স্মৃতি বিপর্যয় ৬: কই আমি তো পাচ্ছি না!!

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি
লিখেছেন লুৎফুল আরেফীন (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৭/০৪/২০০৮ - ৮:০২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

autoসেটা ২০০৩ সালের ঘটনা। জার্মানীতে এসেছি সবে ৩-৪ মাস হয়। যে যা বলে মাথা পেতে নেই। আইন-কানুন জানি না। ভাষা বুঝি না। রাস্তাঘাট চিনি না। কি আর করা। অগ্রজরা বলেন, আমরা নবাগত’রা শুনি। এই অগ্রজদের মধ্যে একজন ছিলেন মোহাসিন ভাই। উনার বৈশিষ্ট ছিল অনেকগুলো। সব এই প্রবন্ধের আওতায় আনা যাবে না। তবে অন্যতম বৈশিষ্টগুলো বলা যায় সহজেই। অন্যতম বৈশিষ্টের মধ্যে কনফিডেন্টলি ভুল বলা উল্লেখ্য। এছাড়া, সবাইকে ‘চিফ’ বলে সম্বোধন করা, ছবি তোলার সময় গড়িলার মতোন হাত মুঠো করে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে দাঁড়ানো; পেটের মধ্যে বায়ো-গ্যাসের সিলিন্ডার নিয়ে ঘুড়ে বেড়ানো এবং যত্রতত্র সেখান থেকে গ্যাস লিক করা – এগুলো সবই ছিল তার একেবারে স্বকীয় গুণাবলী।
প্রথম প্রথম কোন কিচেনে আড্ডার সময় আমাদের মতোন নবাগতদের দিয়ে ধোয়া-মোছা এবং চা বানানোর মতোন টুকটাক কাজগুলো করানো হতো। একবার কিচেনে সবার শখ জাগলো দেশী কায়দার চা পান করবে। অর্থাৎ টি-ব্যাগ ডুবানো, ফ্লেভার্ড ইউরোপীয়ান চা নয়; একেবারে দুধ আর পানি দিয়ে জ্বাল দেওয়া পাতির চা! সেই চা বানানোর ট্রেনিং দিলেন আমাদেরকে মোহাসিন ভাই। একপর্যায়ে চা ছাকার জন্য ছাঁকনী আবশ্যক হয়ে দেখা দিলো। আমি বললাম,
‘চিফ ছাঁকনী তো নাই। থাকার কারনও নাই’। উনি অবাক হবার ভাব করে বললেন, ‘কেন থাকবে না, ওরাও চা ছেঁকে খায় মাঝে মাঝে’। এবার ওনার কথায় আমার অবাক হবার পালা! কারণ এখনও পর্যন্ত সেটা আমি নিজের চোখে দেখি নাই। জার্মানরা পারলে নাকটাও কোনও যন্ত্র দিয়ে ঝারে। ওরা কি না ছাঁকনী দিয়ে চা ছাঁকবে!? এ নিয়ে বেশী ভাবার অবকাশ পেলাম না। দেখি উনি একটা দশাশই আকারের ছাকনী কিচেনের কাপ-বোর্ড থেকে আবিষ্কার করলেন। ‘এই তো পাওয়া গেছে’!

ছাঁকনী দেখে আমার বিশেষ সন্দেহের উদ্রেক হলো, কারণ ওটার জাল দিয়ে মাছ হয়তো কোনওমতে আটকাবে, চা-পাতি আটকানোর কারণ দেখি না – রীতিমতোন এলেবেলে সাইজের ফুটো।
‘চিফ এটা দিয়ে তো আটকাবে না মনে হচ্ছে’।
‘আরে আটকাবে, বেশি টেনশন করো না, আমি জানি তো’।
উনি চা ঢাললেন এবং যে দৃশ্য কল্পনা করার জন্য এঞ্জিনীয়ারীং ডিগ্রীর দরকার নাই, সেই দৃশ্য অবলোকন করলাম। পুরোটা চা, পাতা সহ, গিয়ে কাপের মধ্যে আশ্রয় নিলো। হাতে গোণা গোটা কতক পাতি জালে আটকে রইলো। সেটা দেখেই উনি বিজ্ঞের মতোন বললেন, ‘আগেই বলছিলাম, এটা দিয়েই হবে। জানো না খালি কথা বলো’।

