ফিরে এসো সবুজ পৃথিবী

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: সোম, ০৬/০৬/২০১১ - ১২:০৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই গল্প বহুকাল আগের, তখন হাত মকশো শুরু করেছি সবে। নানা ঊর্ধরৈখিক পাড়ায় যাতায়াতের সুবাদে আস্তে আস্তে পালে বাতাসও লাগছিলো। সেসব পাড়ার কিছু কিছু এখনো আছে, কিছু কিছু আর নেই। সেসব পুরানো দিনের পুরানো পাড়ার লোকেরা অনেকে নতুন পাড়ায় নিয়মিত হয়েছেন। এই গল্পের খন্ড খন্ড অগোছালো অংশ ওসব জায়গায় আগেই হয়তো কেউ কেউ দেখে থাকতে পারেন। আজও পরিবেশ দিবস এলেই নতুন বন্ধুদের সাথে এ গল্প ভাগ করে নিতে ইচ্ছা করে। অন্যরকম পৃথিবীর সেই তিয়া আর তুরাব, সেই সবুজ পৃথিবীর অপেক্ষা। যদিও পরিবেশ দিবস পেরিয়ে গেছে পুবের দিকে, এদিকে এখনও চলছে। হাসি

তিয়া রোজ সকালে একবার করে এসে দাঁড়ায় এই অদ্ভুত ব্যালকনিটায়। খুব ছোটোবেলা থেকে। কেন কে জানে।একেবারে তিন-চার বছর বয়স থেকে। বাইরেটা একবার করে না দেখলে ওর কেমন যেন খুব খালি খালি লাগে। সারাটা দিন কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগে ওর।

স্বচ্ছ প্লাস্টিক বা পলিমার জাতীয় পদার্থের আবরণে পুরোটা ঢাকা এই ব্যালকনিটা। তবু তার মধ্য দিয়ে বাইরেটা দেখা যায়। বাইরেটায় দেখবার কী আছে? শুধু একটা ঝুলকালো আকাশ আর কালচে একটা দিগন্ত। না সূর্য, না চাঁদ, না দুটো একটা পাখির ওড়াউড়ি, না একটা মধুর নীল আকাশ, সবুজ গাছের মাথা-কিচ্ছু না। সেসব নাকি ছিল। অনেক আগে। কয়েকশো বছর আগে। তিয়া শুনেছে আর ছবিতে, মুভিতে, সিডিতে দেখেছে। কী আশ্চর্য সুন্দরই না ছিল তখন পৃথিবীটা। মাঝে মাঝেই এই সক্কালবেলাটায়, যখন কেউ ওঠে নি ঘুম থেকে তখন এইরকম ভাবে তিয়া। নইলে সবাই তো ওকে অস্বাভাবিক ভাববে! হয়তো নিয়ে যাবে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। তিনি তাঁর বহু রকমের প্রোব দিয়ে হয়তো তিয়ার মগজ পরীক্ষা করবেন।

ঝুলকালো আকাশটা দেখতে দেখতে তিয়ার ছবিতে দেখা নীলার মতো নীল আকাশটা মনে পড়ে। সত্যি ঐরকম ছিল আকাশটা? কেন আবার ঐরকম হয় না? মানুষ অত হিতজ্ঞানশূন্য কেন ছিল? কেন তারা ভবিষ্যতের কথা ভাবলো না? কেন পরিবেশ এরকম ভাবে দূষিত করে দিলো? আকাশের ঐ মেঘ থেকে মাঝে মাঝে যে বৃষ্টি নামে, তাতে অ্যাসিড। সেই বিষে সব গাছ মরে গেছে। সামান্য যে কটা নাছোড়বান্দা চারা এখনো গজিয়ে ওঠে দুই বৃষ্টির মাঝে-সব কুঁকড়ে পুড়ে শেষ হয়ে যায় ঐ অভিশাপের মতো বৃষ্টিতে।আবার কবে শুদ্ধ জলের বৃষ্টি নামবে? কবে এই এখনকার ঐ অভিশাপের মতো নষ্টমেঘ শেষ হয়ে নীল টলটলে আকাশটা আবার মুখ দেখাবে?
একটা ছোট্টো দীর্ঘশ্বাস পড়ে তিয়ার।ওর এইসব কবি কবি ভাবনার কোনো অর্থই অন্য কারুর কাছে নেই।

তিয়ার দিদি তিষা ওর থেকে চার বছরের বড়ো।কিন্তু তিষা তিয়ার এইসব কথায় হাসে। আগে যখন তিয়া আরো ছোটো ছিল, তখন দিদিকে এসব কথাগুলো বলতো। কিন্তু শুনে দিদির সে কি হাসি। যেন দারুণ মজার কথা শুনেছে। মাকে ডেকে নিয়ে এলো শোনানোর জন্য। কী অদ্ভুত! যা কিনা দুঃখের, তাই হয়ে গেল হাসির! মাও কথাগুলোর গুরুত্ব দেয় নি সেদিন। বরং বলেছিল, "তিয়া, পৃথিবীর কথা ভাবতে হবে না। নিজের কথা ভাবো। কই, হোম ওয়ার্কগুলো হয়েছে? "

তিয়া তারপর থেকে আর কোনোদিন এইসব কথা কাউকে বলে নি। বরং, ওদের সামনে বেশ সিরিয়াস হয়ে নিজের পড়াশুনোর কথা বলেছে, দুই বোনের পরীক্ষা হয়ে গেলে কোথায় ঘুরতে যাওয়া হবে, চাঁদে না অ্যাস্টরয়েড বেল্টে-এই নিয়ে মতামত দিয়েছে। ওকে ইন্ডোর স্কি শেখার স্কুলে কবে ভরতি করবেন মা, সে কথা সিরিয়াস হয়ে জানতে চেয়েছে।

তিয়ার বাবা একজন বৈজ্ঞানিক। তিনি বছরের বেশীরভাগ সময়েই পৃথিবীর আর পৃথিবীর বাইরের বিভিন্ন ল্যাবোরেটরিতে। তিয়া শুনেছে যে ওঁরা পৃথিবীর পরিবেশ আবার কিকরে সেই অনেককাল আগের মতো বিশুদ্ধ করা যায়, সেই নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। তিয়া একবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কতদিন লাগবে আবার আগের মতো হতে?

