ভুতুড়ে পোড়াবাড়ি তদন্তের অকাল মৃত্যু

অমিত আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন অমিত আহমেদ (তারিখ: সোম, ১৭/০৩/২০০৮ - ২:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তখন সবে সেভেনে উঠেছি। আমি, আমার ছোট ভাই সমিত আর চাচাতো ভাই অনিককে নিয়ে ‘তিন গোয়েন্দা’-র আদলে একটা গোয়েন্দা দল খুলেছি। নাম দিয়েছি ‘গোদল’। মানে গোয়েন্দা-দল। দুষ্টু বন্ধুরা অবশ্য এর অন্য মানে করতো। (এ বিষয়ে লিখেছিলাম এখানে)।

‘গোদল’ এর তখন বড়ই দূরাবস্থা। দেয়ালে মাথা ঠুকেও একটা কেস পাচ্ছিনা। এমন সময় সুখবর।

আমাদের স্কুলের কাছেই একটা পরিত্যক্ত বাড়ি ছিলো। একতলা লাল রঙের বাড়ি। চারপাশে বড় দেয়াল তোলা। ঢোকার দ্বারটা লোহার, যেটা সব সময় বন্ধ থাকে। সেই দ্বারের ফাঁক দিয়ে ভেতরটা কিছু দেখা যায়। দেয়াল থেকে বাড়ির মাঝের জায়গাটুকু বড় বড় ঘাস আর জংলা গাছে ভর্তি। খবর পাওয়া গেল সে বাড়িতে নাকি ভূতের উপদ্রব। ইদানিং অনেকেই দেখেছে।

শুনে আমি আনন্দে বাকবাকুম। অবশেষে একটা রহস্য পাওয়া গেল। সমিত তখন একই স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ে। বিপদজনক কাজ বিবেচনা করে শত আপত্তি সত্ত্বেও তাকে প্রথমেই তদন্ত থেকে বাদ দেয়া হলো। অনিক পড়ে অন্য স্কুলে। তাই সেও বাদ। আমি নিজেকে ‘কিশোর পাশা’র সমকক্ষ বলেই ভাবতাম। তাই দলের অন্য সদস্যদের অনুপস্থিতি আমাকে খুব একটা কাতর করে তুললো না। আমি পকেটে নোটবুক পুরে তদন্তে নেমে গেলাম।

প্রথমেই জেরা করা হলো যারা এ গুজব ছড়াচ্ছে তাদেরকে। সবাই আমাদের ক্লাসেরই ছেলে। জেরায় জানা গেল তাদের কেউই নাকি ভৌকিকতার বিন্দুমাত্র আলামত সে বাড়িতে দেখেনি। তবে তাদের পরিচিত কেউ দেখেছে। জেরার কথা ক্লাসে ছড়িয়ে পড়তেই অতি উৎসাহী কয়েকজন আমার সাথে জুটে গেল। জেরার সময় আমার চেয়ে তাদের হুমকি-ধামকিই বেশি শোনা যায়। ‘ওই হাউয়া, চাপা মারছ না? ছাদের উপর সাদা কাপড় পড়া মাইয়া? ঘুরায়া চড় দিবো’ কিংবা ‘অত কাহিনী কে জানতে চাইছে? চোপা কম চালা! সাব্বির যা জিগাছে তার উত্তর দে।’ জেরা শেষে দেখা গেল এদের অনেকেই ‘গোদল’-এ যোগ দিতে আগ্রহী। এ নিয়ে অনেক বিতন্ডার ভূতে বিশ্বাস করে না বলে এক রুবেলকেই দলে নেয়া হলো।

রুবেলকে নিয়ে প্রথমিক জেরায় যারা যারা সরাসরি ভূত দেখেছে তাদের নাম ঠিকানা নোট করে নিয়ে প্রথমেই বয়স্ক মানুষদেরকে বাদ দিয়ে দিলাম। এ নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের পাড়ার মসজিদে গামছা চুরির একটা কেস নিয়েছিলাম। বড় হুজুরের লাল-সাদা চেক ইমামী গামছা নাকি প্রায়ই চুরি যায়। আমাদের তদন্তে হুজুরের প্রচন্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও এক পর্যায়ে বড়দের জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে পড়লাম ঝামেলায়। সবাই শুরু করলো হাসাহাসি। এরপর থেকে কানে ধরেছি বড়দের আর জেরা করবো না। সেই তদন্তের শেষটাও ভালো হয়নি। কেস হাতে নেবার দু’দিন পরেই হুজুর তাঁর শুকাতে দেয়া গামছা চুরিরত চোরকে হাতে-নাতে ধরে ফেললেন। সামান্য উত্তম-মধ্যমও দিলেন।

কাজের কথায় আসি। বড়দের লিস্টি থেকে বাদ দেবার পর মাত্র তিন জনের নাম থাকলো। অচেনা হলেও ওরা আমাদেরই সমবয়সী। তাই জেরায় কোনো সমস্যা নেই। আমি আর রুবেল তিনজনের বাসায় গিয়ে জবানবন্দী নিলাম। ওরা সবাই ভুতুড়ে বাড়ির পাশের উঁচু দালানে থাকে।

জবানবন্দী নেবার পর আমরা দেয়া তথ্য যাচাই করে নিলাম। একজনের জবানবন্দী প্রথমেই বাতিল হয়ে গেল। সে নাকি পড়ার টেবিল থেকে পোড়াবাড়ির ছাদে সাদা কাপড় পড়া ধোঁয়াশে নারীমূর্তি দেখেছে। দেখা গেল ওর পড়ার টেবিল থেকে সেই বাড়ির ছাদ দেখাই যায় না!

