জলছবির জ্যোৎস্না

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: সোম, ০৪/০৮/২০১৪ - ৪:০৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।

রুপোলী জরির মতন ফিনফিনে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে আমার রাত্রি বাগানে, আকাশে ঝমঝম করে তারারা। ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে ঝিঁঝিঁদের সম্মিলিত অর্কেস্ট্রা। অদ্ভুত নেশা ধরানো এই সঙ্গীতসভা।

এমন রুপোজরি জ্যোৎস্নারাতেই চলে গিয়েছিল টিপু, শেষবারের মতন দেখা করে গিয়েছিল এইরকম এক রাতেই। জ্যোৎস্নারাতে বাগানে বসে থাকলেই টিপুর কথা মনে পড়ে।

"ভালোকাকীমা, আমি আজ চলে যাচ্ছি। ফিরে এলে আবার আসবো তোমার কাছে। " এই বলে প্রণাম করেছিল।

আমি নিচু হয়ে ওকে তুলে ধরে দেখেছিলাম ওর চোখে জলের ফোঁটা, জ্যোৎস্নায় চিকচিক করছিল। আমার চোখও ঝাপসা হয়ে গেল তারপরেই।

টিপু থাকতো আমাদের পাশের বাড়ীতে। ফুটফুটে ছোট্টো বাচ্চাটাকে নিয়ে যখন ওর মা সুলতা হসপিটাল থেকে বাড়ীতে ফিরলো তখনই দৌড়ে দেখতে গিয়েছিলাম। প্রথম দেখার সময় থেকেই কেমন মায়া পড়ে গেল বাচ্চাটার উপর। আর পড়বেই তো, অমন কোঁকড়া কোঁকড়া কালো চুলের গোছা, ফুলো ফুলো গোলাপী গাল, টুকটুকে ঠোঁটজোড়া--

ওর ঠাকুমার কী আনন্দ- নাতি হয়েছে। মিষ্টি দিচ্ছিলেন প্রতিবেশীদের। কত বছর আগের কথা-তখন পাড়া প্রতিবেশীর মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বেশী ছিল, সুখে দুঃখে সবাই সবার কাছে কাছে থাকতো।

আমাদের টোনাটুনীর সংসারে ঝামেলা বলতে কিছুই ছিল না। সুজয়-আমার স্বামী, সে সকাল বেলায় খেয়েদেয়ে অফিসে বেড়িয়ে গেলে আমার অখন্ড অবসর। তখন টিভির বালাইও ছিল না, কেবল টেবলের নামও শোনেনি কেউ। রেডিও শুনত লোকেরা।

বাড়ীতে তৃতীয় ব্যক্তি ছিল না কেউ। শ্বশুর শাশুড়ী সবাই বেঁচে ছিলেন, তাঁরা কেউ তাঁদের গ্রামের বাড়ী ছেড়ে, বিশাল পরিবার পরিজন ছেড়ে, জমিজমা চাষ-আবাদের সদাব্যস্ত জীবন ছেড়ে ছেলের কাছে এসে বাস করতে রাজী হতেন না।

সুজয়ের চাকরিসূত্রে আমাদের থাকতে হতো শহরঘেঁষা সেই মফস্বলে। গ্রাম থেকে আত্মীয়স্বজনেরা মাঝে মাঝে আসতেন, তবে দুই-একদিন থেকেই চলে যেতেন।

সুজয়ের লম্বা ছুটিতে আমরা মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ীতে যেতাম, তবে কেমন যেন একটা সম্মানিত অতিথি-অতিথি ভাবে আমাদের দেখতো সেখানের সবাই যে আমরা হাঁপিয়ে উঠতাম। দুই তিনদিন থেকেই আমরা ফিরে আসতাম। পরের দিকে সুজয় নিজেও আর তেমন আগ্রহী হতো না, ছুটিতে আমরা তখন দিল্লি-আগ্রা বা কুলু-মানালি বা মাদ্রাজ-কন্যাকুমারী এসব জায়্গায় ঘুরতে যেতাম।

