চলে গেলেন কবি তারাপদ রায়

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: শনি, ২৫/০৮/২০০৭ - ১০:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দুঃসংবাদের বাহক হতে ভালো লাগে না।

মাত্র গতরাতে তারাপদ রায়ের একটি কবিতা পড়ছিলাম দেশ-এর ২ অগাস্ট, ২০০৭ সংখ্যায়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খবর এলো, কবি আর নেই, চলে গেছেন।

শক্তি-সুনীলদের সমসাময়িক তারাপদ রায় কৃত্তিবাস পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন শুরু থেকে। এমনই সেই সম্পৃক্তি যে একমাত্র পুত্রের নামও রেখেছেন কৃত্তিবাস।

তাঁর জন্মস্থান ও আদি নিবাস ছিলো টাঙ্গাইলে। দেশভাগের পর কলকাতা। কিন্তু তাঁর গদ্যে-পদ্যে সর্বত্র টাঙ্গাইল ছিলো আজীবন। এমনকি, সর্বশেষ কবিতা যেটি পড়ছিলাম গতরাতে সেখানেও নাম উল্লেখ না থাকলেও টাঙ্গাইলের কথাই লিখেছেন বলে অনুমান করা যায়।

কবিতাটি এখানে তুলে দিই।

পুরনো শহরতলিতে
তারাপদ রায়

আবার ফিরে এলাম,
আর একটু খোঁজ নিয়ে এলেই ভাল হত।

বাড়ির সামনের দিকে
একটা কয়লার দোকান ছিল
কাঠ, কয়লা, কেরোসিন - খুচরো কেনা বেচা,
কেউ চিনতে পারল না

দু'জন রাস্তার লোক বলল,
'এদিকে কোনো কয়লার দোকান নেই
গলির এপারে রাধানাথ দত্তের গ্যাসের দোকান
সেখানে খোঁজখবর নিয়ে দেখুন।'
মনে আছে কয়লার দোকানের পিছনে ছিল বড় উঠোন,
কয়েকটা আম কাঁঠাল গাছ, ভাঙা বারান্দা, ঘর দোর।
এখন তো কিছুই নেই,
শুধু একটা নেমপ্লেট, 'নাগরিক'।
চারতলা বাড়ি, ষোলটা ফ্ল্যাট,
এরই মধ্যে কোনওটায় আমি ফিরে এসেছি।
কিন্তু কয়তলায়, কাদের ফ্ল্যাট?
স্বর্গীয় রূপকবাবুর পদবিটা যেন কী ছিল,
তাঁদের নতুন বাসাবাড়িতে এখন কে থাকে -
কোনও খোঁজখবর রাখি না,
শুধু মনে আছে তাঁর ভাইঝি টুলটুলি।
না। সেই বাড়িটা জগৎসংসারে আর নেই,
টুলটুলিকে কেউ চেনে না।
পুরনো শহরতলির নতুন পাড়ায় বোকার মতো ঘুরি।


মন্তব্য

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

পোস্ট করার পর মনে পড়লো, তাঁর একটি বইয়ের নাম কোথায় চলেছেন, তারাপদবাবু?

তাই তো, কোথায় চললেন কবি?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

সুমন চৌধুরী এর ছবি

কবির প্রতি শ্রদ্ধা
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

হিমু এর ছবি

খুব খুব খুব দুঃখবোধ করছি। আমার বড় প্রিয় কবি, গল্পকার।

কোথাও বন্ধন নেই, লাল আলো, ট্রাফিকের হাত
সমস্ত নস্যাৎ করে শিরস্ত্রাণ খুলে চলে যাব
আশৈশব আমারো আকাঙ্ক্ষা ছিল আগুন নেভাব
দ্রুতশ্বাস দমকলে অগ্নিকান্ডে বন্দিনী দৈবাৎ
অথচ সার্কাস নয় মসৃণ দড়ির সিঁড়ি ধরে
পাঁচতলার ছাদ থেকে প্রিয়তমা সুন্দরীতমারে
বুকে করে নিয়ে আসব দগ্ধ প্রেম উজ্জ্বল উদ্ধার
পাগলা ঘন্টিতে বাজা ভালোবাসা, প্রেয়সী আমার।।