বাকি দু’জনের কথাও কম-বেশি একই রকম, কিন্তু প্রাথমিক যাচাইয়ে ওরা উৎরে গেল। সব চেয়ে কাজের কাজ হলো যখন এক ছেলে আমরা ওর কথা বিশ্বাস করছিনা সন্দেহ করে স্ময়ং ওর মা’কে পাওড়াও করে নিয়ে এলো। ভদ্রমহিলা মধ্যবয়স্কা। হাতে তসবিহ, মাথায় কাপড় দেয়া শান্ত সৌম্য চেহারা। উনি বললেন আসলেই নাকি সে বাসায় দোষ আছে। তিনি নিজেও সে বাড়ির ছাদে ছায়ামূর্তি দেখেছেন। ছেলে মারফৎ আমরা সেই পোড়াবাড়ি নিয়ে তদন্ত করছি জানতে পেরে উনি ব্যতিবস্ত হয়ে পড়লেন। আমাদের তিনি কোনো মতেই এই ভয়ংকর কাজ করতে দেবেন না। আমাদের তো শপথ করালেনই, আমাদের বাবা-মা’র সাথে কথা বলবেন বলে আমাদের ফোন নাম্বারও চেয়ে বসলেন। ‘বাসায় ফোন নেই’ ধরণের সস্তা মিথ্যে বলে সে বেলা পার পাওয়া গেল।

পরদিন এই জেরা... বিশেষ করে খালাম্মার প্রতিক্রিয়ার কথা ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে আমাদের ক্লাসে সাড়া পড়ে গেল। আগে যারা তদন্ত নিয়ে নাখ সিঁটকাচ্ছিলো তারাও তদন্তের অগ্রগতি জানার জন্য আমাদের দু’জনের পাশে হল্লা করতে লাগলো। যারা দলে যোগ দিতে চাচ্ছিলো তারা তো বটেই নতুন অনেকেই শুরু করলো দলে যোগ দেবার জন্য কাকুতি-মিনতি।

সে আবেদনে সাড়া না পেয়ে যা ঘটলো - মনা, রাজু সহ আরো কয়েকজন ঠিক করলো ওরা ওদের নিজেদের গোয়েন্দা দল খুলে ফেলবে। দল তৎক্ষনাৎ তৈরিও হয়ে গেল। নাম দেয়া হলো ‘দ্য ইয়াং ডিটেক্টিভস’। আমরা যে রহস্যের তদন্ত করছি ওরাও সেই রহস্যের তদন্ত করবে জানতে পেরে ওদের সাথে আমাদের ঝগড়া... পরে সামান্য হাতাহাতিও হয়ে গেল।

এদিকে ডরপোক টাইপের কয়েকজন ছেলে শুরু করলো আরেক বায়ানাক্কা। আমাদের নাকি এক্ষুনি এসব বাদ দেয়া উচিৎ। ভূত-পেত্নি না থাকলেও জীন আছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, আর তেমন দুষ্টু জীন হলে আমাদের বিশাল সর্বনাশ হয়ে যাবে সেটা অবধারিত। আমরা সেসব কথায় তেমন পাত্তা দিলাম না।

ক্লাস শেষে আরেক সমস্যা। পাঁচ-ছয়জন দোস্ত আমাদের কিছুতেই একা হতে দেবে না। আমরা একা একা একটা রহস্যের সমাধান করে সবার কাছে হিরো হয়ে যাবো এটা তারা কিছুতেই হতে দেবে না। আমরা ওদেরকে দলে নেই আর না নেই, ওরা আমাদের সাথে থাকবে। রহস্য সমাধান হলে তারাও সে গৌরবের ভাগীদার হবে। শেষে বাধ্য হয়ে ওদের সাথে একটা সমঝোতা করতে হলো। ওরা আমাদের সাথে থাকবে কিন্তু জেরার সময় একটা কথাও বলবে না। আর যদি তদন্তের কাজে কোনো বাসায় যাবার প্রয়োজন পড়ে তাহলে কেবল আমি আর রুবেল যাবো।

আমার সেদিনের পরিকল্পনা ছিলো পোড়াবাড়ির কোনো তত্ত্বাবধায়ক আছে নাকি সে খোঁজ নেয়া। সেটা শুরু করা হলো পাশের অফিসের দারোয়ানের কাছ থেকে। তত্ত্বাবধায়ক থাকলে তার সাথে পাশের অফিসের দারোয়ানের সখ্যতা থাকার একটা সম্ভাবনা আছে। অনুমান সঠিক হলো। জানা গেল বাড়িটা সরকারি আর তদারকি করার জন্য সরকার থেকে একজন লোক নিয়োগ দেয়া আছে। সে নাকি এখানে থাকে না। তবে মাঝে মাঝে এসে বাড়িটা দেখে যায়।

বাড়িতে ভৌতিক কোনো আলামত আছে নাকি সে কথা জিজ্ঞেস করতেই দাড়োয়ান গল্পের তুবড়ি ছোটালেন। বাড়িতে দোষ আছে সে বিষয়ে তার সন্দেহ নেই। রাতের বেলা সে বাড়ি থেকে নানান রকম আলো আসে, শব্দ শোনা যায়! এই তথ্যটা আমরা গতদিনের তদন্তে পাইনি। আমরা উত্তেজনায় টগবগ ফুটতে থাকি।

আরো জানা যায় আলো নাকি কেবল একটা কামরা থেকেই আসে। ভদ্রলোকের ধারণা সেই কামরাতেই কিছু একটা হয়েছিল যার কারণে প্রেতাত্মা সেটার মায়া কাটাতে পারছে না।

দারোয়ানের জবানবন্দী নেবার পর মনে হলো লোহার দ্বারের ফাঁকে চোখ রেখে বাড়িটা ভালো মত দেখে নেয়া দরকার। বিশেষ করে যে কামরা থেকে আলো আসে বলে জানানো হলো, সে কামরাটার জানালা গলে ভেতরে দৃষ্টি যায় নাকি সেটা দেখা গুরুত্বপূর্ণ।

বাড়ির কাছে গিয়ে দেখি বাড়ি থেকে নিরাপদ দূরত্বে একটা ভাঙা দেয়ালে দল বেঁধে ‘দ্য ইয়াং ডিটেক্টিভস’-এর সদস্যরা বসে আছে। আমাদের দেখে ওদের মুখে হাসি ফুটে। রুবেল আমার কানে কানে বলে, ‘শালাদের কোনো বুদ্ধি নাইক্কা। আমারা যা করুম তাই করবো... বুঝছোস? আমাদের জন্যই বইসা আছে।’ আমি গা লাগাই না। সোজা বাড়ির দিকে হাঁটা দেই।

এই ক’দিন আগে পর্যন্ত বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে আমরা ক্রিকেট খেলেছি। কিন্তু বোঝা গেল এখন প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। রুবেল ছাড়া আর কেউ আমার সাথে যাবার সাহস করলো না।