কিন্তু ওর চাকরির সময়গুলোতে আমার দুপুরবেলা আর বিকেলবেলা অখন্ড অবসর। সুজয় সন্তানের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না, নিজেদের হবে না জেনে যখন আমি একবার অনাথ আশ্রম থেকে সন্তান দত্তক নেবার প্রস্তাব তুলেছিলাম, সুজয় একেবারেই আগ্রহ দেখায় নি। আমিও অনাগ্রহ বুঝে আর চাপাচাপি করিনি, বরং নিজের শখ টখ নিয়ে অবসর ভরাট করার খেলায় মেতে গেলাম।

আমার ছিল বাগান করার শখ- ফুল ফল তরিতরকারি-সব কিছু ফলাতেই দারুণ উৎসাহ। বাড়ীর চারপাশটি ঘিরে গড়ে উঠেছিল আমার বাগান- সন্তানের মতন যত্নে তৈরী বাগান। বই পড়ে, বাগান করে, রেডিও শুনে সময় ঠিকই কেটে যেত- তবু কোথায় যেন একটা অধরা ফাঁক থেকে যেত, ধরা যায় না বলা যায় না, তবু বোঝা যায়।

মাঝে মাঝে গোপণে দীর্ঘশ্বাস পড়তো আমার, নিজের মানুষটার উপরে অদ্ভুত অচেনা একটা অনুভূতিতে মনটা ভরে যেত। বুঝতাম না সেটা ঠিক কী, অভিমান, রাগ নাকি নিরাসক্তি? কেন যেন মনে হতো পাশাপাশি আছি আমরা সংসারে, কিন্তু দু'জনের মাঝে যেন অলঙ্ঘ্য পাঁচিল, কেউ কারুর অন্তরের কথা জানি না।

রাতে যখন ঘুমিয়ে পড়তো সুজয়, আমি সন্তর্পণে উঠে বিছানা ছেড়ে বাইরের ঘরে চলে যেতাম, চুপিচুপি জানালার পর্দা সরিয়ে দেখতাম রাত্রির বাগান, কখনো টলটলে জ্যোৎস্না গড়িয়ে পড়তো গাছের পাতায় পাতায় আবার কখনো নিকষকালো অন্ধকারে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকিরা জ্বলতো আর নিভতো।

২।

টিপুকে নিয়ে বিকেলবেলা ঘুরতে বেরোতো সুলতা। ছেলেটা দিব্যি আমার কোলে আসতো হাত বাড়ালেই, একটুও কাঁদতো না। ওকে কোলে নিয়ে আদর করতে দিব্যি লাগতো আমার।

আমাদের বাড়ীর চারপাশ ঘিরে বাগান আর বাগান ঘিরে বেড়ালতার বেড়া। ঘন কালচে সবুজ রঙের শক্ত গুল্মজাতীয় গাছ এই বেড়ালতা।পাতা ছিঁড়লে সাদা আঠালো তরুক্ষীর বেরোয়, পাতার মাঝখানটা ছিঁড়ে ঐ ছেঁড়ার দু'ধারে চাপ দিয়ে চোখের মতো প্রসারিত করলে সুন্দর সূক্ষ্ম জলীয় পর্দা তৈরী হয়- তাতে রামধনুর রঙ ঝলমল করে। কিন্তু বেড়ালতার রস এমনিতে ভালো না, চোখে গেলে চোখ জ্বালা করে।

বাগানের সীমানা পেরিয়ে একটা সবুজ ঘাসে ঢাকা নরম মাঠ- সে মাঠে গোটা কয়েক খেজুর গাছ। তারপরেই টিপুদের বাড়ী। ওদের বাড়ীর চারপাশের খালি জায়গাটুকুতে কয়েকটা নারকেল, সুপুরি আর হিমসাগর আমের গাছ। তবে ওদের বাগান নেই।

টিপু যখন হাঁটতে শিখেছে- একটা দুটো আধো আধো কথা বলে-তখনি টলমল করতে করতে চলে আসতো মাঠটায়। সুলতাও ছুটতো ওর পেছনে। দুরন্ত ছেলেকে সামলাতে ওর প্রাণান্ত। ততক্ষণে টিপু হলদে ইষ্টিকুটুম পাখীর সঙ্গে ভাব জমাতে ব্যস্ত।

