একটি দুর্ঘটনা, শিশুমৃত্যুঃ আমাদের সাংবাদিকতা ও ব্যর্থতা

ধ্রুব আলম এর ছবি
লিখেছেন ধ্রুব আলম [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ৩১/১২/২০১৪ - ২:৩৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জিহাদ মারা গেছে। একটা পরিত্যক্ত পানির পাইপের গর্তে পড়ে। এটুকু সবাই জানে। এর বাইরে আর বেশি কিছু আমাদের জানার প্রয়োজন ছিলো না মনে হয়, তবে অনেক কিছু করণীয় ছিলো। আমরা পারি নি ওকে বাঁচাতে। এটা বড় নির্মম সত্য।

বিদেশে বসে দেশি টিভি দেখার সৌভাগ্য/ দুর্ভাগ্য হয়নি, খবর জানবার হয়েছে। প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় আপডেট পেয়েছি, বলা ভালো, গুজব শুনেছি। সেগুলোর অধিকাংশই আর পাচ্ছি না এখন, মুছে দেয়া হয়েছে। যা আছে তার থেকে টুকরো টুকরোভাবে জেনেছি ঘটনা। সত্য-মিথ্যা কিনা জানিনা।

জিহাদ দুপুর/ বিকেলে একসময় খেলতে বেড়িয়ে গেছে, খোলা রেখে দেয়া এক গর্তে পড়েছে, এরপরে তাকে আর পাওয়া যায়নি, যখন গেছে তখন সে আর বেঁচে নেই।

এর মাঝে শয়ে শয়ে বা হাজারে হাজারে মানুষ দেখতে গিয়েছে, সাহায্য করেছে, করতে চেয়েছে। ছুটে গেছে দমকল বাহিনী, ওয়াসা, পুলিশ, রেলওয়ে, এমনকি মাথামোটা মন্ত্রীটিও।

সবার উপরে ছিলেন সাংবাদিকেরা, তাদের যন্ত্রণায় উদ্ধারকাজ ব্যাহত হয়েছে কিনা তা আমি এখানে থেকে শুধু আন্দাজই করতে পারি, তবে গুজব ছড়াতে তাদের অবদান অনস্বীকার্য! তারা কি কি ও কি ধরনের সংবাদ পরিবেশন করেছিলো, তার একটি সারাংশ বা সারমর্ম করার চেষ্টা করছি এ লেখায়, কিছু মন্তব্যও জুড়ে দিয়েছি। প্রথম আলো- ডেইলি স্টার মিডিয়ার অধিকাংশ নিউজ আর পাচ্ছি না। তারা হয় সেগুলো মুছে ফেলেছে, নয়তো পরিবর্তন/ পরিবর্ধন করেছে। তাই মোটামুটি বিডিনিউজই ভরসা।

যে সকল গুজব মোটামুটি ছড়িয়েছিলো তা হচ্ছে,

(১) জিহাদ পড়েছে কি পড়েনি? গর্তে কেউ আছে নাকি নেই?

(২) জিহাদ কথা বলেছে, জুস খেয়েছে, বেঁচে আছে কি নেই?

(৩) গর্তটা কতটুকু?

(৪) কে বা কারা কাজ করছেন উদ্ধারে? কারা কথা বলছেন, তথ্য দিচ্ছেন?

ইত্যাদি ইত্যাদি।

সমকালে পুরো ঘটনার বর্ণনা পড়ুনঃ ফিরে এসো জিহাদ

কূপটি ৩০০ থেকে ৭০০ ফুট গভীর। এর পরই ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারের বিশেষজ্ঞ সংস্থাগুলো সম্মিলিতভাবে উদ্ধার অভিযান শুরু করে। সরাসরি সম্প্রচার শুরু করে গণমাধ্যম। শিশুটি উদ্ধারে শেষাবধি রাত ২টার দিকে ওই গর্তের মধ্যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বোর হোল ক্যামেরা পাঠানো হয়। সেই ক্যামেরা ২৫৪ ফুট গভীরে যায়। উপরে কম্পিউটারের মনিটরে গর্তের সব চিত্র দেখা যায়। এর গভীরতায় কোনো মানব দেহের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

গভীরতা ৩০০ থেকে ৭০০ ফুট? এটা কি ধরণের হিসাব হলো? আর ক্যামেরা এক্কেবারে মেপে মেপে ২৫৪ ফুটই গেছে!

বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে ১১ ঘণ্টাব্যাপী বিরামহীন উদ্ধার অভিযানের এ পর্যায়ে অর্থাৎ শিশুটির অবস্থান নিয়ে সংশয়ে পড়েন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এক পর্যায়ে পাইপের ভেতর শিশু পড়ে যাওয়ার খবরটি গুজব বলে মন্তব্য করেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার যুগ্ম পরিচালক আবু সাইদ রায়হান। তিনি উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, 'পাইপের ভেতরে অনেক কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। শিশুটি থাকলে তাকেও দেখা যেত নিশ্চয়ই। পুরো ব্যাপারটি শতভাগ গুজব।' ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানও এ রকম বক্তব্য দেন। এনএসআই কর্মকর্তার এমন বক্তব্যে সেখানে তৈরি হয় উত্তেজনা। তবে ঘটনাস্থলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ভেতরে কাউকে পাওয়া যায়নি। প্রয়োজনে আবারও অনুসন্ধান করা হবে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খানও বলেন, তিনশ' ফুট গভীরতা পর্যন্ত পেঁৗছে ক্যামেরার তার আটকে গেছে। আরও গভীরে অভিযান চালানো হবে। এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে তৈরি হয় বিভ্রান্তি। প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে, তা নিয়ে দেখা দেয় নানা প্রশ্ন।

জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার যুগ্ম পরিচালক আবু সাইদ রায়হান এমন কিছু বলে থাকলে তাকে আইনের আওতায় আনা হোক, কিন্তু ভিত্তিহীনভাবে এমন কথা তার মুখে বসিয়ে ছড়ানো হলো কিনা, সেটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। ওয়াসার এমডিও কি এমন কিছু বলেছিলেন? শোনা কথা, ওয়াসার উদ্ধারকার্য তদারকি বা দায়িত্বে যিনি ছিলেন, তিনি একজন বুয়েটিয়ান, সে সূত্রে কিছু ব্যক্তিগত পর্যায়ে জেনেছি, এমন কিছু তারা বলেননি। তবে তাদের ওখানের কর্মচারীরা পালিয়েছিলেন বা তাদের পাওয়া যায়নি। তাদেরকেও জবাবদিহি করতে বলা হোক, তবে গণধোলাইয়ের ভয় সবারই থাকে, এটিও বিবেচনাতে রাখা হোক।

ফায়ার ব্রিগেড বলছে তারা ৩০০ ফুট গেছে, তবে সাংবাদিকরা বুঝে ফেলেছেন, ২৫৪ ফুট! আবার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, যাকে সবার মতো আমিও মাথামোটা বলছি, উনি কিন্তু সমকালের তথ্য অনুযায়ী যথেষ্ট মানবিক, তিনি উদ্ধারকাজ আরো চালিয়ে যেতে বলছেন।

উদ্ধারের প্রথম পর্যায়ে জুস ও দুধের বোতল দেওয়ার পর শিশুটি তা খেয়েছে_ ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীও বলছিলেন, শিশুটি গভীর পাইপের ভেতর পড়ে যায়। এমনকি পরে তাকে ডাকলে ভেতর থেকে সাড়াও দেয়। তবে গভীর রাতে এক কর্মকর্তা বিষয়টি 'গুজব' বলায় উপস্থিত জনতাও ক্ষুব্ধ হন।

