ডেভ আর লিন্ডসে

অনিকেত এর ছবি
লিখেছেন অনিকেত (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৩/০৭/২০০৮ - ৭:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই শহরটায় আমার প্রায় ৫ বছর হতে চলল।এখানটায় সবার আগে যার সাথে আমার পরিচয়, তার নাম ডেভ।
ডেভ আমাদের ডিপার্টমেন্টের সিস্টেম এডমিনিস্ট্রাটর। সবার আগে তার সাথে পরিচিত হবার কোন কারন নেই।
কিন্তু আপনি যদি আমার মত Software Junky হন এবং ঘন ঘন নানান বিজাতীয় Software নির্মম ভাবে Install করে করে আপনার laptop এর নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছেন এবং এমন একটা স্তরে সেটা পৌছে গেছে যে কোন ভদ্র উপায়ে তাকে ঠিক পথে আনা সম্ভব নয়--- সেক্ষেত্রে আপনাকে ডেভের শরনাপন্ন হতেই হবে।

তাই এক সকালে কাঁচুমাচু মুখে তার দরজায় নক করলাম। আমার আগের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিস্টেম এডমিন বেশ শত্রু-ভাবাপন্ন ছিল। আঁশটে মুখে পৃথিবীর সবার প্রতি এক রকমের নিখাদ ঘৃনা। খোদ ডিপার্টমেন্টের চেয়ার তাকে সমঝে চলতেন। কাজেই এবারেও খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। ডেভ কে দেখে ভয় আরো চৌগুন হল। বিশালকায়-- দৈর্ঘে এবং প্রস্থে। চোখ মুখ লাল। দেখে মনে হচ্ছে, আমি মুখ খুললেই তুলে আছাড় দেবে। কোঁত করে ঢোক গিললাম। বিশাল পর্বত থেকে মিহি একটা শব্দ বেরুল।

কি চাই?

ইয়ে মানে, আসলে হয়েছে কি, ওহ সরি, আমার নাম হচ্ছে গিয়ে,.........

ঠিক আছে, তারপর?

আমার 'আসলে' একটা ল্যাপটপ আছে যেটা কোন কারনে, 'আসলে' 'বিনা কারনেই' বার বার রিবুট করছে। 'আসলে' হয়েছি কি জানো, আমি 'আসলে'----

সঙ্গে এনেছ? আমাকে অনেক 'আসলে' থেকে বাঁচিয়ে
দিয়ে ডেভের প্রশ্ন।

প্রায় লাফ দিয়ে বললাম-- নিয়ে আসব?

হ্যা, দেখি কি সমস্যা হয়েছে।

ইয়ে তুমি ব্যস্ত না তো? মানে আমি 'আসলে' তোমাকে কোন জরুরী কাজ করা থেকে বিরত রাখছি না তো?

'আসলে', না। আর এখন 'আসলে' ল্যাপ্টপ নিয়ে এলে ভালো হয়।'আসলে' কিছুক্ষন পরেই কিন্তু লাঞ্চ।

আমি আমার বিখ্যাত ' হে হে হে ' হাসি দিলাম। ডেভ কিছুক্ষন তার কম্পু'র স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, আসলেই কিন্তু কিছুক্ষন পরে লাঞ্চ।আকলমন্দ কে লিয়ে ইশারা কাফি হ্যায়।

আমি তিন লাফে তিন তলায় চলে গেলাম। ল্যাপটপটা বগল-দাবা করে চোখের নিমিশে ডেভের সামনে।

ডেভ ল্যাপটপ বুট করতে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই সেমিস্টারেই এলে নাকি?

-হে হে হে

- ইউ এস এ-তে এই প্রথম?

- 'আসলে' এসেছি বেশ আগে, মানে দুই বছর আগে। আরেক ইউনিভার্সিটিতে এম এস করছিলাম। সেটা শেষ করে এখানে পি এইচ ডি'র জন্যে আসা।

- আগের কোন ইউনিভার্সিটি?