কী ভেবে মাঠের ঘাসের উপরে শুয়ে পড়ে আর ছোট্টো ছোট্টো দুধে দাঁত ঝিকমিকিয়ে হাসে টিপু। "ওরে কানে পিঁপড়ে ঢুকবে,কানে পিঁপড়ে ঢুকবে- দ্যাখো দস্যি ছেলের কান্ড দ্যাখো।" সুলতা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে ওকে কোলে নিতো।

বাগানে জলের ঝারি নিয়ে জল দিতে দিতে দেখতাম ওদের মা-ছেলের কান্ড।

আর একটু বড়ো হলে ও স্কুলে যেতে শুরু করলো। পিঠে ব্যাগ আর কাঁধে জলের বোতল-স্কুলবাসে তুলে দিতে সুলতা যেত সঙ্গে বড়ো রাস্তা অবধি।

স্কুল থেকে ফিরতো দুপুর পার করে। একটু কিছু খেয়েই সোজা মাঠটায়-তারপরে আমাদের বাগানে। ছোট্টো ছোট্টো প্রজাপতি, পিঁপড়ে, পাখী, কাঠবেড়ালী-সবার সঙ্গেই ওর ভাব। হয়তো শেষ দুপুরে শুয়ে শুয়ে কোনো গল্পের বই পড়ছি, ওর ডাকে বাইরে এসে দেখি ছেলে ঘাসের উপরে কান রেখে বলছে " ভালোকাকীমা, দ্যাখো দ্যাখো, ঘাসেরা কথা বলছে!"

আমি তো হাঁ হাঁ করে উঠি সুলতারই মতো, কানে পিঁপড়ে-টিপড়ে ঢুকে না জানি কী কেলেঙ্কারী বাধায়। কিন্তু টিপু হেসে লুটোপুটি- বলে "পিঁপড়েরা আমার বন্ধু হয়। ওরা আমায় কিচ্ছু করবে না।"

ছবি আঁকার দিকে ওর খুব ঝোঁক ছিল খুব ছোটোবেলা থেকেই। মোটে যখন তিনবছর বয়স তখন থেকেই পাখী প্রজাপতি গাছ ফুল এইসব আঁকতো। বিকেলে আমাদের বারান্দাতে বসে বসে এঁকেছে কতদিন!

বিয়ের আগে আমারও আঁকায় খুব শখ ছিল। ছাত্রী থাকার সময় আঁকা শিখেওছি আঁকার স্কুলে গিয়ে। সবাই বলতো হাত বেশ ভালই। কিন্তু বিয়ের পরে আর হয়ে ওঠেনি আঁকা সংসারের হাজারো ঝামেলায়। রঙ, তুলি, প্যালেট, ক্যানভাস- সঙ্গেই রয়ে গিয়েছিল যদিও, কিন্তু ইচ্ছেটা চাপা পড়ে গিয়েছিল। এতদিন পরে ছোট্টো ছেলেটা এসে বহুদিন আগে চাপা পড়ে যাওয়া ইচ্ছেটাকে জাগিয়ে তুললো আবার।

আমার হাতের তুলিও কথা বলে উঠতে থাকলো কাগজের উপরে। এক একটা টানে চাপা পড়া স্বপ্নগুলো আবার মুখ জাগাতে থাকলো। পাখীর বাসায় ছোট্টো ছোট্টো তিনটে ছানা- মা পাখী উড়ে এসেছে কিসব মুখে নিয়ে আর ছানারা উৎসাহে কলকল করে উঠেছে-- অথবা ধানমাঠের শেষে দিগন্তরেখায় সূর্য অস্ত যাচ্ছে,তার আবীর রাঙা আভায় ভরে গেছে সমস্ত আকাশ--- রাতের নদীর পাশে একলা একটা গাছ,যার ডালে ডালে চাঁদের আলোর রুপোলী কারুকাজ-- এইসব অর্ধবাস্তব- অর্ধকল্পনা রূপ নিতে লাগলো কাগজের উপরে।

টিপু মস্ত চোখ মেলে বলতো-"ভালোকাকীমা, তুমি কী সুন্দর আঁকো!"

