বোকায় বোকারণ্য ২ - একটি মোবাইল বাঁচাবো বলে......

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি
লিখেছেন ইয়াসির আরাফাত [অতিথি] (তারিখ: রবি, ০৪/১১/২০১২ - ৬:১৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সম্প্রতি একটা মন্তব্য থেকে জানতে পারলাম তারেকানুর নাকি এখনও মোবাইল ফোন হারায় নি বা ছিনতাই হয় নি। কি আশ্চর্য কথা! এ কি সম্ভব নাকি? উনি মনে হয় সাবালক হবার আগে থেকেই দেশের বাইরে থাকেন। ওনার এত ঘুরাঘুরি করেও কিছু হয় নি, অথচ আমরা যারা রাত বিরাতে অল্প স্বল্প ঘুরে বেড়াই ঢাকা শহরে তারা ঠ্যাক না খেয়ে বাড়ি ফিরতে পারি না, অথবা মোবাইল ফোন পকেট থেকে সিএনজিতে পড়ে গিয়ে সেখানেই রয়ে যায়! অনু সাহেবের দেশ ঘুরানি কপালের পাশাপাশি জিনিস না হারানোর কপালটিকেও লাল সালাম!

আমার বন্ধু ইমতিয়াজের কপাল এত ভালো ছিল না। বেচারা ধানমন্ডি থেকে টিউশনি করে পলাশী ফেরার পথে দুইজনের হাতে পড়ল। রাইফেলস স্কয়ার পার হতেই এরা রিকশা থামিয়ে পকেটের সব কিছু কেড়ে নিল, রাত বেশি না হলেও জায়গাটা ছিলো নির্জন। ইমতিয়াজ হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যার সাড়ে বারো হাজার টাকার রুপালি মোবাইল ফোন দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রায় পুরো টাকা ধার করে আমিও একটা কিনে ফেলেছিলাম। কাজেই দুঃখ ভাগ করে নিতে সে প্রথমে আমার কাছেই এলো।

আমি আর আখতার আহসানউল্লাহ হলে বসে ঝিমাচ্ছিলাম সকাল বেলায়। আজকে হরতাল, তাই করার তেমন কিছুই নেই। শুনলাম মতির মোবাইল হারানোর গল্প (ইমতিয়াজ নামটা ছোট হতে হতে মতি হয়ে যাবে এ আর আশ্চর্য কি? বন্ধুদের কি এত ধৈর্য থাকে?)। গতকাল রাতে ফোন খোলা পেয়ে বার বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে বর্তমান মালিকের (!) সাথে। চার্জ প্রায় শেষের দিকে ছিলো বলে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারে নি। যেটুকু কথা হয়েছে তার সারাংশ হল, ফোন ফেরত পেতে চাইলে পাঁচশ টাকা নিয়ে সায়েদাবাদ ধলপুর গাউসুল আজম জামে মসজিদের সামনে যেতে হবে, একা। পুলিশে খবর দিলে খবর আছে ইত্যাদি।

মোবাইলটা উদ্ধার করতে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে কিনা, সেটাই মতি আলাপ করতে এসেছে সকালে। দেখা যাবে ফোন টোন কিছুই পাওয়া গেল না, বরং পাঁচশ টাকা টাকা কেড়ে নিয়ে কিছু উত্তম মধ্যম দিয়ে দিল ছিনতাইকারী। অসম্ভব নয় ব্যাপারটা!

কম বয়সে রক্ত আর মাথা দুটোই থাকে গরম, জোশ থাকে বেশি। বেশি না ভেবেই ঠিক করে ফেললাম একটা চান্স নিয়ে দেখা যাক। তিনজন মিলে গেলে ধরে পেটাতে পারবে অন্ততঃ। নিচে নেমে দেখি রিকশা ভালোই চলছে। হরতালে সেই আগের মত উত্তাপ নেই, ভাঙচুর জ্বালাও পোড়াও মেজর কয়েকটা পাবলিক পয়েন্টেই সীমাবদ্ধ। প্রথম কয়েকটা রিকশা আমাদের বলা ঠিকানায় যেতে চাইল না, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়াঞ্জাম চলছে নাকি? এক বৃদ্ধ শেষ পর্যন্ত আমাদের উঠিয়ে নিল। তিনজনে মিলে বুড়োর কাঁধে সওয়ার হতে খারাপ লাগছিলো, কিন্তু কি আর করা!

