থেরাপি

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি
লিখেছেন অনার্য সঙ্গীত (তারিখ: সোম, ০৬/১২/২০১০ - ১২:৫৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জিন থেরাপির নাড়িনক্ষত্র আরেকবার ঝালাই করে নেয়ার জন্য ড. ইকবাল স্যারের পুরোনো লেকচারগুলো আমি ঘাঁটতে শুরু করি অনেক দিন পর।

স্যারের লেকচারের গুণেই আমাদের কাছে একেবারে পানির মতো স্পষ্ট ছিল জিন থেরাপির ব্যাপারটা। অনেকদিন পর বলে আরেকবার মনে করে নিতে চাই সব। প্রাণির সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় তার জিন দিয়ে। প্রাণীর জন্য এ এক অলঙ্ঘনীয় নীতিমালা। জিনের ভেতর লেখা থাকে কখন মানুষের খিদে পাবে। অথবা কখন কেউ ভয় পেয়ে আঁৎকে উঠবে। এমনকি কতখানি ভয় পাবে তা-ও। জিন থেরাপির ব্যাপারটা এই বাস্তবতা থেকেই আসে। কোষের ভেতর থাকা জিনের নীতিমালায় কোন ভুল ভ্রান্তি থাকলে তার প্রভাব পড়ে শরীরে। যেমনটা হয় ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে। শরীরের আর সবকিছুর মতো রক্তে চিনির মাত্রারও একটা পরিমিতি আছে। রক্তে চিনির মাত্রা বেড়ে যাওয়া বিপজ্জনক। রক্তে চিনির পরিমাণকে তাই সবসময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। এই কাজটি করে ইনসুলিন। আর এটা বানায় কোষের একটা নির্দিষ্ট জিন। সেই জিনটাতে যদি কোন গন্ডগোল হয়ে যায় তাহলে প্রয়োজনিয় ইনসুলিন তৈরি হয়না শরীরে। রক্তে চিনির মাত্রাও নিয়ন্ত্রিত থাকে না। দেখা দেয় ডায়াবেটিক। এরকম ক্ষেত্রে জিন থেরাপি খুব কাজে দেয়।

ভাইরাস নামক যে অকোষীয় কণাগুলো একই সঙ্গে প্রাণি আর জড়পদার্থের গুণাবলী প্রকাশ করে তাদের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। এরা নিজের জিনকে অন্য প্রাণির জিনের সঙ্গে জুড়ে দিতে পারে। জিন থেরাপিতে তাই ভাইরাসকে ব্যবহার করা হয়। একটা ভাইরাসকে ধরে তার জিনে প্রয়োজনিয় পরিবর্তন আনা হয়। যেমন ডায়াবেটিকের ক্ষেত্রে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয় ইনসুলিন তৈরি করার জিন। এরপর সেই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটানো হয় রোগীর শরীরে। ভাইরাসটা তখন সেই ইনসুলিন তৈরির অংশ সহ তার জিন জুড়ে দেয় রোগীর জিনের সঙ্গে। রোগী পেয়ে যায় একেবারে নতুন একপ্রস্থ ইনসুলিনের জিন। তখন আর ইনসুলিন তৈরিতে তার আর সমস্যা হয়না। তার রক্তে চিনির মাত্রাও চলে আসে নিয়ন্ত্রণে।

জিন থেরাপির বিজ্ঞান এই ক'বছর আগেও একেবারে শৈশবে ছিল। হাত ধরে এই বিজ্ঞানকে পূর্ণতা দিয়েছেন ড. ইকবাল। তার ছাত্র হয়ে আমার গর্বটা তাই মাঝে মধ্যে মাত্রা ছাড়ায়। যেমন মাত্রা ছাড়ায় ৭১' এর জয়ের কথা ভাবলে।

