আজাইরা দেরিদা

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি
লিখেছেন অনিন্দ্য রহমান (তারিখ: মঙ্গল, ০৮/০২/২০১১ - ১:৫৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

There is no outside-the-text.

টেক্সটের ল্যাটিন গোড়ায় টেক্সট্র, মানে বয়ন। জিনিস বোনা । দেরিদা বলছে টেক্সটের বাইরে কিছু নাই। আসলে বলে নাই।

কথাটা এইরকম বলছে: টেক্সটোত্তর কিছু নাই। কিছু লোকে এর সুবিধামতন মানে বাইর করছে একটা। তারা বলে, যা পাইবা টেক্সটের ভিতরেই পাইবা। টেক্সটের বাইরে যে আরো অনেক টেক্সট আছে, যেইগুলা ঐ টেক্সটের মানে তৈয়ার করে বইলা সন্দেহ করা হয়, সেইগুলা ঘাঁটার দরকার নাই।

কিন্তু আমরা কেউ আরেকভাবে ভাবছি বিষয়টা। সেইটা হইল, টেক্সটের বাইরে যা কিছু দেখা যায়, দেখাশোনাপড়া যায়, সেইগুলা সবই টেক্সটের অংশ। মানে সবই টেক্সট, কোনো কিছুই টেক্সটোত্তর না।

এইখানে, কনটেক্সট প্রসঙ্গেও যোগ করি। কনটেক্সট থাইকা অর্থ আসে এইরকম একটা বিশ্লেষণী তরিকা আগে থাইকাই ছিল। কিন্তু আমাদের কারো মত, কনটেক্সট বইলা যা কিছু টেক্সটের সীমানার বাইরে ফেলা হয়, সেইগুলা আসলে বাইরে না। কথিত কনটেক্সট, কথিত টেক্সট - দুইটা মিলায়াই আসলে টেক্সট ‘ঘটে’। সুতরাং কথিত কনটেক্সটও আসলে টেক্সটোত্তর না।

টেক্সটের লেখকেরা, পাঠকেরাও, টেক্সটকে কনটেক্সটের থাইকা আলাদা রাখতে ভালো পায়। তারা দাগ টানে। কিন্তু একজন লেখক (পাঠকের কথা পরে ভাবব, তবে তার কেইসও কমবেশি একই) যখন টেক্সট লিখে, তখন জাইনা বা না-জাইনা, সে টেক্সটকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে চায়। বাইরের টেক্সরে, ফুটনোট, উদ্ধার চিহ্ন, একনম্বর-দুইনম্বর-তিননম্বর ব্র্যাকেট দিয়া, কনটেক্সট বানায়া রাখে। এই প্রবণতায় বুঝা যায়, টেক্সট আর কনটেক্সটের সীমানা নিয়া তারা সচেতন।

কিন্তু সীমানা থাকে না। লেখকের উদ্দেশ্যমূলক টেক্সট-কনটেক্সটের বেড়া শেষপর্যন্ত ভাঙে। টেক্সট কনটেক্স একাকার হইয়া যায়। দেরিদা সম্ভবত বলছে, অ-টেক্সট বইলা কিছু নাই। সবই টেক্সট।

ডিকন্সট্রাকশন ঘটাইতে গেলে এইসব বেড়া ভুইলা যাওয়া ভাল। ডিকন্সট্রাকশনে “একধরণের সীমালঙ্ঘন ঘটে, যেইটা এইসব বেড়া, ভেদ নস্যাৎ করে, এবং ‘টেক্সট’ নিয়া আমাদের স্বীকৃত, ডমিনেন্ট ধারণার সম্প্রসারণ ঘটাইতে বাধ্য করে ...এইটা [টেক্সট] কখনই, কোনো লিখিত রচনা সংগ্রহ না, বই বা বইয়ের মার্জিনে বাধা বিষয়বস্তু না, বরং, একটা পার্থক্যসূচক নেটওয়ার্ক, যেইটাতে নিরন্তর অন্যকিছুর ট্রেইস [বা আলামত] বিন্যস্ত থাকে।” [Derrida, "Living On/Border Lines."]

এইভাবে টেক্সট বুঝলে দেখা যায় লেখক নিজেও আর টেক্সটোত্তর থাকে না। টেক্সটের ভিতরেই তার বাস। তারপরও সে টেক্সটের নিয়ন্ত্রণকারী না। সে যা যা বুঝাইতে লিখছে আমরা ঠিক তা তা বুঝব, বিষয়গুলা এত সহজ না। বরং, লেখককেও তার রচিত টেকস্টের সাথে একত্রে পাঠ করা সমীচিন। লেখক টেকস্ট থাইকা ভাগতে পারে না। লেখকে পাঠ্য হইয়া যায়।

ডিকন্সট্রাকশন কী এই প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর নাই। লোকে এইটা সেইটা লেখছে এই নিয়া। দেরিদা লিখছে, ডিকন্সট্রাকশন ভুতের কারবার। এইটা হন্ট করবে, এইটা হন্টোলজি। আবার, টেক্সটের মধ্যেই বিভিন্ন আলামত আছর/হন্ট করে। ডিকন্সট্রাকশনকে যদি একটা মর্মোদ্ধারের কৌশলমাত্র মনে করার ‘ভুল’ করা যায় (আমাদের ভুলে আপত্তি নাই), তাইলে, টেক্সটের মধ্যে আলামতের আছর খুঁজা আমাদের কাজ হইয়া পড়ে।

পাশাপাশি আমরা আরো একটা কাজে উদ্যোগী হইতে পারি। একটা টেক্সটে কোন শব্দ কেন্দ্রীয় কোন শব্দ প্রান্তীয় এইগুলা বাইর করতে পারি। সব টেক্সটই কিছু শব্দরে কেন্দ্রে রাখতে চায়, কিছু শব্দরে প্রান্তে। এমনও হয়, প্রান্তের শব্দগুলা লিখিতও হয় না। ডিকন্সট্রাকশন এই প্রান্তশব্দগুলারে কেন্দ্র স্থাপন করে। এই পাল্টা স্থাপনের খেলায়, বিনির্মিত [বিশেষভাবে নির্মিত] টেক্সটের অ-বিনির্মাণ ঘটে। ডিকন্সট্রাকশনের বাংলায় গায়ত্রীসহ আরো কেউ তাই অবিনির্মাণ শব্দ ব্যবহার করে।