আমি ওর গালে নরম করে হাত বুলিয়ে বলতুম,"তুই বড়ো হলে এর থেকে অনেক বেশী সুন্দর আঁকবি।"

টিপুর যখন বয়স সাত তখন ওর ঠাকুমা স্বর্গে গেলেন। এবার ওদের বাড়ীতে মোটে তিনজন- বাবা মা আর ছেলে। কালেভদ্রে ওর জ্যেঠারা আসতো বেড়াতে তাদের পরিবার নিয়ে।

টিপুর বাবা ওর কেরিয়ার নিয়ে খুব সিরিয়াস হয়ে উঠলেন। বাংলা স্কুল থেকে ছাড়িয়ে ওকে ভর্তি করলেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। নইলে নাকি ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তাঁর দাদাদের ছেলেমেয়েরা সবাই নাকি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে।

পাড়াও বদলাচ্ছিল, অনেক নতুন লোকেরা এলো। নতুন নতুন বাড়ী হলো অনেক, কিন্তু মানুষে মানুষে আর সেই নিকটত্ব ছিল না। সবাই নিজেকে নিয়ে বড়ো বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

প্রত্যেকের জীবন থেকে সময় কমে গেল অনেক। টিভি এসে সবার বিকেলগুলো গ্রাস করে ফেলেলো। এখান আর লোকেরা বিকেলে একে অন্যের বাড়ী বেড়াতে যায় না, এমনকি দুর্গপুজোর পরে বিজয়াদশমীতে যে প্রায় আবশ্যিক দেখা করার রেওয়াজ ছিল তাও আস্তে আস্তে উঠে গেল।

৩।

কিন্তু টিপু অনেকদিন পর্যন্ত একই রকম ছিল। এত পড়ার চাপ, এত সময়ের অভাব, তবু এরই মধ্যে সময় করে সে ছুটে আসতো আমাদের বাড়ীতে। বাগানে বসে দেখতো কাঠবেড়ালীদের দৌড়োদৌড়ি, আমগাছের ছায়ায় বসে কাঠবেড়ালীরা কাটুর কুটুর করে কিসব খেতো, আর আমাদের টিপুন মুগ্ধ হয়ে তাই দেখতো।

এক একদিন বলতো, "কাকীমা, তুমি কাঠবেড়ালী আঁকো?"

আমি ওকে রং-তুলি আর ড্রইং শীট দিতাম,ও শান্ত হয়ে বসে আঁকতো। একবার এঁকেছিল মস্ত একটা পাহাড়ের পাশে ছোট্টো একটা কাঠবেড়ালী, কাটুর কুটুর করে বাদাম খাচ্ছে। পাহাড়টার রাগী রাগী চোখ মুখ এঁকে দিয়ে টিপু বলতো "জানো কাকীমা, ঐ মস্তবড়ো পাহাড়টা আর ছোট্টো কাঠবেড়ালীটা ঝগড়া করছে।" আমি ওর ছবি আর কল্পনা দেখে আশ্চর্য হয়ে যেতাম।

ওর ছবিগুলো দিনদিন প্রানবন্ত হয়ে উঠছিল। দেখে বুঝতে পারতাম সুযোগ পেলে খুব বড়ো শিল্পী হবে ও একদিন।

কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল একদিন। একবার ওর পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলো বেশ। ওর বাবা খুব রেগে গিয়েছিলেন। ওকে ঘরে বন্ধ করে কী করেছিলেন ঠিক জানি না, তবে এর পর থেকে ও আর আঁকলো ও না কোনোদিন।

সুলতা পরে আমায় বলেছিল ওর বাবা সেদিন ওর সব ছবি ছিঁড়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। খুব বকেছিলেন ওকে, মেরেওছিলেন। বলেছিলেন এরপরে পড়াশোনার বাইরে অন্য কিছুতে সময় নষ্ট করলে মেরে ওর ছালচামড়া তুলে ফেলবেন। ছবি ছিঁড়ে ফেলায় ও নাকি খুব মুষড়ে গেছিল, সেই রাত্রে খায় নি।

কিন্তু তারপর থেকে ও আর ছবি আঁকে নি। মনোযোগী ছাত্র হয়ে গিয়েছিল। সারাক্ষণ শুধু পড়াশোনাই করতো, আর কোনো হবিটবিও আর ছিল না। বেশ ভালো ছাত্র হয়ে গিয়েছিল ও। বাবামা দুজনেই খুশী হয়েছিলেন।

