, সেটা খুলে নেবে। কাছেই দেখবে একটা পাথরের পাত্রে তেল, সেই তেলে পালক ভিজিয়ে মূর্তিগুলোর গায়ে বোলালেই ওরা আবার মানুষ হবে। কিন্তু খুব সাবধান, পাখির কথা শুনে বিচলিত হয়ে যদি কথা বলে ফেলো, তুমিও পাথর হয়ে যাবে।"

সূর্যকুমার গেল, সবই সেই বুড়োদের বলা কথার মত। পাখি কিন্তু তীক্ষ্ণ গলায় বলে, "বোকা রাজপুত্তুর। তুই কে তা তুই কিছু জানিস না। তোর বাপ, বোকা রাজা, সে লড়াই করে আর তোর মা কারাগারে বন্দী।"

সূর্যকুমার বিস্ময়ে চিৎকার করে ওঠে "কী???? আমার মা কারাগারে?"

সঙ্গে সঙ্গে সে পাথরের মূর্তি হয়ে যায়। বাড়ীতে তারাকুমারীর হাতের সেই আংটির পাথর নীল থেকে টকটকে লাল হয়ে যায়। বোন বুঝতে পারে ভাইয়ের কোনো বিপদ হয়েছে।

এবারে রওনা হয় চন্দ্রকুমার। তার অবস্থা অবিকল তার দাদার মতন হয়। বাড়ীতে তারাকুমারীর আংটির পাথর লাল থেকে কুচকুচে কালো হয়ে যায়। ভাইয়ের তবে কোনো বিপদ হয়েছে।

এবারে তারাকুমারী নিজেই রওনা হলো। পথে সেই তিন বুড়োর সাথে তার দেখা হলো, কথাও হলো সব। সে গিয়ে পৌঁছালো সেই বাগানে, কথাবলা পাখির সামনে। পাখি তীক্ষ্ণ গলায় বলে, " তুই ও এসেছিস তবে। তোর দাদারা পাথর হয়েছে, তুই ও হলি বলে। তোর বাপ, বোকা রাজা, সে লড়াই করে আর তোর মা কারাগারে বন্দী। তোর দুই হিংসুটে মাসী সব সুখভোগ করছে।"

তারাকুমারী একটি কথায় ও কান দেয় না, সে একেবারে শান্তভাবে এগিয়ে পাখির ডানা থেকে লাল পালকটা নিয়ে তেলের পাত্রে ডোবায়। প্রথমেই দুই ভাইয়ের মূর্তিতে বোলায়, তারা পাথর থেকে মানুষ হয়। এরপরে সেখানে যত মানুষ পাথর হয়ে ছিলো সবাইকে মুক্ত করে তারা।

কথাবলা পাখি নিয়ে ফিরে আসে ওরা। এখন ওদের বাগান সর্বাঙ্গসুন্দর। সেখানে জল নাচে, আপেল গাছ গান গায় আর পাখি কথা কয়।

সীমান্তের যুদ্ধ শেষ, রাজাও ফিরেছে। এরা তিন ভাইবোন রাজাকে নেমন্তন্ন করে একদিন। রাজা তো এসে সব দেখেশুনে একেবারে বিস্ময়ে থ। নৃত্যশীল জল, গান গাওয়া আপেলগাছ! এমনও হয়! আর সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার এই ছেলেমেয়ে তিনটি। এমন সুন্দর মানুষ হয়! কপালে সূর্য চাঁদ আর তারা! আহা, এমনই কথা না কেজানি বলেছিলো কবে? মনে পড়ে, পড়ে তবু পড়ে না। রাজার চোখ ঝাপসা ঝাপসা লাগে।

পাখিটা কিন্তু কোনো কথা আজ বলছে না। রাজা তার সামনে এসে বলে, " এই পাখি কথা বলে বুঝি?"

পাখিটা তীক্ষ্ণ গলায় বলে, " রাজা, বোকা রাজা, এদের তুই চিনতে পারলি না? এরাই তোর তিন ছেলেমেয়ে। তোর রাণীর বোনেরা হিংসে করে তোকে খবর পাঠিয়েছিলো রাণীর কুকুরছানা হয়েছে আর তা বিশ্বাস করে তুই রাণীকে কারাগারে দিয়েছিস। এদেরও প্রায় মেরেই ফেলছিলো মাসীরা, রক্ষা পেয়েছে পরীদের দয়ায়। এখন তোর রাণী মরতে বসেছে কারাগারে আর প্রাসাদে সুখভোগ করে এদের হিংসুটে মাসীরা। সব তোর বোকামির জন্য। বলতো তোর কী সাজা হওয়া উচিত?"