***

মেহেরজান সিনামা নিয়া নানা লোকে নানা কথা লিখছে। তারা লিখছে 'মেহেরজান' মুক্তিযুদ্ধের ডমিনেন্ট ডিসকোর্সকে ডিকন্সট্রাক্ট করছে। এক্ষণে, ‘মেহেরজান’ ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ‘ডমিনেন্ট’ ‘ডিসকোর্স’ ‘ডিকন্সট্রাক্ট’ এইগুলার মাজরা কী বলা কঠিন। কিন্তু তারা মেহেরজান সিনামার ডিকন্সট্রাক্টশনে উদ্যোগী হয় নাই, এইকথা সত্য মানি। 'মেহেরজান' টেক্সটে ঐ সমালোকদের বেশি একটা মন নাই। 'মেহেরজানে'র মন কথিত ‘মুক্তিযুদ্ধের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভে’, যেইটা একটা টেক্সট। 'মেহেরজান' ঐ টেক্সটরে ডিকন্সট্রাক্ট করছে এই মতে তাদের প্রচুর ভক্তি। ভক্তি এতই যে, ‘মুক্তিযুদ্ধের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’ [এইটা আমার বিচারে একটা অশিক্ষিত টার্ম] নামক টেক্সটে কী আছে সেইটা তারা দেখতেবুঝতেলিখতে চায় না।

ওস্তাদে কইছে কানা বক্কররে মার, তো কানা বক্কররে মার। বক্কররে মাইরা হাতসুখ করার নাম দিছে তারা ডিকন্সট্রাকশন।

***

মেহেরজান সিনামার ওয়েবসাইট http://www.meherjaan.net। সিনামা বন্ধ। আমরা আপাতত এইটাতে মনোযোগী হইতে পারি। এই ওয়েবসাইট-টেক্সটে মোটামুটি যা কিছু লিখা আছে, এইখানে কোট করা হবে। ক,খ দিয়া লিখলে সুবিধা হয়।

ক. Synopsis

During the War in 1971, Meher falls in love with a soldier from the enemy side. When her love is discovered, she is shamed and silenced by her family and society. Today 38 years after the war, Meher has a visitor she cannot turn down. Sarah – a ‘war child’, Meher’s cousin Neela’s daughter, who was given away for adoption has come back to piece together her past. Together, these two women must re-tell history through their stories in order to cut through the stigma and walk into light.

এইখানে প্রথমত যেই ঘটনাটা ঘটছে, সেইটা হইল ইতিহাসের বেনামাকরণ। একাত্তর একটা ‘দি ওয়ার’ হইয়া আছে। এইখানে, কেন্দ্রে ‘দি ওয়ার’। প্রান্তে ‘মুক্তিযুদ্ধ’।

পশ্চিমের সাম্রাজ্যে অ্যান্টিওয়ার ‘শিল্প’ অনেক খায়। বিশেষত, তাদের শেষ বড় দুই ওয়ার (অন টেরর) লাভজনক প্রমাণিত হয় নাই। সেইখানকার অনেক মানুষ দেখছে, টাকায় টাকা গেছে, ‘টেরর’ খতম হয় নাই। তাই মেহেরজানের ‘অ্যান্টিওয়ার’ শিল্পকলা পুরাপুরি সাম্রাজ্যবাদী খেদের বাইরে এইকথা মানা যায় না। ভিয়েৎনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন আর ইরাক-আফগানিস্তানে আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলনে তফাৎ বিদ্যমান। ভিয়েৎনাম যুদ্ধের অ্যান্টিওয়ারবাদীরা মোটাদাগে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের বিরোধী না, কেবল সামরিক আগ্রাসনের বিরোধী। ‘দি ওয়ার বইলা’ জাতীয় মুক্তির প্রশ্নটারে যুদ্ধের ময়দান থাইকা গায়েব কইরা দেয়ার চেষ্টা আমার চোখে সাম্রাজ্যবাদী।

এই সাম্রাজ্যবাদী চেষ্টায়, কেন্দ্রে ‘দি ওয়ার’, প্রান্তে (সাইলেন্সড, উহ্যকৃত) শোষণ, আগ্রাসন এবং সর্বোপরি গণহত্যা। ‘দি ওয়ার’ শব্দ অ্যান্টিওয়ার শিল্পকলার ভানে, পশ্চিম পাকিস্তানের ধনিকশ্রেণীর শোষণ, পাকিস্তানের সামারিক আগ্রাসন, এবং পাকিস্তান নামক ধারণার উপর ভিত্তি কইরা গণহত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি শব্দকে নির্বিচারে মূক কইরা রাখে।

সাম্রাজ্যবাদী ডমিনেন্ট ডিসকোর্সের বাধ্যগত ‘মেহেরজান’ কেবল পশ্চিমা সামরিকতন্ত্রকেই ট্যাক্স দেয় না, উপরন্তু একাত্তরের ভারতীয় ও পাকিস্তানি ডিসকোর্সের সাথে যুগপত তাল মিলায়। এই কাজ কঠিন আবার কঠিন না। পাকিস্তান মনে করতে চায় তারা ভারতের সাথে যুদ্ধ করছে। সেয়ানে সেয়ানে। তাদের আত্মসমর্পণও ভারতের কাছে। ভারতের কাছেও অনেক সময় একাত্তর তাদের বিজয়, এইরকম বিজয় তারা আর পাবে না। বাংলাদেশ উছিলা। সুতরাং, একাত্তরের কথিত গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ ভারত ও পাকিস্তানের এহেন মনোভাবের বাইরে গিয়া রচিত হয় না। এই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভে কেন্দ্রে ভারত, পাকিস্তান, প্রান্তে বাংলাদেশ। এই বিচারে মেহেরজান এই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের নির্ভ্যাজাল পুনরুৎপাদন। কাউন্টার ন্যারেটিভ কোনোমতেই না। তারপরও, আজকে যারা, মেহেরজানরে কাউন্টার ন্যারেটিভের তঘমা দিতে চায়, তারা আম্লীগ বিম্পির বাইরে গিয়া ভাবছে বইলা মনে হয় না।