তিয়ার তখন সাত বছর। বাবা ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিলেন, "অনেক অনেক বছর লাগবে।এই দূষিত মেঘ ভেঙে পুরোটা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার মতো হতেই হয়তো পেরিয়ে যাবে বছর পঞ্চাশ। তারপরে না নীল আকাশ, রোদ, সূর্য। তারও পরে গাছপালা, বনজঙ্গল।"

"বাবা, আমাকে নেবে তোমাদের কাজে?"

বাবা হেসেছিলেন। বলেছিলেন "বড়ো হও।মন দিয়ে পড়াশোনা করে যদি বৈজ্ঞানিক হতে পারো, তখনো যদি এই কাজ করার ইচ্ছে থাকে, তাহলে নিশ্চয় যাবে এই কাজে।"

তিয়া ওর বাবার গালে গাল ঠেকিয়ে বলেছিল, " তুমি খুব ভালো, জানো বাবা? তুমি ভীষণ ভালো।আমি নিশ্চয় মন দিয়ে পড়বো।আর ইচ্ছে আমার থাকবেই।"

আজও সেইদিনের কথাগুলো একদম গতকাল শোনার মতো করে মনে মনে আছে তিয়ার। আসলে বাবা ওর খুব মনের মতন। বাবাকে কাছে পায় খুব কম। কত বছর পর পর বাবা ছুটিতে আসেন! সারাক্ষণ কাজ কাজ আর কাজ। তবু এই কাজের কথা ভেবেই ওর ভালো লাগে। মনে হয়, দূরে কোথাও কোনো গবেষনাগারে একজন মানুষ মন দিয়ে হিসেব নিকেশ করে বার করছে কিকরে পৃথিবীকে আবার আগের মতো নিষ্কলুষ করা যায়।
সূর্যহীন পুব আকাশের ঝুল মেঘের দিকে চেয়ে অল্প মাথা ঝোঁকালো তিয়া।ঐ মেঘরাশির ঐপারে কোথাও আছে রূপময় সূর্য- উজল সোনালি তার রঙ, তীক্ষ্ণ অথচ কোমল তার তেজ। তার কথা ভেবেই উদ্দেশ্যে প্রণাম জানায় তিয়া---রোজ। নাহয়, নাই বা দেখা গেল।

স্পেসে গিয়ে সূর্য দেখেছে তিয়া-কালো অন্ধকার স্পেসে জ্বলজ্বলে একটা সাদাটে আলো। স্পেসশিপগুলো এখন লম্বাটে হয় না,বেশ গোল ধরনের হয়।অনেকটা যেন বেড় পরানো বিরাট একটা কমলালেবু।ঐ বেড়ের জায়গা জুড়ে থাকে সারে সারে স্বচ্ছ আবরনী দেওয়া জানালা।ঐ জানালাগুলোর সামনে সীট পাতা, তাতে বসে বসে বা শুয়ে শুয়ে মহাকাশ দেখেছে তিয়া অনেকবার। প্রত্যেকবার স্কুলের পরীক্ষা হয়ে গেলেই মা ওদের দুই বোনকে নিয়ে যান বেড়াতে। দিদির স্পেসই খুব পছন্দের আর মায়েরও।তাই প্রায় প্রত্যেকবারই স্পেসেই যাওয়া হয়। কিন্তু ঐ সূর্য নয়, পৃথিবীর নীল আকাশে যে অপরূপ সূর্যোদয় হতো, সেটা দেখতে চায় তিয়া।

একবার এক ছুটিতে ওরা গেছিল একটা সংরক্ষিত অরণ্য দেখতে। খোলা বন নয়।একটা পাহাড়ের ঢালে শক্ত পদার্থের বিরাট অর্ধগোলকাকার আবরণে ঢাকা বন। ঐ আবরণের ছাদের তলায় দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো আলো জ্বালানো সেই বন দেখতে অদ্ভুৎ লেগেছিল তিয়ার। ঐসব আলোগুলো নাকি নিউক্লিয় শক্তিতে জ্বালানো।বারো ঘন্টা জ্বালিয়ে রাখা হয়, বারো ঘন্টা বন্ধ। এটা গাছেদের সালোকসংশ্লেষের জন্য।

কৃত্রিম জলাশয় ছিল সেখানে, ছিল সরু সরু কৃত্রিম নদীও। ঐ বন দেখে একটুও ভালো লাগেনি তিয়ার। দমচাপা বিচ্ছিরি। তিয়ার কল্পনায় ছিল অশ্চর্য সুন্দর সপ্রাণ এক বন। সেখানে কত পাখি কিচির মিচির করে ডাকছে! দৌড়ে দৌড়ে খেলা করে বেড়াচ্ছে লেজ ফোলানো কাঠবেড়ালীরা। কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে দেখছে খরগোশ। হরিণের দল ছুটে যাচ্ছে, তাদের আঁকা বাঁকা শিঙের কত বাহার!

আর সেখানে এসব কী? কিচ্ছু নেই। শুধু নিস্তব্ধ একটা বন। সেখানে এতটুকু হাওয়া অবধি বয় না যা গাছের পাতাগুলোকে কাঁপাবে!

তিয়াকে মা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে ওরকম সুন্দর বন আর এখন নেই।যেসব প্রানীদের বাঁচানো গিয়েছে তারা থাকে জু তে। তাছাড়া তিয়াকে আরো বলেছিলেন মা, " এখন তো আমাদের সব খাবার দাবার-চাল ডাল তরি তরকারি সব চাষ হয় হার্ভেস্টিং কমপ্লেক্সের ভিতরে। আগে তো তা হতো না! কয়েকশো বছর আগে যখন খোলা বন ছিল, পশুপাখি বেঁচে ছিল তখন মানুষ খোলা মাঠে চাষবাস করতো।তখন কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করতে হতো না,সূর্যের আলোতে গাছেরা সালোকসংশ্লেষ করতো।তখন বিশুদ্ধ জলের বৃষ্টি হতো,তাতে গাছেরা সতেজ আর আরো বেশী সবুজ হয়ে উঠতো। "

*****

ব্যালকনি ছেড়ে ঘরে এলো তিয়া।ইস্কুলের জন্য তৈরী হতে হবে। যে উড়নযানে করে ওরা দু'বোনে ইস্কুলে যায় তার ড্রাইভার একটি রোবট। নাম তার তুরাব। ফ্লাইং গাড়ীটার কাছে ওরা এলেই তুরাব চালকের আসন থেকে নেমে দরজা খুলে ধরে দাঁড়ায় অল্প মাথা ঝুঁকিয়ে। তিয়া আর তিষা "সুপ্রভাত তুরাব" বললেই তুরাব বলে, "সুপ্রভাত, মাদমোয়াজেল।" ঐরকমই নাকি ওর প্রোগ্রামিং করা।ও নাকি তৈরী হয়েছে ফরাসী দেশে।