হাঁটুপানির জলদস্যু

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

...শিরস্ত্রাণ খুলে চলে যাব

গায়ে কাঁটা দেয়।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

হাসিব এর ছবি

দুঃখিত হলাম । কবির প্রতি শ্রদ্ধা ।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

প্রবাসে একঘেঁয়ে রসকষহীন জীবন।
আইডিয়া স্টোর থেকে ক'দিন আগেই এনেছিলাম তার বই 'সন্দেহজনক'। অর্ধেকটা পড়া হয়েছিল, অর্ধেকটা পড়া হয়নি।
এর মাঝে চলে গেলেন?
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

পাঠক কবে পড়বে সেজন্যে অপেক্ষা করার দায় তাঁদের নেই যে!

তারাপদ রায়ের বেশ কয়েকটা বই আমারও কেনা আছে। পড়া হয়নি এখনো।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নজমুল আলবাব এর ছবি

কবিতার মানুষগুলো এত দ্রুত চলে যায় কেন?

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

অকবিতাময় জগৎ বেশিকাল দেখতে চান না বলে বোধহয়।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আমার কাছে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলির একটি মনে হয় দারিদ্র্যরেখা নামের কবিতাটি। আশির দশকের শুরুর দিকে দেশ পত্রিকায় বেরিয়েছিলো। তখনো ঢাকায় জেরক্স খুব সহজলভ্য ছিলো না। মনে আছে, এই কবিতাটির অন্তত পঞ্চাশটি জেরক্স কপি বন্ধু ও পরিচিতদের মধ্যে বিতরণ করেছিলাম।

যদি সংগ্রহ করতে পারি, সচলদের জন্যে তুলে দেবো।

কে ভুলবে আনন্দমেলা-য় তাঁর ডোডো-তাতাই পালাকাহিনী? দেশ-এর পাতায় ধারাবাহিক রম্য কাণ্ডজ্ঞান, জ্ঞানগম্যি, বিদ্যাবুদ্ধি ইত্যাদি?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

ভাস্কর এর ছবি

দারিদ্র রেখা কবিতার মাধ্যমেই তারে প্রথম চিনি। অসম্ভব ভালো লাগছিলো ঐ বয়সে...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আমি গত ২০ বছরে কবিতাটি পড়িনি। তবু ধারণা করি, এখনো ভালো লাগবে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

??? এর ছবি

এইসব মৃত্যুগুলো রপ্ত করতে হবে আমাদের জীবনছন্দে!

তারাপদ রায়ের অনুমতি না নিয়েই তাঁর একটা কবিতা আমি আমার একটা সম্পাদনা গ্রন্থে (দেখা না-দেখার চোখ) অন্তর্ভূক্ত করেছিলাম। সেই মুহূর্তে অনুমতি নেয়ার সময়ও খুব ছিল না, আর তিনি ইমেইলে অ্যাভাইলেবল ছিলেন না। ঢাকায় তার এক বন্ধুকে বিষয়টি জানালে তিনি বলেন অসুবিধা নাই, পরে কখনো অনুমতি নিয়ে নেবেন! তারাপদ বাবু এতে মাইন্ড করবেন না।

কিছুদিন পর ভারতে একটা লেখক সম্মেলনে আমার যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে তারাপদ রায়ও উপস্থিত থাকবেন জেনেছিলাম। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম সেখানেই পাপক্ষালন করে ফেলব। তারপর জীবনে হঠাত্ শার্প টার্ন, সিঙ্গাপুর চলে আসতে হল। ভারতে আর যাওয়া হল না।

এইবার বোধয় হাঁটু গেঁড়ে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কোনো অপশন খোলা নেই আমার। এইরকম খেলাপি ঋণ ঘাড়ে নিয়ে "দারিদ্রসীমার নিচে" থাকাই আমার নিয়তি! ভাল থাকুন, কবি।

....................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

এইরকম খেলাপি ঋণ ঘাড়ে নিয়ে "দারিদ্রসীমার নিচে" থাকাই আমার নিয়তি!