বাড়ির দ্বারের ফোকড় দিয়ে তাকিয়ে যতটা দেখা যায় দেখে নিলাম। দেখার তেমন কিছু ছিলো না। তবুও ‘দ্য ইয়াং ডিটেক্টিভস’-এর সভ্যদেরকে আমাদের সাহস দেখানোর জন্য আমরা সেখানে বেশ বড় একটা সময়ই নষ্ট করলাম। শুধু তাই নয়, ফিরে এসে ওদের দেখিয়ে এমন ভাবে হাত-পা নেড়ে আলাপ শুরু করলাম যেন ভেতরে খুব ভয়ংকর কিছু একটা দেখে ফেলেছি।

বাড়ির ভেতরটা দেখে করেকটা তথ্য পাওয়া যায়:

১) বাড়িতে দিনে হোক কিংবা রাতে, মানুষের যাতায়াত আছে। চারপাশে বড় বড় ঘাস থাকলেও দ্বার থেকে বাড়ি পর্যন্ত যাবার পথটা পরিস্কার। এটা হয়তো তত্ত্বাবধায়কের কারণে।
২) বাড়ির প্রতিটা জানালা শক্ত করে আটকানো। কাঁচ গুলোও নোংরা। তাই ভেতরে কি হচ্ছে তা পরিস্কার ভাবে দেখা সম্ভব না।
৩) বাড়িতে এখনো বিদ্যুত আর পানির সংযোগ আছে। বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে বৈদুতিক তার থেকে আলগা একটা সংযোগ পাশের ব্যাডমিন্টন কোর্টে গেছে। তার মানে এলাকার ছেলেরা সেখান থেকে বিদ্যুত চুরি করছে। আর বাড়ির পাশের একটা কল থেকে টপ টপ করে পানি পড়তে দেখেছি আমরা।
৪) বাড়ির ছাদে একটা গাছের কিছু অংশ নুয়ে পড়েছে। তার মানে আলো-আঁধারীতে সে গাছের ছায়া মানবাকৃতি নেয় তার একটা সম্ভাবনা আছে।

তদন্তের কাজ সেদিনের মতো শেষ করে বাসায় আসি। রাতে ফোনে কথা হয় রুবেলের সাথে। ঠিক হয় পরদিন আমরা দেয়াল টপকে বাড়ির ভেতরে ঢুকবো। দেখবো বাড়ির প্রধান দরজাটা খোলা কি-না। খোলা থাকলে সম্ভাবনা আছে নেশাড়ুরা সেখানে রাতের বেলা নেশা করে। আর বন্ধ থাকলে জানালার কাঁচে চোখ লাগিয়ে ভেতরটা দেখবো। হয়তো তত্ত্বাবধায়ক ব্যাটা সরকারি বাড়ির সেই রহস্যজনক রুমটা ভাড়া দিয়ে রেখেছে। বেআইনি ভাড়াটিয়া হয়তো রাতের আঁধারে যাওয়া আসা করে।

পরদিন স্কুলে গিয়ে দেখি আমাদের তদন্তে সবার আগ্রহ আরো বেড়েছে। ইমতিয়াজের সাথে কথা ছিলো তদন্তের কথা ও কাউকে বলবে না। কিন্তু ‘দ্য ইয়াং ডিটেক্টিভস’কে ভোদাই প্রমান করতে সেই কথার বরখেলাপ করে রুবেল ইতিমধ্যেই সবাইকে আমাদের গতদিনের অগ্রগতির কথা জানিয়ে দিয়েছে। আজকের পরিকল্পনার কথাও বাদ নেই।

ফলাফল যা হলো তা আমার হিসাবে ছিল না। গতদিনও যারা দলে যোগ দেবার জন্য এক পায়ে খাড়া ছিলো তারাও আমাদের কাছে এসে বললো, ‘দোস্ত যা ইচ্ছা কর কিন্তু ভেতরে যাইস না! কি-না কি হইয়া যাইবো।’ সবচেয়ে টাসকি খেলাম যখন ‘দ্য ইয়াং ডিটেক্টিভস’ এর দলনেতা রাজু আমার কাছে এসে বললো, ‘যাহ তুই জিতছস, হইছে? কিন্তু ভিতরে যাইস না দোস্ত। আল্লার কসম।’ আমি বললাম, ‘আমি কি জিতনের লাইগা তদন্ত করতাছি? একটা কাজ ধরছি, শেষ দেইখা ছাড়ুম।’

ক্লাসের সবার হঠাৎ পরিবর্তনে সত্যি কথা বলতে কি আমি আর রুবেল একটু ঘাবড়েই গেলাম। আগে আমার মনোবল এমন ছিল - কেউ গেলে যাবে না গেলে নাই - আমি একাই দেয়াল টপকাবো। কিন্তু সবার ভয়ার্ত মুখ দেখে আমার মনে হতে থাকে সাথে কেউ গেলে মন্দ হয় না। রুবেল যাবে না যাবে না করেও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে যায়। আর অবাক কান্ড। ‘দ্য ইয়াং ডিটেক্টিভস’ এর সদস্য, ক্লাসের অন্যতম ভীতু ছেলে হিসেবে পরিচিত, মনা এসে বলে আমরা যদি রাজি থাকি তাহলে সে আমাদের সাথে যেতে চায়! রুবেলের চাপে আমিও রাজি হয়ে যাই।

ক্লাস শেষে প্রায় অর্ধেক ক্লাস সঙ্গে নিয়ে আমরা পোড়াবাড়ির কাছে গেলাম। বাবা-মা-জনিত সমস্যা না থাকলে মনে হয় বাকিরাও আমাদের সাথে যেত। আমি, রুবেল আর মনা বাদে বাকি সবাই অবশ্য পোড়াবাড়ির সাথে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকে। দেয়ালের একটা অংশ সামান্য ভাঙা ছিলো। সেখানে কাঠের বাক্স ধরনের কিছু একটা রেখে আমি প্রথমে উঠে দাঁড়ালাম। মনা ছিলো তোতলা। সে তোতলাতে তোতলাতে কোনো এক অজানা সূরা পড়া শুরু করলো। সূরা শেষ না করে ও আমাদের কিছুতেই ওপাশে যেতে দেবে না। এই বিশেষ কাজের জন্যই নাকি সূরাটা মুখস্থ করা হয়েছে। এখন বলতে বাঁধা নেই, বেচারার উচ্চারণ জনিত সমস্যার কারণে সেই সূরা পাঠের প্রহর অসম্ভব রকমের দীর্ঘই হলো।