পলাশী থেকে সায়েদাবাদ যত দূরে ভাবতাম ততটা আসলে নয়। পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই জায়গামত পৌঁছে গেলাম, বাস টার্মিনাল বা তার আশেপাশে কোনই গিয়াঞ্জাম নেই। কেবল ধলপুর ঢোকার গলির মুখে জনৈক পীর বাবার ঝলমলে দরবার শরীফ দেখতে পেলাম, সেখানে তারস্বরে মাইক বেজে চলেছে অবিরাম। সব ব্যবসারই প্রচার লাগে, ধর্ম ব্যবসা তার ব্যতিক্রম হতে যাবে কেন?

রিকশাওয়ালা যখন আমাদের নামিয়ে দিলো তখন সে একেবারে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। গাউসুল আজম জামে মসজিদ কোথায় জিজ্ঞেস করতে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল একটা গেট, সেখানে ছোটখাটো একটা তোরণে নাম লেখা। আমরা বড়সড় মিনার অথবা কারুকাজ করা সিংহদ্বার আশা করছিলাম বলে চোখে লাগে নি। মসজিদের সামনে গ্যাঁট হয়ে দাঁড়ালাম, চারিদিকে ঘাড় চোখ ঘোরাচ্ছি, কেউ কি মসজিদের গেটের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে? আমাদের নড়াচড়া লক্ষ করছে? তাহলে সেই হবে আমাদের কন্টাক্ট।

আধা ঘণ্টা পার হয়ে গেল, এমন কাউকে দেখতে পেলাম না যাকে আমাদের ব্যাপারে উৎসাহী বলে মনে হয়। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। দুটো ভবনে নির্মাণ কাজ চলছে, অলস ভঙ্গিতে কিছু শ্রমিক কাজ করে চলেছে। মসজিদের গেটের ঠিক উল্টোদিকে একটা সরু গলি একেবেঁকে চলে গেছে, সেটার দিকে আমি বারবার তাকাচ্ছিলাম, এই বুঝি কেউ বের হয়ে এসে জিজ্ঞেস করবে, আপনারা কি মোবাইল ফোনের খোঁজে এসেছেন? গলির কোনায় একটা মুদি দোকান। মধ্যবয়স্ক দোকানির গায়ে পাঞ্জাবি আর সাদা-সবুজ স্কার্ফ, গালে দাড়ি, কপালে বড়সড় একটা কালো দাগ। নামাজী লোক বোঝাই যাচ্ছে। তাকে গিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে কি লাভ হবে? এই লোক মনে হয় না দুর্বৃত্তদের চেনে।

পৌনে এগারোটা বাজে, সকালে খাওয়া হয় নি এখনও। তিনজনে শলা পরামর্শ করে খেতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম, দশ মিনিটে নিশ্চয়ই হাইজ্যাকারের কিছু এসে যাবে না। কিছুক্ষণের মধ্যে খাওয়া শেষ করে আবার আগের জায়গায় ফেরত এলাম। খাওয়াটা ভালো হয় নি, এত ঝাল মানুষ কি ভাবে খায়? ভেবেছিলাম এসেই দেখব দুই তিন জন লোক অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছে মোবাইল হাতে, দেখা হলেই ঝাড়ি দিয়ে বলবে, “মিয়া অপেক্ষা করতে পারলেন না আমাদের জন্য? আমাদের কি সময়ের দাম নাই?” কিসের কি!