আমাদের সবারই। আপনি একা নন।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

অন্তঃরের অন্তস্থল থেকে কবির প্রতি শ্রদ্ধা।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

সুজন চৌধুরী এর ছবি

খুব মন খারাপ হয়ে গেলো।
ওনার কাণ্ডজ্ঞান আর ক খ গ ঘ খুব প্রিয় ছিল।
কাণ্ডজ্ঞান থেকে প্রায়ই কোড করতাম।
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......

অমিত আহমেদ এর ছবি
প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

কবিকে শ্রদ্ধা।

অতিথি লেখক এর ছবি

তারাপদ রায়কে আমি প্রথমে চিনেছিলাম রম্য লেখক হিসেবে .... আমি তাতেই মুগ্ধ ছিলাম তার কবি সত্ত্বার সাথে পরিচয় তারপরে.......... এই প্রজন্মের যাওয়ার সময় হলো ; একে একে চলে যাচ্ছেন সবাই ... কিন্তু তারপর ??
আমরা কি ক্রমশঃ মেধাশূন্য হয়ে যাচ্ছি ??

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

পুরনোরা চলে যাবেন, তার জায়গায় আসবেন নতুন কোনো মেধা নতুন কিছু শোনাতে। বিগতদের জন্যে থাকে আমাদের দীর্ঘশ্বাস, আর-কখনো-পাবো-না ধরনের অনুভূতি। পৃথিবী হয়তো এইভাবেই প্রবহমান থাকে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

ঝরাপাতা এর ছবি

প্রচন্ড মর্মাহত।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

তারাপদ রায়ের কবিতা পড়ার সুযোগ হয়নি দেশত্যাগী হওয়ার পর । সংগৃহে থাকলে কিছু দিন তো জুবায়ের ভাই

-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

সংগ্রহে আছে কিছু। কিন্তু এখন দিতে মন সায় দেয় না। যে সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, এখন কবিতা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক লাগবে। টুঁটি চেপে ধরা হাতটা সরে যাক, তখন দেওয়া যাবে।

কবির মৃত্যুর সংবাদটি প্রচার না করে উপায় ছিলো না। কারণ, তিনি আর কখনো মারা যাবেন না।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

কবির মৃত্যুর সংবাদটি প্রচার না করে উপায় ছিলো না। কারণ, তিনি আর কখনো মারা যাবেন না।

কঠিন একটা ডায়ালগ দিলেন।

সৌরভ এর ছবি

খুব দুঃখ পেলাম।
তারাপদ রায়ের সাথে আমার পরিচয়, তাঁর রম্যের মাধ্যমে।
"কান্ডজ্ঞান" পড়ে কৈশোরে অনেক হেসেছি।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আর কোনো নতুন হাস্যরস নিয়ে তিনি আসবেন না।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

কনফুসিয়াস এর ছবি

তারাপদ রায়-এর সাম্প্রতিক কালের লেখাগুলো পড়তে গিয়ে ক্লান্তি চলে আসতো। খুব একটা ভক্ত ছিলাম না কখনো। তবু মন খারাপ হলো।
ওনার কোন একটা বইয়ের ভূমিকায় দেখেছিলাম, লিখেছিলেন, ' আমি যখন ইচ্ছে যত খুশি কবিতা লিখতে পারি'। এই কথাটা খুব মাথায় গেঁথে আছে, আর কাউকে এরকম বলতে শুনি নি।
-যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ধন্যবাদ, মন্তব্যের জন্যে। তাঁর লেখা সবাই সমান পছন্দ করবেন, এমন আশা করা অনুচিত। বস্তুত, সকল লেখকের ক্ষেত্রেই এই কথা চলে।

'যখন খুশি যতো ইচ্ছে কবিতা লিখতে পারি' - এরকম ঘোষণা অভিনব বটে। আমি দেখিনি। তবে তারাপদ রায়ের মতো কিঞ্চিৎ ক্ষ্যাপাটে (যদিও পেশায় ছিলেন বড়োসড়ো আমলা) মানুষের পক্ষে তা বলা অসম্ভব নয়।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অসমাপ্ত এর ছবি

"পুরনো শহরতলিতে" খুঁজতে গিয়ে এই পুরানো পোস্টটিও খুজে পেলাম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।