আর কিছু বলার দরকার ছিলো না, রাজা সব বুঝতে পারে। মৃতপ্রায় রাণীকে মুক্ত করা হয় কারাগার থেকে। রাজা রাণীর কাছে আর ছেলেমেয়েদের কাছে ভুলের জন্য ক্ষমা চায়। ছেলেমেয়েরা আর রাণী তাকে ক্ষমা করে দেয়। হিংসুটে মাসীদের প্রাণদন্ড হয়।

এরপরে আর কী? রাজারাণী তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখেশান্তিতে বসবাস করতে থাকে।


মন্তব্য

অপছন্দনীয় এর ছবি

পরিপূর্ণরূপে স্ববিরোধী তথ্যসমৃদ্ধ।

যে রাজা প্রজার দুঃখ দেখার জন্য ছদ্মবেশে ঘুরতে পারে, সাধারণ ঘরের মেয়ের গুণ দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে রানী করতে পারে - সে একজন মহাপুরুষ, এবং প্রেমিকপুরুষও বটে। আর যে রাজা লোকমুখে কুকুরছানা হয়েছে শুনে এত প্রিয় রানীকে কয়েদ করতে পারে, সে একটি খাঁটি রামছাগল - এবং সেইসঙ্গে পাষন্ড।

এবং ইহা স্বতঃসিদ্ধ যে একই ব্যক্তি কদাচ একইসঙ্গে রামছাগল এবং মহাপুরুষ হয় না।

অতএবঃ...

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

একজন মেয়ে তার ভবিষ্যত সন্তান কেমন হবে সেই বর্ণনা করে কীভাবে? এর ভিত্তি কী? সেই ভিত্তিহীন কথা বিশ্বাস করে যে তাকে বিয়ে করে ফেলতে পারে সে মহাপুরুষ বা প্রেমিকপুরুষ নয় - সে মহাখেয়ালী (মতান্তরে মহা রামছাগল)। আর এমন একজন খেয়ালীর (মতান্তরে মহা রামছাগল) পক্ষে তার ঔরসে কুকুরছানা পয়দা হবার গল্প বিশ্বাস করতে পারা বা রাণীকে কয়েদ রাখা উভয়ই সম্ভব। তার এই খেয়ালীত্ব (মতান্তরে ছাগলত্ব) প্রৌঢ়াবস্থায়ও বিদ্যমান। নয়তো প্রতিবেশীর ঐশ্বর্য দেখে সে ভিমরি খাবে কেনো, আর একটা কথা শেখানো পাখির বয়ান শুনে অপরিচিতদের নিজের সন্তান বলে গ্রহন করবে কেনো!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অপছন্দনীয় এর ছবি

ওই ব্যাটা কি কপালে চাঁদ তারা সূর্যের কথা শুনে বিয়ে করতে চেয়েছিলো নাকি 'নিজের জন্য কিছু চায় না' দেখে?

গোড়ায়ই কি বুঝতে ভুল করলাম নাকি? ইয়ে, মানে...

তবে যদি সত্যি চাঁদ তারা সূর্যের কথা শুনে বিয়ে করতে চেয়ে থাকে, তবে ঠিক আছে, ওটা শুরু থেকেই মহা রামছাগল।

তুলিরেখা এর ছবি

একদম। রাণী কত জুটবে! দেশে মেয়ের অভাব? ভাত ছড়ালে কাকের অভাব? ঐ ব্যাটা সূর্য চাঁদ তারা শুনেই বিয়ে করতে চেয়েছিলো শিওর। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অপছন্দনীয় এর ছবি

তাহলে ষষ্ঠ পান্ডব পুরোপুরি ঠিক কথাই বলেছেন, ওটা রামছাগলের রাজাই হবে।

আর ইয়ে,

বছর পুরলে আমাদের ঘরে আসতো দুই রাজপুত্র আর এক রাজকন্যা

মাত্র বছর পুরলেই এই হবে!!!..এদের কি মাথায় ওই একটা 'কর্ম' ছাড়া আর কোন চিন্তা আসে না?