মাঝে মাঝে তিয়া অবাক হয়ে ভাবে ওর একটা নাম থাকার কী দরকার ছিল? শুধু একটা যন্ত্র, কেবল এই ফ্লাইং গাড়ীটা চালায় আর এটা দেখভাল করে, নতুন এনার্জি বক্সের দরকার থাকলে জানায়, নিজের এনার্জি বক্সের শক্তি ফুরিয়ে গেলে রিচার্জ সেন্টারে যায়-আর বাকি সময়টা শুধু চুপ করে গাড়ীর মধ্যে বসে থাকে-ওর একটা নামের কি দরকার ছিল? কী জানি বোধহয় ওর কোম্পানি থেকেই নামটা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ফরাসী কোম্পানি এরকম অদ্ভুৎ নাম কেন দেবে?

তুরাব এমনিতে কোনো কথা বলে না। হয়তো ওর প্রোগ্রামিংএ ওই কটার বেশী শব্দ দেওয়া নেই। অনেকদিন পর্যন্ত তাই ধারনা ছিল তিয়ার। কিন্তু একদিন সে জানতে পেরেছিল যে তুরাব আরো কথা বলতে পারে। এমনকি ওর মধ্যে সুখ দুঃখ আন্দোলিত একটি মন পর্যন্ত আছে!

কিন্তু সে ঘটনা পরে।আগে তিয়ার সঙ্গে তিয়ার ক্লাসে গিয়ে আমরা দেখি সেখানে ওরা কীকরে লেখাপড়া করে। ওদের ইসকুল একটা বিরাট উঁচু বাড়ীর একেবারে সর্বোচ্চ তলায়।পুরো বাড়ীটাই একটা বিরাট আবরণের ভিতরে। আবরণটা আবার ফুলারিনের গঠনের। মানে অনেক ষড়ভুজ আর পঞ্চভুজ জুড়ে জুড়ে তৈরী হয়েছে সেই মজবুত আবরণ। কিন্তু সেগুলো স্বচ্ছ নয়। সেগুলোতে অনেককিছু ডিসপ্লে করে দেখানো হয়।

তিয়ার ক্লাসের উপরে যে বিরাট পঞ্চভুজটা, তাতে আজ দেখানো হচ্ছিল আকাশের গ্রহনক্ষত্র। এমনিতে তো আর তাদের দেখা যায় না কয়েকশো বছর। কিন্তু এতে কি সুন্দর দেখাচ্ছিল আর তাদের দিদিমণি খুব সুন্দর করে সব বোঝাচ্ছিলেন।তিয়ার সবচেয়ে ভালো লাগে সপ্তর্ষিমন্ডল। সাতটা ঝকঝকে তারা আকাশে কেমন জিজ্ঞাসা চিহ্ন হয়ে জেগে ওঠে, কী অদ্ভুত সুন্দর! আর ভালো লাগে কালপুরুষ। ঝলমলে তিনটে তারা দিয়ে তৈরী তার কোমরের বেল্ট আর তা থেকে ঝোলে তরবারি। সেখানে লেসারের ঝলমলে লাল তীরটা এসে পড়তেই দৃশ্যপট বদলে যায়।

এবারে দেখানো হচ্ছে নীহারিকা।কালপুরুষের তরবারির কাছে আছে একটি নীহারিকা আর কোমরের বেল্টের কাছে আছে আরেকটি নীহারিকা। দিদিমণি সেই দুটো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ডিসপ্লে করে লেসারের তীরচিহ্ন দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তাদের অন্তর্নিহিত পার্থক্য।তিয়ার ভালো লাগে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্লাস।

শেষ হয়ে গেলে সিলিঙের আলো মিলিয়ে গিয়ে ঘরের আলো জ্বলে উঠলো। আলো কোমল, সুন্দর। দিনের আলোর অনুভূতি দেয় নাকি এই আলো।কিজানি, কেমন ছিল সে দিনের আলো।

এবার দিদিমণি প্রশ্ন করছেন তিয়াদের। ওরাও প্রশ্ন করতে পারে, কিছু যদি না বুঝতে পারে। তাহলে দিদিমণি আবার ভালো করে বুঝিয়ে দেন।

পরের ক্লাস সৌরমন্ডলের ভূগোল। প্রথমে পৃথিবীর-ভূপ্রাকৃতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভূগোল। পরে অন্য উপনিবেশগুলো যেমন চাঁদ, মঙ্গল, বৃহস্পতির বড়ো উপগ্রহগুলো--গ্যানিমিড, ইউরোপা, আইও আর ক্যালিস্টো, শনির উপগ্রহ টাইটান, ইউরেনাসের ওবেরন, এরিয়েল, টিটানিয়া, মিরান্দা- এইসব নিয়ে বলছেন দিদিমণি। এইসব উপনিবেশগুলোতে এখন মানুষ থাকে যদিও সংখ্যায় তারা মুষ্টিমেয়।

আর পৃথিবীর জনসংখ্যাই তো মাত্র চার মিলিয়ন মানে চল্লিশ লক্ষ এখন.। তিনশো বছর আগের সেই ভয়ানক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগে তখনকার পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল সাতশো কোটি। বিপর্যয়ের পরে তা নেমে দাঁড়ায় মাত্র এক মিলিয়নে মানে দশ লক্ষে। এইসব মানুষেরা আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিল মাটির নীচের মজবুত কুঠুরিগুলোতে।এইগুলো তৈরী করা হয়েছিল বিধ্বসী পরমাণু বোমা বা অ্যান্টিম্যাটার বোমার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। কিন্তু সেসব বিপদ হয় নি, হলো প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বছরের পর বছর খরা চললো !