আর ফায়ার ব্রিগেড কি জুস-দুধের দাবি সত্যই করেছে, তাহলে কখন করেছে, সেটা বললে ভালো হত না? যতটুকু জানা যায়, একটু রাত হতেই তার আর সাড়াশব্দ মেলেনি। সত্য নির্মম হলেও মেনে তো নিতে হবে। বললে ক্ষতি কি হতো যে, "দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, শিশুটি হয়তো বেঁচে নেই। যদি বেঁচে থাকে তবে সেটি হবে মিরাকল, তবুও আমরা সে আশাই করছি।" আর গভীররাতে কোন কর্মকর্তা এমন দাবি করলেন, তাকেও প্রমানসাপেক্ষে বিচারের আওতায় আনা হোক। তবে আমার সন্দেহ হচ্ছে, যে যা বলেছে, মিডিয়া তাইই প্রচার করেছে। এর প্রমাণ দেখুন এখানে

কেন আরও পরীক্ষা না করে তাৎক্ষণিক মন্তব্য করেছেন_ এমন প্রশ্ন তোলেন অনেকে। জিহাদের মা রাত ৩টায় দাবি করেন, তার বাচ্চা ওই গর্তেই পড়েছে। আর যদি না পড়ে থাকে তাহলে তার ছেলে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। এদিকে রাত ৩টার দিকে জিহাদের বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় আনা হয়।

এ বিষয়টি নিয়ে অনেক কথা উঠেছে। কিন্তু পুলিশের দায়িত্বই তো এমন অদ্ভুত বা সন্দেহজনক কিছু ঘটলে, সংশ্লিষ্ট সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা। সারাদেশ হামলে পড়েছে, কিন্তু গর্তে কাউকে পাওয়া যায়নি, এমন ক্ষেত্রে কি ঘটেছে আসলে, সে সত্য উদ্ধারে পুলিশ কিছু প্রশ্ন থানায় নিয়ে করতেই পারে।

এর আগে ২০০৬ সালের ২৩ জুলাই ভারতের দক্ষিণ হরিয়ানায় মাটির নিচে ৬০ ফুট গভীর পাইপ থেকে উদ্ধার করা হয় প্রিন্স নামের পাঁচ বছর বয়সী একটি শিশু। ভারতীয় সেনাবাহিনী টানা ৫০ ঘণ্টার অভিযানে কূপ খনন করে শিশুটিকে উদ্ধার করে।

এটা কি ধরনের তুলনা হলো? কোথায় ৬০ ফুট আর কোথায় ৩০০ ফুট? আর ৫০ ঘন্টা কি কম সময়? এই উদাহরণ দিয়ে সাংবাদিকেরা কি বুঝাতে চাইলেন?

প্রথম থেকেই ঘটনাস্থলটি 'ক্রাইম সিন' লেখা রশি বা অন্য কিছু দিয়ে ঘেরাও করে আলাদা করা হয়নি। শত শত উৎসুক জনতা দুর্ঘটনাস্থল ঘিরে ভিড় করেন। উদ্ধার অভিযান নির্বিঘ্ন করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শুরুতে তেমন তৎপর থাকতেও দেখা যায়নি।

এটি অত্যন্ত দুঃখজনক, আমাদের পুলিশের আরো সচেতন হওয়া উচিত এ ব্যাপারে। এর সাথে মিডিয়াকর্মীদেরকেও দুর্ঘটনাস্থলের এত কাছে ভিড়তে দেয়া মোটেই উচিত না।

রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ অন্তত ৬০০ ফুট দীর্ঘ পাইপটি তোলা শেষ হয়। এ সময় সিসি ক্যামেরা নিচে পাঠিয়ে শিশুটির অবস্থা দেখার চেষ্টা চলে। কিন্তু ৬০০ ফুটের বেশি গভীরে ক্যামেরা পাঠিয়েও ক্যামেরার ফোকাসের আওতায় শিশুটিকে পাওয়া যায়নি। রাত পৌনে ১২টার দিকে বশীর আহমেদ নামে একজন স্বেচ্ছাসেবক পাইপের ভেতরে নেমে শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য প্রস্তুতি নেন। প্রথম পর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারসংশ্লিষ্টরা এতে রাজি থাকলেও শেষ মুহূর্তে তাকে নামতে বাধা দেওয়া হয়।