- ইলিনয়.........

-ওহ

বেশ খানিক ক্ষনের অস্বস্তিকর নীরবতা। আমার ল্যাপ্টপ
তখনো বুট হচ্ছেন। ডেভ মনে হল আর প্রশ্ন খুঁজে পাচ্ছে না। আমিও বলার মত তেমন কিছু পাচ্ছি না। এই ধরনের অস্বস্তিকর মুহুর্তগুলোয় আমি সাধারনত ঘাড় চুলকাই।ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে দেখলাম ডেভ নাক চুলকাচ্ছে।

আমাদের এই যন্ত্রনাময় পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করল আমার ল্যাপ্টপ---- বুট হয়ে।

ঝড়ের বেগে ল্যাপ্টপের কি-বোর্ডে আঙ্গুল চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করল, করেছ কি তুমি? এইটার তো দেখছি মরনদশা।

-হে হে হে

সেই আলাপের শুরু। দেখা গেল,ডেভ ও আমার মত software junky। আমি নুতুন কোনো softwareএর খবর পেলে তাকে জানাই। সেও তাই।Software টা আসলে কোন কাজে লাগবে কিনা, সেইটা পরের কথা। আমি দেশ থেকে ফেরার সময় ঝুড়ি ভর্তি software নিয়ে আসতাম। ডেভ চোখ গোল গোল করে জিজ্ঞেস করত, এই এত্ত গুলো জিনিস তুমি কিনেছ ৫০ ডলারে?? বল কি?

-হে হে হে

ডেভ কে দেখলে বোঝা যায়, যদি সে কোনদিন আমেরিকার বাইরে কোথাও পা ফেলে, সেটা বাংলাদেশ হবার সমূহ সম্ভাবনা।

গ্রীষ্ম-কালীন সময়, হচ্ছে আমাদের এখানে চোখ কান বন্ধ করে রিসার্চের সময়।এই সময় আমরা খুব বেশি করে যাদের দেখা পাই, তারা হয় আমাদের সুপার ভাইসার, নয় জ্যানিটর। সকালে একবার দেখা হয় নিজের সাথে, দাঁত মাজতে মাজতে। কিন্তু ডেভের ব্যাপার আলাদা। সবসময়ই কোন না কোন ল্যাবে কম্পু বাবাজীরা ঝামেলা করছেন। কাজেই সে এক ল্যাব হতে আরেক ল্যাব ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক ফাকে আমার ল্যাব ও ঘুরে যায়। এক বার এসে বসলে ওঠানো মুস্কিল। এদিকে আমার হয়ত খুবই জরুরী কিছু কাজ আটকে রয়েছে। কোন কোন দিন তার দুই ছেলে মেয়ে চলে আসে তাদের বাবার সাথে। ডেভ তাদের দুই কম্পিউটারে বসিয়ে দেয় গেম খেলতে। বাচ্চা গুলো ও দেখলাম বেজায় শান্ত। মাঝে মাঝে করিডর ধরে বিনা কারনেই ছুট লাগানো ছাড়া তাদের আর কোন বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে দেখিনি। সারা দিন বাবার সাথে থেকে, সন্ধ্যে বেলায় বাবার হাত ধরে ছেলে মেয়ে দুটো এমন গল্প করতে করতে বাড়ি যেত, যে মনে হত বহুদিন পর তারা বাবার দেখা পেয়েছে।

যাই হোক, পাঁচ বছর পরের কথা।

গত সপ্তাহে আমাদের সবার মেইল বক্সে দেখা গেল এক নোটিস রাখা। সাধারনতঃ কেউ মারা গেলে, কারো নুতুন বাচ্চা হলে অথবা নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী কেউ সেমিনার দিতে আসলে এই রকম গন নোটিস দেয়া হয়।