দূরে দাঁড়ানো কয়েকজন বন্ধু ততক্ষণে বুঝে গেছে আমরা আসলেই ওপাশে যাবো। ওরা শুরু করলো অনুরোধ, ‘দোস্ত, যাইস না... যাইস না দোস্ত... এখনো সময় আছে।’ আমি দেয়ালে দু’হাতে ভর করে লাফ দিয়ে ওপাশে লাফ দিলাম।

ওপাশে কোমড় পর্যন্ত ঘাস হয়ে আছে। মাসুদ রানা শিখিয়েছে যে কোনো জায়গায় গিয়ে আগে পালানোর রাস্তাটা দেখতে হয়। দেখলাম দেয়াল থেকে খসে পড়া ইট গুলো ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে পড়ে আছে। সেগুলো জড়ো করে উপরে দাঁড়িয়ে সহজেই দেয়াল টপকে যাওয়া যাবে। আমি ইট গুলো জড়ো করতে করতে মনা-রুবেলও এপাশে চলে আসলো।

রুবেল এপাশে এসেই কেমন যেন আড়ষ্ঠ হয়ে গেল। মুখ ফ্যাকাশে, হাত কাঁপছে থর থর করে। আমি ওকে দেখে একটু ভয়ই পেয়ে গেলাম, ‘দোস্ত, ঠিক আছস?’
‘হ! লাফ দিয়া একটু ব্যাথা পাইছি। আমি এখানেই থাকি।’
মিথ্যে বলছে বুঝতে পেরেও আমি আর কথা বাড়ালাম না।

অন্যদিকে ভীতু মনার সাহস দেখে অবাক হলাম। সে আমাকে বাদ দিয়েই বাড়ির কাছে গিয়ে দরজা টানাটানি, জানালা দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি শুরু করে দিয়েছে। আমি হেঁটে গিয়ে কেবল জানালায় চোখ রেখেছি কি রাখিনি... হঠাৎ... আমাকে চমকে দিয়ে শুরু হলো রুবেলের পৈচাশিক চিৎকার! চিৎকার শুনেই আমার অন্তরাত্মা মোটামুটি খাঁচা ছাড়া হয়ে গেছে। পেছনে তাকিয়ে দেখি রুবেল ঘাসের মাঝে কোনো এক অজানা জায়গায় আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে ভয়ার্ত চিৎকার করছে।

দুপুর বেলা। আকাশে তখনো সূর্য। জনবহুল ঢাকা শহরের মাঝে একটা বাড়ি। কিন্তু হঠাৎ করেই আমার মনে হলো আমরা যেন সম্পূর্ণ চেনা জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। একটা পোড়াবাড়ি। চার পাশে ঘন ঘাসের জঙ্গল। মৃদু হাওয়ার সেই ঘাসে নদীর স্রোতের মতো স্রোত বয়ে যাচ্ছে। আমরা দু’জন সেই পোড়াবাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে। আর ওদিকে রুবেল চোখে মুখে এক বিভৎস আতংক নিয়ে ঘাসের মাঝে অজানা কিছু একটা আমাদের দেখাতে চেষ্টা করছে। হঠাৎ করেই আমার মনে হলো এখন কিছু একটা ঘটবে, ভয়ংকর কিছু একটা।

কিন্তু কিছু যে করবো তার ক্ষমতা নেই। হঠাৎ করেই পা জমে গেছে বরফের মত। আমার পাশে মনারও একই অবস্থা। ঠিক সেই সময় ঘাসের যেখানে রুবেল আঙ্গুল তুলে দেখাচ্ছিল সেখানটা হুড়মুড় করে নড়ে উঠলো।

এরপরের ঘটনা গুলো মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে গেল। প্রচন্ড একটা চিৎকার দিয়ে দেয়ালের দিকে ছুট দিল মনা। বাড়ি আর দেয়ালের ঠিক মাঝখানে এসে পড়ে গেল হুড়মুড়িয়ে। মনাকে পালাতে দেখে রুবেলও মনে আলাদা বল পেয়েছে। সেও চরম উদ্যমে লাফিয়ে পড়লো আমার সাজানো ইটের স্তুপের উপরে। স্তুপটার গাঁথুনি হয়তো তেমন শক্ত করতে পারিনি, কিংবা হয়তো রুবেলের লাফের ভয়াবহতার কারণেই, ইটের স্তুপ ছিন্নভিন্ন করে রুবেলের এক পা পিছলে নেমে গেল অর্ধেকটা। রুবেল কোনো এক অজানা কৌশলে ওর লেছড়ে পড়া দেহটা নিয়েই হাঁচড়ে-পাঁচড়ে দেয়ালের ওপাশে চলে গেল।

ভয়ে মানুষ যে কি করতে পারে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখলাম। দেয়ালের উচ্চতা নেহায়তই কম ছিলো না। ইটের স্তুপ ছাড়া নাগাল পাওয়ার কথা না। কিন্তু মনা মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে, নিমিষে দৌড়ে কিভাবে যেন এক লাফে দেয়ালের ওপাশে চলে গেল। দু’জনে তখনো চিৎকার করে যাচ্ছে।

ওদের চিৎকার শুনে আমার মধ্যেও কি যেন হয়ে গেল। আমিও কিভাবে, জানিনা, নিজেকে আবিষ্কার করলাম ওপাশে, ওদের সাথে ভোঁ ছুট লাগাচ্ছি। আমাদের তিনজনকে এভাবে অপ্রকৃতস্থের মত ছুটতে দেখে ক্লাসের অন্যরাও ভড়কে শুরু করলো উলটো দিকে দৌড়।

এর পরের কাহিনীটা বেশ করুণ।

সবাই দৌড়ালাম যতক্ষণ না মনে হলো আমরা নিরাপদ। এরপর অর্ধেক ক্লাস মিলে কোনো এক রাস্তার পাশে হাঁফাতে লাগলাম হাপড়ের মত। আমি তখনো জানি না আসলে হয়েছেটা কি। আমার মতো বাকি সবারও একই প্রশ্ন। কিন্তু রুবেল একদম বোবা হয়ে গেছে। একটা কথাও বলছে না। কেমন ফ্যালফ্যালে চোখে দূরে তাকিয়ে আছে, আর মাঝে মাঝে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠছে।