এখান থেকে জানা যাচ্ছে, চেষ্টার ত্রুটি কেউ করেননি, তবুও শিশুটিকে পাওয়া যায় নি, দেখা যায়নি। আর ভাগ্য ভালো বলতে হবে, কাউকে নামানো থেকে বিরত রাখা হয়েছে। আমি ধরে নিচ্ছি জনগণের চাপে পড়ে হয়তো দমকল বাহিনী কাউকে নামাতে রাজি হয়েছিলো, সেটি আরেকটি দুর্ঘটনার জন্মও দিতে পারতো।

গভীর রাতে শিশুটিকে উদ্ধারে 'ক্যাচার' প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়ে রাতে ঘটনাস্থলে যায় বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একটি দল।

এটি একটি বড় ধরণের ভ্রান্ত তথ্য, যা মিডিয়া ছড়িয়েছিল। বুয়েটের কোন টিম সেখানে যায়নি, ওরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে গিয়েছিলো। আমি তাদের অন্তর থেকে সাধুবাদ জানাই, বুয়েটের ছেলে-মেয়েরা বাইরের জগৎ থেকে যে বিচ্ছিন্ন না, বালুতে সারাক্ষণ মুখ গুজে পড়ে না থেকে মাঝে মাঝে যে তারাও এগিয়ে আসে, ওরা দেখিয়েছে।

ঘটনার নয় ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে পেঁৗছে ওয়াসার শক্তিশালী ওয়াটারপ্রুফ 'বোর হোল' ক্যামেরা। কিন্তু ব্যবহারে অনভিজ্ঞতার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে সেটি চালু করতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।

এই দেরি কেন এবং এটি চালানোর ক্ষমতা কেন ওয়াসার নেই, সেটির জবাব তাদের কাছে চাওয়া হয়েছে কি? এর জন্যে তদন্ত করে, দোষী খুজে বের করে কঠিন শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।

রাত ১১টায় সর্বশেষ তারা জিহাদের কান্নার আওয়াজ পান।

এটি কি বিশ্বাস করবো না ময়নাতদন্ত রিপোর্টকে মানবো? আমি ময়না তদন্তের উপর বিশ্বাস রাখছি। সেক্ষেত্রে এ জাতীয় বাজে কথা প্রচারের দায় সংবাদমাধ্যমগুলোকেই নিতে হবে।

এদিকে আমরা জনতার আচরণ লক্ষ্য করিঃ

এদিকে ঘটনাস্থলে উৎসুক জনতাকে সামলাতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেশ কয়েকবার ধাওয়া ও লাঠিপেটা করে জনতাকে সরিয়ে দেয় পুলিশ।

আর সাংবাদিকের নাম কামানোর, প্রথম হওয়ার প্রতিযোগিতাটি দেখুনঃ

জিহাদের পাইপে আটকা পড়ার খবরটি সমকাল অনলাইন প্রথম প্রকাশ করে। মুহূর্তে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। সন্ধ্যা নাগাদ গণমাধ্যমের খবর ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক বিরোধকে হটিয়ে সবচেয়ে আলোচিত হয়ে ওঠে জিহাদের উদ্ধার তৎপরতা। টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করে উদ্ধার তৎপরতা।

এত নোংরা মানসিকতার জন্যে কি এদের কোন শাস্তি দেয়া যেতে পারে কি? আমার মনে হয় এদের একটা বড় ধরণের শিক্ষার প্রয়োজন।

এরপরে বিডিনিউজের ফলো-আপঃ এক শিশুর মরণের পর বন্ধ হল সেই মৃত্যুকূপ

এখান থেকে আমরা জানতে পারি-

রেলওয়ের মহাপরিচালক তফাজ্জল হোসেন শুক্রবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “সেখানে একটি নতুন ডিপ টিউবওয়েল করা হচ্ছিল। কিন্তু পুরনো ডিপ টিউবওয়েলের মুখ বন্ধ না করেই তারা কাজ করছিল।

“অথচ এ ধরনের কাজ করার সময় পরিত্যক্ত নলকূপের মুখ ঝালাই করে বন্ধ করার নিয়ম রয়েছে।”

তবে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বা নেবেন? যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা কি মুখোমুখি হবেন গাফিলতির কারনে হত্যা মামলার?

