কতটুকু স্বাধীন আমরা?

অরফিয়াস এর ছবি
লিখেছেন অরফিয়াস (তারিখ: শুক্র, ২৭/০৩/২০১৫ - ১১:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কিবোর্ড-কলমের একঘেয়ে যুদ্ধে একের পর এক লেখার জন্ম হয় সত্যি কিন্তু নিজের অক্ষম ক্রোধের কারনগুলোর কতটা পরিসমাপ্তি হয় তার প্রশ্নটা থেকে যায় বারংবার। এখন পর্যন্ত অনলাইনে লেখালেখির সময়টুকুতে দেশের নাগরিকদের মানসিকতার যতটুকু চিত্র দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তাতে পরিবর্তন বলতে গেলে নগন্য। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, বৃত্তের এক বিন্দু থেকে শুরু করে আবার সেই একই বিন্দুতে এসে থমকে দাঁড়িয়েছি। পরিবর্তন আকস্মিক হয়না সত্যি কিন্তু পরিবর্তনে অনিচ্ছুক একটি সমাজ ও তার নাগরিকেরা কি কখনও পরিবর্তনকে ভাল চোখে দেখে কিনা এই প্রশ্নটা হয়ত আমরা এড়িয়ে গেছি বারবার, হয়ত কিছুটা ইচ্ছে করেই।

ডঃ অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের একমাস একদিন পূর্ণ হল। তদন্তের গ্রহণযোগ্য অগ্রগতি শুন্য। ঢাকার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র টিএসসির মত একটি জায়গায় অসংখ্য মানুষের সামনে দুজন মানুষের উপর এমন নৃশংস হামলা, অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু, তাঁর সহধর্মিণী বন্যা আহমেদের গুরুতর শারীরিক আঘাত, পরবর্তী রাজনৈতিক-সামাজিক নাটক এবং কিছু নপুংসকের উদ্দাম নৃত্য, কোন কিছুই কি আমাদের সমাজকে সামগ্রিকভাবে নাড়া দিয়েছে? কিংবা এই ঘটনার কোন অংশ কি একেবারেই নতুন? উত্তরটা কিন্তু 'না'। প্রায় একই জায়গায় বছর ১১ আগে অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদের উপর মৌলবাদী হামলার পরবর্তী রাজনৈতিক-সামাজিক নাটকও কিন্তু প্রায় একই ঘরানার ছিল। এইভাবেই মুখোশের পেছনের আসল চেহারাটা দেখিয়ে দিতে দ্বিধা বোধ করেনি আমাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অঙ্গনের অগ্র্যগন্যরা। ১১ বছর ধরে তাহলে মানসিকতার ঠিক কোন উন্নতিটা আমাদের মনে আশা যোগায়? শাহবাগ আন্দোলনের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করতে খুব বেশি কিছু কি প্রয়োজন ছিল? ব্লগার রাজীব হায়দারের হত্যাকাণ্ডের পরেও যে ঘটনাপ্রবাহ, খুব কি পার্থক্য ছিল তাতে? দেশের অধিকাংশ নাগরিকের মানসিকতা ঠিক কোন বিষয়ে এসে তাদের সাম্প্রদায়িক রূপের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় সেটা আমরা সবাই জানি। এই মানসিকতার কোন পরিবর্তন আসেনি বরং এর আগ্রাসন বৃদ্ধি পেয়েছে আশঙ্কাজনকভাবে।

বন্যা আহমেদ কিংবা ডঃ অভিজিৎ রায় এর বাবা অধ্যাপক অজয় রায়ের ভাষ্যে বারবার উঠে এসেছে সেই রাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্বে অবহেলা এবং আশেপাশের মানুষের নির্বিকার উপস্থিতির কথা। হত্যাকারীরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করার পরেও রক্তাক্ত দুজন মানুষকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে মানুষের মনে যে দ্বিধা এর পেছনের কারন কি? মানবিক দিক বিবেচনা করলে, আমাদের সামাজিক অবস্থানটা ঠিক কোথায়? শুধু তাই না, এই হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিকভাবে সরকারের যে অস্বাভাবিক নিরবতা তা কি আমাদের সামাজিক অবনতির দিকেই নির্দেশ করেনা!