আজকে আমি যেটা করতে যাচ্ছি সেটা কার কাছে কতটুকু সমর্থনযোগ্য মনে হবে তা জানিনা। আর তাছাড়া আমি কতটুকু সফল হব তা-ও জানিনা। ব্যর্থ হবার সম্ভাবনাটাই বেশি। তারপরও আমি সবটুকু চেষ্টা করছি। কেন জানি আমার মধ্যে ছেলেমানুষি একটা উত্তেজনা ভর করে আছে। হৃৎপিণ্ড এত বেশি ধুকপুক করছে যে তাতে আমার কাজেরই সমস্যা হচ্ছে। মানুষের শরীরবিদ্যায় আমার জ্ঞান একেবারেই নেই পর্যায়ের। এ পেপার ও পেপার ঘেঁটে যতটুকু পারাযায় জানার চেষ্টা করছি। তাতে খুব একটা লাভ হচ্ছে বলে মনে হয়না। আমার ভরসা কেবল জিন ব্যাঙ্ক আর জিন বানানোর কোম্পানিগুলোর উপর। কোনমতে অর্ধেকটা বোঝাতে পারলেই এরা কাছাকছি একটা সমাধান দিতে পারে। অবশ্য সেটা তাদের পণ্য বিক্রির স্বার্থেই করে এরা।

অনেক ঘেঁটেঘুঁটে শেষপর্যন্ত আমি খুঁজে বের করলাম কিছু জিনিস। তীব্র যন্ত্রণার অনুভুতি দেয় এরকম একটা নিউরোট্রান্সমিটার পাওয়া খুব কঠিন হলোনা। নিউরোট্রান্সমিটার হচ্ছে এমনকিছু উপাদান যেটা স্নায়ুর মধ্য দিয়ে অনুভুতির সংকেত বয়ে বেড়ায়। মানব জিনোম প্রজেক্টের তথ্যভান্ডার ঘেঁটে বের করলাম আমার নিউরোট্রান্সমিটারের জন্য প্রয়োজনিয় জিনটাকে। তারপর অনলাইনে একটা কোম্পানিকে অর্ডার দিয়ে সেই জিনটাকে বানিয়ে আনতে বললাম। একেবারে প্রস্তুত অবস্থায় সবকিছু চাচ্ছিলাম আমি। তাই বহুল ব্যবহৃত রোটাভাইরাসের মধ্যে আমার সেই জিনটাকে ঢুকিয়ে কাজের উপযোগী করে নিতে হল। সেটা অবশ্য খুব একটা সমস্যা না। জিন থেরাপিতে পড়াশোনা ছিলো আমার। সেই পড়াশুনা খুব সাহায্য করল। সমস্যাটা হল অন্য জায়গায়। একটা জিন সবসময় কাজ করে না। কাজ করে শুধু যখন তার প্রয়োজন তখন। সেই হিসেবে আমার বেছে নেয়া জিন'টার কোন প্রয়োজন নেই মানুষের শরীরে। এই সমস্যা থেকে বাঁচতে আমাকে কিছু কাজ করতে হলো। রক্তে চিনির মাত্রা ঠিক করে যে জিনটা সেটা প্রায় সবসময়ই কাজ করতে থাকে। যেসব কারণে সেই জিনটা কাজ করে সেটা বের করে আমি আমার প্রয়োজনিয় জিনটাকে সেই মত সাজালাম। এরফলে আমার জিনটা মানুষের শরীরে সবসময়ই কাজ করবে।

সবকিছু গুছিয়ে নিতে আমার বেশ সময় লাগলো। অবশ্য নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শেষ করতে পারলাম কাজ। আগে থেকেই খোঁজ নিয়ে জেনেছি আমার হাতে সময় আছে মাসখানেক। সব কাজ শেষ করে ১৯ দিন পর যখন ক্লিনিকে যাচ্ছি তখন আমি অনেকটা বিপর্যস্ত। কিছুটা ঘোরের মধ্য আছি। আমাদের ল্যাব থেকে ক্লিনিকটা খুব দূরে নয়। মেডিকেল মাইক্রোবায়োলজির উপর কাজ করছি বলে সেখানে আমার প্রায়শই যেতে হয়। আমাদের ল্যাবের সঙ্গে এই ক্লিনিকটির দীর্ঘদিনের যোগাযোগ। সেটা কাজের সূত্রেই। আমরা ওদের রোগীদের নিয়ে অনেক গবেষণা করেছি। সেই সূত্রে ক্লিনিকের অনেকেই আমাকে চেনে। কাজের তাগিদে ঘুরছি এরকম একটা ভাব করে তাই ক্লিনিকের যে কোন জায়গায় যেতে পারি আমি। ভালোমন্দ ছাড়া অন্যকিছু জানতে চায়না কেউ। আজকেও আমি সেরকম একটা ভাব নিয়েই হাঁটতে থাকলাম। খুঁজতে থাকলাম তিন সপ্তাহ আগে দেখা নিজামী মইত্যার কেবিনটা।