দুই পাঁচ দশ মিনিট করে আরও ঝাড়া দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেল, দেখা নেই কারো। কত লোক রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, কেউ এদিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। অনেকের চোখেই উদাস দৃষ্টি, নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে পথ বা আকাশের দিকে। চোখে পানি ছলছল করছে দুই একজনের, কি সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে তারা আন্দাজ করা কঠিন। লোকগুলো যে জায়গা থেকে আসছে সেটা হলো একটা বস্তি। নিচু ঘরগুলোর ওপর দিয়ে একটা বড় সাবস্টেশন দেখা যাচ্ছিলো। তড়িৎকৌশলের ছাত্র হওয়াতে কিছুটা আগ্রহ বোধ করছিলাম কাছ থেকে দেখে আসার। এগিয়ে গিয়ে দেখি ওখানে যেতে হলে বস্তির ভেতর দিয়ে হাঁটাপথে যেতে হবে, নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আগ্রহ দমালাম। যে রাস্তায় এসেছি সেটা একটা কানাগলি, শেষমাথায় ঢাকা ওয়াসা লেখা একটা বড় ধাতব দরজা। কাঁটাতার দিয়ে দেয়াল দুর্ভেদ্য করে রাখা। এটাকে সাধারণ পানি সরবরাহ কেন্দ্র বলে মনে হচ্ছিলো না। তখনো জানি না এটাই সেই বিখ্যাত ওয়াসা ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট যার কথা খবরের কাগজে পড়ি প্রচুর। এখানে একটা বিষাক্ত লেগুন আছে যেখানে মাছ চাষ করে পরে বাজারে বিক্রি করা হয়। লেগুনের তলা থেকে মাঝে মাঝেই উদ্ধার করা হয় বস্তায় ভরে ডুবিয়ে দেয়া লাশ।

ইতিমধ্যে জোহরের নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গেছে, মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতে ঢুকছে মসজিদের ভেতর। মুদি দোকানদারও তার ঝাঁপি বন্ধ করে সেই দলে যোগ দিয়েছে। আমরা ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি, মনে হচ্ছে এখানে আসাই ভুল হয়েছে ঝোঁকের মাথায়। আমি আর আখতার চলে যাবার কথা তুলতেই মতি বলল আরেকটু থাকতে, বেচারা মোবাইল হারাবার শোক মেনে নিতে পারছিল না। দোকানি আবার ঝাঁপি খুলেছে, আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কাউরে খুঁজেন ভাই?” মতি উৎসাহী হয়ে এগিয়ে গেল তার দিকে, নিজের গল্প খুলে বলল। দোকানির নাম আজিজ মিয়া, সে এই এলাকায় অনেকদিন ধরে আছে, অনেককে চেনে। ঘটনা শুনে সে বলল, “খাড়ান দেখি কাউরে পাই কিনা।” একটা ছোট ছেলে হেঁটে যাচ্ছিল, তাকে বস্তির ভেতর দিকে পাঠিয়ে দেয়া হলো খবর নিয়ে আসার জন্য।

আধা ঘণ্টার পরে পিচ্চিটা সাদা শার্ট আর লুঙ্গি পড়া এক লোকের সাথে বেরিয়ে এলো। লোকটা একেবারে তালপাতার সেপাই, কিন্তু দেখতে ভয়ানক। তার ডান হাত এবং বাম চোখ নেই, গালে গভীর একটা চেরা দাগ। বিপদের সাথে তার গলায় গলায় দোস্তি, বোঝা যায়। চেহারায় নিষ্ঠুর ভাব প্রচণ্ড বেশি। এর নাম কি ছিলো এতদিন পর ভুলে গেছি, ধরে নেই তার নাম কানাবাবা। কানাবাবা আমাদের কাছে এসে ঘোষণা করল, মোবাইল ফোন তার দখলে আছে। দুজন লোক গতকাল রাতে এটা নিয়ে আসে এবং বস্তির এক মহিলার ঘরে রাত কাটায়। মহিলার কাছে তারা ঐ ফোন এক হাজার টাকায় বিক্রি করেছে। সেই মহিলা আবার কানাবাবাকে ফোন পনেরোশ’ টাকায় বেচেছে। এখন সেটা আমাদেরকে পেতে হলে আড়াই হাজার টাকা দিতে হবে। গুল মারছে বোঝাই যায়! সিটিসেলের মোবাইল সেট কেউ এক পয়সা দিয়েও কিনবে না, যদি তার জিকে ঠিক থাকে।

আমরা বুঝতে পারছিলাম না আপত্তিটা কার কাছে করব। মতি নালিশের ভঙ্গিতে আজিজ মিয়াকে বলল, “কিন্তু আমাকে তো বলছিলো পাঁচশ টাকা হলেই ফোন দিয়ে দিবে, আমি অনেক কষ্টে পাঁচশ টাকা জোগাড় করে নিয়ে আসছি”। কানাবাবা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, “চইদ্য হাজার ট্যাকার মোবাইল ইউজ করেন আর আড়াই হাজার ট্যাকা আনতে পারবেন না?” মতি বলল, “আমার কাছে আর টাকা নাই, কালকে রাতে আপনের লোক সব টাকা নিয়া নিছে”। কানাবাবা জবাব দিল, “হলে যান, বন্ধুর কাছে টাকা ধার করে নিয়া আসেন।”