মনাকে জিজ্ঞেস করেও একেকবার একেক উত্তর পেলাম। একবার বলে সে নাকি দেখেছে ঘাসের মাঝে একপাটি রক্তাক্ত দাঁত। আর কিছু না। কেবল এক পাটি দাঁত। রক্তাক্ত। সেই দাঁত কট-কট শব্দ করছে। যেন কিছু একটা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। আরেকবার বলে সে নাকি দেখেছে ঘাসে হামাগুড়ি দিয়ে আসছে বিকৃত কুঁকড়ে থাকা বিভৎস একটা দেহ।

আমি দেখিনি কিচ্ছু।

সেখানেই কাটালাম সবাই আধা ঘন্টা।

ক্লাসের সবাই মিলে যখন হল্লা করছে, ‘আগেই কইছিলাম’, ‘এইবার আল্লা বাচাইছে’, ‘মনা সূরা পড়ছিলো দেইখা কেবল রক্ষা’, ‘মসজিদে দশটা টাকা দিয়া দিস’, আইজকা বাসায় গিয়া দুই রাকাত নফল নামায পড়িস’ তখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আমি আবার পোড়াবাড়ির ভেতরে যাবো। এক্ষুনি। এর শেষ আমাকে দেখতেই হবে।

পরিকল্পনা শুনলে আমাকে যে ওরা কেউ যেতে দেবে না সেটা ভালো মতই জানা ছিলো। তাই সবাইকে ফাঁকি দিয়ে আমি এক ফাঁকে শুরু করচছি উলটো দিকে হাঁটা। কিছু দূর গিয়েছি কি যাইনি, তাকিয়ে দেখি একদল বন্ধু তেড়েফুঁড়ে আমার দিকে দৌড়ে আসছে। ওদের দেখে আমিও শুরু করেছি দৌড়। লাভ অবশ্য হয়নি। আমার কোনো কথা না শুনে, আমাকে প্রায় চ্যাংদোলা করে আগের জায়গায় নিয়ে আসে সবাই। ওদের কথা আমাকে নাকি জীন ডাক দিয়েছে।

এতক্ষণ সবার চোখ মনা-রুবেলের দিকে ছিলো। এবার আমাকেও ওদের সাথে বসানো হয়। আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছি আমি। আমাকে স্ময়ং জীন ডেকে নিয়ে যাচ্ছিলো। এর চেয়ে উত্তেজক আর কি হতে পারে! ‘সাব্বির, আসলে কি হইছে ক তো?’, ‘তুই কি কোনো ডাক শুনছিস?’, ‘কেউ কি নাম ধরে ডাকছে তোরে?’, ‘হ! কিছু না শুইনাই তুই এমনি দৌড় শুরু করছস...’ সবাই ভয় আর অবিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

সর্বসম্মত ভাবে সিদ্ধান্ত হয় আমাদের তিনজনকে আজ একা ছাড়া হবে না। আমাকে নিতে গাড়ি আসতো। একদল আমাকে জাবড়ে ধরে গাড়িতে তুলে দেয়। বাকিদের একদল যায় রুবেলকে বাসায় পৌঁছে দিতে, আরেকদল মনাকে।

বাসায় পৌঁছে খাওয়া দাওয়া হতে না হতেই আম্মুকে রুবেলের মা’র কল। রুবেলের নাকি কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। এখনো কোনো কথা বলছে না। চাচী নাকি ফোনে কান্না-কাটিও করেছেন। বাসা থেকে লোক পাঠিয়েছেন মসজিদে, পানি পড়ার জন্য। এসবের পেছনে যে আমি সে কথাটাও বলতে বাকি রাখেননি।

আম্মুও ভয় পেয়ে যায়। ভয় পাবারই কথা। ছেলে নিজের পরিচয় ভুলে বসেছিলো। ভূতগ্রস্থের মত কার যেন ডাক শুনে অজান্তে শুরু করেছিলো ভুতুড়ে বাড়ির দিকে দৌড়। এসব শুনে যে কোনো মা মাত্রেই ভয় পাবেন।

আমাকে তখন আরবি পড়াতে হুজুর আসতেন। সেই হুজুরকে কাহিনী বিস্তারিত জানানো হলো। উনি কি সব দোয়া পড়ে আমাকে ফু দিয়ে দিলেন। সেদিন আর পড়া হলো না। কেবল আমি যে কতটা বোকা, কতটা গর্দভ সেটাই ঘুরে ফিরে জানানো হলো। মা নামায-টামায পড়ে একাকার করলেন। শপথ করালেন আমি যেন আর ওই দিকে না যাই। এমনকি রাতে খাবার টেবিলে আব্বু পর্যন্ত বললেন, ‘বেশি সাহস দেখানো ভালো না।’

এরপরের কয়েকটাদিন মনা আর আমি, আমাদের দুইজনকেই নজরে নজরে রাখা হলো। আমাদের মা আমাদের সাথে স্কুলে এসে বসে রইলেন। প্রচন্ড জ্বরের কারণে রুবেল অনেকদিন স্কুল কামাই দিলো। ও যে আসলে কি দেখেছিলো সেটা রুবেল কোনোদিনই আমাদেরকে আর জানায়নি।

© অমিত আহমেদ

বিঃদ্রঃ বন্ধুদের সবার আসল নাম বদলে নকল নাম ব্যবহার করলাম।


মন্তব্য

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- রুবেলের দেখা সেই জিনিষটাই তাহলে বিরাট এক রহস্য হয়ে রয়ে গেলো অবশেষে!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

অমিত আহমেদ এর ছবি

আমার ধারণা ব্যাটা কিছুই দেখে নাই।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- বিশাল টাইপের কোনো ধেঁড়ে ইঁদুরের উঁচু ঘাসের জঙ্গলে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এটা বেস্ট কেইস। মানুষের সাড়া পেয়ে সেটা জানের ভয়ে গর্ত খুঁজতে গিয়ে রুবেলের সামনের ঘাস নাড়িয়ে দিয়েছে।

আর ওয়র্স্ট কেইসে সেটা হতে পারে একটা মাথামোটা ঢোঁড়া সাপ।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

অমিত আহমেদ এর ছবি

আমারো একই ধারণা।

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

ওয়েল ডান।

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

অমিত আহমেদ এর ছবি

থ্যাংক ইউ।

উদেশ্যহীন এর ছবি

Interesting!!!
আচ্ছা...এটা কি মীরপুরের সেই দু'বোন রীতা-মিতাদের ভুতুড়ে বাড়িটা?