নিজামী মইত্যা বাংলাদেশের একজন খুব বড় রাজনীতিবিদ। মন্ত্রীসভায় পর্যন্ত ছিলেন। ইদানিং তার ডায়াবেটিকটা বেড়েছে। দেশ থেকে এই ক্লিনিকে তিনি এসেছেন জিন থেরাপি নিতে। বেশ বড় একটা কেবিনে আছেন তিনি। তার কেবিনের একপাশের অংশ ল্যাবের মতো। জিন থেরাপির ব্যপারটা সহজ নয়। সেজন্যই এই আয়োজন। আমি যখন তার কেবিনে ঢুকলাম তখন তিনি ঘুমাচ্ছেন। তাঁর চেহারাটা নুরানী। ঘরটা যেন আলো করে রেখেছে। নার্স ছিল রুমে। আমি তাকে আইডি দেখিয়ে জানালাম রোগী আমার দেশের মানুষ। সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা তাই দেখতে এসেছি। কিছুক্ষণ থাকবো এখানে। সে চাইলে এককাপ কফি খেয়ে আসতে পারে এই ফাঁকে।

পরের কাজ খুব একটা কঠিন ছিলনা। নিজামী মইত্যার জিন থেরাপির ভাইরাসের সঙ্গে আমার আনা ভাইরাসটিকে মিশিয়ে দেয়া দু'মিনিটের কাজ। আমি চলেই আসতাম তখন, তবে নার্স বাইরে ছিল। আমাকে অপেক্ষা করতে হলো। আর সেই সময়ের মধ্যে দেখলাম মইত্যা সাহেবও চোখ মেললেন। আমি বাংলায় বললাম, কেমন আছেন? উনি বললেন, আল্লাকি শুকর। আমি বললাম আমি এখানেই কাজ করি। আপনার জিন থেরাপি তো পরশু থেকে শুরু না? উনি বললেন, হুম। আমি কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, আচ্ছা একটা ব্যপার খুব জানতে ইচ্ছা করছিলো যদি কিছু মনে না করেন। উনি প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি বললাম দশ বছর আগে তো আপনাকে যুদ্ধাপরাধী বলে খুব শক্তভাবে বিচারের আয়োজন চলছিলো, সেটা কিভাবে সব উল্টে গেল বলেন তো? উনি কোন কথা বললেন না। কলিং বেলের সুইচটা চেপে ধরলেন। আধা মিনিটের মাথায় আমাকে তার ঘর থেকে বের হয়ে আসতে হলো। নিজামী মইত্যা সাহেব কেন আমার উপর ক্ষেপে উঠেছিলেন সেটা ক্লিনিকের লোকজনকে বোঝাতে অবশ্য আমার দুঘণ্টা লেগেছিল। আগে থেকে চেনাজানা ছিল বলে রক্ষা।

পুনশ্চ: আমাদের ল্যাবেও নিজামী মইত্যার জিনোম এসেছে। সারা পৃথিবীর কয়েক জায়গায় তার জিনোম নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। এরকম ব্যপার আগে কখনো দেখা যায়নি। তাঁর রক্তে নাকি অত্যাধিক মাত্রায় এমনকিছু প্রোটিন তৈরি হয় যেগুলো তীব্র যন্ত্রণার অনুভূতি সৃষ্টি করে। তিনি আছেন আমেরিকার একটা হাসপাতালে। শুনেছি তাকে সবসময় অজ্ঞান করে রাখতে হয়। জ্ঞান ফিরলেই তিনি তীব্র যন্ত্রনায় চিৎকার করতে থাকেন...