‘দি ওয়ার’ নিয়া আরো দুইচার কথা বলতে চাই। মেহেরজান সিনামার বিভিন্ন জায়গায় সাতচল্লিশের দেশভাগের সাথে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একটা সমান্তর দেখান হইছে। সাতচল্লিশের সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গা, হত্যা, আগুন, লুটপাট, ঘৃণা, ‘বন্ধু’ বিচ্ছেদ, বিরহ এইসবের সাথে মুক্তিযুদ্ধের সমান্তর দেখাইলে কী ঘটে - প্রশ্ন এইটাই। যেইটা ঘটে সেইটা হইল, একাত্তরে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর একতরফা আগ্রাসন, গণহত্যা এবং আত্মরক্ষায় ও জাতীয় মুক্তি লক্ষ্যে বাঙালি ও অন্য জাতিসত্তার লড়াইয়ের প্রশ্নগুলা সেকেন্ডারি হইয়া যায়।

সংখ্যার তুলনায় না যাই। কেবল লিখতে চাই, সাতচল্লিশের হত্যা হত্যা, একাত্তরের হত্যাও হত্যা। কিন্তু সাতচল্লিশে যেইটা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, একাত্তরে এইটা বর্ণবাদী গণহত্যা। এথনিক ক্লিনজিং। পাকিস্তানের ধারণা-প্রেমীরা, মুসলিমভার্তৃত্বের কাঠামো থাইকা বাইর হইয়া এই সত্য মানতে পারে না। কিন্তু, মনে রাখতে হবে, মুসলমানের উপর মুসলমানের আগ্রাসনে ধর্ম কমন পড়লে, বর্ণ সামনে আসে। পশ্চিম পাকিস্তানের আগ্রাসন সেই হিসাবে বর্ণবাদী। ধর্ষণ তাদের রেসিস্ট শোধনপ্রক্রিয়ার অংশ। এখন এই রেসিজমের বিরুদ্ধে যাবতীয় প্রতিবাদকে ‘জাতীয়তাবাদী’ বইলা চিহ্নিত করার মধ্যে পাকিস্তানের ধারণা-কে সংহত রাখার চেষ্টাই দেখি। ধর্মীয় একাত্মতার মিথ ভাইঙ্গা, নিষ্ঠুর বর্ণবাদ (বর্ণ মানে খালি গায়ের রং না, তবে গায়ের রংও) মাথাচাড়া দিলে, পাকিস্তানের ধারণা (=পাকিস্তানের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ) আর অটুট থাকে না। একত্তরে ঠিক এই ঘটনাটাই ঘটছে। মেহেরজান সিনামাতেও ঠিক এই ঘটনাটারই ‘কাউন্টার’ দেয়ার চেষ্টা হইছে। এই বিচারে একাত্তর স্বয়ং কাউন্টার ন্যারেটিভ। এবং 'মেহেরজান', পাকিস্তানী গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের অসৎ পুনরুৎপাদন, এর কমবেশি না।

এইসূত্রেই আরেকটা সূত্র আবিষ্কার করা যায়। লক্ষ্য করি মেহেরজানের ‘প্রেম’ যখন প্রকাশ্য হয় তখন তাকে ‘সাইলেন্সড’ করে ‘পরিবার’ ও ‘সামজ’। নারীবাদী আলোচনায় ‘সাইলেন্স’ শব্দ ওজনদার। ডিকন্সট্রাকশনেও এই শব্দের যাতায়ত আছে। এইখানে, ‘প্রেমের’ বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় নামে ‘পরিবার’ ও ‘সমাজ’। প্রান্তে থাকে বাঙালির জাতীয়তা, তার অর্থনৈতিক শোষিত হওয়া ইতিহাস, বর্ণবাদী নৃশংসতার ক্ষতচিহ্ন, এবং আত্মরক্ষার স্পৃহার প্রশ্নগুলা। বেনামা-বেতারিখ-বেজন্মা ‘পরিবার’ ও ‘সমাজ’ এইখানে প্রধান চরিত্রে। বিদ্বৎজনে 'মেহেরজান' নিয়া বলছে, ধর্ষক-ধর্ষিতের মধ্যে ‘পুনর্মিত্রতা’ ঘটাইতে তাদের ইতিহাস-শূন্য স্পেসে নিয়া যাইতে হবে। মেহেরজান সিনামায় ‘পরিবার’ ও ‘সমাজ’ ঐ শূন্যতায় ভাসমান। ঠিক যেইভাবে ভাসমান ছিল পাকিস্তানের ধারণা।

ঐ ধারণায় ফেরত যাইতেই, সন্দেহ করি ৩৮ বছরের ‘স্টিগমা’ কাটানোর দাবী আরো জোরালো হইয়া উঠে। স্টিগমা একপ্রকারের চিহ্ন। লজ্জা বা কলঙ্কের চিহ্ন। সিনপসিসে লিখা, মেহের ও সারাহ-র গল্প স্টিগমা কাটাবে। আমরা যেইটা বুঝি, এইকথার মানে, মেহেরের শত্রুসৈন্যরে [‘এনিমি সোলজার’রে] ভালোবাসার কলঙ্ক, এবং সারাহর শত্রুসৈন্যের কন্যাত্বের [ধর্ষণ শব্দটা সিনপসিসে নাই] কলঙ্ক, এই দুইটা কাটানো দরকার। এইখানেই, এই সিনামায়, কেন্দ্রে উপস্থিত ইতিহাস-শূন্য প্রেমিকা ও নিরূপায় কন্যা। প্রান্তে বিদ্যমান, নীলা, যাদের ‘বীরাঙ্গনা’ বলে তাদের একজন। ধর্ষিতার ইতিহাসকে প্রান্তে রাইখা, প্রেমিকার ইতিহাসকে কেন্দ্রে নিয়া আসার মধ্যে আমি ডিকন্সট্রাকশন দেখি না। বরং নিখিল পাকিস্তানের গায়েবী সংহতির যেই কনস্ট্রাকশন, সেইটার পুনরুৎপাদন দেখি।