রাজনৈতিক অঙ্গনে কিংবা সাধারণ নাগরিকদের মাঝে যে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্যনীয় ছিল তা আর যাই হোক একটি সুস্থ সমাজের উদাহরন বহন করে না। একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে যখন গুটিকয়েক মানুষ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত তখন সরকারী দলের পেইড অনলাইন স্ট্যাটাসবাজ থেকে শুরু করে আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সবাই ব্যস্ত ছিল এই ঘটনার থেকে চোখ অন্যদিকে সরিয়ে নেয়ার কিংবা এই ঘটনাকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার। শুধুমাত্র তাই না, ডঃ অভিজিৎ রায় এর ব্যাক্তিগত এবং চারিত্রিক নানা বিষয় নিয়ে জঘন্য বিশ্লেষণে পর্যন্ত কুণ্ঠাবোধ করেনি কিছু অমানুষ। সামাজিক অবক্ষয়ের মানদণ্ডে ঠিক কতটা পচে গেলে মানুষ নিজের নুন্যতম মনুষ্যত্ববোধ হারিয়ে ফেলে এই বিষয়ে কোন গবেষণা হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমাজ নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার উদাহরন হবে বৈকি। আমাদের মৌসুমি মানবিকতার ঝাণ্ডা ধর্ম-বর্ণ-জাতি-সংস্কৃতি এরকম হাজারো বিভক্তির কাছে বন্দি। মানবিকতা শব্দটিই আমাদের দেশে ফালতু।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক অজয় রায়ের একটা কথা তাই তিক্ত সত্য হিসেবেই থেকে যায়, 'অভিজিৎ মারা গ্যাছে তো কি হইছে, ও তো আমার কেউ না, দায়টা তার বুড়া বাপের'।

সেকুল্যার চিন্তাবিদ এবং আলোর পথের মানুষগুলোর বিরুদ্ধে একের পর এক হামলা, বাক-স্বাধীনতা এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার বিরুদ্ধে একের পর এক আঘাতকে নীরবে সায় দিয়ে গেছে এদেশের অধিকাংশ মানুষ। মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িক চর্চা শুধু রাজনৈতিকভাবেই নয় সামাজিকভাবেও সমর্থনপুষ্ট আমাদের দেশে। একটি দেশ সম্পূর্ণ হয় তার নাগরিকদের নিয়ে, আর সেই নাগরিকদের মানসিকতা নির্দেশ করে সামাজিক উন্নতি কিংবা অবনতির, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের সাম্প্রদায়িক আগ্রাসী মনোভাব দেখলে ভাবতে বাধ্য হই আমরা একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী না হয়ে বৃহৎ জনগোষ্ঠী হলে কতটা ভয়ংকর পরিনতি অপেক্ষা করত পুরো পৃথিবীর জন্য।

বছরের পর বছর ধরে দেশের ভেতরে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, সন্ত্রাসী জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান হয়েছে সরাসরি সরকারী মদদে। আর এদের ব্যাপ্তির পেছনে আছে সামাজিক সমর্থন। তাই এই ধরনের খবরে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারন ২০১২ সালে লেখা এই ব্লগটিতে একই ধরনের আশঙ্কার ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছিল নানা সংবাদ মাধ্যম থেকে। ২০১৫ সালে এসে 'ইসলামিক বাংলাদেশ' এর স্বপ্নে বিভোর হওয়ার মাঝে আমি কোন সমস্যা দেখি না। কারন অনলাইন বিভিন্ন মাধ্যমে সাধারন মানুষের মন্তব্যে এমনিতেই 'বাংলাদেশ একটি ইসলামিক রাষ্ট্র' এই উক্তিটি নানাভাবে উঠে আসে। মৌলবাদীরা আমাদের সাধারন নাগরিকদের এই স্বপ্নকে বাস্তবায়নে এগিয়ে আসলে রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে সমর্থন পাবে বলেই আশা করা যায়। কারন এই খবর কিংবা এই স্ট্যাটাসের মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দেয় ঠিক কতটা পরিকল্পিতভাবে 'এথিনিক ক্লিন্সিং' কে সমর্থন দিয়ে গেছে সমাজের অধিকাংশ মানুষ এবং মদদ দিয়ে গেছে রাষ্ট্রযন্ত্র। তাই পাহাড়ে ফি বছর সরকারী এবং সামরিক মদদে উচ্ছেদ অভিযান চলে, যার কারনে কিছুদিন আগেও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়ের পরিস্থিতি আরও একবার। শুধু পাহাড়েই না, মুক্তিযুদ্ধের পরে মূল জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ সনাতন ধর্মালম্বী ৪৪ বছর পরে হয়ে যায় ৮ থেকে ৯ শতাংশ সমগ্র দেশজুড়ে। আবার এভাবেই মায়ানমারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিক্রিয়া রামুর সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের জন্ম দেয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিত্য ঘটে চলা এধরনের নির্যাতন নিপীড়নের ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের অধিকাংশ নাগরিক নীরব। তাদের নীরবতা আর যাই হোক কোন সুস্থ ভবিষ্যতের দিকে নির্দেশ করে না।