অবাক হয়ে কথা শুনছিলাম, বলে কি এই লোক! ডিসকাউন্টে কেনা মোবাইলের আসল দাম জানে, হলে গেলে বন্ধুরা টাকা ধার দেবে সেটাও জানে। কঠিন চিজ, এর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সহজ হবে না। আজিজ মিয়া কানাবাবার কথায় মৃদু আপত্তি করে বলল, “এরা ছাত্র মানুষ, শিক্ষিত লোক, এদেরকে বিপদে ফালাইও না...” দুজনে কিছুক্ষন তর্ক চলল। শেষ পর্যন্ত কানাবাবা এক হাজার টাকার দাবীতে ঘাড় গোঁজ করে বসে রইল। আমরা দেখছিলাম আজিজ মিয়াকে যেরকম মানুষ বলেই মনে হোক, বস্তির মানুষের ওপর তার একটা প্রভাব আছে। মতি সুযোগ বুঝে আজিজ মিয়াকে চেপে ধরল কানাবাবাকে পাঁচশ টাকায় রাজি করানোর জন্য। বহুত গাঁইগুঁই করে কানাবাবা রাজি হয়ে গেল মোবাইল ফোন ফেরত দিতে।

এবার জিনিস ফেরত পাবার পালা। কিন্তু কানাবাবা সেটা তার কাছে রাখেনি, রেখেছে বস্তির একজনের কাছে। সেটা আবার সে নিজের হাতে এনে দেবে না, আমাদের কাউকে ভেতরে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের সবাই নয়, যে কোন একজন যেতে পারবে। পরিস্থিতি যথেষ্ট ঘোলাটে হয়ে গেল, বস্তির ভেতর কারো একা একা যাওয়াটাকে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হচ্ছে না। এদিকে মতি নিজের ফোন ফেরত পাবার জন্য বেপরোয়া, সে নিরাপত্তা নিয়ে কোন কথা শুনতে রাজি নয়। আজিজ মিয়া, কানাবাবা আর মতি দল বেঁধে রওনা হয়ে গেলো, আমি আর আখতার বোকার মত দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম।

টেনশন নিয়ে অপেক্ষা করা এক মহা বিরক্তিকর ব্যাপার, একেক মুহুর্ত কখনো মিনিট কখনো ঘন্টায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। উদ্বিগ্নতার মধ্য দিয়ে একটু একটু করে দেড় ঘন্টা পার হয়ে গেলো, মতির দেখা নেই। কানাবাবা যেই ভয়ানক লোক, ভেতরে নিয়ে মতিকে আটকে রেখেছে নাকি? হয়তো আমাদেরকে এসে বলবে, বন্ধুকে ফেরত চাইলে আরও টাকা নিয়ে এস। খানিক পর আরও দুশ্চিন্তা হতে থাকে, মেরেটেরে ফেলেনিতো আবার? বিকেল সোয়া চারটায়, পৌণে দুই ঘন্টা পরে, মতিকে দেখতে পেলাম বস্তির একটা রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে আসছে, সাথে আজিজ মিয়া। উৎকণ্ঠা হঠাৎ রাগে পরিণত হয়ে যায়, ক্ষেপে গিয়ে মতিকে শুধালাম, কি করলিরে এতক্ষন হারামজাদা? মতি ইশারায় চুপ থাকতে বলে আজিজ মিয়াকে বলল, ভাই তাইলে আসি। আজিজ মিয়া হাসিমুখে বলল, ঠিক আছে যান। কোন সমস্যায় পড়লে আমারে স্মরণ কইরেন। আমি এইখানেই থাকি সবসময়।

রিকশায় উঠে মতিকে জিজ্ঞেস করলাম, “মোবাইল পাইছিস?” মতি পকেট থেকে জিনিস বের করে দেখালো। যাক, ভালোয় ভালোয় সব শেষ করে ফিরে যাচ্ছি। মতিকে জিজ্ঞেস করলাম, “এত দেরি করলি কোথায়? আমরা তো ভয়ে আধমরা হয়ে গেছিলাম। একবার চিন্তা করছিলাম থানায় গিয়ে পুলিশ নিয়ে আসব।” মতি কাষ্ঠ হাসি হেসে বলল, “পুলিশ আনলে কোন লাভ হইত না। এরা মারাত্মক চিজ। ভিতরে গিয়ে কি দেখলাম শোন। প্রথমে গেলাম সেই মহিলার ঘরে। সে সেখানে নাই। তার খোঁজে লোক পাঠানো হইল। তারপর ঘটল আসল ঘটনা।” মতি একটু দম নেয়।