এই ‘সিনপসিসে’ সবচেয়ে বড় ঘটনা ‘ওয়ার চাইল্ড’ শব্দের ব্যবহার। ‘ওয়ার চাইল্ডে’র মানে হালনাগাদ করি। সহজ মৃগয়া উইকি, সেইখানে লিখছে,

A war child refers to a child born to a native parent and a parent belonging to a foreign military force (usually an occupying force, but also soldiers stationed at military bases on foreign soil). It also refers to children of parents collaborating with an occupying force. Having a child with a member of a belligerent foreign military, throughout history and across cultures, is often considered a grave betrayal of social values. Commonly, the native parent is disowned by family, friends and society at large. The term "war child" is most commonly used for children born during World War II and its aftermath. [উইকি]

এইখান থাইকা ‘ওয়ার চাইল্ড’ শব্দের ডমিনেন্ট অর্থের আভাস হইলেও পাওয়া যায়। 'ওয়ার চাইল্ডে'র উইকিভাষ্যে ধর্ষণ গৌণ, প্রায় অনুল্লেখ্য একটা বিষয়। কথিত শত্রুপ্রেম মুখ্য। ‘মেহেরজান’ সিনামাও এইভাবে ধর্ষণের ঘটনাটাকে প্রান্তে ঠেইলা দেয়। পাশাপাশি, নীলার জীবনে ধর্ষণকে (যেইটা নিয়া ‘মেহেরজান’ ছবি আর মুখ খুলে না, নীলা চরিত্রও ছবির মাঝামাঝি একবারে হারায়া যায়, আর আসে না) মেহেরের জীবনের ‘শত্রুপ্রেমে’র সাথে সমীকৃত করে। ধর্ষণের চিহ্ন মুইছা, প্রেমের প্রতিস্থাপন একপ্রকারের সহিংসতা। এই সহিংসতার উৎসে পাকিস্তানের ধারণা-প্রেম যেমন থাকতে পারে, তেমনি থাকতে পারে, পুনরায়, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদি যুদ্ধের খাপে গল্প বেঁচার খায়েশ।

খ. Plot Summery

ক অংশের আলোচনার পরে, খ অংশ নিয়া বেশি আলাদা কিছু বলার নাই। প্রথম বাক্যটা খেয়াল করি [ফুটনোট দ্রষ্টব্য] : ‘স্টেইট অফ পাকিস্তান রেইজড ইন্টু ওয়ার’। এই বাক্য সব কিছুর আগে যেই জিনিসটা দাবী করে, সেইটা হইল পাকিস্তানের অখন্ডতা। গোটা স্টেইট অফ পাকিস্তানের ‘ক্রোধন্মত্ত’ হইয়া ‘যুদ্ধে নামা’ আর আংশিক পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা বাহিনী কর্তৃক পূর্বপাকিস্তানের নিরস্ত্র মানুষ হত্যা ও ধর্ষণ এক ঘটনা না। এইখানে কেন্দ্রে পাকিস্তানের অখণ্ডতা। প্রান্তে, অস্বীকারে, বিদ্যমান পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক-শোষিতের সম্পর্ক। তাদের বিচ্ছিন্ন সত্তা। স্বাতন্ত্র। বর্ণভেদের, বর্ণবাদী নৃশংসতার প্রশ্নগুলাকে গৌন রাইখা, অখণ্ড পাকিস্তানের ‘উন্মত্ততা’ এইখানে মুখ্য। সাদামানুষের চিন্তাকাঠামোয় ‘উন্মত্ততা’ সাময়িক। তারা বিশ্বাস করে, মানুষস্বভাবে স্বাভাবিকতা ফিরা আসবেই। সাদামানুষের হিউম্যানিজম দিয়া পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা পায়, আশ্চর্য কী।

কিছু গৎ কথার পরে, প্লট সামারিতে নীলার কথা পাই। এইখানে নীলাকে পরিচয় দেয়া হইছে ‘রেইপ সার্ভাইভার’ বইলা। রেইপ ‘ভিক্টিম’ না বইলা সার্ভাইভার বলার রাজনীতি বুঝতে চাইলে এই হাজিরকরা টেক্সটের বাইরের জিনিসকে টেক্সটের মধ্যে টানতে হবে। এইরকম একটা বাইরের জিনিস হার্ভার্ডধারী শর্মিলা বসুর Anatomy of Violence: Analysis of Civil War in East Pakistan in 1971 প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে লেখক দাবি করছে, পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক বাঙালি রমণী ধর্ষণের ডিসকোর্স ‘বিপুলভাবে অতিরঞ্জিত’। সে বলে, একাত্তরে বাংলাদেশে একটা ‘গৃহযুদ্ধ’ লাগছিল। তখন ‘দুইপক্ষে’র লোকই হিংসাত্মক আচরণ করছিল। তাই, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের যাবতীয় বিরোধ মিটায়া ফেলা কর্তব্য। যাই হোক, এই প্রবন্ধে, লেখক বলছে , একাত্তরে গণহত্যা [এবং ধর্ষণ] নিয়া বাংলাদেশ একটা অস্বাস্থ্যকর ‘ভিক্টিম কালচার’ লালন করে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিনিধনের সাথে পাল্লা দিয়া থাকে। এইটা একটা ‘মানুষখেকো’ প্রতিযোগিতা। তার ধারণা, বাংলাদেশের মানুষের এই প্রবণতা নিয়মতান্ত্রিক পড়াশুনাকে বাধাগ্রস্ত করে। সুতরাং মনে করতে পারি, ‘ভিক্টিমহুডের পলিটিক্স’কে [এই শব্দ পাকিস্তানের ধারণাপ্রেমী বিদ্বৎজনের লেখায় উপলব্ধ] প্রশ্রয় না দিয়া, ‘ট্রু আন্ডাস্ট্যান্ডিং’য়ের নিমিত্তে, রেইপ সার্ভাইভার শব্দ আমদানি করা হইছে।