সেই রকম একটা কিছু হবে ভেবে নিয়ে পড়তে গিয়ে আমার চক্ষু চড়ক গাছ। নোটিস এসেছে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারের কাছ থেকে। অত্যন্ত আঁট সাট ভাষায় সেখানে যা লেখা তা হল, সামনের মাস থেকে ডেভ আর আমাদের মাঝে থাকছে না। তার বদলে সেখানে আসছে লিন্ডসে। মুস্কিল হল, ডেভ আর লিন্ডসে---দুই জনই একই মানুষ, কেবল ভিন্ন লিঙ্গের।
বোধ করি মিনিট পাঁচেক আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একজন এসে বলল, তুমি এক কাজ কর। একটু বস কোথাও গিয়ে। মনে হচ্ছে তুমি আসলে বেশ আশ্চর্য হয়েছ। তুমি কি কিছুই টের পাওনি।

আমি আমতা আমতা করে বললাম টের পাব কি করে? খালি দেখেছি ইদানিং গোলাপি রঙের টিশার্ট পরে ঘুরতে। সাথে লম্বা চুল। আমি আরো তার সামনেই খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলেছি, কি বস, বাসায় কি লন্ড্রি সমস্যা নাকি যে বউ এর টি শার্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছ? আর চুল যে দেখি কাটছই না। বেনী ফেনী বাঁধবে মনে হচ্ছে, হে হে হে .........

মনে হল আমি M Night Shamalyan এর কোন আধি ভৌতিক ছবির শেষ দৃশ্য দেখছি। এত ক্ষন ছবিতে যে সকল ক্লু ধরতে পারিনি, সে সব কিছুই এখন এক সাথে ডাল পালা মেলে ধরেছে। আর মনে হচ্ছে যাকে খুনি বলে সন্দেহ করে ছিলাম সে আসলে, খুনি নয়, খুনি তার বউ!!!

একরাশ দ্বিধা দ্বন্দ সাথে নিয়ে আমি আমার অফিসে ফিরলাম। সারাটা দিন চারিদিকে কেবল গুজ গুজ। ফিসফাস। কখনো চাপা গলায় হাসি। কখনো কারো কারো হৃদয়হীন মন্তব্য ('ব্যাটা আর ইয়ে করার টাইম পেলো না, সার্ভার ডাউন হয়ে আছে কিন্তু এই অস্বস্তির মাঝে কি করে তার কাছে যাই)।

সপ্তাহ শেষে আমাদের ডিপার্টমেন্টের সব চাইতে আলোচিত ব্যাক্তি ডেভ/লিন্ডসে (লিন্ডসে নাম নাকি ডেভের নিজের পছন্দ করা এবং সে সকলকে এই নামে তাকে ডাকার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে)।

আমার সবচেয়ে অবাক লাগল একটা বিষয়। ডেভ/লিন্ডসে যত না আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে, তার চেয়ে বেশি অস্বস্তিতে ফেলেছে-----আমার নিজের অস্বস্তি। আমি নিজেকে বেশ খোলা মনে মানুষ বলেই জানতাম (কারো কারো প্রবল দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও)। সেই আমি দেখা গেল এই ব্যাপারটা নিয়ে মোটেও স্বস্তিতে নেই।

অস্বস্তি অনেক গুলো। তার মাঝে প্রথম পাঁচটা হবে এই রকমঃ

---- ডেভের এই লিঙ্গান্তর আমাদের মাঝের যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সেটার উপরে কি ছাপ ফেলবে? সে কি সহজ হতে পারবে আমার সামনে? আমি কি পারব?

---- এক সপ্তাহ পরেই তার ছেলেমেয়ের স্কুল ছুটি। তাদের মনে না জানি কি হচ্ছে।তারা ব্যাপারটা কিভাবে নিচ্ছে? এতদিন বাবা-মা ছিল। এখন কি তাদের 'দুই মা'?

---- ডেভের চাকরি কি রইবে?