বছর দুয়েকের মধ্যেই ওর চোখে উঠলো মোটা ফ্রেমের চশমা। খুব গম্ভীর আর চুপচাপ। ওদের বাড়ীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে মাঝে মাঝে দেখতাম ওর পড়ার টেবিলে বসে পড়ছে ও। অথবা লিখছে। জানালার গ্রিলের ওপাশের চশমা চোখে বিরসবদন কিশোরটিকে দেখে আমার সেই চকচকে চোখের ঝলমলে শিশুটিকে মনে পড়তো। কেন জানিনা মনটা মেঘলা হয়ে যেত।

যদিও টিপু আর আসতো না, তবু আমার ছবি আঁকা থামলো না। সবার অলক্ষ্যে নির্জন দুপুর আর বিকেল ভরে চলতে লাগলো আমার ছবি ছবি খেলা। ছোট্টো টিপু ছবিগুলোর মধ্যে বারে বারে ফিরে আসতো।

মাধ্যমিকে বেশ ভালো হয়েছিল ওর রেজাল্ট। কিন্তু ওর বাবা তাতেও সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি আরও ভালো চেয়েছিলেন। উচ্চামাধ্যমিকে তিনি ওকে টার্গেট ঠিক করে দিলেন-প্রথম দশজনের মধ্যে থাকতে হবে আর জয়েন্টে খুব ভালো করতে হবে। নইলে নাকি আত্মীয়স্বজনের কাছে তাঁর মানসম্মান বলে কিছু থাকবে না।

উচ্চমাধ্যমিকের টেস্টের পরে ও যখন দিনরাত নাওয়া খাওয়া ভুলে পড়াশোনা করতে শুরু করলো তখন সুলতা বিচলিত হয়ে পড়লো। সত্যি খুব রোগা হয়ে গেছিল টিপু, মাঝে মাঝে নাকি অল্প অল্প জ্বর হতো। ডাক্তার ভালো করে পরীক্ষা করে নাকি বলেছিলেন প্রচন্ড মানসিক চাপ থেকেই এইরকম হচ্ছে।

পরীক্ষার দুদিন আগে ঘটলো বিপর্যয়। টিপু মাথা ঘুরে পড়ে গেল, অজ্ঞান হয়ে গেল। ওদের বাড়ীতে হুলুস্থূলু কান্ড। ডাক্তার এলেন, তাঁর চেষ্টায় যখন জ্ঞান ফিরলো তখন বোঝা গেল কোথাও একটা খুব গন্ডগোল হয়েছে, টিপু স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে, কিছুতেই আর কিছু মনে করতে পারছে না।

সেই বছর পরীক্ষা দেওয়ার তো আর প্রশ্নই ওঠে না। টিপুর মন তখন সম্পূর্ণ ব্ল্যাংক। তার কিছুদিন পরেই একটা রিহ্যাবে নিয়ে যাওয়া হয় টিপুকে। আশ্চর্যের কথা, রিহ্যাবে যাবার আগে ও কেমন করে যেন আমাকে মনে করতে পেরেছিল, যাবার রাতে ওর মায়ের সঙ্গে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে বলে গেল, " ভালোকাকীমা, ফিরে এলে আবার আসবো তোমার কাছে। "

ওর ফিরে আসা হয় নি, রিহ্যাবেই মারা যায় ছ'মাস পরে। সুলতারা বাড়ী বিক্রি করে পন্ডিচেরী চলে গেল। টিপুর বাবা স্বেচ্ছাবসর নিয়েছিলেন সময়ের অনেক আগেই।

আমার ছবিতে কিন্তু এখনো লুকোচুরি খেলে বেড়াচ্ছে ছোট্টো টিপু। ঘাসের উপরে কান রেখে কচি গলায় বলছে "ভালোকাকীমা, দ্যাখো, ঘাসেরা কথা বলছে।"

দেখতে পাই গ্রীষ্মের ছুটির দুপুরে আমগাছের ছায়ায় বসে বিভোর হয়ে আঁকছে টিপু। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে সূর্য ঢলে পড়ছে মাঝ আকাশ থেকে পশ্চিমে, টিপুর হুঁশ নেই।

সুলতা আসছে ডাকতে ডাকতে, "টিপু উ উ উ ", টিপু শুনতে পাচ্ছে না। ওর কাছে এসে সুলতা বলছে, "হ্যাঁরে তোর কি খিদে তেষ্টাও পায় না? এত বেলা হয়ে গেল, কখন স্নান করবি, কখন খাবি?"