প্লট সামারিতে লিখা, নানাজান, একাত্তরে যেইটা প্রত্যক্ষ করছে, সেইটা হইল ‘অ্যানাদার রিফট’। কলিন্সের ডিকশনারিতে লিখছে, rift মানে a break in friendly relations between people or groups of people। পাকিস্তানের লগে সাতচল্লিশ থাইকা একাত্তর পর্যন্ত নানাজান কেবল ‘দোস্তানি’ই দেখছে। এই rift শব্দ ঢুইকা আছে drift শব্দের মধ্যে। মেহেরজান সিনামা শুরুতে এই বাক্য আছে two parts of Pakistan drifted away from each other। এই (ডি)রিফটের মধ্যে দু্ইটা অস্বীকারের ঘটনা ঘটে। প্রথমত, এইটা অস্বীকার করে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিকতন্ত্রের ২৪ বছরের শোষণকে, সুতরাং ড্রিফট। দ্বিতীয়ত, নিখিল পাকিস্তানের ধর্মকেন্দ্রিক সংহতির ধারণার উপর ভিত্তি কইরা, এইটা অস্বীকার করে পাকিস্তানের দুই অংশের মৌলিক নৃতাত্ত্বিক পার্থক্যকে। উভয় কাণ্ড ঘটাইলে একটা সুবিধা অন্তত পাওয়া যায় - পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর এথনিক ক্লিনজিং (ধর্ষণ যার একটা অংশ) কে এথনিসিটি-শূন্য এলাকায় নিয়া, দুই দোস্তের মনকষাকষি হিসাবে চালায়া দেয়া যায়।

প্লট সামারির আর একটা অংশে নজর দিব। সারাহ-র প্যাশনেট নোম্যাডরূপ। ‘Passionate Nomad’ বই ব্রিটিশ ভ্রমণকাহিনী লেখিকা ফ্রিয়া স্টার্কের জীবনী। স্টার্ক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরে, আরব দেশে দুর্গম পথ পাড়ি দিছে। এইটা কেবল নারী হিসাবেই না, যে কোনো অভিযাত্রী হিসাবেই দুঃসাহসিক ধরা হয়। স্টার্কের এই দুঃসাহসিক ভ্রমণের সাথে সারাহ-র বাংলাদেশ ভ্রমণ সমীকৃত ধরি। এবং তার সাথে টীকা দেই যে, স্টার্ক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ব্রিটিশ তথ্যমন্ত্রণালয়ের প্রপাগান্ডাযন্ত্রে কাজ করছে। তার উদ্দেশ্য ছিল, আরবরা যাতে মিত্রবাহিনীরে সমর্থন যোগায়, এমন প্রচার চালান। সুতরাং, এই প্লট সামারি, সিনামায় সারাহ-র নিজেকে জানার ব্যক্ত উদ্দেশ্যের পিছনে ‘সমর্থন আদায়ে’র প্রপাগান্ডার আলামতও অনিচ্ছায় সরবরাহ কইরা থাকতে পারে।

গ. Director’s Note

ডিরেক্টরস নোটে প্রচুর কথাবার্তা আছে যেইগুলা নিয়ে ইতিমধ্যে বহুত আলোচনা হইছে। এই ডিরেক্টরস নোটে কী নাই (সুফিবাদও আছে)– সেইটা নিয়াও কেউ লিখবে।

কেবল পাকিস্তানের ‘বামপন্থী’ কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতার উদ্ধৃতি এইখানে কী কাজে নিয়োজিত সেইটা নিয়া আলোচনা করা যাক। ‘ভালো পাকিস্তানি’র উদাহরণ হিসাবে ফয়েজ বহুব্যবহৃত কুমিরের বাচ্চা। তাই,বিস্ময়কর না যে, শর্মিলা বসু তার পূর্বোক্ত প্রবন্ধের শুরুতেও ঠিক একই উদ্ধৃতি দিছে, খালি ইংরেজি অনুবাদটা ভিন্ন।ডিরেক্টরের মনোবাঞ্ছা অগ্রাহ্য কইরা আমরা চাইলে, এই দুই লাইন নিজের মতো পাঠ করতে পারি। দেখতে পারি এই ভালো পাকিস্তানি কী বলতে চায়।

“আর কবে আমরা কলঙ্কহীন সবুজের সৌন্দর্য্য দেখব? আর কত বর্ষা পেরোলে রক্তের দাগ ধুয়ে যাবে?”

... আমরা দেখছি আমাদের পতাকার রঙ সবুজ। ঐখানে লাল, একাত্তরের রক্তক্ষরণ। রক্তের দাগ ধুইতে গেলে,একাত্তরকে ধুইতে হবে। পাকিস্তানের ধারণাপ্রেমী বিদ্বৎসমাজ দেরিদার নাম নিয়া এই কাজে ইতিমধ্যেই নামছে, সন্দেহ নাই।

[সহসচল টিউলিপ এবং অন্য বন্ধুদের ঋণ স্বীকার করি]

