দারিদ্র্য রেখা : তারাপদ রায়ের সেই বিখ্যাত কবিতাটি

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: রবি, ২৬/০৮/২০০৭ - ১২:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দারিদ্র্য রেখা
তারাপদ রায়

আমি নিতান্ত গরীব ছিলাম, খুবই গরীব।
আমার ক্ষুধার অন্ন ছিল না,
আমার লজ্জা নিবারণের কাপড় ছিল না,
আমার মাথার উপরে আচ্ছাদন ছিল না।
অসীম দয়ার শরীর আপনার,
আপনি এসে আমাকে বললেন,
না, গরীব কথাটা খুব খারাপ,
ওতে মানুষের মর্যাদা হানি হয়,
তুমি আসলে দরিদ্র।

অপরিসীম দারিদ্র্যের মধ্যে আমার কষ্টের দিন,
আমার কষ্টের দিন, দিনের পর দিন আর শেষ হয় না,
আমি আরো জীর্ণ আরো ক্লিষ্ট হয়ে গেলাম।
হঠাৎ আপনি আবার এলেন, এসে বললেন,
দ্যাখো, বিবেচনা করে দেখলাম,
দরিদ্র শব্দটিও ভালো নয়, তুমি হলে নিঃস্ব।

দীর্ঘ নিঃস্বতায় আমার দিন রাত্রি,
গনগনে গরমে ধুঁকতে ধুঁকতে,
শীতের রাতের ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে,
বর্ষার জলে ভিজতে ভিজতে,
আমি নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে গেলাম।
আপনার কিন্তু ক্লান্তি নেই,
আপনি আবার এলেন, আপনি বললেন,
তোমার নিঃস্বতার কোনো মানে হয় না,
তুমি নিঃস্ব হবে কেন,
তোমাকে চিরকাল শুধু বঞ্চনা করা হয়েছে,
তুমি বঞ্চিত, তুমি চিরবঞ্চিত।

আমার বঞ্চনার অবসান নেই,
বছরের পর বছর আধপেটা খেয়ে,
উদোম আকাশের নিচে রাস্তায় শুয়ে,
কঙ্কালসার আমার বেঁচে থাকা।
কিন্তু আপনি আমাকে ভোলেননি,
এবার আপনার মুষ্টিবদ্ধ হাত,
আপনি এসে উদাত্ত কণ্ঠে ডাক দিলেন,
জাগো, জাগো সর্বহারা।

তখন আর আমার জাগবার ক্ষমতা নেই,
ক্ষুধায় অনাহারে আমি শেষ হয়ে এসেছি,
আমার বুকের পাঁজর হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে,
আপনার উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে
আমি তাল মেলাতে পারছি না।

ইতিমধ্যে আরো বহুদিন গিয়েছে,
আপনি এখন আরো বুদ্ধিমান,
আরো চৌকস হয়েছেন।
এবার আপনি একটি ব্ল্যাকবোর্ড নিয়ে এসেছেন,
সেখানে চকখড়ি দিয়ে যত্ন করে
একটা ঝকঝকে লম্বা লাইন টেনে দিয়েছেন।
এবার বড় পরিশ্রম হয়েছে আপনার,
কপালের ঘাম মুছে আমাকে বলেছেন,
এই যে রেখা দেখছো, এর নিচে,
অনেক নিচে তুমি রয়েছো।

চমৎকার!
আপনাকে ধন্যবাদ, বহু ধন্যবাদ!
আমার গরীবপনার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার দারিদ্র্যের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার নিঃস্বতার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার বঞ্চনার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আমার সর্বহারাত্বের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,
আর সবশেষে ওই ঝকঝকে লম্বা রেখাটি,
ওই উজ্জ্বল উপহারটির জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।

কিন্তু,
ক্রমশ,
আমার ক্ষুধার অন্ন এখন আরো কমে গেছে,
আমার লজ্জা নিবারণের কাপড় এখন আরো ছিঁড়ে গেছে,
আমার মাথার ওপরের আচ্ছাদন আরো সরে গেছে।
কিন্তু ধন্যবাদ,
হে প্রগাঢ় হিতৈষী, আপনাকে বহু ধন্যবাদ!