অমিত আহমেদ এর ছবি

নাহ হাসি
এই বাড়িটা সোবহানবাগে।
মন্তব্যের জন্য আপনাকে বিপ্লব।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- লেখাটা কিশোর উপন্যাস থেকে খারাপ হয় নি। এটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। হাসি
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

অমিত আহমেদ এর ছবি

ধন্যবাদ।
ছেলেবেলায় কি আর কম ডানপিটেমী করেছি হাসি

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

স্বাদে মুচমুচা।

এটা কি রহস্যপত্রিকা'য় আগের ছাপানো?
নাকি সদ্য লেখা?

অমিত আহমেদ এর ছবি

সদ্য। এক্ষুনি লিখে পোস্ট। তাও সত্যকাহিনী অবলম্বনে। রহস্যপত্রিকায় এমন লেখা এলে তো চিন্তার কথা!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

আমি ভাবলাম, ফেলে দেয়া প্লটগুলো আবার জেগে উঠছে কিনা হাসি

অমিত আহমেদ এর ছবি

এটা নিপাট স্মৃতিচারণ।
প্লট গুলো সব গল্পের। আস্তে আস্তে নামাবো।
হাসি

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- আমারোতো ভ্রান্তি হলো কত্তা!
ভেবে রেখেছিলাম এ বুঝি জোন্স বাবুর টুকলিখাতা থেকেই তোলা!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

অমিত আহমেদ এর ছবি

হাঃ হাঃ
নজরুল ইসলাম ভাই সঠিক ধরতে পেরেছেন।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ঠিক আছে। /)

অনিন্দিতা এর ছবি

বেশ লাগল।

অমিত আহমেদ এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ ও বিপ্লব।
আমাদের এক প্রিয় স্যারের মেয়ের নাম ছিলো অনিন্দিতা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

রুবেল আসলে কিছুই দেখে নাই, প্রথমে বেশী সাহস দেখাইছিলতো তাই বাড়িটার ভিতরে গিয়ে ওর যে পচন্ড রকমরে ভয় পাইছিল তা ঢাকোনের জন্যেই অমন জোরে চিৎকার দিয়া দে ছুট মারছিল..

এক কাম করন যায় না! এখনতো রুবেল বড় হইয়া গেছে তো তারে একদিন ভুলায়া ভালাইয়া কথাডা নেওয়ন যায় না যে, তিনি ঐদিন কি এমন দেইখা আকাশ ফাটানো চিৎকার দিছিলেন?

কল্পনা আক্তার

.........................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা

অমিত আহমেদ এর ছবি

সম্ভব।
আমার ধারণা আমার মতই মনা কিচ্ছু দ্যাখে নাই। পাট নেওনের লাইগা পরে ওই সব কাহিনী বানাইছে। আর নতুবা ভয়ে হ্যালুসিনেট করছে। তবে এইটা ঠিক যে ওর গল্পের কারণে ক্লাসের অন্য পোলাগো কাছে আমরা বেশ আলগা সম্মান পাইছি।

রুবেল পোলাটার লগে আমার কোনো যোগাযোগই নাই। ইনফ্যাক্ট স্কুলের চারজন ছাড়া আর কারো লগেই যোগাযোগ নাই। তাও যে চারজনের কথা কইলাম তাদের একেকজন একেক জায়গায়... চায়না, কানাডা, ইংল্যান্ড, বাংলাদেশ।

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ও বিপ্লব।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হ... পুরাতনী নিজস্ব ঘটনার সাথে বর্তমানের চিন্তাবহুল অমিত আহমেদের একটু মিশ্রন হইছে আরকি... আর সেইজন্যই মনে হইতেছে এইটা গল্প উপন্যাস।
তবে আমার মনে হয় তিন গোয়েন্দাকালে যারাই কিশোর আছিলো তাগোরই এইরম একটা না একটা কাহিনী আছে। আমি তো বেবাক সময় পকেটে নানান পদের যন্ত্রপাতি লয়া ঘুরতাম, কখন সামনে কোন কেইস আইসা হাজির হয়... সেইটা তো আমারেই সামাল দিতে হইবো। দুনিয়াতে তো আমার চাইতে বড় গোয়েন্দা আর নাই। কিন্তু এখন দেখা যাইতেছে প্রায় কাছাকাছি সময়ে এমনকি মিরপুরেই অমিত আহমেদ নামের কোনও এক কুচক্রি গোয়েন্দাও ছিলো। আগের বয়স থাকলে তো চ্যালেঞ্জ জানাইতাম!!!

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

এই মন্তব্যে জাঝা

অমিত আহমেদ এর ছবি

নজরুল ইসলাম ভাই একদম আসল জায়গায় হাত দিছেন। তবে ঘটনা যা কইছি তা কিন্তুক সত্য। আমাদের গাড়ি চুরির আরেকটা কেস আছিলো। সব মিলায় তিনটা কেস হাতে নিছিলাম আমরা। তিনটাই অসফল। প্রথম কেস গামছা চুরি। আমরা ধরার আগেই চোর ধরা খাইলো। এরপরে গাড়ি চুরির কেসটা নেওনের পর দেখি অনেক ঘোরাঘুরির ব্যাপার আছে। বয়স কম ছিলো পারি নাই। এইটা নিয়া একটা পোস্ট দেওন যায় অবশ্য। আর শেষ কেস এইটা।

আমার পকেটেও নানান জিনিসপাতি থাকতো। ম্যাকগাইভার দেখনের ফল। একবার হইছে কি শুনেন, এক বাসায় গেছি বাপ-মার লগে। সেখানে কারেন্ট গেছে গিয়া। সবাই তখন ড্রইংরুমে হাতে খাবারের প্লেট নিয়া বসা। কেউ নড়তেও পারতাছেনা, না জানি কি ভাইঙ্গা ফালায়। তখন আমি করছি কি, পকেট থেইকা মরিচ লাইট আর ব্যাটারি দিয়া আলো জালাইছি। আরে আমার সে কি পাট তখন। লাইফে এই একবারই পকেটের মশলা আসল কোনো কাজে লাগছিলো।