“অপেক্ষা করতে করতেই আসল হেরোইনের এক বড় চালান। এখানে দিনে দুইবার হেরোইন সাপ্লাই আসে। কমবেশি সবাই হেরোইন খায়। খবর পেয়ে চারদিক থেকে পিলপিল করে লোক আসতে থাকলো। সেই দৃশ্য যদি দেখতি। এক এক পুরিয়ার দাম একশ’ টাকা। কেউ লুঙ্গির গিঁট থেকে, কেউ সালোয়ারের ভাঁজ থেকে, কেউ ব্লাউজের ভেতর থেকে আর কেউ কেউ একশ’ টাকার নোট হাতে নিয়ে ঝাঁপায় পড়লো চালানওয়ালার কাছে। সবাই হেরোইন চায়। বাপ-বেটা, জামাই-বউ, ইয়াং-বুড়া কোন ভেদাভেদ নাই। এই একশ’ টাকা জোগাড়ের জন্য কেউ ভিক্ষা করে, কেউ ছিনতাই করে, কেউ চুরি করে, কেউ পকেট কাটে। কারো কারো এক পুরিয়ায় চলে না, তাদের ক্রাইম করতে হয় বেশি। কেউ কেউ আবার ছোট চাকরি বা রিকশা চালানোর টাকা পুরাই হেরোইনের পিছনে উড়ায়।” মতির কথা শুনতে শুনতে আমাদের চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছিলো। ঢোঁক গিলে বললাম, “কস কি?”

মতি বলল, “জানিস এই হেরোইন চক্রের লিডার কে? আজিজ মিয়া। এই বস্তির সবাই তার কাছে বান্ধা। পুলিশ আইসা তার কাছ থেকেই টাকার ভাগ নিয়া যায় রেগুলার। পুলিশ আনলে লাভ হইত না ক্যান বুঝছস?”

মাথা নাড়লাম, বুঝেছি। আরও বুঝেছি ওই এলাকার প্রায় সব লোক ছলোছলো চোখে শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে কেন হাঁটে।


মন্তব্য

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

আমিও মোবাইল খুইয়েছি দুইবার, কিন্তু ঘটনা ঘটেছে অত্যন্ত সাদামাটা ভাবে। ভীড়ের মধ্যে পকেট হাতিয়ে নিয়ে গেছে, আবলামীর চুরান্ত, কাউকে বলতেও লজ্জা লাগে। আহা, একবার যদি এইরকম সিনেমার মত একখান ঘটতো, কলার উঁচা কইরা গল্প করা যাইতো।

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

মূল গল্পটা আসলে ইমতিয়াজের। সে তো আর লেখালখি করে না, তাই চিকনে আমিই পোস্ট করে দিলাম দেঁতো হাসি

সবজান্তা এর ছবি

খুবই রোমাঞ্চকর ঘটনা এবং 'অন্যরকম' অভিজ্ঞতা। তবে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে যে খুব বড় একটা রিস্ক নিয়ে ফেলেছিলেন, সেটা সম্ভবত আপনারাও বুঝতে পেরেছেন। বিশেষ করে একা ভিতরে ঢোকার সিদ্ধান্তটা প্রায় বোকামির সামিল, খুব বড় ঝামেলা হতে পারতো হয়তো।

কিছু যখন হয়নি, সেটাই স্বস্তির। এবং অভিজ্ঞতা হিসেবেও অনন্য। আপনার লেখা ভালো লাগলো। নিয়মিত লিখুন।

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না, আদর্শলিপিতে পড়া আমার প্রথম বাক্য, আফসোস জীবনে প্রয়োগ করতে পারি নি। ঘটনা ঘটে যাবার পর খোঁজ খবর নিয়ে দেখি একেবারে সাপের গর্তে পা দিয়েছিলাম। দুইজন পুলিশ সদস্য দুটি ভিন্ন সময়ে বস্তির সদস্যদের হাতে গুম খুন হন বলে কথিত আছে। ধলপুর বস্তি ঢাকা শহরের সবচেয়ে বিপদজনক জায়গাগুলোর একটা।