---- ডেভ আসলে কি ? তার সন্তান আছে। একটা পরিবার আছে। বয়েস কম করেও ৪৫। এত দিন পরে হঠাৎ করে কি ভাবে এইটা ঘটল?সে কি পুরুষ শরীরে নারী নাকি উল্টোটা?

----- এখন আমার ল্যাপ্টপ বিগড়ে গেলে আর তো ডেভ কে পাবো না। লিন্ডসে কি ডেভের মতই ভালো হবে?

যত যাই বলি না কেন, আমার মাথা থেকে তার বাচ্চা দুটোর মুখ কিছুতেই সরছিল না। তারা কেমন আছে? কি ভাবে নিচ্ছে এই গোটা ব্যাপারটা। আমাদের অস্বস্তিতে কি আসে যায়। এমনকি ডেভও হয়ত কিছু দিন পরে সব কিছুর সাথে মানিয়ে নেবে। কিন্তু এই দুটো ছোট্ট মানবকের মনে যে অনপনেয় ছাপ পড়ল, সেইটা কি আর মুছবে?

টানা দু'দিন নিজের সাথে যুদ্ধ করে শেষে অস্বস্তি কে হার মানালাম। ডেভের দরজায় নক করলাম। দেখলাম ভেতরে বসে আছে লিন্ডসে। পাশেই তার ছেলেটা কম্পিউটার নিয়ে খেলছে। লিন্ডসে এখনো তার গোলাপী টি শার্টটা পরে আছে। এখন বরং সেটাতে তাকে খুব একটা খারাপ দেখাচ্ছে না। দেখলাম পোশাকের সাথে মানিয়ে হাতের আঙ্গুলগুলোও গোলাপী নেল পোলিশে ঢাকা।

কিছুক্ষন কারো মুখেই কথা নেই। শেষ মেষ নীরবতা ভাঙ্গলাম আমি।

--- আমি আসলে আরো আগেই আসব ভাবছিলাম। কিন্তু...কিন্তু...যাই হোক আমি শুধু তোমাকে একটা ছোট্ট কথা জানাতে এলাম। তুমি কি কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ, সেইটার পরিমাপ করার ধৃষ্টতা আমার নেই। আমি শুধু তোমাকে জানাতে এলাম, আমি কিন্তু তোমার সেই বন্ধুই আছি। আমার সম্পুর্ন সাপোর্ট তুমি আশা করতে পার। আসলে যত যাই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত আমাদের জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপুর্ন বিষয় হল যে জীবনটা আমি যাপন করছি সেটাতে কি আমি সুখী? আমি কি এই জীবনে আমার আমি কে দেখতে পাই? আমি খুশি এই জন্য যে যত ভয়াবহই হোক না কেন, তুমি অসম সাহসিক এক সিদ্ধান্ত নিয়েছ।

একটানে কথা গুলো বলে যখন চলে আসছি তখন দেখলাম লিন্ডসের চোখে চিকচিক করছে জল। আর ডেভ হাসি মুখে বলছে, Thank you, thank you so much....!!!!!


মন্তব্য

তানভীর এর ছবি

শুরুতে মজাই পাচ্ছিলাম, শেষে এসে মন খারাপ হয়ে গেল। পড়তে পড়তে ধাক্কাটা আমিও খেলাম! লেখাটা 'আসলে' ভালো লিখেছেন।

= = = = = = = = = = =
ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত
আমরা আনিব রাঙ্গা প্রভাত
আমরা ঘুচাব তিমির রাত
বাধার বিন্ধ্যাচল।

