গ্রন্থমেলা ডায়রি: ছয় বছর পর

অমিত আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন অমিত আহমেদ (তারিখ: রবি, ০৩/০২/২০০৮ - ২:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অমর একুশে গ্রন্থমেলা ডায়রি
২ ফেব্রুয়ারি ২০০৮

আজ "জাগৃতি প্রকাশনী"-র অফিসে যাবার কথা সাত সকালে। "গন্দম"-এর ফাইলাল প্রুফ দেখে দিতে হবে। তা-না হলে বই প্রিন্টে যেতে পারছে না। কাল সারা রাত রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছে কেটে গেছে। সেই গল্পগুলোর গুচ্ছপ্রভাবে আজ ঘুম থেকে উঠে দেখি দুপুর দু'টো বাজে।

তড়িঘড়ি করে হাত মুখ ধুয়ে খাওয়া-দাওয়া করতে করতে আবিষ্কার করি বাবা-মা সারাদিনের জন্য বাইরে গেছে। এদিকে আমার পকেটে নেই ফুটো পয়সাও। ইচ্ছে ছিলো মা'র কাছ থেকে টাকা নিয়ে তবে বাইরে বেরুবো। বিপদ যেদিন আসে সব দিক থেকেই আসে। এরই মাঝে জানা গেল আমাদের দু'টো গাড়ির একটিও নেই। বিমর্ষ মুখে শিবলীকে কল দেই। বাংলাদেশে আমার সেরা বন্ধু। এই "গন্দম"-এর জন্য আমি যতোবার আজিজে মার্কেটে গিয়েছি আমাকে সঙ্গ দিতে সাথে ছিলো শিবলী সাদিক শোয়েব। জানা গেলো তার গাড়িটিও নাকি বাইরে গেছে এবং তারও পকেটের অবস্থাও অনুরূপ।

নানান ফ্যাকড়া করে কিছু টাকার যোগান হয়। বিকেলের দিকে পৌঁছুই আঁতেল পাড়ায়। সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই প্রুফ দেখার কাজ হয়ে যায়। আমার ইচ্ছে ছিলো একেবারে পাঁচ তারিখে মেলায় যাবো। ততদিনে সব স্টল সাজানো শেষ হয়ে যাবে। নতুন বইগুলোও চলে আসবে। কিন্তু আজিজ থেকে বেরিয়ে ভাবলাম এলামই যখন বইমেলাটা দেখে যাই।

এই বইমেলা নিয়ে নানান স্মৃতি আর স্বপ্ন আমার মনে লালিত আছে। সেগুলো এখন না হয় না-ই বলি। তবে মোদ্দা কথা হলো এই মেলাটি নিয়ে আমার আবেগের একটু বাড়াবাড়ি আছে। বইমেলার হতে আমাদের দূরত্ব রিকশাওয়ালা কমিয়ে আনতে না আনতেই আমার রক্তপ্রবাহ জলচ্ছাসে রূপান্তরিত হতে যায়। বন্ধু পাশে বলে আমি একটা নির্লিপ্ত ভাব ধরে রেখে সেই ছেলেমানুষী আবেগটা চাপা দেবার চেষ্টা করি। বইমেলার একদম দ্বারপ্রান্তে এসে রিকশা থামে। বিস্ময়কর ব্যাপার।

সেই ছ'বছর আগে শেষ যেবার বইমেলায় আসি তখন পর্যন্ত দেখেছি গেট থেকেই ফেরিওয়ালা আর খাবার দোকানের দাপট। ভিড় সেখানেই বেশি হতো। আর সেই ভিড়ের জন্য টিএসসি-তে এসেই রিকশা ছেড়ে দিতে হতো। বাকিটা পথ যেতে হতো জনসমুদ্রে সাঁতার কেটে। এখন বাইরে খাবার দোকান তো নেই-ই সেই সাথে ফেরিওয়ালার দাপটও প্রায় নেই বললেই চলে। এটি আবার বইমেলা জমে ওঠার সাথে সাথে বদলে যাবে না তো?

প্রবেশ গেটেও চমক। ড়্যাব সদস্যরা সামরিক সাজে দাঁড়িয়ে আছেন। যেতে হলো মেটাল ডিটেক্টরের মধ্য দিয়ে। বেশ কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এটাও বেশ ভালো লাগলো। আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় এ নিরাপত্তার দরকার আছে। বইমেলা ধূমপান মুক্ত। আমি শেষ বার যখন এসেছিলাম তখনো মনে হয় বইমেলা খাতা-কলমে ধূমপান মুক্তই ছিলো? তবে মানুষের সচেতনতা বেশ বেড়েছে দেখলাম। প্রকাশ্যে ধূমপানরত কাউকেই আমার চোখে পড়েনি। সচেতনতা যে সব ক্ষেত্রে বাড়েনি তারও নিদর্শন পেলাম। কিছু দূর পর পর ময়লা ফেলার বিন থাকলেও সবাই নিদ্বিধায় ময়লা ফেলছে এখানে সেখানে।