পৃথিবীতে গরম প্রচন্ড বেড়ে গেল।তারপরে দেখা দিলো ধূসর কালো মেঘ।সেই মেঘ থেকে নামলো কালান্তক অ্যাসিডবর্ষণ।সমস্ত গাছপালা নষ্ট হয়ে গেল।বনের পর বন জ্বলে গেল।সমস্ত শস্যক্ষেত্র নষ্ট হয়ে গেল।নদীর জল অম্লতিক্ত হয়ে গেল।মাছেরা ও অন্যান্য জলচর জীবেরা মরে গেল।

রক্ষা পাওয়া মানুষেরা নিজেদের জন্য ফার্ম তৈরী করলো আবরণের ভিতরে। এখানে গাছপালারা কৃত্রিম আলোয় সালোকসংশ্লেষ করে। সেই আলো জ্বলে নিউক্লিয় শক্তিতে। এখানে বৃষ্টি কৃত্রিম।জল ক্রমাগত রিসাইকল করা হয়। বাইরের নদীর জল সরাসরি আনা যায় না, তা অম্লে বিষাক্ত। সেই জলকে বেশ অনেকবার করে নানা শুদ্ধিকরণের মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়ে তবে সেই জল ব্যবহার করা চলে। মাংসের জন্য যেসব পশু ও পাখী পালন করা হতো তাদেরও রাখা হয়ছিল ইন্ডোর ফার্মে। কিন্তু বন্য প্রানী দের রক্ষা করা যায় নি।নিযুত পশুপাখী লোপ পেয়ে গেছে।

বহু বছর ধরে জনসংখ্যা প্রায় একই জায়গায় থমকে ছিল। কমে যাবারই বরং আশংকা ছিল। তারপরে এই গত পঞ্চাশ বছর ধরে জনসংখ্য বেড়েছে কিছুটা। এখন পৃথিবীতে এটা চল্লিশ লক্ষে দাঁড়িয়েছে। বিপর্যয়ের আগেই চাঁদে মঙ্গলে ও অন্যান্য বাসোপযোগী উপগ্রহে মানুষের উপনিবেশ ছিল। কিন্তু পৃথিবীতে অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের পর সেগুলিরও আর তেমন সম্প্রসারণ হয় নি, কারণ সেগুলো ছিল বহুলাংশেই পৃথিবীর প্রযুক্তি ও মানবসম্পদনির্ভর।

শুনতে শুনতে আর দেখতে দেখতে তিয়ার মনটা অতীতে হারিয়ে গেছিল। দিদিমণি চাঁদের উপনিবেশ কেপলারে লেসার তীর তাক করে বলছেন, ঘর সম্পূর্ণ অন্ধকার--তিয়া পাশে তাকিয়ে দেখলো বন্ধুদের মধ্যে অনেকে ঘুমোচ্ছে। এই ক্লাসটা অনেকের কাছেই বেশ বোরিং। অনেকে এই ক্লাসটায় বেশ একঘুম দিয়ে নেয়। পরে বাড়ীতে পড়ে ম্যানেজ করে নেবে। আসলে এই কিশোর বয়সে মানুষ খুব বর্তমানে আর যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে বাঁচতে চায়, তাই বোধহয় সেই দূর অতীতের ঘটনা আর দূর গ্রহ উপগ্রহের ডিটেলস এই
কিশোর কিশোরীদের ভালো লাগে না।

পরের ক্লাসটা বেশ এনজয়েবল। প্রচুর মুভি দেখানো হয়। আসলে এই ক্লাসটা মুভি তৈরী কিভাবে হয় সেই কৌশল শেখার।স্পেশাল এফেক্টগুলো দেখার সময় সব ছেলেমেয়েরা একেবারে উৎসাহে টগবগ করতে থাকে। কেমন করে সেগুলো করা হয় সেটাও সকলের কাছে দারুণ একটা আনন্দের শিক্ষা। তিয়ার বেশ মজা লাগে ভাবলেই যে কি দ্রুত এই পরিবর্তন, মাত্র কয়েক মিনিট আগেই প্রায় সবাই ঘুমে ঢুলে পড়ছিল। আর এখন এই অন্ধকারেও সবাই বড়ো বড়ো চোখ করে চেয়ে আছে। এবারের ইন্সট্রাক্টর একজন তরুণ, তার এক একটা জিনিস বোঝানো শেষ হতে না হতে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্য থেকে এমন প্রশ্নের ঝড় যে ভদ্রলোক উত্তর দিতে দিতে জেরবার! কিন্তু খুবই ধৈর্যশীল এই তরুণ, একেবারে রেগে যান না। বরং খুব চমৎকার করে বুঝিয়ে বুঝিয়ে উত্তর দেন। একে ভালো লাগে তিয়ার।অন্য সকলের মতোই।

ক্লাস শেষ হলে এবার সবাই দল বেঁধে চলেছে ল্যাবে। সেখানে হাতে কলমে কাজ। আজকের ল্যাব ক্লাসে তিয়ারা শিখবে কিকরে লেজার দিয়ে ক্রিস্টালের গঠন পর্যবেক্ষণ করা যায়। তারপরে শিখবে কেমন করে ইউ ভি লাইট পড়লে এক বিশেষ জাতের অণু ঘুরে যায়।

হলওয়েতে দেখা হলো ভিকির সঙ্গে। ভিকি তিয়ার থেকে মাস ছয়েকের বড়ো।একই ক্লাসে পড়ে। যদিও সেকশন আলাদা। ভিকির মুখ কেন কে জানে প্রায় সবসময় খুব বিষন্ন। ওকে খুব কম হাসতে দেখেছে তিয়া। ভিকিরা থাকে তিয়াদের থেকে বেশ কয়েক ব্লক দূরে। ভিকি, ভিকির ছোটো ভাই রোশন আর ওর মাবাবা। ওদের সঙ্গে পরিচয় আছে তিয়াদের। দুয়েকমাস পর পর তিয়ারা যায় নয়তো ভিকিরা সবাই আসে তিয়াদের ফ্লাটে। তিয়ার তো ভিকিদের বেশ সুখী পরিবার বলেই মনে হয়। কিন্তু ছেলেটার মুখ এমন গোমড়া কেন সর্বদা?

তিয়া ভিকির দিকে এগিয়ে গিয়ে একটু হেসে বললো, "কিরে ভিকি, কেমন আছিস?"

ভিকি অন্যমনস্ক ছিল, চমকে মুখ তুলে বললো,"আরে, তিয়া! তুই কেমন? আমি তো ভালোই আছি।"

তিয়া হেসে ফেললো এবার, "ভালো তো মুখটা এমন তুম্বো কেন তোর?"

ভিকি বিষন্ন একটা হাসি হেসে বললো, "আমার এরকমই। তোর ক্লাস কেমন হলো?"