অনিকেত এর ছবি

ধন্যবাদ তানভীর।

মুশফিকা মুমু এর ছবি

আমিও তো আপনার ডিসকাভারি শুনে প্রথমে বুঝতে পারিনি, দ্বিতীয়বার পড়ার পর বুঝতে পারলাম গড়াগড়ি দিয়া হাসি
শেষের দিকে এসে আসলেই খারাপ লাগল
আমারও এমন একটা ঘটনা ঘটে ৪-৫বছর আগে। আমার সাথে কাজ করত একটা টার্কিশ মেয়ে, মুসলিম। আমরা বেশ ভালোই বন্ধু ছিলাম, অনেক মজা করতাম, টিকল করা বা পাশে হেটে গেলে গুতা দেয়া, মানে সাধারনত মেয়ে বন্ধুরা যেমন হয় আরকি। যাইহোক ওর সাথে ২-৩ বছর কাজ করার পর একদিন হঠাত বলল ও লেসবিয়েন। আমি বেপারটা কিভাবে নেই তার জন্য এতদিন আমাকে বলেনি। আমি প্রথমে ভাবলাম আমার সাথে জোক করছে কিন্তু পরে দেখি যে না সত্যি। ইয়ে, মানে... শুনে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি বলব। কয়েকবার "কিন্তু কেন?" বলার পর যখন বুঝলাম এই প্রশ্নের উত্তর নেই তখন চুপ হয়ে গেলাম।
তারপরে যা হয় তা হল ওর সাথে মজা করা কেন জানি একটু কমে যায় আমার সাইড থেকে, মানে আমি আগের মত হতে পারিনা কিন্তু যথাসাদ্ধ চেষ্টা করি ওকে বুঝতে না দিতে। ও এসে কখনও খোঁচা দিলে বা হাগ করলে বা টিকল করলে কেমন জানি লাগত, মনেহত কোন ছেলে কাছে আসছে, জানি বেপারটা পুরা আমার মেন্টাল কিন্তু তবুও আমি আগের মত নির্মল আনন্দ করতে পারতাম না, করলেও আমার অসস্থিটা লুকাতাম জানিনা ও বুঝতে পারত কিনা। মন খারাপ
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

অনিকেত এর ছবি

আসলেই.........আশ্চর্য!

আমি পরে অনেক ভেবেছি। আমার মনে হয়, যাকে আমরা বন্ধু বলে কাছে টেনে নিই, তাকে অজান্তেই আমাদের নিজের শর্তে গ্রহন করি। আমার ছেলে-বন্ধুদের সাথে আমার যে আচরন, সেটা আমি আমার মেয়ে বন্ধুদের সাথে একই মাত্রায় ব্যবহার করতে পারিনা। সমস্ত কিছুর পরেও, কেউ আমাদের 'ছেলে' বন্ধু, আর কেউ আমাদের 'মেয়ে' বন্ধু। আমরা সযত্নে আলাদা একটা দাগ দিয়ে রাখি এই দুই বাড়ির সীমানায়। কারো দাগ হয়ত গাঢ়, কারোরটা হালকা। কিন্তু দাগ কিন্তু রয়েছেই। আমরা হয়ত একে অন্যের খুব ভালো বন্ধু হতে পারি, কিন্তু আমার খুব 'জিগরী' ছেলে দোস্তদের সাথে মেয়ে বন্ধুদের শেষ পর্যন্ত একটা তফাত রয়েই যায়। কাজ থেকে বাড়ি ফিরতে রাত হলে অথবা আড্ডা শেষ হতে হতে রাত ভোর হয়ে উঠলে, আমি বিনা অস্বস্তিতে আমার দোস্তদের সাথে রাত কাটিয়ে পরের দিন ঘরে ফিরব। কিন্তু মেয়ে বন্ধু যত আপনই হোক না কেন এবং তার প্রতি সর্বপ্রকারের আকর্ষন মুক্ত হয়েও একা তার বাড়িতে রাত কাটাতে আমার সঙ্কোচ হবে। সংশয়টা যত না আমার দিক থেকে, তারচেয়ে বেশি হয়ত তার দিক থেকে হবে। কাজেই আড্ডা-ফাড্ডা দিয়ে যত রাতই হোক, মেয়ে বন্ধু'র বাড়ি থেকে রাতে বাড়ি ফিরতেই হবে।