আরো জানা যায়, সেই কূপ এখন বন্ধ হয়েছে, নেয়া হয়েছে কিছু পদক্ষেপ।

(১) পরিত্যক্ত ওই গভীর নলকূপের পাইপে জিহাদের পড়ে যাওয়ার ঘটনায় রেলওয়ের জ্যেষ্ঠ উপসহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলমকে শুক্রবারই বরখাস্ত করা হয়।তিনি ওই প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন।

(২) এছাড়া কালো তালিকাভুক্ত করা হয় নতুন গভীর নলকূপ স্থাপন প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এস আর হাউসকে।

এই শাস্তি আমার কাছে গুরু পাপে লঘু দণ্ড মনে হয়েছে। সামান্য এটুকু করেই কি আমরা খুশি, যেখানে শাস্তি হওয়া উচিৎ দৃষ্টান্তমূলক।

এছাড়াও জেনে রাখা ভালো, আমরা আমাদের বাঙ্গালিয়ানা বজায় রাখতে কি করেছিঃ

জিহাদকে মৃত অবস্থায় উদ্ধারের পর ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা ওই এলাকায় রেলের জমিতে স্থাপিত বিভিন্ন দোকানপাট এবং ওয়াসার অস্থায়ী স্থাপনা ভাংচুর করে

আমি তানভির আরাফাত ধ্রুব'র (অনুমতিক্রমে) একটি স্ট্যাটাস তুলে দিলাম, ওর ভূমিকা ও নিজ অভিজ্ঞতার বর্ণনার জন্যেঃ

বেশ কয়েকটা মিডিয়া থেকে যোগাযোগ করছে। তাদের আলাদাভাবে আলাদাভাবে বলেছি। এইখানেও বলা উচিৎ।

শুক্রবার রাতে ১০টার দিকে ফেসবুকে ঢুকে জিহাদের খবরটা জানতে পারি। তারপর চট করেই একটা আইডিয়া আসে মাথায়। সেইটা দিয়ে মাইক্রোসফট পেইন্টে একটা স্কেচ করি। সেইটা শেয়ার করি ফেসবুকে অ্যাক্টিভ বেশ কয়েকজন মানুষের সাথে। তাদের মাঝে কয়েকজন দ্রুত এগিয়ে আসে এবং স্পটে যায়। আমি আর ইমতিয়াজও স্পটে যাই। এর মাঝেই ফেসবুকের কল্যানে আমাদের করা স্কেচটা অনেকের কাছেই পৌঁছে যায়।

ঠিক রাত ১২টার দিকে স্পটে আমরা সরাসরি ফায়ার সার্ভিসের ডিজির সাথে কথা বলি। উনি জানান যে আইকন নামে একটা কনস্ট্রাকশান কোম্পানি একটা ক্যাচার বানানোর প্রস্তাব দিয়েছে। উনি আমাদের আইকনের কনট্যাক্ট নাম্বার দ্যান এবং আমরা আফতাবনগরে আইকন কাজ করছে এমন একটা সাইটে যাই। সেখানে আমরা আমাদের আইডিয়াগুলা আইকনের ইঞ্জিনিয়ার-টেকনিশিয়ানদের সাথে শেয়ার করি। এরই মধ্যে আমাদের বুয়েটেরই আরেক বড় ভাই আসিফ ভাই ফেসবুকে লোহার ফ্রেম আর জাল ব্যবহার করে একটা ক্যাচারের স্কেচ দ্যান। আমরা সেইটাও আইকনের সাথে শেয়ার করি।

