পৃথিবী-জাতকের যাত্রাপথ

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: শুক্র, ২৭/০১/২০১২ - ৭:৩৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক দেশে এক মানুষ ছিল, শান্ত এক সবুজ গাঁয়ে ছিল তার ভিটাবাড়ী। কবে কোন্‌ পুরাতন অতীতে ঈশা খাঁয়ের হাতী বাঁধা হয়েছিলো গাঁয়ের শিমূলগাছে, সেই থেকে গাঁয়ের নাম শিমূলিয়া।

সেই মানুষের নেশা ছিলো কবিতা লেখা আর পেশা ছিলো সেই গাঁয়েরই ইস্কুলে শিক্ষকতা। গরীব স্কুলমাষ্টারের কবিতার আর কী ই বা দর, কেই বা কদর করে! তবু সে লেখে আর লেখে, শক্ত মলাটের খাতায় লিখে যায় কবিতার পর কবিতা। কিছু কিছু ছাপায়ও কিন্তু বেশী লোকের কাছে সেসব পৌঁছায় না! তার হয়ে প্রচারেরও কেউ নাই, খুঁটির জোরও তার নাই। বড়ো শহরের সুযোগসুবিধাও সে পায় না। তা হোক, তবু সে লেখে আর লেখে আর একটা রঙচটা লোহার ট্রাঙ্কের মধ্যে রেখে দেয়, মাঝে মাঝে বার করে, পড়ে আর হাত বুলায় সন্তানের মতন যত্নে।

তার ছেলেরা কেউ তার কবিতার ধারেকাছে আসে না বিশেষ, তারা তাদের নিজেদের পড়াশুনা খেলাধূলা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত আর মেয়েরা ব্যস্ত ঘরের কাজে। শুধু স্ত্রী গুণগ্রাহী, সামান্য অক্ষরজ্ঞান আর সংখ্যা জানা আর যোগবিয়োগগুণভাগ পর্যন্ত যার শিক্ষাসম্বল সেই শ্যামলা কর্মঠ গাঁয়ের মেয়েটির কাছে স্বামীর লেখা কবিতাগুলো এক একটি নিখাঁদ বিস্ময়! " কেমুন কইরা এমুন ল্যাহেন গো!" দাওয়ায় বসে লিখতে থাকা স্বামীকে কাঁসার বাটিতে মুড়ি-নারকেল এনে দিয়ে সে কাছে বসে, বলে, "পড়েন দেহি, শুনি।" কিন্তু বেশীক্ষণ সে থাকতে পারে না, রান্না বসাতে হবে, জল আনতে হবে, তরকারি কাটতে হবে, মাছ কাটতে হবে, দাওয়া লেপতে হবে, ধান ভানতে হবে-সংসারের হাজারো কাজ।

"আমরা মানুষ জাত" কবিতার একজায়গায় আমাদের এই লাজুক কবি লিখেছিলো-
"পুরাণ, কোরান, বেদ, বাইবেল আমাদের জন্য,
আনিয়াছে অমরার সুধাসার; আমরা যে ধন্য !
তাই নিয়ে, তাই পিয়ে বাড়িয়াছে জীবনের শক্তি,
অজানারে জানিয়াছি, শিখিয়াছি ভগবানে ভক্তি;
যত জীব তত শিব, জীবে দয়া-মহাপুরুষত্ব,
"সত্যই বেঁচে থাকা", "মিথ্যাই মরা" এই তত্ত্ব।
হিংসায় মহাপাপ, প্রেমে লাভ হয় সদা স্বর্গ,
প্রেম, ধন, দৌলত, ভগবৎ সাধনার অর্ঘ্য।"

কৃষ্ণ, মোহাম্মদ, মহাবীর, যীশু, গোরা, বুদ্ধ,
আমাদের সম্পদ, আমাদেরে করিয়াছে শুদ্ধ,
সুন্দর সুখময়, তাহাদের মঙ্গল স্পর্শে
আমাদের গৌরব দেবতারে জিনিয়াছে হর্ষে।
আমরা মানুষ জাত-"মানুষতা" আমাদের চিহ্ন,
কিছু নয় কিছু নয় পরিচয় নাহি আর ভিন্ন।
এক পিতা, এক মাতা, এক পরিবার এই বিশ্ব,
মোরা সব ভাই ভাই ছোট বড় ধনী আর নিঃস্ব। "

দিন আসে, দিন যায়। ছেলেমেয়েরা বড় হয়, বাপমায়েরা হয় বুড়া। পাল্টে যেতে থাকে চারিদিক, ভাগ হয়ে যেতে থাকে দেশ- নদী, নালা, পাহাড়, পর্বত, রোদ, বৃষ্টি, ধানক্ষেত, আখক্ষেত সবকিছু "আমার" "তোমার" হয়ে ভাগ হয়ে যেতে থাকে সেই মানুষের চোখের সামনে।

সেই মানুষ, যে একদিন লিখেছিল "এক পিতা এক মাতা এক পরিবার এই বিশ্ব", লাইনগুলো সজল করুণ চোখে চেয়ে থাকে তার দিকে। তাদের গোটা পাড়া প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে, চেনাজানা প্রতিবেশীরা চলে গেছে। আত্মীয়স্বজনের খবর পায় সে, কাছের দূরের সব আত্মীয়রা চলে যাচ্ছে। রোজই কেবল চলে যাবার খবর।

সে চলে যেতে চায় না। তার ছাত্রেরা ছড়িয়ে আছে চারিপাশে, তার স্কুলটি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গাঁয়ের মাঝখানে, যার প্রতিষ্ঠা থেকে এর সাথে সে জড়িয়ে আছে, প্রথমদিনের উৎসবে পাঠ করার জন সে লিখেছিল, "অন্তহারা অন্ধকারের নিবিড় কালো জল / ধন্য হয়ে ফুটলো সেথায় আলোর শতদল", প্রথম যোগ দেওয়া ছাত্রেরা সুর দিয়ে সেই গান গেয়েছিলো, সেই শতদল ছেড়ে ছেড়ে সে কোথায় যাবে? কোন্‌ অচেনায়?