"ভালো। আচ্ছা ভিকি, তোকে কি কেউ বকেছে নাকি রে? "

"না, নাহ। এখন তো বকাটকা বেআইনী রে।"

"বেআইনী তা জানি।কিন্তু ঘরের ভিতরে কে কী করছে তা তো আর কেউ দেখতে যায় না সবসময়! আমার কী মনে হয় জানিস? তোর মাবাবা তোকে খুব মারেন আর ভীষণ বকেন।"

"কীসব বলছিস? না না, মিথ্যে কেন বলবো বল? ওঁরা সাদাসিধে ভালো মানুষ, কিছু করেন না আমায়।এমনিই আমার ভালো লাগে না। আমি ওদের সঙ্গে বেশী কথাও বলিনা।"

"কিন্তু তোর কেন ভালো লাগে না রে? কী হয়েছে তোর?" তিয়ার গলায় সত্যি সত্যি সমবেদনার সুর।

ভিকি অন্যদিকে তাকিয়ে উদাস সুরে বলে, "তেমন কিছু না।কেন জানি রাত্তিরে আমি উদ্ভট উদ্ভট স্বপ্ন দেখি।একদম অচেনা সব স্বপ্ন। অচেনা সব মানুষেরা--অচেনা সবকিছু। ওদের ভাষা এত আলাদা, তবু কেন যেন আমার মনে হয় ওরা যা বলছে, তা আমি বুঝতে পারি। ঘুম ভেঙে আমার মন খারাপ হয়ে যায়।"

তিয়া কৌতূহলী হয়ে বলে, "কতদিন থেকে এরকম হচ্ছে তোর?"

"খুব ছোটোবেলা থেকে। আমার মনেও নেই কবে প্রথম ওদের দেখা শুরু করেছিলাম। তুই কাউকে বলিস না কিন্তু তিয়া। তাহলে আমাকে মানসিক রোগের ডাক্তারদের কাছে নিয়ে যাবে মাবাবা।বলবি না তো?"

তিয়া হাসে, প্রতিশ্রুতি দেয়, "না, কারুক্কে বলবো না।" ওর নিজের ব্যালকনিতে দাঁড়ানোর কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছিলো, মনে পড়ছিল সেইসময়ের ভাবনাগুলোর কথা।সেকথাও তো ও কাউকে বলতে পারে না।

তিয়া ভিকিকে বলে,"ঠিক আছে, এটা আমাদের সিক্রেট। আমারও এরকম একটা সিক্রেট আছে। কিন্তু তার জন্য তো আমি মুখ গোমড়া করে থাকিনা!"

ভিকির চোখে এই প্রথম কৌতূহলের একটা ঝিলিক জ্বলে ওঠে।ও জিজ্ঞাসা করে,'কী সিক্রেট রে তিয়া? তুইও স্বপ্ন দেখিস? কীরকম স্বপ্ন? পাহাড়, বন, ঝর্ণা, নদীর স্বপ্ন? ময়ূরের স্বপ্ন? খুব সুন্দর দেখতে একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ের স্বপ্ন? হলদে লাল নীল বেগুনী ফুলের স্বপ্ন? আমার মতন?" স্বভাবত মুখচোরা ভিকি আজকে যেন প্রগলভ হয়ে গেছে।

তিয়া দূরের দিকে তাকিয়ে বলে, "তা একরকম স্বপ্নই বলতে পারিস। তবে রাতে ঘুমিয়ে নয়, জেগে জেগে। সক্কালে উঠে পুবের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আমি হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি, ভিকি।" তিয়ার মুখে একটা বিষদের ছায়া ভেসে আসে।

ভিকি কী বুঝলো কে জানে, তাকিয়ে রইলো তিয়ার মুখের দিকে। তারপরে খুব আস্তে নরম গলায় বললো, "তিয়া, তোর বাবা কবে আসবেন রে?"

তিয়া দূরের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে ভিকির মুখে স্থাপন করে, বলে "বাবা এবছর আসতে পারবেন না। খুব নাকি ব্যস্ত।"

ভিকি তিয়ার দিকে এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে বলে, "তাই তোর মন খারাপ, তিয়া?"

তিয়া হেসে আলতো করে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, "বারে বেশ মজা তো! মন খারাপ বুঝি আমার আর তুম্বো মুখ করে ঘুরছিস তুই? নারে, বাবার জন্য মন কেমন করলেও আমি জানি বাবা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত। আমার স্বপ্নটাকেই তো বাস্তব করবেন ওঁরা। এর জন্য দু'তিন বছর বাড়ীতে না আসতে পারা তো কিছুই নয়।"

তারপরে কী মনে পড়েছে এইরকম ভাবে ভিকিকে তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলো, "তুই তোর স্বপ্নের কথা কী বলছিলিস যেন? ময়ূর, লালনীল হলদে বেগুনী ফুল আর খুব সুন্দর দেখতে একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ে?"

ভিকি আস্তে করে বলে, "হ্যাঁ, তাই তো দেখি প্রায়ই। স্বপ্নের মধ্যে ওদের সঙ্গে খেলিও।"

তিয়া দুষ্টুমীভরা মুখ করে বলে, "তুই স্বপ্নের মধ্যে ভবিষ্যৎ দেখতে পাস, তা জানিস? ঐ সব বাচ্চারা সব তোর ছেলেমেয়ে।"

ভিকির মুখ আর কান লাল হয়ে গেল, কিন্তু তারপরেই অবিকল তিয়ার দুষ্টুমীভরা মুখের মতন মুখ করে বললো, "হ্যাঁ, তোর আর আমার।" বলেই দৌড় দিলো নিজের ক্লাসের দিকে। তিয়া হাসতে হাসতে নিজের ল্যাবের দিকে চললো।

স্কুলের শেষে দিদির সঙ্গে উড়নযানে করে বাড়ী ফেরে তিয়া। উড়িয়ে নিয়ে আসে নীরব তুরাব। দিদি এরপর একটু বিশ্রাম নিয়েই যাবে ব্যালে ক্লাসে। তিয়া ব্যালে শেখে না, ওর ইয়োগা ক্লাস পরদিন। আজ বাড়ীতেই একটুখানি যোগ প্র্যাকটিস করবে। মায়ের অফিস থেকে ফিরতে এখনো ঢের দেরি। তিষাকে কিন্তু এবারে তুরাব গাড়ী চালিয়ে নিয়ে যায় না। তিষার বয়ফ্রেন্ড চিনুক বলে একটি ছেলে এসে ওকে নিজের গাড়ীতে চড়িয়েনিয়ে যায়। বাড়ী এসেই চিনুককে ফোন করেছিলো তিষা। চিনুক ওর সঙ্গেই ব্যালে শেখে।