হেফাজতে ইসলামের মত জঙ্গি সাম্প্রদায়িক দলকে সরকারীভাবে তোষণ, সমাজে মৌলবাদী গোষ্ঠীর উত্থানকে এড়িয়ে যাওয়া কিংবা ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠীর প্রতি সরকারী-বিরোধী দলের রাজনৈতিক সমর্থনের কারন কি শুধুই ভোটব্যাঙ্কের খেলা নাকি একইসাথে তা বাংলাদেশের নাগরিকদের একটা বড় অংশের সাম্প্রদায়িক মানসিকতার প্রতিফলন মাত্র? সরকার যদি দেশের নাগরিকদের মতামতের প্রতিফলন হয় তাহলে সরকারের কার্যক্রমে আমি অবাক হওয়ার কোন কারন দেখিনা, সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রতিবিম্ব দেখি মাত্র। তাই যেই পরিবর্তনের ধারনা থেকে প্রগতিশীল দলকে ক্ষমতায় আনা হয়েছিল সেই প্রগতিশীল দলটিই মৌলবাদের কাছে অসহায় আর্তসমর্পণ করেছে বারবার। এটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয় এটা সামগ্রিকভাবে আমাদের সামাজিক ব্যর্থতা। পাকিস্তানের শোষকযন্ত্রের থেকে রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতার অর্জন, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন, সেই পথ থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৪৪ বছর পরে অনেকটাই সরে এসেছে আমাদের সমাজ।

দেশের নানা জনগোষ্ঠীর মানুষের বিরুদ্ধে লাগাতর নির্যাতন, ধারাবাহিক এথিনিক ক্লিঞ্জিং, পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িকতার চর্চা, মৌলবাদের উত্থানে প্রত্যক্ষ সামাজিক ও রাজনৈতিক মদদ, সেকুল্যার চিন্তা এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে লাগামহীন আঘাত তাই বারবার মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা অর্জনের থেকে রক্ষা করা অনেক বেশি কঠিন।

এই কঠিন কাজটার দায়িত্ব যেসব মানুষ কাঁধে তুলে নিতে চেয়েছিল, তারা খুব অসময়ে হারিয়ে গেল। আমাদের আলোর মশালগুলো স্তিমিত হতে হতে নিভে যাচ্ছে খুব দ্রুত।


মন্তব্য

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

চারদিকে কেবলই হতাশার গল্প!

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অরফিয়াস এর ছবি

হতাশার কারন আশা করি বুঝে গেছেন, এই ব্লগটা লেখার কদিন পরেই আরও একজনকে মেরে ফেলল মৌলবাদীরা।

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

শাহীন হাসান এর ছবি

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক অজয় রায়ের একটা কথা তাই তিক্ত সত্য হিসেবেই থেকে যায়, 'অভিজিৎ মারা গ্যাছে তো কি হইছে, ও তো আমার কেউ না, দায়টা তার বুড়া বাপের'।

আমাদের আলোর মশালগুলো স্তিমিত হতে হতে নিভে যাচ্ছে খুব দ্রুত।

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

অরফিয়াস এর ছবি

মন খারাপ

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

এক লহমা এর ছবি

... ... ... ... 'অভিজিৎ মারা গ্যাছে তো কি হইছে, ও তো আমার কেউ না, দায়টা তার বুড়া বাপের' ... ... ... ... উদাসীনতার, নিস্পৃহতার অন্ধকার গভীর থেকে গভীরতর

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অরফিয়াস এর ছবি

উদাসীনতার, নিস্পৃহতার অন্ধকার গভীর থেকে গভীরতর

মন খারাপ

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অরফিয়াস এর ছবি

কি আর বলার আছে!

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।