[গল্পটিতে সায়েন্সের চাইতে ফিকশনের মাত্রা অনেক বেশি। যদিও এখানে সায়েন্সের সব তথ্য যতদূর সম্ভব অবিকৃত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তারপরও এসব তথ্যকে আনকোরা বিজ্ঞান বলে গ্রহণ না করার জন্য অনুরোধ রইল। জিন থেরাপি এখনো তার শৈশব পেরোয়নি। এই বিজ্ঞানের অনেক কিছুই তাই ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হচ্ছে।]


মন্তব্য

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

ওহে, সায়েন্সটা তো সেরিল্যাকের মতো হলোরে, বুজসি দেঁতো হাসি
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

রনি।

অতিথি লেখক এর ছবি

সায়ন্সের অংশটুকু ভালই ছিল। শেষের দিকটুকু ঠিক .....মেলাতে পারিনি। শুরুতে অনেক ব্যাখ্যা, শেষে যেন আরো বলার বাকী ছিল কিংবা অত বেশী ব্যাখ্যার হয়তো প্রয়োজন ছিল না। তাই মজাটা খুঁজে নিতে হয়েছে। আমার এমনই লেগেছে।

আশা করি আপনার শরীর মন দুটোই ভাল ।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

এইটা ভাল্লাগসে। কিন্তু 'অন্ন'টা আরো বেশি ভাল্লাগসিল।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

দিগন্ত বাহার [অতিথি] এর ছবি

লেখাটি আরেকটু গোছানো হলে ভালো হতো। হাসি

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

কনফুসিয়াস ভাইয়ের 'শব্দশিল্পী' গল্পটার মতন লাগলো মাঝামাঝি জায়গায়...

কিছু সায়েন্স সম্পর্কিত শব্দ ঢুকায়ে দিলেই গল্পটার 'ফিকশন-ফিকশন' ভাবটা কমে যাবে মনে হয়। মইত্যার জিনের বর্ণনা পরের গল্পটায় দিয়ে দিয়েন।

_________________________________________

সেরিওজা

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্প বলার চেয়ে বইয়ের কথা বেশী। কিছু বিভ্রান্তি চোখে পড়েছে।

উদ্ধৃতি
"এই কাজটি করে ইনসুলিন। একটা প্রোটিন। আরো স্পষ্ট করে বললে, একটা এনজাইম।"
ইনসুলিন এনজাইম নয়, এটি এক ধরণের হরমোন।

আপনি মঈত্যাকে কী করলেন তা কিন্তু বললেন না!
আর একটা কথা, বানানের দিকে খেয়াল রাখবেন।

লেখা চলুক।

কামরুল হাসান রাঙা

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

হরমোনের সঙ্গে এনজাইমকে গুলিয়ে ফেলার কাজটা কিভাবে করলাম বুঝতে পারছিনা! অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য দুঃখিত। আমি এটি ঠিক করে দেয়ার জন্য মডু'কে অনুরোধ করব।
____________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

কৌস্তুভ এর ছবি

বিজ্ঞান অংশটা আরেকটু জমত, তবে প্লটটা ভালৈসে।

অতিথি লেখক এর ছবি

দাদা, ভালোই লাগলো। অনেক দিন পরে আপনার লেখা পড়লাম। চলুক।।।
সাকিব জাওহার ব্রত

সচল জাহিদ এর ছবি

বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়ছিলাম, শুরুতে ট্যাগ লক্ষ্য করিনি, আর যেহেতু আপনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের লোক তাই ধরে নিয়েছিলাম জিন নিয়েই লিখবেন। বেশ সহজ ভাষায় বর্ননা দিচ্ছিলেন। ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে এসে বুঝলাম এটা ফিকশন/ সায়েন্স ফিকশনে রূপ নিচ্ছে। যাই হোক গল্প লেখা চালিয়ে যান কিন্তু , আপনার কাছ থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জটিল ও প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর সহজ সাবলীল ব্যাখ্যা নিয়ে আরো পোষ্ট আশা করি।

----------------------------------------------------------------------------
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
সচল জাহিদ ব্লগস্পট


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।