আনন্দপুর

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বুধ, ২২/০৮/২০১২ - ৩:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাই, দেখি নারকেল গাছের সারি। কান্ড বেয়ে গোলমরিচের লতা উঠেছে। বৃষ্টির কণারা লেগে আছে লতার গায়ে আর পাতাগুলোর উপরে। রোদ্দুর পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে কেমন! ভিজা হাওয়ায় নারকেল গাছগুলো মস্ত মস্ত পাতা নাড়িয়ে খুব আহ্লাদ করছে। ঠিক যেমন বলে দিয়েছিলো প্রীতি।

ছোট্টো হাসি শুনে চমকে তাকাই, দেখি পাশের জঙ্গল থেকে প্রণতি বেরিয়ে আসছে, হাতে নীল রঙের ফুল। আমি বললাম, "আনন্দপুরে যাবে?"

ও মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে আরো হাসলো। বললো, "সেখানে গিয়ে রাজেনের রেখে দেয়া রঙতুলি দিয়ে শূন্য কাগজে অনেক ছবি আঁকবো। সে নাকি আজকাল আর ছবি আঁকতে পারে না! এটা কোনো কথা হোলো? সে আবারও আঁকবে। আমিও আঁকবো।আরো নতুন নতুন রঙ বানাবো। নীল রঙ, লাল রঙ, সবুজ-সবই বন থেকে পাওয়া যাবে, কী বলো?"

ওর চোখের মধ্যেই মেঘ-রোদ্দুর-বৃষ্টির ছবি এমনিতেই চিকচিক করছিলো, ছবি না এঁকে ও থাকতে পারবে কেন?

আরো খানিক এগোতেই দেখি মস্ত লম্বা একজন মানুষ মৃদু গান গাইতে গাইতে উল্টোদিক থেকে এগিয়ে আসছে। চিনলাম, ও তো সুমন্ত।

সুমন্ত বললো, " চন্দ্রাবতী নদী পার হবার সময় কই মাছ ধরবো।"

আমি কইলাম "আরে, কীকরে ধরবে? তোমার জাল কই? নয়তো ছিপ? বা নিদেন ছাঁকা দিয়ে মাছ ধরার গামছা?"

ও কইলো, "দেখতেই পাবে। আমি শুধু হাতেই মাছ ধরতে জানি।"

এসে গেলো চন্দ্রাবতী। জল এখন গভীর যদিও তবু এই জায়্‌গায় নদীটা বইছে উঁচু পাথুরে ডাঙার উপর দিয়ে, কিছু কিছু পাথরের মাথা জলের উপর দেখা যাচ্ছে। এখানে জল বড়ো জোর একমানুষ গভীর। হেঁটে পার হওয়া যাবে ঠিকই। ডুবে গেলে সুমন্ত হাত বাড়িয়ে ঠেলে দেবে নাহয় কোনো পাথরের দিকে।

না তেমন ডুবজল ছিলো না, দিব্যি নদী পার হতে গিয়ে আমাদের ভালো করে স্নানও হয়ে গেলো।

পার হয়ে এসে দেখি সুমন্তের পাঞ্জাবির দু'পকেট ভর্তি কইমাছ!!!

কী মোটাসোটা কুস্তীগীরের মতন কইমাছ সে কী বলবো! সত্যি মানুষটা শুধু হাতে কই ধরে ফেলেছে?

সুমন্ত খুব হাসছে আর কবিতা বলছে, বলছে, "ক্যালেন্ডারের পাতা ওড়ে, দোলে এলোমেলো ধোঁয়ার কুন্ডলী" আরো অনেক কিছু বলছিলো, ব্যাপারটা বেশ ধোঁয়াটে বলে কিছুই বিশেষ আর বুঝলাম না। ধোঁয়া দোলে কীকরে সেও এক কূট প্রশ্ন! কিন্তু কবিদের কাছ থেকে কোনো প্রশ্নের জবাব আশা করতে নেই। কবির জবাব বড় ভয়ানক!