পাদটীকা

  • ১. In 1971, the state of Pakistan raged into war, and East Pakistan emerged as sovereign Bangladesh. ... Years later, Sarah, a war child begins a journey into her past. ... Meher, a middle aged sculptress, a survivor of 1971 war lives in Dhaka city alone. ... Together, these two women must walk down the memory lane and re-tell history through their stories. ... When Meher opens her chest of story she pulls one story after another. ... The story of Neela – a rape survivor, who is not ashamed to be raped, rather opts for retaliation. ... The story of Nanajaan, Meher’s Grandpa – a Bengali Musalman who had lost part of his homeland in partition, and found himself at a loss to witness yet another rift in 1971. ... The chest of story also has in store the story of Salma, Meher’s aunt, a young clairvoyance, who lives in her won domain of fantasy, and is lunatically obsessed by the idea of romance and marriage. ... Finally at the bottom of the box, there is the secret story of Meher’s own past of falling in love with an enemy. ... The stigma of love has been heavy on her. ... However, when Sarah, the war-child says, “your story gives me hope!” – Meher finally feels forgiven. ... Together, Sarah and Meher get strength, courage and hope to go forward. ... Lightened and healed by re-telling of her past, Meher rejoices herself in making a sculpture. ... Sarah goes ahead with her life – ‘a passionate nomad’.
  • ২. There is also the cultivation of an unhealthy “victim culture” by some of the pro-liberationists – hence the people of Chuknagar complain about being left out of the official history books and vie to establish their village as the site of the “biggest mass killing” in the country, and people are instigated at the national level to engage in a ghoulish competition with six million Jews in order to gain international attention. These tendencies hamper the systematic study of the conflict of 1971 and hinder a true understanding of a cataclysmic restructuring in modern south Asian history.
  • ৩. “Kab nazar mein ayegi bedagh sabze ki bahar
    Khoon ke dhabbe dulhein ge kitni basaaton ke baad”

    When shall we see the beauty of innocent greens?
    How many monsoons will it take to wash away the patches of blood?
    - Faiz Ahmed Faiz, Dhaka Se Wapsi Par (1974)

    History is not a coherent narrative.

    A war is always made into a glorious narrative with certain male heroes and villains. Women mostly appear as sacrificing creatures, mother and sisters who bravely let go of their men for the cause of the nation. Women also appear synonymous to the landscape – ready to be raped, plundered, and give their lives and izzat or chastity for the cause of the nation.

    The purpose of ‘Meherjaan’ is to break the glorious narrative of national history, and open up a modest avenue to explore perhaps not only one or two, but multiple narratives of war.

    History is always a creation of the present. We stand here, in our time and space, looking back in search of ourselves in present time, piecing together what we call history; First of all, no one will ever know actually what it was like if one didn’t live it. However, there is at least one safe way to piece together a good enough contour of the past in order to comprehend the prominent political, socio-economic, cultural and spiritual forces at play during a certain chunk of time.

    This safe way is about making room for more than one voice. History has to be told, not only from the vantage point of the armed forces, the politicians, the freedom fighters, the men; rather history has to be told from the voices of every other person that was left out – the old women, the man who didn’t fight, and may be a young girl who was coming off age and falling in love while the entire country was plunging into hatred, killing, separatist emotions and nationalist turmoil.

    The most intensive love stories are those that are difficult to consummate.

    In Sufi philosophy love relationship between the divine and the devotee always remain fueled by the consciousness of impossibility of ultimate union. ‘Meherjaan’ love story is driven by such impossible material conditions of union while indefatigable emotional desire to unite throbs throughout the narrative.

    Perhaps, the story of death, violence, trauma and loss can be best told veiled in love and romance. Korean author Noeleen Heyzer, in her writing about Korean Comfort women’s sexual slavery during World War II gives an aesthetic solution to overcome the history of violence. She suggests to look feminist studies for a “more powerful power,” a “power” which is “life sustaining, liberating, and transforming.”

    I believe in that “power.”

    While violence and terrorism have become a common currency today, the urge is pressing on us to comprehend a feminine life sustaining language that is related to nature, beauty and love.

    Rubaiyat Hossain,
    Writer/Director
    Meherjaan


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

দেরিদার মেশিনে পাকিসোনাপেয়ারু রুবাইয়াতের সাক্ষাৎকারগুলিও ফেলা প্রয়োজন।

কৌস্তুভ এর ছবি

চিন্তিত

লেখক-সহলেখকদের চলুক । সাইটের টেক্সট নিয়ে আপনারা যে ডিসকোর্সটা করেছেন সেটা মহাবিনির্মাণ কিনা তা আমি জানি না, তবে বক্তব্যটা বেশ পরিষ্কার।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

Perhaps, the story of death, violence, trauma and loss can be best told veiled in love and romance.

উপরে দেয়া উদ্ধৃতিটি পরিচালিকা রুবাইয়াতের। তিনি বলতে চাচ্ছেন প্রেম ও রোমান্সের আবরণে ঢেকে মৃত্যু, সন্ত্রাস, শোক বা ক্ষতির গল্প যদি বলা হয় তবে সম্ভবত: স্বার্থকভাবে বলা যায়।

এই অনুধাবন থেকে তিনি 'মেহেরজান' ছবিটি নির্মাণ করেছেন বলে অনুমান করি। তবে তার এই নতুন করে পুরনো কথা বলার ভঙিটি যে স্বার্থক হয়নি তা আমরা যারা ছবিটি দেখিনি তারাও জেনে গেছি। মানুষের বাদ-প্রতিবাদে এখন ছবিটি অনেকটা শত্রুপক্ষীয় প্রোপাগান্ডা হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।

যত উঁচু মানের লেখক হলে এরকম বিষয়গুলো নিয়ে গল্প বলা যায় এবং নতুন একটা বার্তা যোগ করা যায় তত ক্ষমতাবান বা দক্ষ নির্মাতা তিনি নন। যারা ছবিটি দেখেছেন তারা সিরিয়াস দৃশ্যে দর্শকদের অট্টহাসির খবরও আমাদের জানিয়েছেন - এতে তার অদক্ষতাই বরং বেশি ধরা পড়েছে।