একা বাড়ীতে বেশ অনেকক্ষণ যোগ অভ্যাস করে তিয়া উঠলো। সমস্ত নীরব,এত নীরব বলেই বোধহয় হাল্কা কান্নার স্বর ওর কানে গেল। কে কাঁদছে, কোথায়? উড়নযানটার দিক থেকে আসছে। ও সেদিকে এগোলো আস্তে করে। তারপরে ভীষণ অবাক হয়ে গেলো। তুরাব কাঁদছে! না, চোখে জল নেই, জল কোথা থেকে আসবে ধাতুর রোবটের চোখে? কিন্তু ওর মুখটা নীচের দিকে ঝোঁকানো, শরীরটা কাঁপছে। অল্প একটা গোঙানির মতন আওয়াজ হচ্ছে।

তিয়া গিয়ে আলতো হাত রাখে তুরাবের কাঁধে। বলে, "কী হয়েছে, তুরাব?"

তুরাব চমকে মুখ তোলে,নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করে বলে, "কিছু না।"

তিয়া খুব নরম গলায় বলে, "নিশ্চয় কিছু হয়েছে। আমাকে বলতে চাও না, তাই না?"

তুরাব মুখ তুলে তিয়ার মুখের দিকে চেয়ে থাকে একটুক্ষণ।তারপরে একবার নিজের কপালে হাতটা ঘষে, একটু কিন্তু কিন্তু করে বলে, "তিয়া, আজকে আমার খুব ফারহানার কথা মনে পড়ছে। আজ তার জন্মদিন কিনা,তাই বোধহয় এত করে মনে পড়ছে।"

তিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে "ফারহানা কে?"

তুরাব বলে, "সে ছিলো ভারী মিষ্টি একটা ছোট্টো মেয়ে।ওকে গাড়ী করে ওর ইস্কুলে নিয়ে যেতাম আমি।"

"তারপরে?"

"তারপরে একদিন অসুখ করলো ওর। আর ইস্কুলে বেশী যেতে পারতো না। শেষে খুব অসুখ বাড়লো, খুব শ্বাসকষ্ট হলো ওর।ওর মা বাবা ওকে নিয়ে হসপিটালে গেলেন। তারপরে কী হলো আর জানিনা। আর আমাদের দেখা হয় নি। ওর বাবা আমকে কোম্পানিতে ফিরিয়ে দিয়ে এলেন। পরে তোমার মাবাবা গিয়ে আমায় কিনে আনলেন।"

তিয়া তুরাবের কাঁধে আবার হাত রেখে বলে, "তুমি তাকে খুব ভালোবাসতে, তাই না তুরাব?"

তুরাব একটু অবাক গলায় বলে, " ভালোবাসা? সে কাকে বলে? কোনো উন্নত প্রোগ্রামিং বুঝি?"

তিয়া হাসে, বলে, "না, সে কোনো প্রোগ্রামিং নয়। মানে মানুষের বানানো কোনো প্রোগ্রামিং নয়। কিন্তু হয়তো ঈশ্বরের প্রোগ্রামিং।"

তুরাব এতখানি চোখ করে বলে,"ঈশ্বর, সে কে?"

তিয়া হাসে, "ঈশ্বর কে সে কি আমিও জানি নাকি? সবাই বলেন, বড়ো বড়ো সব লোকেরাও বলেন যে এই জগতের সব কিছু যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই হলেন ঈশ্বর। এই পৃথিবী, ঐ আকাশ, মেঘের পিছনে লুকিয়ে থাকা সব তারা, গ্রহ, গ্যালাক্সি-সব কিছু। একদিন তিনিই আবার এই সব কিছু ধ্বংস করে দেবেন।"

"ধ্বংস করে দেবেন? কেন?"

"কেন তা কেউ জানেনা।ধ্বংস করে দেবেন কিনা তাও ঠিকমতন জানেনা কেউ। মানুষেরই ভাবনা সব।"

"তিনি কি ফারহানাকেও সৃষ্টি করেছিলেন? তারপরে আবার ছোটোতেই তাঁকে ধ্বংস করে দিলেন?"

"তুরাব, তুরাব, তুমি তো জানোনা যে শেষ অবধি ফারাহানার কী হয়েছিলো। হয়তো সে আজও আছে, ভালোই আছে, হয়তো তোমাদের আবার কোনোদিন দেখা হবে।"

তুরাব চেয়ে থাকে তিয়ার মুখের দিকে, তারপরে আস্তে আস্তে বলে, "তিয়া, তুমি খুব ভালো, তুমি বড়ো ভালো। তোমার ভালো হবে।"

তিয়া হেসে বলে, "তুরাব, তুমি জিজ্ঞেস করছিলে না ভালোবাসা কাকে বলে? এই যে তোমার কতকাল ধরে না দেখা ফারহানার জন্য মন কেমন করছে, একেই মানুষে বলে ভালোবাসা। এই যে যেমন আমার ও তো বাবার জন্য খুব মন কেমন করছে, বাবাকে তো ভালোবাসি, তাই। আচ্ছা, কতদিন আগের কথা বলছিলে তুমি তুরাব যখন ফারহানার কথা বলছিলে?"

তুরাবের চোখের দৃষ্টি সুদূরে চলে যায়। মনে করার চেষ্টা করতে করতে বলে, "কি জানি সে কতদিন আগের কথা। ফারহানার বাবা আমাকে কোম্পানিতে ফিরিয়ে দেবার পরে বহুকাল আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। সময়ের হিসেব নেই আমার।"

তিয়া বলে,"তুরাব, তোমার নামটা বুঝি ফারহানার দেওয়া?"

তুরাব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তিয়ার দিকে। বলে "হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কেমন করে জানলে তা?"

তিয়া মুচকি হেসে বলে, "আমি ওরকম অনেক কিছু জানতে পারি। এই যে দেখো বললাম তোমাদের একদিন দেখা হবে। এখন বলছি আজকালের মধ্যেই বাবার ফোন আসবে। তুমি মনখারাপ কোরো না তুরাব, দ্যাখো তো আমিও তো কত বছর বাবাকে দেখি না, তাতে কি আমি এমন মনখারাপ করছি তোমার মতন?"