কিচেনের বাকিরা চায়ের এই অভিনব ম্যানুফ্যাকচারিং দেখলো না। তারা সবাই আড্ডার মধ্যে ডুবে আছে। রাজনীতির মাঠে রাজা-উজির মরছে একে একে। স্বভাবতঃই চায়ের তৃষ্ণাটা সবারই চড়া। এরই মধ্যে আমাদের চা পরিবেশিত হলো।

পাঠক হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন, সভা সমিতিতে চোঙাকৃতির টিনের একপ্রকারের মাইকের ব্যবহার হয়ে থাকে। মাইকের সেটিং ভুলভাল হলে অথবা বক্তৃতাকারী বেশী উত্তেজিত হয়ে পরলে লেকচার দেবার সময় মাঝে মাঝে গলার চেয়ে মাইকের চিঁ চিঁ আওয়াজ অনেক বেশি তেড়ে ওঠে, কানে হাত দেওয়া লাগে।
এখানেও দেখলাম, চা মুখে দেওয়া মাত্র রাজা-উজির মারার আলাপে ভাটা পরলো। সেটা ছাঁপিয়ে থুঃ থুঃ শব্দের জপন শুরু হলো। প্রথমে কিঞ্চিৎ লঘুভাবে হলেও ক্রমাগত সেই শব্দ মেশিনগানের আওয়াজ ছাড়িয়ে যাবার জোগার! ছোটবেলায় একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে থুথু ফেলার প্রতিযোগীতা করতাম বন্ধুদের সাথে। কে কতোদূরে থুথু ফেলতে পারে, তারই প্রতিযোগীতা। এই দৃশ্যের সাথে ছোটবেলার সেই আকুতির স্পষ্ট মিল পাচ্ছিলাম!! ঘটনা অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসলো যে, ইসুবগুলের ভুষিতেও এতো ভুষি থাকে না যতোটা পাতা ঐ চায়ের মধ্যে ছিলো! পাতা এড়িয়ে শুধু তরলটুকু মুখে নেওয়াই দায়! সবাই থুঃ থুঃ করে সেই পাতা সরাতেই ব্যস্ত। আর এহেন রসভঙ্গের জন্য চায়ের কারিগরের দিকে সবাই ক্ষুব্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মোহাসীন ভাই সেই দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য ঢাল হিসেবে ক্রমাগত পাতা সহই স্বরচিত চা ঢোকের পর ঢোক গলধঃকরণ করা শুরু করলেন। সেই সাথে ‘কই আমি তো পাতা পাচ্ছি না!’ বলে বাকিদের পাতা পাওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করতে লাগলেন।

বি.দ্র.
১. ছঁাকনী দিয়ে চা খাওয়ার চল জার্মানীতে আছে। তবে সেটা যেন তেন ছাকনী নয়। কেতলীর সাথে ইন্টিগ্রেটেড ছাঁকনী।
২. ঐ ছাঁকনীটা ছিল সেদ্ধ করার পরে নুডল্স ছাঁকার জন্য

ছবিসূত্র: ইন্টারনেট


মন্তব্য

নজমুল আলবাব এর ছবি

আগেরগুলোর মত হয়নাই। হাসি কম আসছে

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

জ্বী হুজুর, আর এমনটি হবে না হাসি

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

পরিবর্তনশীল এর ছবি

স্মৃতি বিপর্যয়ের আমি কিন্তু নিয়মিত পাঠক। চলুক এবং নিয়মিত।

---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

জেনে খুশি হলাম। নিয়মিত তো পারছি না। হঠাৎ হঠাৎ জোশ উঠে।

ধন্যবাদ

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

স্বপ্নাহত এর ছবি

আমি তো ভালই হাসলাম দেঁতো হাসি

---------------------------

থাকে শুধু অন্ধকার,মুখোমুখি বসিবার...