তুলিরেখা এর ছবি

প্রাচীনকালে "বিবাহ" এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো তাই। এখন তো কত উন্নতি হয়েছে মানুষের, তবু কত শিক্ষিত কেসেও শুনতে পাই এই নিয়ে ঝামেলা। কোনো কোনো কেসে আরো ডার্ক, "পুত্র" চাই তাই নিজের স্ত্রীর বার তিনেক অ্যাবরশন করিয়েছেন আইটি চাকুরে "ভদ্রলোক"(মেয়ে ভ্রূণ জানার পরেই ), আর হুমকী দিয়েছেন এবারও ছেলে না হলে ডিভোর্স করবেন। মন খারাপ
কী বলবো বলুন, ২০১১ সাল চলছে, মানুষ চাঁদে একাধিকবার গেছে, মঙ্গলে যাবার ছক কষছে, হাবল টেলিস্কোপ মহাকাশে তুলেছে, আরো একটা তুলবে বলে ছক কষছে, হিউম্যান জিনোম ডিকোডেড হয়ে গেছে, দুনিয়াজোড়া নেটোয়ার্ক এসে গেছে---সেই একই সময়ে এইসব ও চলছে। মাঝে মাঝে মনে হয় টেকনোলজি আমাদের কয়েকটা টুল হাতে দিয়েছে শুধু, মনের অন্ধকার মনেই থেকে গেছে।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তুলিরেখা এর ছবি

ঠিক কইছেন, হক কথা। হাসি
গ্রীক মিথের রাজারাও অনেকে এরকম ছিলো, ডেলফিতে কী দৈববাণী হলো তা জানাও চাই, নিজের মতন ইন্টারপ্রিটও করা চাই আবার আসলে কী ব্যাপার তা না বুঝেই একে মার তাকে বলি দে ওকে বনে ফেলে আয় এসবও করা চাই। কী আর বলবো! বৈষ্ণব কবিদের রাধা হইলে বলতো , "কী আর বলিবো আমি!"
চিন্তিত

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

guest_writer এর ছবি

উপকথার তথ্যে স্ববিরোধীতার হিসাব করতাসেন!! ভাইজান, আপনে শিওর ফাইজলামী করতাসেন, কন?
-মেফিস্টো

অপছন্দনীয় এর ছবি

দেঁতো হাসি

মেফিস্টো??? আপনার নামের পিছনে আপনি সাধারণত লেখেন না এরকম কিছু আছে কি?

তুলিরেখা এর ছবি

এই বোকা রাজা তো বটেই, বেশীরভাগ রাজারা এরকমই! স্ববিরোধী। মহান মোগল রাজাদের ভিতরের গল্প দেখুন, বিশ্বাস হবে না একই লোক কীভাবে এত "মহান" আর এত "নিষ্ঠুর" হতে পারে। আকবর দ্য গ্রেট এত সব মহান মহান কাজ করলেন, কী মহান শাসনব্যবস্থা, কী মহান আইনকানুন অথচ সামান্য দুর্বল মেয়ে আনারকলিকে জ্যান্ত গাঁথলেন।
আর ওই মহান ব্রিটিশ রাজা? এত সব ভালো ভালো কাজ করলেন, চার্চ রাষ্ট্র আলাদা করলেন অথচ রাণীদের মুন্ডু কাটলেন।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অপছন্দনীয় এর ছবি

ব্যাটারা পাজি... ইয়ে, মানে...

আরাকানের রাজাও শুনেছিলাম সুজা না কে যেন তারই আশ্রয়ে থেকে তার রাজ্য দখলের পাঁয়তারা কষছিলো বলে তার মুন্ডু ঘ্যাঁচাং করে দিয়ে (উচিত কাজ হয়েছে, একটা খাঁটি রামছাগল কমেছে পৃথিবী থেকে) তার বউ মেয়েকে মারতে গিয়ে 'দয়াপরবশ হয়ে'(!) অথবা 'ধর্ম রক্ষা করতে গিয়ে' রক্তপাত যাতে না হয় সেজন্য একটা ঘরে আটকে রেখে খাবার আর পানি বন্ধ করে দিয়ে মেরেছিলো...কতদূর সত্যি জানি না।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এই ফাঁকে একটা প্রশ্ন করে রাখি সবাইকে, কেউ কোন অবসরে এখানে বা সুবিধা মতো কোথাও উত্তরটা দিলেই চলবে। প্রশ্নটা হচ্ছে, "কী বিচারে, কী কী গুণে, কী কী সুনীতি ও সুকীর্তির জন্য আকবরকে গ্রেট বলতে হবে?" উত্তর দেবার সময় কেউ দয়া করে "আইন-ই-আকবরী", "ফতোয়ায়ে আলমগীরি" বা "হুমায়ুননামা" জাতীয় কেচ্ছার বই থেকে রেফারেন্স দেবেন না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অপছন্দনীয় এর ছবি

উত্তর দেবার সময় কেউ দয়া করে "আইন-ই-আকবরী", "ফতোয়ায়ে আলমগীরি" বা "হুমায়ুননামা" জাতীয় কেচ্ছার বই থেকে রেফারেন্স দেবেন না।