নদী পার হয়ে টিলা, এখন গভীর সবুজ। তার উপরে পড়ে আছে ছড়ানো ছিটানো বড়ো বড়ো নুড়ি, এই ভরা বর্ষায় সবুজ শ্যাওলা আর লতায় ঢেকে গেছে।

টিলার উপরে স্মিতমুখে দাঁড়িয়ে আছেন অচ্যুতচরণ, লম্বা সাদা দাড়ি বর্ষার ভিজা হাওয়ায় উড়ছে। উনি মন্ত্রের মতন করে বলছেন, "অখন্ডমন্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচর ... " আমাদের দেখে থেমে গিয়ে হেসে অভিনন্দন জানালেন," এই যে উষসী দেখছি। অনেকদিন পরে এবার। তা সঙ্গে এনারা কারা?"

আমি বললাম, "নমস্কার অচ্যুতদা। এনারা আমার দুই বন্ধু-প্রণতি আর সুমন্ত।"

সুমন্ত ততক্ষণে ওর কবিতা বলতে শুরু করে দিয়েছে আর অচ্যুতদা অবাক খুশী হয়ে মুহূর্তের মধ্যে বন্ধুত্ব পাতিয়ে আলোচনায় জমে গেছেন সুমন্তের সঙ্গে। এখন আমরা কথা কইতে কইতে হাঁটছি অনন্তিকার বাড়ীর দিকে। আর একটু পরেই সে আমাদের দেখতে পাবে।

সুমন্তের ধরা কইমাছ দিয়ে কিছু একটা রান্না করা হবে নিশ্চয়। কাঁচা মরিচ দেওয়া ঝোলও বেশ ভালোই হতে পারে নয়তো শুধু ভাজা।

অচ্যুতদা হঠাৎ কইলেন, "সবচেয়ে বড়ো জাদুকরী কে জানো সুমন্ত? এই বিশ্বপ্রকৃতি। কোনো কথা না বলেই কত আশ্চর্য্য কথা তৈরী করে যাচ্ছে। ঐ যে দ্যাখো পুবের আকাশটা, এই ছিলো রোদ্দুর, এই এখনি মেঘলা হয়ে গেলো, আবার কখন একটু মেঘ ফাঁক হয়ে যাবে, আলো চলকে নামবে। এইরকম করে আমরা কি কোনোদিন কথা কইতে পারি?"

****


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

তুলি আপুর লেখা এমনিতে অসাধারন, এই লেখাটা তার ব্যতিক্রম নয়। সুন্দর শব্দ চয়নে কত নিখুত ভাবে মানুষের অপরাগতা বুঝিয়ে গেলেন। সত্যি চমৎকার।

ধন্যবাদ।

কামরুজ্জামান স্বাধীন

তুলিরেখা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

একটানে শেষ করে ফেললাম - ভালো লাগলো। কিন্তু পড়তে পড়তে বার বার নীললোহিতের কথা মনে হচ্ছিল। কেন যে! বোধহয় দুটো জায়গায় প্রকৃতির কোলে বলে।
-অয়ন

তুলিরেখা এর ছবি

এটা দিকশূন্যপুর অনুপ্রাণিত, নিজের বন্ধুদের সেখানে নিয়ে যাওয়া। হাসি
আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

একদ্ল সবুজ বাতাস অরণ্যের ঘ্রাণ বয়ে আনলো।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

তুলিরেখা এর ছবি

আপনার কমেন্টটা কবিতার ঘ্রাণ নিয়ে এলো। হাসি
ভালো থাকবেন।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

কৌস্তুভ এর ছবি

হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ধুসর গোধূলি এর ছবি
তুলিরেখা এর ছবি

উপকথা দিয়া দিসি। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

কড়িকাঠুরে এর ছবি

এরকম করে আমরা কোনোদিন কথা কইতে পারি না...

তুলিরেখা এর ছবি

হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।