মোদ্দা কথা, প্রকৃতি আমাদের নিয়ে বড় নিষ্ঠুর একটা খেলা খেলেছে। নিজের মা-বাবা-ভাই-বোনদের পর সবচাইতে আপন যে হতে পারত----আমার বন্ধু, প্রকৃতি তার কপালে একটা 'হুরমতীর পোড়া দাগ' দিয়েছে----যৌনচিহ্ন। কাছে যেতে যেতেও এক সময় থমকে দাঁড়াতে হয়।

আপনার আসলে কি মনে হয়েছে জানি না, আমি যা অনুভব করেছি, সেইটা খানিকটা এই রকমই। ডেভের ব্যাপারটাতে আমার মুল অস্বস্তির কারন হয়ত ডেভের লিন্ডসে হওয়া নিয়ে নয়---বরং তার সাথে সম্পর্কের ছাঁচটা আমাকে পালটে নিতে হবে, এই ভয়টাই হয়ত মুখ্য।

আমি জানিনা এইটা আমার একে বারে নিজস্ব কোন সীমাবদ্ধতা কি না।

এ বিষয়ে আপনাদের সকলের একটা বক্তব্য পেলে খুব উপকার হত।

রেনেট এর ছবি

চমতকার লাগল লেখাটি।
-----------------------------------------------------
We cannot change the cards we are dealt, just how we play the hand.

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

অনিকেত এর ছবি

রেনেট, ধন্যবাদ।

আপনার একটা বিষদ মন্তব্য আশা করছি।

দ্রোহী এর ছবি
অনিন্দিতা এর ছবি

প্রকৃতি আমাদের নিয়ে বড় নিষ্ঠুর একটা খেলা খেলেছে। নিজের মা-বাবা-ভাই-বোনদের পর সবচাইতে আপন যে হতে পারত----আমার বন্ধু, প্রকৃতি তার কপালে একটা 'হুরমতীর পোড়া দাগ' দিয়েছে----যৌনচিহ্ন। কাছে যেতে যেতেও এক সময় থমকে দাঁড়াতে হয়।

আমাদের সংকোচ, সীমাবদ্ধতার জন্য সামাজিক কারণ ই দায়ী।

আলমগীর এর ছবি

ব্যপারটা আসলেই অদ্ভুত এবং যথার্থই বিব্রতকর। আমাদের এক টেকনিশিয়ান গে, আর একজন হাফ-গোথিক।

হিমু এর ছবি

অনেকদিন পর হলেও খুব চমৎকার একটা লেখা পেলাম আপনার কাছ থেকে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

অনিকেত এর ছবি

ধন্যবাদ হিমু।

খানিকটা মন খারাপ হল অবশ্য। আমার বাকী লেখা গুলো মনে হচ্ছে আপনার ভাল লাগে নাই।

হা হতোস্মি...............

হিমু এর ছবি

আমারই বোঝানোর ভুল। বলতে চেয়েছিলাম দীর্ঘ বিরতির পর। ব্যাপারটা এখন এমন শোনাচ্ছে, "অবশেষে একটা ভালো পোস্ট দিতে পাল্লেন তবে!" হো হো হো

না রে ভাই, আপনার সব পোস্টই মনোযোগ দিয়ে পড়ি। সবসময় মন্তব্য করার মতো বক্তব্য থাকে না, কিংবা সিম্পলি ক্লান্ত থাকি অনেক। তাই চুপচাপ রেট করে চলে যাই।


হাঁটুপানির জলদস্যু

অনিকেত এর ছবি

হা হা হা .........

(যাক স্বস্তি পাওয়া গেল খানিকটা......)