উপন্যাসটির নাম মনে পড়ছে না তবে সৈয়দ শামসুল হকের একটা উপন্যাসে একজন মুক্তিযোদ্ধার বিধবা দ্বিতীয় বিবাহ করেন একজন রাজাকারকে। সরাসরি গল্পকে দেখলে মনে হতে পারে এখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরাজয়কেই সৈয়দ হক বড় করে দেখাচ্ছেন। কিন্তু ঐ উপন্যাস পড়ে কেউ এরকম আপত্তি তোলেনি। এটা সৈয়দ হকের শিল্পসৃষ্টির ক্ষমতা এবং ইতিহাস সচেতন থেকে সংবেদনশীল বিষয়ে নতুন ব্যাখ্যা তৈরির দক্ষতা।

ডিসকোর্স ইত্যাদি শব্দ যত সহজে অ্যাকাডেমিক আলোচনায় ব্যবহার করা যায়, বাস্তবে সমাজ-রাজনীতির ব্যাখ্যায় এসব প্রয়োগ করা ততোটাই কঠিন। আর তা নিয়ে ছবি বানানো আরো অনেক পরিশ্রমের দাবী রাখে।

আশা করি আমরা ড্যান ব্রাউনের দ্যা ভিঞ্চি কোড-এর কথা ভুলে যাইনি। যীশু খ্রিষ্ট বা খ্রিষ্টান ধর্ম সম্পর্কে এই ছবির ব্যাখ্যা কিন্তু নতুন। প্রচল জনপ্রিয় ডিসকোর্সের বাইরে নিভৃতে বয়ে যাওয়া রুগ্ন একটা ডিসকোর্সকে এই উপন্যাসে বা ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে। এই ব্যাখ্যায় যারা আহত হয়েছিলেন তারা সমালোচনাও করেছেন। তবে জবাবে ছবির নির্মাতারা কেউ ডিসকোর্স, মেটা-ন্যারেটিভ ইত্যাদি টার্মিওনলজি ছুঁড়ে কাউকে ভড়কে দেয়ার চেষ্টা করেননি। দ্যা ভিঞ্চি কোডের গল্পের কাঠামোতেই এই নতুন ডিসকোর্সের পক্ষের সমস্ত প্রামাণিক তথ্য, দলিল বা বক্তব্য জুড়ে দেয়া আছে - শিল্পসম্মতভাবে। আর ড্যান ব্রাউন এই ডিসকোর্স বানাননি - তিনি শুধু গ্রন্থনা করে উপস্থাপন করেছেন।

রুবাইয়াতের পাঠ আর প্রয়োগের ব্যর্থতা এখানেই। তিনি তার ছবির কাহিনীর ডিসকোর্সটা বানিয়েছেন তার মাথায় - ঐতিহাসিক তথ্য দিয়ে তার ছবিতে সেই ডিসকোর্সের উপস্থিতি ঐ সময় যে ছিল তা দেখাতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। সমস্যাটা এই জায়গায়। ডিসকোর্স নিজেরা কয়েকজন ইয়ার-দোস্ত মিলে ২০১০ সালে এসে কফি খেতে খেতে বানালে হবে না। সমাজের, ইতিহাসের, রাজনীতির ঘটনা-উপঘটনার মধ্যে লুকিয়ে থাকা রুগ্ন ডিসকোর্সকে যত্নের সাথে উদ্ধার করতে হবে। অতীতের ডিসকোর্স উদ্ধার করতে গিয়ে বর্তমান সময়ের ব্যাখ্যার ভেজাল ঢুকে যাচ্ছে কিনা তাও খেয়াল করতে হবে।

ও আরেকটা কথা লেখক বা নির্মাতার নিজস্ব কাল্পনিক ব্যাখ্যাকে ডিসকোর্স বলে না - এটা আশা করি রুবাইয়াত জানেন।

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

ডিসকোর্স নিজেরা কয়েকজন ইয়ার-দোস্ত মিলে ২০১০ সালে এসে কফি খেতে খেতে বানালে হবে না।

চলুক

অনেকদিন পর। পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

অতীতে লিখসিলাম


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

যুধিষ্ঠির এর ছবি

চমৎকার বিশ্লেষণ। এরকম একটা লেখা বক্তব্যটাকে টেক্সটের (ব্লগের) বাইরের পৃথিবীতে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

ঘ্যাচাং

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

পাঠ-মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অতিথি লেখক এর ছবি

এই বিচারে একাত্তর স্বয়ং কাউন্টার ন্যারেটিভ। এবং 'মেহেরজান', পাকিস্তানী গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের অসৎ পুনরুৎপাদন, এর কমবেশি না।

এইডাই হইলো আসল কথা। সব কথার সার কথা। তয়, "গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের অসৎ পুনরুৎপাদন"-কে আমরা কি নাম দিতে পারি ? নতুন একটা চীজ, নতুন একটা নাম তো দরকার ? 'ট্রোজান ন্যারেটিভ' চলবে ?

মনমাঝি

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

আজাইরা কাজ চালু রাখি।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

হ ... নাইলে কী উপায় মন খারাপ


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এই লেখার প্রতিক্রিয়ায় ফাহমিদুল হক গংরা কী লেখেন তা পড়ার জন্য বসলাম। উনারা এখানে এসেও আলোচনা চালাতে পারেন। তাতে খাটুনী কমে।

ওয়েল ডান কমরেড!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

‘দি ওয়ার বইলা’ জাতীয় মুক্তির প্রশ্নটারে যুদ্ধের ময়দান থাইকা গায়েব কইরা দেয়ার চেষ্টা আমার চোখে সাম্রাজ্যবাদী।

খাঁটি কথা।

পাকিস্তান মনে করতে চায় তারা ভারতের সাথে যুদ্ধ করছে। সেয়ানে সেয়ানে। তাদের আত্মসমর্পণও ভারতের কাছে। ভারতের কাছেও অনেক সময় একাত্তর তাদের বিজয়, এইরকম বিজয় তারা আর পাবে না। বাংলাদেশ উছিলা। সুতরাং, একাত্তরের কথিত গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ ভারত ও পাকিস্তানের এহেন মনোভাবের বাইরে গিয়া রচিত হয় না। এই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভে কেন্দ্রে ভারত, পাকিস্তান, প্রান্তে বাংলাদেশ। এই বিচারে মেহেরজান এই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের নির্ভ্যাজাল পুনরুৎপাদন। কাউন্টার ন্যারেটিভ কোনোমতেই না।