গড়াগড়ি দিয়া হাসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

উল্টো দিক থেকে দ্বিতীয় লাইন হবে, "হেঁটোয় কন্টক দাও, উপরে কন্টক। ডালকুত্তাদের মাঝে করো হে বন্টক।" যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন হেঁটো আর ডালকুত্তা মানে কী, তাহলে আমি বলতে পারবো না।

ইতালীর উপকথাগুলোর মধ্যে রাজকুমারী হাইসিন্থিয়ার গল্পটা এই সিরিজে যোগ করতে পারেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তুলিরেখা এর ছবি

ডালকুত্তা মানে ডালমেশিয়ান কুকুর। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

উপকথা গুলি খুব উপভোগ করছি। আপনার বর্ননা ভঙ্গি খুবই চমৎকার। অনেক অনেক ধন্যবাদ।

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ। সদ্য একটা ইনুইট উপকথা আর সাইবেরিয়ান উপকথা পেয়েছি, একটু সুযোগ পেলেই লিখে দেবো। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মানাবি এর ছবি

দুইটা জিনিস খুবই চোখে লাগলো, মেয়েদের একমাত্র চাওয়া পাওয়া শুধু বিয়ে, রাজাকে বিয়ে করে মেয়েরা ধন্য হবে।
আর গল্পের ভিলেনগুলি সব সময়ই মেয়ে হয়। রূপকথা কিভাবে মেয়েদের ছোটবেলা থেকে সাইকোলজিকালি এফেক্ট করে, এই নিয়ে রিসার্চ হওয়া উচিত।

guest_writer এর ছবি

হেহে। উপকথার লগে দেখা যায় আজকালকার হিন্দী - ইংরেজী সোপ অপেরার মিল খুইজা পাওন যাইতাসে।

-মেফিস্টো

অপছন্দনীয় এর ছবি

রূপকথা-উপকথা সমাজের চেহারা বর্ণনা করে, সমাজের চেহারার গড়ন ঠিক করে দেয় না। এগুলো ফলাফল, কারণ নয়।

কাজেই খালি উপকথার প্রভাব নিয়ে রিসার্চ করে তেমন কিছু পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। যারা রীতিমত নির্দেশ দিয়ে পুরুষতান্ত্রিকতার প্রমোশন প্লাস মেয়েদের ঠেলে নিচে নামিয়ে রাখার কাজটি করে দেয়, অর্থাৎ প্রচলিত মূল ধর্মগুলো এবং সেই সূত্রে গড়ে ওঠা সামাজিক বিধিনিষেধসমূহ, তাদের প্রভাবটা কাটিয়ে দিতে পারলে দেখবেন সমাজের চেহারা সুশ্রী হওয়ার সাথে সাথে উপকথা নিজে নিজেই পাল্টে গেছে। আর এই পুরোনোগুলো পাল্টানোর কোনই দরকার নেই, প্রায় সব ধর্ম এবং সেইসূত্রে সমাজ যদি পুরুষ আর নারীকে সমান দৃষ্টিতে দেখতো, এই উপকথা পড়েও মেয়েদের "বিয়ে করবো - ভিলেন হবো" ধরনের কোন ধারণা তৈরী হতো না। যেসব দেশের আইন ধর্মকে সাপ্রেস করে সমান দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করে, সেদেশেও মেয়েরা এই উপকথা পড়েই বড় হয়, কিন্তু বিয়ে করার জন্যও খেপে থাকে না, আর ভিলেনও হয় না, আর যেদেশে পুরুষতান্ত্রিকতাকে ধর্ম আর সমাজের নামে এতটাই প্রমোট করা হয়, সেখানেও ছেলেরা উপকথা পড়ে ব্যাঙ কি শেয়াল বিয়ে করতে বের হয়না।

রিসার্চ যদি করতেই হয়, যে রিপোর্টে (অর্থাৎ উপকথায়) মেয়েদেরকে "বিয়েপাগল ভিলেন" হিসেবে দেখানো হয় সেগুলো না পাল্টে, ঈশ্বরের নামে যে সব ঐশ্বরিক বিধানের সাহায্যে ওই একই কাজ করতে নির্দেশ দেয়া হয় সেগুলো নিয়ে করুন, সেগুলোকে পাল্টে দিন, পৃথিবীটা অনেক সুন্দর আর বাসযোগ্য হবে। রিপোর্ট পাল্টালে সমস্যা যাবে না, ঢেকে রাখা হবে শুধু।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।