মেলার দ্বিতীয় দিন বলে আমার ধারনা ছিলো মেলা থাকবে শূণ্যপ্রায়। এ ধারনাটা সম্পূর্ণ ভাবেই ভুল প্রমানিত হলো। স্টল প্রায় সবই বানানো শেষ। দর্শনার্থী কিংবা ক্রেতাদের সমাগমও যথেষ্ট পরিমানেই ছিলো। অনেকের হাতেই বইয়ের প্যাকেট দেখেছি। ধূলোও তেমন ছিলো না। তবে দর্শনার্থী-ক্রেতা বাড়ার সাথে সাথে ধূলো বাড়বে কী-না সেটাই এখন দেখবার বিষয়।

মেলায় স্টলের সংখ্যা কমেছে। এটিও আমার কাছে শুভ পদক্ষেপ বলে মনে হয়েছে। শুনলাম প্রকাশক ছাড়া আর কাউকেই নাকি এখন স্টল দেয়া হয় না। আর স্টলেও নাকি কেবল প্রকাশনীর বই রাখতে হয় (এ নিয়ম সম্ভবত আগেও ছিলো, কিন্তু কঠোর ভাবে পালন করা হতো না)। এটা ভালো লেগেছে কেননা আগে সব স্টলে ঘুরে ফিরে সেই একই বই দেখতে হতো। প্রচন্ড বিরক্তিকর। আর আবজাব হাজার স্টলের ফাঁকে কাঙ্খিত স্টলগুলোও আর খুঁজে পাওয়া যেতো না। এখন স্টলগুলোর মধ্যে বেশ আরামদায়ক দূরত্ব। হাঁটা চলার জায়গাও ভালো সুপ্রশস্ত।

নতুন বই তেমন আসেনি। পুরানো বইগুলোই সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পকেটে টাকা নেই আগেই বলেছি। টিপে টিপে হয়তো একটি কিংবা দু'টি বই কেনা সম্ভব। আমার জন্য ভালোই হলো। ঠিক করলাম সব স্টল ঘুরে "লিটলম্যাগ কর্নার"-এ "শুদ্ধস্বর" আর "শস্যপর্ব" স্টলে লীলেন আর আলবাব ভাইয়ের নতুন বইয়ের খোঁজ করবো। লিটলম্যাগ কর্নারে দেখলাম "শস্যপর্ব" থেকে বেরুনো আলবাব ভাইয়ের প্রথম গল্পের বই "বউ, বাটা, বলসাবান" স্বগর্বেই অবস্থান করছে। এখন কিনবো না পরে উনার উপস্থিতিতে স্বাক্ষর সহ কিনবো তাই ভাবতে ভাবতে ঠিক করলাম কিনেই ফেলি। প্রয়োজনে পরে না হয় আরেক কপি কেনা যাবে।

"শুদ্ধস্বর"-এ মাহবুব লীলেন ভাইয়ের বেশ ক'টি বই সাজানো। তবে সবই আগের। উনার নতুন বই এসেছে নাকি খুঁজছি এমন সময় কাঁধে কার যেনো হাত। দেখি স্ময়ং লীলেন ভাই মিটি মিটি হাসছেন। এই চান্স কোন গর্দভ হারায়? সঙ্গে সঙ্গে গত বইমেলায় প্রকাশিত লীলেন ভাইয়ের দূর্দান্ত ছোটগল্পের বই "নিম নাখারা" কিনে উনার স্বাক্ষর নিয়ে নিলাম। জানলাম নতুন বই আসবে আগামী সপ্তাহে। লীলেন ভাইয়ের বইয়ের সংখ্যা নেহায়তই কম নয়। ঠিক করি আগামী সপ্তাহে এসে উনার নতুন বইয়ের সাথে পুরানোগুলোও ঝোলায় পুরে ফেলতে হবে।

বইমেলা চলে রাত নয়টা পর্যন্ত। পৌনে ন'টার দিকে বেরিয়ে যাবার পথে দেখা হয় "শুদ্ধস্বর"-এর প্রকাশক আহমেদুর রশীদ ভাইয়ের সাথে। হাত মিলিয়েই বেরিয়ে যাই। লক্ষ্য করি বইমেলার প্রবেশদ্বার আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তার মানে কী প্রতিদিনই মেলা বন্ধ হবার আগেই প্রবেশদ্বার বন্ধ হয়ে যাবে? এ-তো কোনো কাজের কথা নয়! প্রথমদিন মেলা ভ্রমনে এই একটা জিনিসই কাছে আমার ভালো লাগেনি।

© অমিত আহমেদ


মন্তব্য

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

কুইক বর্ণনা ভালো লাগলো। বইমেলার সচিত্র পোস্ট যদি প্রতিদিন অন্তত ১ টা করে পাওয়া যেত!