মেয়ে কাঁদে, মাকে বলে, " বাবা যদি না যাইতে চায়, থাউক বাবা এইহানো। আমরা লন চলি মা।" মা মেয়ে একসাথে কাঁদে। হাসিকান্না সুখদুঃখ মিলানো মানুষের সংসারে কেন এসে পড়ে বীভৎস অন্ধকার ডানার ছায়া? দাঙ্গার ভয় কেন এসে ওঠে নশ্বর মানুষের ঘরেদুয়ারে? কেন? কার কাছে এর উত্তর আছে?

নাই, নাই, ঐ তো সেই মানুষ চলে যাচ্ছে তার জীর্ণখাতায় লেখা কবিতাভরা রঙচটা ট্রাঙ্কখানি আঁকড়ে ধরে, ছাত্রেরা চোখের জলে বিদায় জানিয়ে গেছে। সে চলে যাচ্ছে, পরিবারের বাকীরা তার সঙ্গে। কোথায় সে যাবে, কোথায় আছে তার ঘরবাড়ী?

একদিন সে লিখেছিলো, " মানুষের কাছ থেকে মানুষেরে কে করিবে ভিন্ন? " সে সেই কথা জপতে জপতে যায়, জপতে জপতে যায়। ঝাপসা লাগে নদী, ঝাপসা লাগে সবুজ মাঠ, ঝাপসা লাগে সব। এমন কোথাও কি সে গিয়ে পৌঁছতে পারবে যেখান থেকে আর উচ্ছেদ হতে হবে না?

অনেক অনেক বছর আগে আষাঢ় মাসের প্রথম দিনে জন্ম হয়েছিলো তার, সেই দিনেই সে ভিটা ছেড়ে চললো দূরে, সজলধারা নদীর স্রোত তার নৌকাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কোথা থেকে সে এসেছিলো, সে কোথায় যাবে?

******


মন্তব্য

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

মনের ভেতরে লুকিয়ে রাখা একটা নরম কোন ছুঁয়ে গেল আপনার লেখা ।

ভালো থাকুন আর আরও লিখুন ।

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ প্রদীপ্তময়। ভালো থাকুন সবসময়।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তৌফিক জোয়ার্দার এর ছবি

খুব ছুঁয়ে গেল লেখাটা।

তুলিরেখা এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ তৌফিক। ভালো থাকবেন।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অনিকেত এর ছবি

ঝাপসা লাগে নদী, ঝাপসা লাগে সবুজ মাঠ, ঝাপসা লাগে সব। এমন কোথাও কি সে গিয়ে পৌঁছতে পারবে যেখান থেকে আর উচ্ছেদ হতে হবে না?

পরানের গহীন ভেতরে স্পর্শ করল এই শব্দনিচয়!

মঙ্গল হোক!

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ অনিকেত। কতদিন পরে আপনার কমেন্ট পেলাম। ভালো থাকবেন।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

CannonCarnegy এর ছবি

মন ছুয়ে গেল আপনার লেখা। ভালো থাকুন।

তুলিরেখা এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ। আপনিও খুব ভালো থাকুন।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

কাজি মামুন এর ছবি

সজলধারা নদীর স্রোত তার নৌকাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কোথা থেকে সে এসেছিল, সে কোথায় যাবে।

দারুণ লিখেছেন! এই সভ্য পৃথিবীর অন্তরালে প্রায়ই ফুটে উঠে আদিম ভাসমানতার ছবি; রাজনীতি, কূটনীতি ও ভেদনীতির অসভ্য চাকার তলায় পিষ্ট হয়ে মানুষ আবার হয়ে যায় যাযাবর! আর মনে ফিরে আসে সেই প্রথম প্রশ্ন, কোথা থেকে সে এসেছিল, কোথায় সে যাবে!

তুলিরেখা এর ছবি

ঠিক। মানুষের ভাসমান জীবনের সজল দীর্ঘশ্বাস।
ভালো থাকবেন।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তাপস শর্মা এর ছবি

হারিয়ে যাওয়া দীর্ঘশ্বাস... গল্প ভালো লেগেছে। বাই দ্য ওয়ে সাংগ্রিলা কই ?? ওটা জলদি চাই...

তুলিরেখা এর ছবি

সাংগ্রিলা তো ভাই ভয়েই দিতে পারি না, কেউ মনে হয় পড়েন না।:-(
ভালো থাকবেন।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তাপস শর্মা এর ছবি

কে বলেছে পড়েনা !!!!!! ২য় পর্বটাও পাবলিশ হওয়ার পর প্রায় ১দিনের উপর পাঠক পছন্দের শীর্ষে ছিল। আমি নিজে দেখেছি। অন্য কোন কথা না। তাড়াতড়ি সাংগ্রিলা চাই। আরে একটা ফ্লো থাকে তো , ওটা নষ্ট হয়ে গেলে পড়তে ভালো লাগবে না আর মন খারাপ

তুলিরেখা এর ছবি

আপনি কোথায় তাপস? আমার কোনো পোস্টেই আর তো আপনাকে কমেন্টাইতে দেখি না! চিন্তিত

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

মুগ্ধপাঠ

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ রিশাদ ময়ূখ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ধূসর জলছবি এর ছবি

খুব ভাল লাগল।

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ ধূসর জলছবি।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।