হিমু এর ছবি

ভূতটারও হয়তো সেদিন রাতে জ্বর উঠেছিলো।


হাঁটুপানির জলদস্যু

অমিত আহমেদ এর ছবি

সবার চিৎকারে ভয় পেয়ে বেচারার জ্বর আসাটা অবশ্য অস্বাভাবিক নয়।

কনফুসিয়াস এর ছবি

আমাদের ছেলেবেলা আসলেই কি মজার ছিলো। এখনকার কিশোররা কি তিন গোয়েন্দার দল করে করে বড় হয়?
আমার দুইটা দল ছিলো। স্কুলে একটা পাড়ায় একটা। স্কুলেরটায় আমিই কিশোর পাশা ছিলাম। কিন্তু পাড়ারটায় পারি নাই, সাইজে ছোটখাটো ছিলাম, দলের একজন ছিলো বেশ লম্বা-চওড়া, মুসা আমান হইলেই ওরে মানাইতো, কিন্তু ধমক খাইয়া ওরে কিশোর পাশার পদ দিতে হইছিলো। সে কি দুঃখ আমার!
অমিত আহমেদ এক ধাক্কায় একদম ছেলেবেলায় নিয়ে ফেলেছেন আমারে। আজ খবর আছে আমার, সারাক্ষণ এইসবই ঘুরবে...
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

অমিত আহমেদ এর ছবি

তাহলে তো আমাদের পোয়াবারো। ঘুরবেই যখন, তখন ঝটপট করে কয়েকটা তরতাজা গরম পোস্ট চটজলদি নামিয়ে দেন।

নিঘাত তিথি এর ছবি

হাসি
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

অমিত আহমেদ এর ছবি

খাইছে

অমিত এর ছবি

কিশোর গোয়েন্দা জেনারেশনের রেশ কি এখনও আছে ?
(চুপিচুপি বলি, আমারটা এখনও আছে। সেদিন মাত্র লোভে পইড়া একটা সুইস নাইফ কিনে ফেললাম। এখন ২২শে মের জন্য হাকুইল্যা হয়া বইসা আছি।)

অমিত আহমেদ এর ছবি

আমিও! ডাবল-ও-সেভেন আর ইন্ডি ছাড়া অন্য কোনো সিক্যুয়েলের জন্য আমার এই অবস্থা হয় না।

আমার মনে হয় আমাদের কমবেশি সবারই রেশটা থেকে গেছে হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পটা পড়ে সেইরকম মজা পেলাম, হাহা করে হাসতে পারলাম না, বাবা কাছেই ছিলেন, পুরানো কথা মনে পড়ে গেল, তিন গোয়েন্দা তখন পড়া না বলে গিলি বললেই ঠিক হবে, ক্লাস ফোর কি ফাইভ হবে, আমরা তিন বন্ধু মিলেও খুলেছিলাম এক গয়েন্দা দল, তবে তা ছিল স্কুল-কেন্দ্রিক, একটা কেস সল্ভ করেছিলাম তাও মনে আছে ।

- খেকশিয়াল

অমিত আহমেদ এর ছবি

বাহ! আরো একজন গোয়েন্দা। আপনাকে ধন্যবাদ ও জাঝা খেকশিয়াল। তবে এটা কিন্তু গল্প নয়... সর্বৈব সত্য ঘটনা। তা আপনাদের সলভ করা কেসটি নিয়ে সচলে লিখে ফেলুন না?

অতিথি লেখক এর ছবি

আমারটা আসলে আপনারটার কাছে কিছুই না, তবে ওই সময়ের গোয়েন্দা গোয়েন্দা ভাবটা এখন ভাবলে হাসি পেলেও ছোট ছোট ব্যাপারগুলিও খুব বড় হয়ে ধরা পড়ত ক্ষুদে গোয়েন্দা মনে, সে সময়ের ছিল এক অন্যরকম রোমাঞ্চ, সবচে হাসির ব্যাপারটা হল আমরা নিজেদের ডাক-সাইটে কিশোর, রবিন, মুসা ও বলে বেড়াতাম! এখন কে কিশোর হবে তা নিয়ে ব্যাপক 'হাঊ কাউ' যে হয়নি তা বলার অপেক্ষা রাখে না ! তো বলে রাখি আমি তাতে জয়ী হয়েছিলাম ।

যাই হোক কেসটা বলতে গেলেই শেষ হয়ে যাবে । এক বন্ধুর কলম চুরি হয়ে গিয়েছিল, আমরা তা সল্ভ করে দেই একে ওকে নানাজনকে জিজ্ঞাসা করে, বের হয় যার কলম হারানো গিয়েছিল সে সেই চোরের কাছ থেকে তার টিনেজ মিউট্যান্ট নিনজা টারটেলস এর স্টিকার গুলি নিয়ে নিয়েছিল তাই এই প্রতিহিংসা মূলক চুরির ঘটনা, চোর স্বয়ং ধরা পড়ে ঘা ঘা করে কাঁদতে কাঁদতে এই তথ্য আমাদের দিয়েছিল, যাই হোক আমরা আবার তাদের মধ্যে জিনিস পত্র লেন দেন করে দিয়ে মিলমিশ করে দেই ।

- খেকশিয়াল

অমিত আহমেদ এর ছবি

সত্য। কিশোর পাশা কে হবে সেটা নিয়ে নানান বাক বিতন্ডা হতো। আমি কিশোর পাশা আর বরিন মিলফোর্ডের মধ্যে ঘুরপাক খেতাম। তবে গো-দলে আমি কিশোর পাশাই ছিলাম।