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

নিঘাত তিথি এর ছবি

হঠাৎ সকালে ঘুম ভাঙ্গায় ব্লগে ঢু মেরেছি, দেখি ব্লগে "বইমেলা" চলে এসেছে। এই পোস্ট না পড়ে পারা গেলো না...
গত আট বছরে এই প্রথম আমি একুশে বইমেলায় যেতে পারছি না, এই দুঃখে আমার মোটামুটি মাথা খারাপ অবস্থা। প্রতিদিন এই ডায়েরীটি লিখবেন প্লিজ!

লেখা ভালো হচ্ছে, খুব। তবে এক প্রকাশনীর বই আরেক প্রকাশনীতে না দেবার নিয়ম তো তিন বছর আগে প্রথম শুরু হয়েছিলো, তখন মানা হয় নি। এবারও আর কিছুদিন পরে ওটা মানা হবে না বলেই আমার বিশ্বাস! কড়া চেকিং-ও চলছে বছর তিনেক ধরেই, তবে এবার নাকি দুই টাকার টিকেট কাটতে হচ্ছে? সত্যি? আর প্রবেসদ্বারের সামনে ফেরীওয়ালা, খাবার দোকান না থাকলে কেমনে হবে? এত টিপটপ হলে বইমেলা জমে??
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

অমিত আহমেদ এর ছবি

নাহ, বাংলা একাডেমী প্রথমে বলেছিলো টিকেট কাটতে হবে। সে টিকেটের টাকা দিয়ে নাকি তারা গবেষণা করবে। পরে সবার যৌথ ঝাড়িতে তারা সে পরিকল্পনা ত্যাগ করেছে। টিকেট নাই হাসি

ডায়রীতে মোটামুটি নিয়মিত ভাবেই এন্ট্রি দেবার চেষ্টা করবো।

বাইরে খাবারের স্টল নেই। তবে ফেরীওয়ালা নেই বললে ভুল বলা হবে। আছে, তবে আগের মতো বাড়াবাড়ি রকম ভাবে নেই। এই আজকেই তো বইমেলা থেকে টিএসসি আসতে আসতে পেটিস, ভাঁপা পিঠা, পাঁপড়, বড়ই এর আচার আর ভেলপুরি খাওয়া হয়ে গেলো দেঁতো হাসি


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

সুজন চৌধুরী এর ছবি

আচ্ছা দাদা,
টিএসসির সামনে যে চিংড়ি মাছের ভাজা মাথা পাওয়া যেতো সেটা কি
আছে?
আর রাজু চত্তরে যে সারাদিন মাইকে কবিতা চলতো 'তাহের তাহের বলে ডাকি" সেটা?
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এই চিংড়িটা আমি শুধু বইমেলার সময়ই খাই
মেলা থেকে বের হবর সময়
এবছর এখনও খাইনি। তবে আছে

সুমন চৌধুরী এর ছবি

তাহের তাহের না "তহের তহের" হাসি ১৯৯৩,৯৪,৯৫ একটানা চলছে...



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

অমিত আহমেদ এর ছবি

আজ সময় স্বল্পতায় সেভাবে বই দেখতে পারিনি। এ বিষয়ে আগামীকাল খোঁজ নিতে হবে তো!


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

কেমিকেল আলী এর ছবি

কতদিন যাওয়া হয় না বই মেলায়!!
আফসোস!!

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

অরূপ ভাইয়ের স্টাইলে একটা ভিডিও ট্যুর তৈরি করেন বইমেলায়। ঘোলে সুখী হই!! তবে, এই দফা মিলার গান ছাড়াও চলবে। রহিম মিয়া হইতে হইতে ক্লান্ত! খাইছে

কত্ত যুগ হয় বইমেলা দেখি না!

অমিত আহমেদ এর ছবি

করবো করবো... মেলাটা একটু জমে উঠুক আগে।


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

মাহবুব লীলেন এর ছবি

বই যেখান থেকেই বের হোক না কেন
প্রথম বই প্রকাশের উচ্ছাস কিন্তু লিটলম্যাগ চত্বর ছাড়া অন্য কোথাও ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারবেন না
তাই চলে আসেন এখানেই

অমিত আহমেদ এর ছবি

এটা এবারই প্রথম এভাবে অনুভব করলাম লীলেন ভাই!


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

অমিত:
যতদিন বই মেলায় যাবে, প্রত্যেকদিন এরকম একটা তরতাজা বিবরণ চাই।

অমিত আহমেদ এর ছবি

চেষ্টা করবো ফর সিওর হাসি


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।