স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখ তুলে টিপু বলছে, "অ্যাঁ? কী বলছো?"

পুরু লেন্সের পিছন থেকে এক কিশোরের দুঃখী চোখও আমার দিকে চেয়ে থাকে, তার ছবিও ফুটে ওঠে তুলির টানে - জানালার গ্রিলের ওপাশ থেকে কিশোর টিপুর শান্ত-গম্ভীর মুখ। পড়ার টেবিলে টিপু, মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোবার পরের হাসিমুখ টিপু।

সে আমাকে ভোলে নি। আমি যখন আঁকি, একা একা নির্জন দুপুর, আমার রং তুলি প্যালেট ছড়িয়ে, তখন সেই পলাতক বালক এসে আমার পাশে দাঁড়ায়, আমার হাত দিয়ে আঁকতে থাকে সে, আমার চোখে তার দৃষ্টি বুনে দিতে থাকে। দেখতে দেখতে আমার আঁকা গুলো অন্যরকম হয়ে যেতে থাকে- অনেক আশ্চর্য কল্পনা মিশে সেগুলোকে পাল্টে দিতে থাকে ।

৪।

বহুকাল পরে আমার স্কুলবেলার বান্ধবী মধুচ্ছন্দার ফোন পেয়ে অবাক হয়ে যাই। ও নাকি বহুকাল দিল্লিতে ছিল, এত বছর পরে কলকাতায় ফিরেছে। আমার ঠিকানা আর ফোন নম্বর পেয়েছে আমার বোনের কাছ থেকে। একদিন ওর বাড়ীতে যেতে নেমন্তন্ন করলো। ভালো করে বুঝিয়ে বলে দিল কোন রুট কত নম্বর বাস সব কিছু।

তবু সেসব ভুলেই গেছিলাম। মধুচ্ছন্দা আবার ফোন করলো। এতবার করে যেতে বলছে- যে শেষ পর্যন্ত মন ঠিক করতেই হলো আমার। একদিন সকাল সকাল তৈরী হয়ে গেলাম ওর বাড়ীতে।

"রূপন, রূপন, একবার এঘরে এসো। তোমার আন্টি এসেছেন।"

পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এক শান্ত কিশোর, কিন্তু তার চশমার আড়ালে চোখ দুটো রাগী-রাগী।

আমি চমকে উঠি, ঠিক যেন টিপু!! শুধু টিপুর চোখে এত রাগ ছিল না।

আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ছেলেটি বলে "গ্ল্যাড টু মিট ইউ আন্টি। হাউ আ' ইউ ডুইং ?"

আমি হেসে ফেলি,"আমিও খুশী হয়েছি রূপণ।"

রূপণ একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গী করে। তারপরে বলে,"এক্সকুইজ মী আন্টি,আ' ম ভেরি বিজি।" এই বলে চলে যায়।

আমি মধুচ্ছন্দার দিকে তাকিয়ে বলি," সে কিরে ছন্দা,তোর ছেলে একেবারেই বাংলা বলতে পারে না?"

আরো কিছু কথা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ওর দিকে তাকিয়ে আমি থেমে যাই। ওর চোখ দুটো জলে ভরে গিয়েছে , ঠোঁট দুটো কাঁপছে।

ও আস্তে আস্তে থেমে থেমে আমাকে বললো সব কিছু। রূপণ ওদের একমাত্র ছেলে, পড়াশোনাতে ভালই ছিল-উপরন্তু খুব ভালো আঁকতো ও। কিন্তু পড়াশোনার ক্ষতি হবে ভেবে ওর বাবা ওর আঁকা কঠোর ভাবে নিষেধ করে দিলেন একদিন।

তারপর থেকে ও আর কোনোদিন রঙতুলি ছোঁয় নি, কিন্তু স্বভাব পাল্টে যেতে থাকলো ওর। আগে ছিল হাসিখুশী ছেলে, এখন হয়ে গেল রাগী। একদিন ভয়ানক রেগে জিনিসপত্র ছুঁড়তে থাকে ও, সবাই মিলে ধরে বেঁধে মনোরোগবিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।