আপনার তদন্তের কথা শুনে দারুন মজা পেলাম। চাইলে এটাকেই বড় করে লেখা যেত কিন্তু। আমি আমার এই লেখাটা লিখেছি আমার ছোট খালাতো/মামাতো/চাচাতো ভাই/বোন গুলোর কথা চিন্তা করে। "গন্দম" প্রকাশের পরে পিচ্চি গুলো মন খারাপ করে ছিলো। কেন ভাইয়া ওদের জন্য লিখলো না। ওদের অভিযোগ পাবার আগে ব্যাপারটা আমি এভাবে চিন্তাই করিনি। পরে ভাবলাম ঠিকই তো। ভারতীয় উপমহাদেশে ছোটদের কোনো পাত্তাই দেয়া হয় না। ওদের মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই, বড় অনুষ্ঠানে ওদেরকে উপেক্ষা করে যাওয়া হয়, ওদের জন্য টিভি চ্যানেল নেই, রেডিও স্টেশন নেই, ভালো পত্রিকা নেই (কিশোর পত্রিকা, ছোটদের কাগজ বন্ধই হয়ে গেল), ভালো বই নেই, এমনকি খেলার জন্য ভালো খেলনা কিংবা পার্কও নেই। আমি সবসময় ওদের মতামত, ব্যক্তিত্বকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছি বলে আমার কাছে ওদের প্রত্যাশাটাও হয়তো বেশিই ছিলো।

আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

বাংলাদেশে এখন বাচ্চাদের জন্য লেখছে কে বলুন তো, বইমেলায় বাচ্চারা দেখলাম অনেক ছড়ার বই গল্পের বই বগলদাবা করে ঘুরছে তবে আমাদের সময়ের তুলনায় কম দেখলাম ব্যাপারটা। মুহম্মদ জাফর ইকবালের কিছু বই দেখলাম, শাহরিয়ার কবিরের একটা তাও পুরান কিনা জানি না, আমি পড়িনি অন্তত, এছাড়া দেখেছি কিছু কিন্তু মনে ধরল না তেমন । বাচ্চাদের জন্য সচলায়তন থেকে কিছু বের করা যায় না ?

- খেকশিয়াল

অমিত আহমেদ এর ছবি

বাচ্চাদের জন্য প্রকাশিত বই গুলো এবার আমি ভালো মত নেড়ে চেড়ে দেখেছি। বাচ্চাদের বই বইমেলায় খুব ভালো চলে জানেন তো? নিজেদের জন্য বই না কিনলেও পরিবারের ছোট্ট সদস্যদের জন্য একটা বই অনেকেই কিনে নিয়ে যায়। তাই সব প্রকাশকই ছোটদের বই করতে এক পায়ে খাড়া থাকেন। কিন্তু জাত চলে যাবে ভেবে বড় লেখকরা ছোটদের বই লেখেন না। আর ছোটদের বই লেখাটা খুব একটা সহজও নয়। ভাবগম্ভীর আলোচনায় অভ্যস্থ আঁতেল লেখকদের ছোটদের মত ভাবতে যাওয়াটা একটা অত্যাচার মনে হতেই পারে। তাই যেসব বই প্রকাশিত হয় সেগুলো খুব নিন্ম মানের। এবারের বইমেলায় ছোটদের বইয়ের বিন্যাস এভাবে করা যায় -

১) রূপকথার বই - বেশির ভাগই বিদেশী রূপকথার অনুবাদ। একটা অনুবাদও প্রাঞ্জল লাগেনি। অনেকেই ছবি দিয়ে বই ভরে রেখেছেন, সেই ছবিগুলোও দৃষ্টিনন্দন নয়। আমাদের নিজস্ব রূপকথার বই যেগুলো আছে সেগুলোর মানও খুব খারাপ। আর ঘুরে ফিরে সব বইয়ে সেই ডালিমকুমার টাইপ একই গল্প। একটা বই পড়লে সব বই পড়া হয়ে যায়। লেখার মানও ভালো নয়।

২) কিশোর ক্লাসিক, অনুবাদ - সেবা প্রকাশনী আর সেবার আদলে এখন অনেক প্রকাশনী এইসব সিরিজ করে। সেবা আর সেবার অনুবাদকদের অনুবাদ বাদে বাকি গুলো নেড়েচেড়ে আমার তেমন ভালো লাগেনি। আরেকটা ব্যাপার হলো এই ধরণের বই একদম ছোট ক্লাসের ছেলেমেয়েরা কতটা উপভোগ করবে তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।

৩) গ্রাফিক নভেল, কমিকস - এখানেও মানের সমস্যা। গল্প ভালো হলে আঁকা ভালো নয়, আঁকা ভালো হলে গল্প ভালো নয়। আর প্রকাশনাও নিন্ম মানের। কাগজ ভালো না, প্রিন্টিং ও যাচ্ছেতাই। আর কিছু ছবিওয়ালা বই পড়ে মনে হলো এসব কি পড়ছি। কাহিনী বলতে কিচ্ছু নেই। ১২ পাতার বই। প্রতি পাতায় একদুই লাইন করে লেখা। সব মিলিয়ে শেষ মেষ কোনো গল্প দাঁড়ায় না।

৪) ঈশপ ও ঈশপ গোত্রীয় - ঈশপের গল্প গুলি নানান ভাবে বিক্রি হচ্ছে। এখানেও সেই ভেরিয়েশনে সমস্যা। একটা বই কিনলেই ঈশপ কভার করা হয়ে যাচ্ছে।

৫) কিশোর উপন্যাস, গল্প - নতুন লেখকদের কিছু বই দেখেছি। সংখ্যায় খুবই কম। হাজার বইয়ের ফাঁকে এগুলো চোখেই পড়ে না। বইগুলো নেড়েচেড়ে প্রথম ইমপ্রেশন ভালো আসেনি। তবে যেহেতু পুরো বই পড়ে দেখিনি, কোনো মন্তব্য করছি না।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল একাই চালিয়ে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকেরও মনে হয় প্লটে টান পড়েছে। ইদানিং কালের কিশোর উপন্যাস গুলোতে ঘুরে ফিরে সেই একই কথা। তবে এই মহৎ কাজ যে তিনি করছেন, সে জন্য আমার একটা লাল সেলাম পাবেন তিনি। আর শাহরিয়ার কবির এখন আর বাচ্চাদের জন্য লিখেন না।

সচল কি করতে পারবে জানি না। তবে আমি সবাইকে অনুরোধ করবো ছোটদের জন্য কিছু না কিছু লিখতে।

ধন্যবাদ।


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

শেখ জলিল এর ছবি

ভালো। এবার কিশোর রহস্যগল্পেও দারুণ!

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

দারুণ উপাদেয় !

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

বিপ্লব রহমান এর ছবি

লেখাটি সেই রকম! চোখ টিপি

মন্তব্যের ঘরে বার বার নাম ধরে ডাকায় (বিপ্লব) @ অমিত আহমেদ।


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।