তুরাবের চোখ দুটো আবার এতখানি হয়ে যায়। আস্তে আস্তে বলে, "তিয়া, তুমি বলছো যে মন কেমন করা, মন খারাপ করা। মন কী গো?"

"উরে বাবা, ভালোবাসা, ঈশ্বর, এখন আবার মন। এত প্রশ্ন করছো যে, আমি কি সবকিছুর উত্তর জানি? আর এসব খুব কঠিন প্রশ্ন, এগুলোর উত্তর প্রায় কেউই জানেনা।আসলে এসবের সঠিক উত্তর বলে কিছু নেইও। একি তোমার অংক নাকি ইতিহাস নাকি ভূগোল, নাকি বিজ্ঞান যে উত্তর থাকবে একেবারে মাপা মাপা?"

তুরাবের মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে যায় হঠাৎ। বলে "রাগ করলে নাকি তিয়া? আমি তো কিছু জানিনা, তাই জিজ্ঞেস করছিলুম। আমাকে ক্ষমা করে দাও।"

তুরাবের কাঁচুমাচু মুখের দিকে চেয়ে হেসে ফেলে তিয়া। বলে, " ওমা তোমার মুখ শুকিয়ে গেলো এতেই?"

তারপরে এসে তুরাবের কাঁধে মাথা রেখে বলে,"তুমি আর কখনো মন খারাপ করবে না, কেমন?"

অভিভূত তুরাব কোনোক্রমে শুধু বলে,"না, আর মনখারাপ করবো না।"

টেবিলে রাখা ছোট্টো আর ঝকঝকে ঘড়ি-টেলিফোনটা ঝিকমিক করে জ্বলে ওঠে আর তারপরেই একটা মিঠে সুরের জলতরঙ্গ বাজনা ছড়িয়ে পড়ে ঘরের বাতাসে। তিয়া তুরাবের ধাতব গালে একটা চুমো খেয়ে ছুটে চলে যায় টেবিলের দিকে। ঘড়িফোন হাতে নিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে বাবার গলা।

তিয়া আনন্দে একবার লাফিয়ে ওঠে, "হ্যালো বাবা, কেমন আছো তুমি?"
"--------- "
"আমরা ভালো। দিদি এখন ব্যালে ক্লাসে।মা অফিসে। তুমি কি তোমার ল্যাব থেকে ফোন করছো?"
"--------------"
"কী বললে? তোমাদের এক্সপেরিমেন্ট সফল? ১০০%? এবার তোমরা সত্যি সত্যি বাইরের ঐ মেঘ থেকে বৃষ্টি নামিয়ে সব মেঘ ঝরিয়ে দিতে পারবে?আবার আকাশ দেখা যাবে? নীল রঙের আকাশ? ঐ অনেক আগেরমতন? কতদিন লাগবে বাবা?"
" ------------------"
"না না উত্তেজিত হচ্ছি না। এই একটুখানি --- কেমন একটু আনন্দে এরকম করে ফেলছি। তুমি তো জানোই আমি কীরকম।"
"-------------------"
"তুমি কবে বাড়ী আসবে বাবা?"
"--------------------"
"ও।ঠিক আছে। তাহলে তিন বছরের মধ্যেই তোমরা বৃষ্টি নামাতে পারবে? নোনতা জলের বৃষ্টি? তারপরে?"
"--------------------"
"তারপরে সেই জল থিতিয়ে পরিষ্কার হবে? সবুজ গাছপালারা জন্মাবে? আবার দেখা যাবে সবুজ পৃথিবী?"

তিয়ার গলা আনন্দে কাঁপছিলো।আরো অনেকক্ষণ বাবার সঙ্গে কথা চললো তিয়ার। কথা শেষ হলে ঘড়ি -টেলিফোন টেবিলে রেখে দিয়ে তিয়া নিজের ঘরে চলে গেল। এবার বিছানায় মুখ গুঁজে প্রাণভরে কাঁদবে তিয়া। অনেকক্ষণ।

কতদিন সে বাবাকে দেখেনি, দেখবে না আরো কতদিন। তারপরে কোন্ সোনা রোদ্দুরের সকালে হয়তো একদিন সবুজ ঘাসের এক উপত্যকার মধ্যে বাবার সঙ্গে দেখা হবে। যুবতী হয়ে যাওয়া তিয়া কি তখনো এমন সজীব সবুজ থাকতে পারবে? এমন দুরন্ত বিস্ময়ে ভরা? এমন সুদূরের স্বপে মগ্ন? বাবাও কি আর তখন এরকম যুবক থাকবেন? হয়তো প্রৌঢ় হয়ে যাবেন। হয়তো এই উৎসাহ আর থাকবে না তখন কথায়।

তুরাব কিন্তু চলে যাওয়া তিয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো। এইমাত্র মেয়েটা বললো ওর বাবার ফোন আসবে আজকালের মধ্যে আর এক্ষুণিএসে গেল? সত্যি কি মেয়েটা সেইরকম অদ্ভুত ক্ষমতা ধরে নাকি যা বলে তাই হয়ে যায়? তাহলে কি ফারহানার সঙ্গে সত্যি দেখা হবে একদিন? সেই মিষ্টি নরম একরত্তি মেয়েটা এসে আবার হাত বাড়িয়ে মিষ্টি দিতে দিতে বলবে, "আমার আজকে দম্মদিন তো তাই তোমায় মিত্তি দিলাম। ভায়ো, খাও, ভায়ো।"

ও তখন এত ছোটো ছিলো যে জানতো না তুরাবকে মিষ্টি দিতে নেই।পরে বড়ো হয়ে আর দিতো না,ওর বাবামা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ওকে। যাঃ, আবার সেইরকম ছোটো দেখবে কি করে ফারহানাকে? সে তো এতদিনে কত বড়ো হয়ে গেছে!