মোক্ষম বিশ্লেষণ।

... আমরা দেখছি আমাদের পতাকার রঙ সবুজ। ঐখানে লাল, একাত্তরের রক্তক্ষরণ। রক্তের দাগ ধুইতে গেলে,একাত্তরকে ধুইতে হবে। পাকিস্তানের ধারণাপ্রেমী বিদ্বৎসমাজ দেরিদার নাম নিয়া এই কাজে ইতিমধ্যেই নামছে, সন্দেহ নাই।

তাই তো বলি,
সবুজের বুকে মিশেছে কতটা লাল
এই ক্যানভাসে, অগ্নি ঝরানো দিনে
এসো হে যুবক, এসো বিজয়ের দিনে
প্রতি ফোঁটা মাপি সময়ের প্রয়োজনে!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

ভালো সাম আপ করছেন।
সময়ের প্রয়োজন বটে ...


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

দারুন ভাল লাগলো লেখাটা।

মেহেরজান সিনামার ওয়েবসাইট http://www.meherjaan.net

কাস্টিং-এ একজন মহামানবের দেখা পেলাম। তিনি মহাসাধক লীলাবাবু অরুপ রাহী। অভিনয় করেন বলে কখন শুনিনি। তার একটা গান দেখেছিলাম টিভিতে, গানটা আমাকে পরযাপ্ত বায়ুত্যাগে সহযোগিতা করেছিলো-

আমি তোমার মাঝে ঝিরঝিরিয়ে বই।

যত্তোসব পাগোলের আস্তানা।

তবে আমার প্রিয় কবি, এলাকার বড়োভাই প্রয়াত রুদ্রদার বেয়াই কবি রিফাত চৌধুরিকে ভালোই লাগে। আবার জিগাইয়েন না যে রিফাত রুদ্রের বেয়াই হয় কেমনে! চোখ টিপি

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

মহাসাধক লীলাবাবু


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

নীলকান্ত এর ছবি

ব্যাখ্যাটা ভালো হইছে, ভাই।
সিনেমাটা দেখি নাই, তয় দেখলাম একটা গজল আছে। পাকিস্তান ভাগ হওয়া নিয়ে। হয়তো রুবাইয়াত একই শোকে কাতর।


অলস সময়

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

এই আলোচনাটার দরকার ছিল খুব। ধন্যবাদ। এখন আবার কিছু নতুন শব্দ খুঁজে বের করতে হবে মেহেরজান গংকে, আফসোস।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

তারা এইসব আজাইরা লেখা পড়ে না। তুমি পড়লা তাই ধন্যবাদ।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

হিমু এর ছবি

তারা কোনো কিছুই পড়ে না। কভার আর ফ্ল্যাপ পড়ে শুধু। তারপর হন্তদন্ত হয়ে গোলটেবিলে গোলালুপনা করতে যায়। গিয়ে বলে এই সিনামায় ডিকনস্ট্রাকশন হইছে, কাউন্টারনেরেটিভ হইছে। তারপর কিছু সাদালোকের নামধাম বলে। যেখানে সবাই মামা-গাগা আবোলতাবোল বকে, সেখানে খুড়োর মুখে গুংগা শুনলে লোক চমকাতে বাধ্য।

বুদ্ধিজিগোলোবৃত্তি করতে নামলে পড়াশোনার সময় থাকে?

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

অবভিয়াস জিনিস 'প্রমাণ' করা প্রায়শই যায় না ...


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

নৈষাদ এর ছবি

চমৎকার বিশ্লেষণ। এইসব আজাইরা লেখা চলুক। চোখ টিপি

অতিথি লেখক এর ছবি

খুবি চমৎকার বিশ্লেষণ।ভাল লাগল।
---------------------------------------
Sad Quote|[url=http://www.loverofsadness.net/show_story.php ]Sad Love Story[/url]

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ফাহিম হাসান এর ছবি

আপনার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। গুরু গুরু

ভুলজন্ম এর ছবি

বাংলা সিনেমায় দেখসি . . . ধর্ষিতারে ধর্ষণকারীর লগে বিয়া দিলেই ল্যাঠা চুকচুক . . . বাংলাদেশ-পাকিস্তান বিয়া . . . বেচারা দ্বোজবর পাকিস্তান . . . মুখে তালিবান রুমাল . . . মিশন মেহেরজান . . . "উভলিঙ্গের কবিতা" . . .

আগে তো টিএসএলিয়েট . . . তবে না দেরিদা . . .

কেএফসি . . . রুট বিয়ার . . . টিস্যু পেপার . . . কত টাকা আসে???? . . . ইচ্ছামত ফুটেজ . . . আইসে . . . যা ভাগ . . . আমাগো পোলা বিয়া দিমু না . . .

বামনি চেনা গ্যালো তবে . . .

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

এলিয়ট মডার্ন মডার্ন কইরা লাস্টে পাঁড় ইঙ্গক্যথলিক হয়ে গেসিলেন। তার উপর রয়ালিস্ট, ক্লাসিসিস্ট। পরিবর্তনের স্বার্থে কোনো কাজে লাগে নাই। আমরা কিসু নিরূপায় ভক্ত থাকতে পারি। কিন্তু মডার্নিজমের প্রজেক্ট গোড়া থাইকাই ইনকমপ্লিট। সেই কথা আরেকদিন হবে। দেরিদা একজন সচেতন উপদ্রবকারী। দেরিদার অনুবাদক গায়ত্রী স্পিভাক নিজেরে বলসে, গ্যাড ফ্লাই। A gadfly is a person who upsets the status quo by posing upsetting or novel questions, or just being an irritant. উইকি বলতেসে ... পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অতিথি লেখক এর ছবি

গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু
---------------------------------
Sad Songs

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।