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ঘটনা ও বিষয় নিয়ে আপনার অস্বস্তিটা অনুমান করতে পারি, যদিও মাত্রা হয়তো এক নয়। আমার পড়তে অস্বস্তি হচ্ছিলো, স্বীকার না করে উপায় নেই।

লেখাটা খুবই সংবেদনশীল। অনেক ভাবনা উস্কে দেয়।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অনিকেত এর ছবি

ধন্যবাদ জুবায়ের ভাই।

স্নিগ্ধা এর ছবি

অনিকেত - চমৎকার পোস্ট! পড়তে পড়তে আপনার জায়গায় নিজেকে চিন্তা করছিলাম, এবং বুঝতে পারছিলাম যে আমারও বন্ধুতার ধরনটা এরপর কোনদিকে যাবে সেটাই হতো সবচাইতে বড় চিন্তা। কিন্তু, একইসাথে আবিস্কার করলাম আমি এখনও অনেক, ইংরেজীতে যাকে বলে naive, কারণ দেখলাম অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে কিভাবে ঐ বন্ধুর হয়ে লোকজনের সঙ্গে ঝগড়া করবো আর কি করলে তার এই যাত্রা যথাসম্ভব সহনীয় হয়, সেটা নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে লাগলাম সবচাইতে বেশী! যদিও, ব্যক্তিগতভাবে একজন ট্র্যান্সজেন্ডারডের সাথে পরিচয় থাকলেও পরিচয় হবার পরে আমার কোন বন্ধু এরকম রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যায় নি, তাও আমি 'কিরূপে তাহার হইয়া মারপিট করিতাম' সেটা নিয়ে বেশী দুশ্চিন্তিত হয়ে পড়লাম হাসি

জাহিদ হোসেন এর ছবি

লেখাটি ভারী ভাল লাগলো। আজকাল এই জাতীয় ঘটনা আকসার টিভিতে দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবে তা দেখাটা সত্যিই এক্সেপশনাল।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

অনিকেত এর ছবি

ধন্যবাদ জাহিদ।

আমি ভেবে দেখেছি যে টেলিভিশনে নানান জিনিস দেখতে দেখতে যখন আমার মনে হয় আমি অনুভুতিহীন এক জড় পদার্থে পরিনত হয়েছি, ঠিক তখনি হয়ত এমন কিছু ঘটে যা আমার সমস্ত জানার জানালাটা ধরে ঝাঁকি দিয়ে যায়। তখন মনে হয়, যে আসলেই কত দুর্বল আমি।

অতিথি লেখক এর ছবি

আজব পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন ভাই! যাই হোক, লিঙ্গান্তর নিয়ে আরো জানার আগ্রহ বোধ করছি। দেখি নেট এ ঘাঁটাঘাঁটি করে কি পাওয়া যায়...

~ ফেরারী ফেরদৌস

রানা মেহের এর ছবি

অপূর্ব লেখা অনিকেত।

আমি চিনি একজনকে।
মেয়ে থেকে ছেলেতে রুপান্তর হওয়া।

সে অতি বিরক্তিকর মানুষ।
খুব একগুয়ে একনায়ক।
তার নিন্দা করার অনেক রকম পদ্ধতি খোলা আছে।
অনেকগুলো গালি দেয়া যায় তাকে।

তবু কেন যেন তাকে গালি দিতে গেলে
তার সেক্সট্রানসেকশনটাই ঘুরিয়েফিরিয়ে ব্যাবহার করা হয় শুধু।
খুব বাজে লাগে। কষ্ট লাগে
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অনিকেত এর ছবি

ধন্যবাদ রানা, আপনার সহৃদয় মন্তব্যের জন্য। আর সাথে যে কথাটা বলেছেন, সেইটা আসলেই কষ্টের। প্রানী হিসেবে আমরা আসলে বেশ নিষ্ঠুর। আমরা খুঁজে পেতে সবচাইতে দুর্বল জায়গা গুলোতেই আঘাত করি।

সাইফ এর ছবি

জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপুর্ন বিষয় হল যে জীবনটা আমি যাপন করছি সেটাতে কি আমি সুখী?

একমত @ অনিকেতদা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।