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

ঐ তো দেখেন না, পাবলিকের হা এত্তো বড় হইছে! যতো দেই ততোই চায়। হাসি

ধন্যবাদ আপনাকে।

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

বিপ্রতীপ এর ছবি

স্মৃতির বিপর্যয় ঘটুক নিয়মিত...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
খুঁজে যাই শেকড়ের সন্ধান…

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

আপনাকে অনেকদিন পরে পেলাম! যাহোক, ধন্যবাদ।
চেষ্টা করবো নিয়মিত বিপর্যয় ঘটাতে।

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

ধুসর গোধূলি এর ছবি
লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

ঠিক আছে 'চিফ' - সালাম পৌছে দিলাম সচলায়তনের মাধ্যমেই।

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

ধুসর গোধূলি এর ছবি
লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

ধুসর ভাই 'ঠাডা'র ডয়েচ কি হইতে পারে? দেঁতো হাসি

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোয় কেতলীর সাথে ইন্টিগ্রেটেড এবং সেপারেটেড দু'রকম ছাঁকনিরই প্রচলন আছে। এরাও বেশ চা-খোর। তবে দুধ-চা'র মাহাত্ম্য বোঝে না।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
নিজেকে জয় করার অর্থ বিজয় না পরাজয়? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

আমি মাঝে মধ্যে শখ করে দুধ চা খাই। পছন্দ অবশ্য লিকার চা। দেশী চা খাওয়ার ইচ্ছা হলেই কেবল ঐ বিশেষ চা বানাই। অবশ্যই ছাঁকনী ছাড়া, টিব্যাগ দিয়ে।

আপনার শ্লোগানটা তো আমাকেও কনফিউজড করে দিলো, বিজয় না পরাজয়? আসলেই তো!

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

বিপ্লব রহমান এর ছবি

চা 'রান্না করা' সহজ নয় দেখছি! খাইছে

আর রুশ বইয়ে পড়া সেই সব সামোভার @ সংসারে এক সন্ন্যাসী ?

সে সবের পাট অনেক আগেই চুকে গেছে বুঝি? আমাদের কলের গানের মতো সামোভারও এখন বোধহয় ঠাঁই নিয়েছে জাদুঘরে।... এখন তো সবখানেই বিদ্যুৎচালিত কেতলির জয়-জয়োকার।


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

শহুরে ‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍লোকজনদের সামোভার ব্যবহার করতে দেখি না।

সামোভারও এখন বোধহয় ঠাঁই নিয়েছে জাদুঘরে

এখনও নেয়নি। তবে দেরিও খুব বেশি নেই বলেই মনে হয় মন খারাপ

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
নিজেকে জয় করার অর্থ বিজয় না পরাজয়? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

ও সন্যাসী, জিনিসটা কি কইনছেন?

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

হা হা। মজাই!

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

আপনি পাইছেন টা কি?
আগের দিন বললেন, 'অনেক বড় লেখা!'
আজকে বললেন, 'মজা-ই'

এগুলা তো আমার ক্যারিয়ার একদম শ্যাষ কইরা দিবো।

মজা করলাম শিমুল ভাই। ... হো হো হো
মন্তব্যর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

আগের দিন বললেন, 'অনেক বড় লেখা!'

ঊমম---
আমি বলেছিলাম-ম-ম?

স্মৃতিবিপর্যয়টা তবে আসলেই ঘটছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কার?

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

একটু পুরু ধরনের পেপার টাওয়েল দিব্যি ভালো ছাঁকনির কাজ করে। অনেকটা কফিমেকারে ব্যবহৃত ফিল্টার পেপারের মতো।

চা রান্নার গল্প মজাই লাগলো।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

জুবায়ের ভাই, ছাকনী পরে আমরা আসলেই বের করেছি। সম্ভবত চাইনিজদের দ্বারা আমদানী হয়েছে।

ঠিক বলেছেন। চা রান্নাই বটে!

আপনার দিয়াশলাই জ্বালাবেন কবে? অপেক্ষায় আছি কিন্তু। হাসি

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

ক্যামেলিয়া আলম এর ছবি

থুথু ছিটানোর প্রতিযোগিতার দৃশ্য চোখে দেখলাম------কানে শুনলাম------হাঃ হাঃ হাঃ------করে হাসলাম!
.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........

.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

হাহাহা! দেখলেন কারণ আপনার প্রবল কল্পনাশক্তি আছে বলে। ... ... অভিজ্ঞতাটা আমাদের সবারই খুব আপন।

আপনাকে ধন্যবাদ হাসি

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

ঐ মহসীন ভাই টাইপের দু-চারজন ক্যারেকটারের সাথে আশা করি আমাদের সবারই কমবেশি পরিচয় আছে... জিনিস একখান!

--------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।