যা বলেছেন সেটাই, কিছু যে হয় নি এটাই স্বস্তির। উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ

বন্দনা এর ছবি

বাব্বাহ আপনারা তো মেলা সাহসী, ভালোয় ভালোয় ফিরে আসছেন বলে আজকে এই কাহিনী লিখে আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারছেন।

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

ঝড়ে বক মরে আর ফকিরের কেরামতি বাড়ে, কপালগুণে বেঁচে গিয়ে সাহসী খেতাব পেয়ে গেলাম, একটু নেচে নি খাইছে

আজকে দশটা আইফোন ৫ দিলেও দাদা আর যাবোনা ওই স্কুলেতে এ এ এ এ এ

বাপ্পীহায়াত এর ছবি

চলুক
সেরকম অভিজ্ঞতা!

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ

রু এর ছবি

বাপরে বাপ! মতি খুব বড় রিস্ক নিয়েছিল।

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

তিন পাগলের হইল মেলা হ্রদে এসে হাসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমার মোবাইল ছিনতাই ও পকেটমারের ঘটনাগুলো এই ঘটনার তুলনায় নিতান্তই পান্তাভাত। এই ধরুন, একজন কিডনীর কাছে পিস্তল ঠেকিয়েছে আর টাকা-পয়সা-মোবাইল নিয়ে গেছে। অথবা পেটের কাছে একবার ছুরি আর একবার ক্ষুর ধরেছে - এবং নিয়ে গেছে। অথবা নিরাপত্তাজনিত কারণে পুলিশ কোথাও সবাইকে চেক করে ঢোকাচ্ছে। সেখানকার কিউতে দাঁড়িয়ে আছি তখন এক ফাঁকে নিয়ে গেছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

পান্তাভাত কি বলছেন দাদা? পেটের কাছে ছুরি আর ক্ষুর ঠেকালে আমরা হয়তো কিছু একটা ছেড়েই দিতাম (নাউজুবিল্লাহ), কিডনীর কাছে বন্দুক ঠেকালে অতি আতঙ্কে ফট ফটাস শব্দে হৃদয় পিন্ড বিদীর্ণ হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি দেখি দিব্যচোখে। আমরা ভেবেছিলাম রাতের আঁধারে ভয়ানক যা হবার হয়ে গেছে, দিনের বেলা হেসে খেলে হারানো জিনিস নিয়ে আসব। ওরকম একটা জায়গায় গিয়ে পড়ব জানলে ভোঁ দৌড় দিয়ে পালাতাম

আপনি লেখাটা পড়েছেন জেনে ভালো লাগলো।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমি সম্ভবত আপনার সবগুলো লেখাই পড়েছি। আগে মন্তব্য করা হয়ে ওঠেনি। আপনার ভাষা সাবলীল। যে বিষয় নিয়ে লেখা হচ্ছে সে বিষয়ে সৎ থাকলে এবং কোন চালাকি করার চেষ্টা না করলে এমন স্বচ্ছ ভাষায় লেখা যায়। লেখা চালিয়ে যান, আমরা আপনার সাথেই আছি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

আমার স্বল্পদৈর্ঘ্য ছাইপাঁশ লেখালেখির সবচেয়ে মুল্যবান কমপ্লিমেন্ট আপনার কাছ থেকে পেলাম। অনেক ধন্যবাদ জানবেন

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

বেশ ঝরঝরে লেখা!
আমার জীবনের প্রথম মোবাইল রিক্সায় পড়ে গিয়েছিল, পকেটে নেই- টের পেয়ে যখন রিক্সা থামিয়ে পেছনে দৌড়ে রাস্তায় খুঁজছি, হঠাৎ রিক্সাওলা ডাক দিলো। রিক্সার পা'দানিতে পড়েছিল।

আরেকটা শখের মোবাইল ফোন গত এপ্রিলে ছিনতাইকারী ছোঁ মেরে হাত থেকে নিয়ে গিয়েছিল। অনেক কাহিনির পরে র‍্যাবের কল্যাণে ৫০দিন পরে ফেরত পাই। তবে, যে/যারা মাঝে ফোনটা ব্যবহার করে যত্ন করেনি। পরে ব্যবহার করে আরাম পাইনি। তবুও হারিয়ে ফিরে পাওয়া ফোন বলে, রেখে দিয়েছি। স্মৃতি।

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

আপনার এই প্রায় অলৌকিক গল্প নিয়ে একটি পোস্ট হতে পারে কিন্তু!