কিন্তু স্কেচ থেকে ডিজাইন করার জন্য আমাদের দরকার ছিল স্পেসিফিক ডেটা, যেটা তখন কারো কাছেই ছিল না। রাত মোটামুটি ২টার দিকে আমরা আবার স্পটে ব্যাক করে ডিজির সাথে কথা বলি। কিন্তু উনি জানান যে ওয়াসা ক্যামেরা নামিয়ে বাচ্চার ছবি পাওয়ার চেষ্টা করছে। আর ডিজাইন করার জন্যে আমাদেরও দরকার ছিল বাচ্চাটার এক্সাক্ট পজিশনিং। না হলে সেইফ কোন ডিজাইন করা সম্ভব ছিল না। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে ওয়াসার টিম জানায় যে তারা বাচ্চাকে লোকেট করতে পারে নাই।

আমাদের কন্ট্রিবিউশান আসলে সে পর্যন্তই শেষ। কারণ বাচ্চার ছবি/ফুটেজের অভাবে আমরা কিন্তু আর আইডিয়া/স্কেচটা থেকে ডিভাইস ডিজাইন করতে পারি নাই।

আমরা আফতাবনগর থেকে স্পটে চলে আসলেও আইকনের টিম কিন্তু বসে থাকে নাই। উনারা নিজেদের মত করে একটা ক্যাচার বানিয়ে যদ্দূর মনে পড়ে রাত ৪টার দিকে স্পটে আসেন।

ওয়াসার টিম উইথড্র করার পরে আরো কয়েকটা টিম ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা চালায়। একটা পর্যায়ে আইকনের বানানো ক্যাচারটাও কূপে নামানোর চেষ্টা চলে। কিন্তু কূপের ডায়ার সাথে না মিলাই আঁটকে যায়। তারা সেটাকে ফারদার ইম্প্রুভ করার কাজ করতে থাকে।

বাই দ্যাট টাইম আমাদের উৎসাহ আসলে শূন্যের কোঠায় চলে আসে। কারণ আমাদের মাথাতে একটা জিনিসই ছিল যে বাচ্চার পজিশন নিশ্চিত না হয়ে এক্সপেরিমেন্টাল কোন ডিভাইস পাঠানো রেস্পন্সিবল কাজ হবে না। উল্টা ভুল ডিজাইনের ডিভাইসে বাচ্চার ক্ষতি হবার চান্স থাকবে। আর বাচ্চার কোন ফুটেজঅ আমরা তখনও পাই নাই। অ্যাট দিস স্টেজ রাত ৫টার দিকে আমরা স্পট থেকে বের হয়ে যাই।

অল্পকথায় আমরা এটুকুই করেছি যে একটা স্কেচ নিয়ে ডিজিকে দেখাইসি, সেটা আইকনের সাথে শেয়ার করসি। দেন স্পেসিফিক ডেটা না পাওয়ায় হাল ছেড়ে চলে আসছি।

কিন্তু আমাদের আসল হিরোরা হতাশও হন নাই, হালঅ ছাড়েন নাই। তারা ট্রায়াল-এরর চালায়ে, বারবার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত ঠিকই জিহাদকে উঠিয়ে এনেছেন।

এখন কথা হচ্ছে যে এতোগুলা কথা বলার মূল কারণ কিছু কনফিউশান দূর করা। আমরা যে দুইজন স্কেচ করে নিয়ে গেলাম আমরা কিন্তু বুয়েটের অদোরাইজড কেউ না। অথচ মিডিয়া সেটাকে বানাই দিল বুয়েটের বিশেষজ্ঞ টিম! আমরা তখনই যেই মিডিয়াই আমাদের সাথে কথা বলতে চেয়েছে তাদের স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি যে আমরা নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকে আসছি, নোওয়ান সেন্ড আস। তারপরেও তাদের ভুল উপস্থাপনায় অনেকে আশার জাল বুনেছেন বুয়েটের উপস্থিতি চিন্তা করে।