একটি রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে বেশ কিছুদিন থাকার পর কিছুটা ভালো হয় ও। এখন অনেক ভালো, তবু একেবারেই বাংলা বলে না, সারাদিন অংক খাতায় হিজিবিজি টানে। ডাক্তার ওকে কোনোরকম মানসিক চাপ দিতে বারণ করেছেন। কিছুদিনের জন্য জায়গা বদল করতে পারলে ভালো হয়। সেই ভেবেই ওরা দিল্লি ছেড়ে কলকাতা এসেছে, কিন্তু এখানেও কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না।

৫।

আমার বাগানে আমগাছের ছায়ায় নির্জন দুপুর নেমেছে। নরম ঘাসের উপরে এলিয়ে বসে রূপন ড্রইং শীটের উপরে তুলি টানছে। পাশে আমি, আমার ড্রইং শীটে তুলির টানে টানে ফুটে উঠছে সেই পক্ষীনীড়, মা পাখী আর তার তিন ছানা।

রূপন বেশ কিছুদিন আছে আমার এখানে। প্রথমে আসতে রাজী হয় নি কিছুতেই, আমি বলেছিলাম যে আমার অনেক ছবি দেখাবো ওকে-সব আমার নিজের হাতে আঁকা।

এখন রূপন দিব্যি বাংলা বলে, এক একদিন হাসেও। মাঝে মাঝে আমি চমকে উঠি, ঠিক যেন টিপুর হাসি!

একটু একটু করে রাগী কিশোরের মধ্য থেকে সেই পলাতক বালকটি দেখা দিতে থাকে, আমি আমার সবটুকু ক্ষমতা জড়ো করে ওকে শেখাতে থাকি। যা এতদিন ওর জন্যে জমিয়ে ছিলাম, সবটুকু উজার করে ওকে দিয়ে দিতে থাকি।

(সমাপ্ত)


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

(সমাপ্ত)

গড়াগড়ি দিয়া হাসি

কেউ কি আপনার ঠাকুরঘরের আশেপাশে গমনাগমন সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছে? চিন্তিত
নইলে স্ব-প্রণোদিত হয়ে এমন তীব্রভাবে কদলীভক্ষনের দায় অস্বীকার করা কেন? দেঁতো হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তুলিরেখা এর ছবি

কলা খাওয়া তো ছাইড়া দিছি কবেই, বান্দরদের নামে উৎসর্গ করছি। দেঁতো হাসি

এইটা তো সেপারেট গল্প, কোনো সিরিজ না তো! দেঁতো হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

এইটা তো সেপারেট গল্প, কোনো সিরিজ না তো!

আমি কি "প্রশ্ন" নাকি? রেগে টং বুচ্চি তো।

[মাগার, আন্নের অত্যুৎসাহী পাদটিকা দেইখা ঈমান দুব্বল হয়ে গেছে খাইছে ]

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

এক লহমা এর ছবি

হো হো হো
তুলিদিদির গল্প পড়ে পড়ছি, আপাততঃ হেসে নিই।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

এক লহমা এর ছবি

ভাল লেগেছে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তুলিরেখা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

গান্ধর্বী এর ছবি

মনটা খারাপ করে দিলেন! মন খারাপ

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

তুলিরেখা এর ছবি

মনখারাপ হয়ে গেল? চিন্তিত

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লেগেছে অনেক।
আপনার "কথা ও কবিতা" পাচ্ছিনা অনেকদিন হল। মন খারাপ

-ছায়াবৃত্ত

তুলিরেখা এর ছবি

ধইন্যা। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
"কথা ও কবিতা" আসবে। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার গল্প আগে পড়েছি কিনা মনে করতে পারছিনা।পড়লেও বিচ্ছিন্নভাবে হয়ত। তবে এটি পড়ে মনে হচ্ছে কাজটি ভীষন অন্যায় হয়েছে।

এককথায় "দারুন" চলুক

--------------------
আশফাক(অধম)

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ ভাই। আসলে গল্প সেভাবে লেখা হয়ে ওঠে না, কালেভদ্রে হয়।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

দীনহিন এর ছবি

মোটামুটি! তবে তুলিদির সেই আকুল করা গদ্য কই এতে!

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

তুলিরেখা এর ছবি

ভাই দীনহীন, পড়েছ বলে ধন্যবাদ নাও। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।