র‍্যাব সাধারন মানুষের কাজে এসেছে, এটা শুনেই আমি আনন্দিত। নাকি আপনি সাধারন মানুষ নন? চোখ টিপি

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

হা হা। আমি সাধারণই। র‍্যাব অসাধারণ চোখ টিপি

ওডিন এর ছবি

শুনতে আজব লাগলেও- রাত বিরেতে অনেক হাঁটাহাটির পরেও এখন পর্যন্ত 'আসল' ছিনতাইকারীর কবলে পড়ার অভিজ্ঞতা হয় নাই। একবার দুই মাদকসেবী এসে গিয়ানজামের চেষ্টা করেছিলো, দেখেই বুঝেছিলাম মাদকসেবী- হাতে থাকা ব্যাগ ভেতরে ময়দার প্যাকেটশুদ্ধু মুখের ওপর ছুড়ে মারতেই একজন ধরাশায়ী আর আরেকজন ভেগে গেছিলো। তারপরেও পরে বুঝেছি- যা করেছিলাম ওইটা চরম বোকামী হয়েছে। বোমাটোমা থাকলে মেরে দিতে পারতো। আসল হাইজ্যকার হলে এই বোকামীটা কক্ষনোই করতাম না।

তবে দেখা হয়েছে এবং হয় পুলিসের সাথে। আমি ভীষণরকমের ঠোলা-ম্যাগনেট মন খারাপ

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

রাখে আল্লাহ মারে কে - আপনার কপালে আসল ছিনতাইকারী নেই মনে হচ্ছে। তবে এই দিন দিন না আরও দিন আছে ------ দেখা যাবে কয়েকবছর পর থেকে নিয়ম হয়েছে রাত এতটার পর পুলিশের সাথে দেখা হলে পকেটে থাকা সব কিছু দিয়ে দিতে হবে - সে ক্ষেত্রে, লাকি ইউ দেঁতো হাসি

ওডিন এর ছবি

আমার ধারণা, আমার ক্ষেত্রে এইটাই ঘটবে। ইয়ে, মানে...

রংতুলি এর ছবি

ভয়ংকর দম আটকানো একটা ঘটনা! বর্ণনা ঝরঝরে। তবে জানের উপর বড় কোনো জিনিস নাই, এতটা রিস্ক নেয়া ঠিক হয় নাই। এমনিতে দেশের যা অবস্থা তাতে জানে টিকে থাকাটাই আলহামদুলিল্লাহ্‌! মোবাইল-টোবাইল সব ফি-সাবিলিল্লাহ!

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

ধন্যবাদ রংতুলি।
যখনকার ঘটনা (মনে হয় ২০০১ সন) তখন মনে হয়েছিলো ছেলেখেলা। জগৎ সংসার বাস্তবতা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন থাকার কুফল। মানুষের এত হিংস্র হবার খবরও তখন কাগজে কম আসত।

জুন এর ছবি

বয়স কম এবং ছাত্রত্ব; দুইটা মিলেই করে ফেলেছিলেন বুঝতে পারছি। আমার মনে হয়না এত হ্যাডম হইত। মোবাইল হারাইছি মেলা। কিন্তু ছিন্তাই হইনাই এখনো। বোধহয় আমার পোষাক আর চেহারা আমার এই উপকার করেছে। দেঁতো হাসি এইভাবেই যেন বাকী জীবনটা কাটায় দিতে পারি। আমার বড় দুই ভাইই ছিন্তাই রাশির জাতক।

যদি ভাব কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ...

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

আমার বড় দুই ভাইই ছিন্তাই রাশির জাতক

ব্যাপারটা মোটেই হাসির নয় কিন্তু কথাটা এমনভাবে বলেছেন যে হাসি এসে যাচ্ছে। পার্ডন

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

পড়ছি। চলুক

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

ধন্যবাদ প্রৌঢ় ভাবনা আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

CannonCarnegy এর ছবি

আপনার লেখা ভালু পাই। চমৎকার ঝরঝরে। লিখতে থাকুন।

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ কামান সাহেব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।