আবার উদ্ধার হবার পরে অনেকেই মনে করছেন যে আমাদের করা 'ডিজাইন' এর মাধ্যমেই জিহাদকে উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে টেকনিক্যালি আমরা কেবল একটা স্কেচই করেছিলাম, সেটাকে কোন ডিভাইসের ডিজাইন বলার সুযোগ নাই। ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কে ধারণা রাখা মানুষদের জন্য স্কেচ কিংবা স্কেমেটিক ডায়াগ্রামের সাথে ডিজাইনের তফাৎটা ধরা সহজ হবে। সহজ কথায় বললে স্কেচে একটা ডিভাইসের মেজর জিনিসগুলা দেখানো হয়, সেইখানে মাপ তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। যেমন আমরা ছোট বেলার গাড়ি কিংবা ট্রেনের মডেল আঁকাইতাম। কিন্তু ডিজাইনে সবকিছু ডিটেইল থাকে, মাপ থাকে, কোনটা কী দিয়ে বানাতে হবে সেটা থাকে এইসব আর কি।

এখন কথা হচ্ছে যে জিহাদকে এক্সাক্টলি কারা উঠাইছে সেটা নিয়ে আমাদের তেমন স্পষ্ট ধারণাই নাই। আইকনের টিম নাকি অন্য কেউ সেইটা নেট থেকে তেমন নিশ্চিত হইতে পারি নাই। তাহলে যারাই কাজটা করুক না ক্যান, তারা আমদের ডিজাইনে কাজ করেছে এমনটা দাবি করার আসলে সুযোগ নাই। ফ্রেমের নিচে জাল লাগায়ে কাজটা করা যায় এইটা যে কারো মাথাতেই আসতে পারে। তাই এইখানে আমাদেরকে ক্রেডিট দেয়ার কোন মানে নাই। যদি এমন হইতো যে আইকনের ঠিক যেই টিমটাকে আমরা আইডিয়াগুলা দিয়া আসছিলাম তারাই কাজটা করসে, তাহলে হয়তো বলা যাইতো যে হ্যাঁ ওই টিমের সাথে আমরা আইডিয়া শেয়ার করসিলাম। কিন্তু নেট ঘাঁইটা যতটুকু বুঝছি যে একদমই স্থানীয় মানুষদের প্রচেষ্টায় কাজটা সম্ভব হইছে। তাই ক্রেডিট বা মোটিভেশান যদি দিতেই হয়, এই মানুষগুলারেই দেয়া উচিৎ।

হ্যাঁ, ইচ্ছা ছিল যদি কিছু কন্ট্রিবিউট করতে পারি তো করার। এর আগে রানা প্লাজাতেও লম্বা সময় নিয়ে কাজ করসিলাম আমরা। কিন্তু সেবার সাফল্যের সাথে মিডিয়া থেকে নিজেদের দূরে রাখা সম্ভব হইছিল, কিন্তু এইবার হয় নাই। ফলে কনফিউশান তৈরির সুযোগ হইছে। মিডিয়াদেরও দোষ দেয়ার কিছু নাই। লাইভ ফিড দেয়ার সময় এতো ক্রসচেকের সুযোগও হয়তো তাদের থাকে না। তবে প্রিন্ট মিডিয়াতে যারা এখনও ফলোআপ করছেন তাদের অন্যরোধ থাকবে আপনারা প্রকৃত প্রশংসার দাবিদার মানুষগুলারে খুঁজে বের করেন প্লিজ। আমাদের দেশটা আগাচ্ছেই এই সাধারণ মানুষের উপর ভর করে। তাদের উৎসাহিত করা বেশি দরকার।

বুয়েট দেশের পয়সায় আমাদের ইঞ্জিনিয়ার বানাচ্ছে, নাইলে পরিবারের পয়সা খরচ করে ইঞ্জিনিয়ার হবার সামর্থ্য আমার ছিল না। এই কথা আমার মাথাতে সবসময়েই আছে। তাই সেই বিদ্যা কাজে লাগানোর সুযোগ থাকলে ইনশাআল্লাহ সবসময়ই আগাই আসব। তবে এইবারের ঘটনায় আমাদের তেমন কোন কৃতিত্ব নাই - এইটাই মোদ্দা কথা। আপনাদের সবার শুভকামনা ভবিষ্যতের জন্য উঠাই রাখলাম, হয়তো তখন সত্যি সত্যি কোন ডিফারেন্স মেক করে সেইটার মর্যাদা রাখব।