সেই রাত্রে তুরাব আর তিয়া দুজনেই দুটো স্বপ্ন দেখলো। তুরাব দেখছিলো একটা পাহাড়ের ঢালে সে দাঁড়িয়ে আছে আর দূর থেকে ছুটতে ছুটতে আসছে ছোট্টো একটা মেয়ে। প্রথমে তুরাব মনে করেছিলো বুঝি ফারহানা, কিন্তু তারপরে দেখলো তাকে অনেকটা তিয়ার মতন দেখতে, কিন্তু আরো মিষ্টি, আরো সুন্দর মুখটা। তুরাব দু'হাত বাড়িয়ে ওকে কোলে তুলে নিলো।

তিয়া দেখছিলো একটা বিরাট উড়নযানে চড়ে সে, দিদি, মা, চিনুক, ভিকি, ভিকির মাবাবাভাই-সবাই কোথায় চলেছে উড়ে। যানটা চালাচ্ছে হাসিমুখ তুরাব, সে আর ধাতব রোবট নেই, মানুষের মতন দেখতে হয়ে গেছে।

আকাশ নীল, দুরে অল্প অল্প হাল্কা সাদা মেঘ শুধু। উড়নযানটা এরকম সবঢাকা দেওয়া নয়, উপরটা খোলা। হাওয়া এসে তিয়ার লম্বা চুলগুলোকে ওড়াচ্ছে, সে মাথা তুলে হাওয়ার স্পর্শ নিচ্ছে। নীচে দেখা যাচ্ছে ছবির মতন সুন্দর সবুজ, প্রাণময়ী পৃথিবী।

দূরে একটা পাহাড়ে একটা সাদা রঙের বাড়ী, তার চারপাশ ঘিরে অপরূপ বাগান। সেখানে ঠিক ভিকির স্বপ্নের মতন ময়ূরেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাগানে দোলনায় কারা যেন দুলছে আর অনেকে দৌড়ে দৌড়ে খেলা করছে। তিয়া জানে ঐ বাড়ী থেকে বাবা বেরিয়ে এসে হাত নাড়বেন আর তুরাব ঐ বাগানে উড়নযানটা নামাবে।

স্বপ্নের মধ্যেই একটুকরো হাসি ফুটে ওঠে তিয়ার মুখে। ঘুমের ঘোরে পাশ ফেরে সে বলে " আমি আসছি বাবা। এই দেখো আমরা সবাই আসছি।"

(শেষ)


মন্তব্য

কৌস্তুভ এর ছবি

সাই-ফাই-কাফ-লাভ দেঁতো হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

আহা আর রোবো-লাভ টা বুঝি কিছু না? হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

কৌস্তুভ এর ছবি

ঐটাও ওরই মধ্যে! (ইমোশনালি) বাচ্চা রোবো তো।

তুলিরেখা এর ছবি

আহা তাই তো! এরা সবুজ! ইহারা মনে মনে সবুজ, ধূসর পৃথিবীর মধ্যে তাই সবুজের স্বপ্নকে ধরে রেখেছে।
কিন্তু আপনে আজকে "দুষ্ট" বালককে হারাইয়া দিলেন। সে কয়েছিলো সে সবসময় প্রথম কমেন্ট দিবে। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অপছন্দনীয় এর ছবি

লেজে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মুড়ো ভুলে গেছি...দেখি আবার পড়তে হবে।

তুলিরেখা এর ছবি

হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তুলিরেখা এর ছবি

আবার পড়লে নাকি দুষ্ট বালক? চিন্তিত

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অপছন্দনীয় এর ছবি

উঁহুঁ, ছানাপোনাদের পড়াচ্ছি, সামার কোর্স...পড়ানো শেষ হলে যদি গুরু কিছু পড়তে বা পড়াতে না আসেন তাহলে পড়বো...

অপছন্দনীয় এর ছবি

আজকে পুরোটা পড়লাম - ছানাপোনাদের ক্লাস শেষ, স্প্রিং টার্ম চলে গেলো। সামার শুরু হবে আগামী মাস থেকে, কাজেই কয়দিন একটু কাজের চাপ কম।

এই গপ্পের মেয়েটা তো বড্ড পাকা!

রোবট স্বপ্ন দেখে! আবার কাঁদেও! এইরকম একটা রোবট পেলে আর মানুষের দিকে তাকাতাম না।

আশালতা এর ছবি

লেখা ভালো হয়েছে, তবে ভাগ ভাগ করে দিলে বোধ হয় আরও ভালো হত ।

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ আশালতা।
ভাগ ভাগ করে দিলে হয় কী, অনেকে বলেন খেই হারিয়ে যাচ্ছে। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মর্ম এর ছবি

বড় গল্প, তবে একবারে পড়ে ফেলতেই ভাল লাগল।

আমাদের দূর্ভাগ্য যে আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি যা দিনে দিনে এগিয়ে চলেছে আমাদেরই তৈরি করে দেওয়া ধ্বংসের পথ ধরে।

আমাদের সৌভাগ্য যে এখনো সকালের ঝলমলে সূর্য আমাদের মন ভাল করে দেয়, এখনো গাছের সবুজ আমাদের মনকে তরতাজা করে আর হঠাৎ বৃষ্টি এসে কাকভেজা করে দিয়ে যায় আমাদের।

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

তুলিরেখা এর ছবি

সেই। আমরা যে এখনো সোনালি রোদের ভোর, শিশির, শিউলি, হঠাৎ বৃষ্টি, সবুজ গাছের ছায়া দেখতে পাচ্ছি, পাখির গান শুনতে পাচ্ছি, সৌভাগ্য বলেই মনে হয়।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নৈষাদ এর ছবি

ঠিকাছে।

তুলিরেখা এর ছবি

চিন্তিত

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তুলিরেখা এর ছবি

আমাদের ছোটোবেলা আনন্দমেলায় কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞানে আর শুকতারায় ভালো ভালো সব কল্পবিজ্ঞান গল্প বেরোত। মৌলিক আর অনুবাদ দুই ই। সেসব আজকাল আর শুনি বেরোয় না। মন খারাপ
কালচারের বিরাট শিফট হয়ে গেছে মনে হয়। চিন্তিত

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

তিয়া, পৃথিবীর কথা ভাবতে হবে না, নিজের কথা ভাবো।

বাহ, চমৎকার!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

তুলিরেখা এর ছবি

দু:খের কথা কী বলবো রোমেল, দুনিয়ার পনেরো আনা লোকের কাছেই কেবল শুনলাম এই ধরনের কথাই।
সবাই খালি বলে, Be practical! পরের কথা দূরের কথা জগতের কথা কেবল সভার মাঝে বলার, আসলে নাকি কেবল নিজের আখের! তবু এখনো মনে হয় কিছু কিছু মানুষ এখনো রয়ে গেছে, বিষয়ী সমাজ যাদের পাগল বলে, তবু সেই পাগলদের কারণেই আজো টিকে আছে মানুষের দুনিয়া।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।