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আবার পড়লাম আর প্রচন্ড কষ্টে ব্যথিত হলাম।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

এই কবিতার বয়স কমপক্ষে ২৫ বছর। এরপর কতোদূর এগোলাম আমরা? এই কবিতা তো এখনো প্রাসঙ্গিক। কষ্ট সেখানেই।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

সৌরভ এর ছবি

এই কথাটাই বলতে চাইছিলাম।
সময় কতো পেরিয়ে গেছে, পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘোরে ডিজিটাল মোবিলিটি সম্পন্ন সব স্মার্ট মানুষ।
তারপরেও এ কবিতা যৌক্তিক থেকে গেছে পুরোপুরি।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

হাসিব এর ছবি

আচ্ছা জুবায়ের ভাই, আপনার কি মনে হয় আমাদের জেনারেশন এধরনের কবিতা লিখতে পারে ?


আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

নতুন জেনারেশন দারিদ্র্য রেখা আর হয়তো লিখবে না, কারণ তা লেখা হয়ে গেছে। তারা অন্যকিছু লিখবে। নতুন কিছু দেখাবে আমরা যা আগে দেখিনি। শুনিনি।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

দৃশা এর ছবি

বিধাতা সবাইকেই কিছু না কিছু অক্ষমতা দিয়ে পাঠায়...আমাকে কবিতা না বুঝার অক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছেন...তাও এই নির্বোধ মস্তিষ্ককেও মাঝে মাঝে কিছু কবিতা নাড়া দিয়ে যায়...যেমন দেয় এটি।।
জয় গুরু।

দৃশা

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আমাকেও আপনার দলে রাখবেন। তারাপদ রায়ের কবিতা অতি সরল বাক্যে লেখা। অথচ ভেতরের ব্যঞ্জনা ও মেসেজ ঠিক টের পাওয়া যায়।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অয়ন এর ছবি

অসহ্য কষ্টের কবিতা।

অতিথি (সনাতনপাঠক) এর ছবি

আপনার কাছে "গ্রামপতনের শব্দ" কবিতাটি থাকলে শেয়ার করবেন?

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

সনাতনপাঠক, কবিতাটি আমার কাছে নেই। দুঃখিত। খোঁজ করে দেখছি কারো কাছে আছে কি না।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

কামরুল হাসান মঞ্জুর আবৃত্তির ক্যাসেটে আবিষ্কার করি এই কবিতা। এখন আবৃত্তিযোগ্য বাংলা কবিতার সব সংকলনে এই কবিতা থাকে।

পিএটিসি-তে অর্থনীতির ক্লাশ নিতেন ড. মোহামমদ তারেক। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থসচিব (কবি মুহাম্মদ রফিকের ছোট ভাই।)। তারেক প্রতিটি ক্লাশ শেষ করতেন একটা কবিতা দিয়ে। অর্থনীতির বিষয়ের সাথে মিল রেখে একটা কবিতা। তারাপদ রায়ের কবিতাও দারিদ্র দূরীকরণের ক্লাশের শেষে ছিল। মনে আছে মোহাম্মদ তারেক যখন ক্লাশে এটা পাঠ শুরু করেন তখন আমরা কয়েকজনও তার সাথে উচ্চারণ করতে শুরু করি এবং তার উত্সাহে ক্লাশ একটা বৃন্দ আবৃত্তিতে পরিণত হয়।

কবিরা আগাম দেখতে পান। কবিরা আধুনিক কালের পয়গম্বর। তাদের কথা, শব্দমালা এতো দ্রুত প্রাচীন হয়ে যায় না।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আবৃত্তিযোগ্য অভিধাটি কার মাথায় প্রথম এসেছিলো? নিশ্চয়ই কোনো দক্ষ বিপণনকারী কেউ। খুব অশোভন লাগে আমার কাছে। তার মানে অন্য কবিতাগুলি আবৃত্তির অযোগ্য?

পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকারের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ও লেখক অশোক মিত্র তাঁর স্মৃতিকথা আপিলা চাপিলা-তে দারিদ্র্য রেখা কবিতাটিকে অর্থনীতির জরুরি পাঠ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্যে শোমচৌ।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

হিমু এর ছবি

তারাপদ রায়ের সাথে পরিচয় "একটি কুকুরের উপাখ্যান" দিয়ে। কী মর্মন্তুদ কাহিনী, একটা কুকুরের প্রতি কী অসহ মমত্ববোধ গল্পটার পাতায় পাতায়। চিলির জন্য ডুকরে কেঁদেছি তখন।

তারাপদ রায়ের "ছোটসাহেব" ... কী অসাধারণ একটা গল্প। একজন মানুষ মেঘ নিয়ে মেতে থাকে, ওদিকে ঘরে চাল বাড়ন্ত। তার খেয়াল নেই, সে মেঘদের ওপর হুকুমদারিতে ব্যস্ত। শেষমেশ একদিন কয়েকটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বাজারে সে দাঁড়িয়ে যায়। এখানে দুষ্টু মেঘ শিশুদের শিক্ষা দেয়া হয়। গোটা গল্পটা মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার গল্প, যে ভালোবাসা সব উদ্বেগ উৎকণ্ঠার কথা ভুলিয়ে দেয়।

মরা মাছি লাখ টাকা আর হাতিমারা কেরানীর গল্পের কথা বাদ দিলাম।

তারাপদ রায়কে ধন্যবাদ জানাতে পারলাম না সময়মতো।


হাঁটুপানির জলদস্যু

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

দুষ্টু শিশু মেঘদের শিক্ষা দেওয়ার কথা একজন কবি ছাড়া আর কার কল্পনায় আসবে?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

হাসান মোরশেদ এর ছবি

প্রিয় কবিতাগুলোর একটি ।
জুবায়ের ভাইকে ধন্যবাদ ।
-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

এত সুন্দর কবিতা!

...........
যত বড় হোক সে ইন্দ্রধনু দূর আকাশে আঁকা
আমি ভালবাসি মোর ধরনীর প্রজাপতির পাখা

শেখ জলিল এর ছবি

নতুন করে পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

বিপ্লব রহমান এর ছবি

প্রায় শৈশবে কবিতাটি পড়েছি। আবারো অসীম মুগ্ধতায় পড়লাম। কবিকে অনেক শ্রদ্ধা।


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ধন্যবাদ হাসান মোরশেদ, প্রকৃতিপ্রমিক, শেখ জলিল ও বিপ্লব রহমান।

এই কবিতাটি উদ্ধার করার কাহিনীটি, অর্থাৎ কীভাবে আমার হাতে এসে পৌঁছলো, জানলাম আজ। কৃতজ্ঞতা আসলে আমার প্রাপ্য নয়। সে গল্প আগামী কোনো সময়ের জন্যে তোলা থাক।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অতিথি (সনাতনপাঠক) এর ছবি

আরও কিছু তারাপদ রায় এখানে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ধন্যবাদ, সনাতন পাঠক।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

AZM Nurul Haque, BCS(Admn) এর ছবি

jholsano ruti

সুমন চৌধুরী এর ছবি

সচলায়তনে ফোনেটিক পদ্ধতিতে বাংলা টাইপ করতে Ctl+Alt+P চাপুন

অথবা ইউনিজয় ব্যবহার করে টাইপ করতে ctl+alt+u চাপুন।

ধন্যবাদ।



অজ্ঞাতবাস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।