মন্তব্য

মাসুদ সজীব এর ছবি

ভোর পাঁচটা পর্যন্ত লাইভ টেলিকাষ্ট দেখলাম। সন্ধ্যা থেকেই সাংবাদিকদের জঘন্য আচরনে আর সবার মতোই হতাশ হয়েছি। মানুষের আবেগকে পুঁজি করে যে জমজমাট ব্যবসা করা যায় তার উজ্জ্বলতম একটা সাক্ষী টিভি সাম্বাদিকররা সেদিন দিয়েছে। যেমন-সময় টিভি মেসেজ দিয়ে মানুষের মতামত জানতে চেয়েছে অ্যাঁ , আর চ্যানেল ২৪ সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত একই খবর কয়েকহাজার বার প্রচার করেছে আর যার কাছে যা শুনছে তা যাচাই-বাছাই ছাড়াই লাইভ প্রকাশ করছ। ফলে অসংখ্য বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।

তবে সব বিভ্রান্তিকে পরাজিত করেছে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার যুগ্ম পরিচালক আবু সাইদ রায়হান। ৬০০ ফুট গর্তে মাত্র একবার গর্তে ২৫৪ ফুট পর্যন্ত ক্যামেরা নামিয়ে এই মানুষটি সন্ধ্যা থেকে চলমান প্রচারিত সকল খবরকে স্রেফ গুজব বলে উড়িয়ে দেন! এত বড় দায়িত্বে থেকে কি করে এই লোকটি হুট করে এমন একটি মন্তব্য করতে পারেন চিন্তিত ? তারপর পর ফায়ার ব্রিগেড প্রধানও শিশু সুলভ এই মন্তব্য করেন। ওরা কি একবার ও কমন সেন্স ব্যবহার করেনি যে কূপ ৬০০ ফুট, সেই কুপে ২৫৪ ফুট নেমে কি করে নিশ্চিত হওয়া যায়? নাকি কূপের গভীরতা নিয়ে তাদের মনে সন্দেহ-সংশয় ছিলো? তাদের এমন দায়িত্বহীন মন্তব্যেই আসলে উদ্ধার কর্ম বিতর্কিত হয়। তাই এই দুজনকে আইনের আওয়তায় আনা উচিত।

এর পাশাপাশি আরো কিছু ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। যেমন
১। সারাদেশে উন্মুক্ত ম্যানহোল-কূপগুলোতে ঢাকনা দেওয়া আর বৈদ্যুতিক তারগুলোকে বাসাবাড়ি থেকে নিদিষ্ট দূরত্বে সরিয়ে নেওয়া।
২।ফায়ার ব্রিগেড কর্মীদের আরো আধুনিক প্রশিক্ষনের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলা।
৩। আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং সেই যন্ত্র চালানোর দক্ষতা অর্জন।
৪। দুর্ঘটনা স্থানের নিদিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত নিরাপত্তা বলয় গঠন করা। (সাম্বাদিকরাও সেই বলয়ের বাইরে থাকবে)
৫। দুর্ঘটনা স্থানের খবর প্রচারের নীতিমালা। (যার কাছে যা শুনছে তা প্রচার করে দিলে বিভ্রান্তি বেশি ছড়ায়)

সর্বোপরি দায়িত্বে থাকা ব্যাক্তিদের আরো দায়িত্ব নিয়ে মন্তব্য করা। এই একটা বিষয় সব দুর্ঘটনাতে সরকারকে বেশি বেকায়াদায় ফেলে দেয়। যেমন রানা প্লাজার সময় মখা, সুন্দরবনে শাহাজান প্রভৃতি। দায়িত্বে থাকা মানুষ যখন দায়িত্বহীন ও হাস্যকর মন্তব্য করবে তখনি তাকে অপসারণ করা উচিত।

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।