একটা গল্প লিখব বলে বসে আছি

ফাহিম এর ছবি
লিখেছেন ফাহিম [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ২৮/০৮/২০১৩ - ৯:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একটা গল্প লিখব বলে বসে আছি। অনেক দিন ধরে!

গল্পগুলো মাথার এ'কোণ থেকে ও'কোণে দাবড়ে বেড়ায় প্রতিনিয়ত, কিন্তু সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা হয়ে ওঠেনা। এ বড় আপদ।

গল্পটা হতে পারতো সালমাকে নিয়ে। যে প্রতিদিন সকালে দুলে দুলে হেঁটে গিয়ে গার্মেন্টসে ঢুকে। দুপুরের টিফিনের সময় ছোট্ট টিনের কৌটা থেকে দুটো রুটি সামান্য ডালে মেখে খেতে খেতে, যে ছোট ছোট কিছু স্বপ্নের জাল বুনতো। চারটা মেশিন পরে যেই ছেলেটা কাজ করতো, তাকে মাঝে মাঝেই আড়নয়নে দেখে নিজেই লজ্জা পেত। ছেলেটা কি বুঝেছিলো কিছু? কোনও এক অসচেতন পলে তার চোখ ছেলেটির চোখে আটকেছিল কি?

অথবা গল্পটা হতে পারতো মজিবরকে নিয়ে। শেখ মুজিবের নামে নাম বলে সবসময় যে বুক ফুলিয়ে চলতে বন্ধুদের কাছে। এমনকি রিক্সা টানার সময়ও সিনা টান টান থাকতো তার। হোক না সে রিক্সাওয়ালা, স্বাধীনতাকে ধনী-গরিব সবার সমান অধিকার বলেই ধরে নিয়েছিল সে, নিজেকে তার মুজিবের মতই মনে হতো।

কিংবা, সৌমেন? ভুল সময়ে ভুল রাজনৈতিক বিশ্বাসের তোড়ে ভেসে গিয়ে, সব অগ্রাহ্য করে, যৌবনের তীব্র আবেগ নিয়ে যে অচলায়তনের দেয়াল ভাঙ্গতে গিয়েছিল। ভুলে গিয়েছিল কি সে সুপ্রিয়াকে দেয়া কথা?

মাঝে মাঝে মনে হয়, কালাম, সাকের আর টিলোর কথা লিখি। কিছুই হলো না জীবনে যাদের। এ'পাড়ায় ও'পাড়ায় ভাড়াটে গুন্ডামি করে, আর ছিঁচকে ছিনতাই করে, রাতে ফেনসিডিলের বোতলে বুঁদ হয়ে যাওয়ার সময় কেমন লাগে তাদের?

কিছুই লেখা হয়ে ওঠে না। সব গল্পেরই শেষে কেমন যেন একটা সুতো ঝুলতে থাকে, কোনভাবেই যাকে বাগে আনা যায়না। শেষ হিসেবটা কেন যেন কখনই মেলানো যায় না। তাই গল্পগুলোও আমি শেষ করতে পারিনা।

তা না হলে কেন সালমার গার্মেন্টসটাই ধ্বসে পড়তে হলো? প্রাণে হয়তো বেঁচে গিয়েছে সে, কিন্তু একটা কাটা হাত নিয়ে এখন সে কী করবে? ভিক্ষা, নাকি বেশ্যাবৃত্তি? এক হাত কাটা বেশ্যাকে কেউ নেবে? এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই, তাই এই গল্পটা আমি লিখতে পারি না।

মজিবরের কথাই ধরি। ছেলেকে নিজের রিক্সায় নিয়ে বাজারে নামিয়ে দেবে বলে রওনা হয়েছিলো সেদিন। সেদিনই কেন বাসটাকে তার রিক্সার উপর উঠে পড়তে হলো? ছেলেটা দূরে ছিটকে পড়ে বেঁচে গেলেও মজিবর নিজে বাসের চাকার নিচে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেল। স্বাধীন বাংলার স্বাধীন রিক্সাওয়ালা মজিবরের মগজ যখন রাস্তায় থেতলে গিয়ে পরে রোদে শুকাচ্ছিল, তার ছেলেটা সেই দৃশ্য দেখে কী ভেবেছিলো, তা আমি অনেক ভেবেচিন্তেও বের করতে পারি না। তাই এই গল্পটাও না লেখা থেকে যায়।

সৌমেন, আহ সেই প্রাণোচ্ছল উদ্যমী ছেলেটা? বিপ্লব কি শেষ হলো তার? প্রতিদিন প্রতিরাত পুলিশের হুলিয়া মাথায় নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে, বন থেকে বনে পালিয়ে কোন রাষ্ট্রটা উদ্ধার হলো তার? শেষে একরাতে, ফকফকা জোছনায়, মাঠের পারে, পুলিশের গুলি খেয়ে পড়ে ছিল যখন, কার মুখটা ভেসে উঠেছিলো তার চোখের সামনে? মা'র, নাকি বড়দি'র? আমি জানি না, তাই লিখতেও পারি না।

অথবা টিলোর কথা। হারামির বাচ্চা ওসিটার সাথে মাসিক বন্দোবস্ত থাকার পরও লোকাল এমপির নির্দেশে তাদের সবাইকে ক্রসফায়ারে দিয়ে দিল। সাকেরটা মুখেই বড় বড় হাতি ঘোড়া মারত, আদতে ভিতু ছিল, ফতুল্লার বালুর মাঠে ওদের দাঁড় করানোর পর ভয়ে মুতে দিয়েছিলো। কিন্তু টিলো তো শক্ত ছিলো, বাঁধা হাত নিয়েই ঝেড়ে দৌড় দিয়েছিলো। কী ভাবছিলো সে? এইবার বেঁচে ফিরলে শালা ওসি কল্লা নামিয়ে দেবে, সেই কথা? সীসার বলটা তার মাথার খুলি উড়িয়ে দেওয়ার এক মুহূর্ত আগেও কি সে আশাবাদী ছিলো যে, সে বেঁচে যেতে পারে? নাকি ফেনসিডিলের ঘোরে অত কিছু চিন্তাই করে নি, স্রেফ জীবন বাঁচানোর পাশবিক তাড়নায় দৌড়েছিল? কিভাবে লেখব আমি এই গল্প, পাঠকের এইসব প্রশ্নের উত্তর যদি আমি না জানি?

আমার গল্পটাও তাই লেখা হয়ে ওঠে না।


মন্তব্য

শিশিরকণা এর ছবি

মন খারাপ

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

ফাহিম এর ছবি

মন খারাপ

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

মন মাঝি এর ছবি

হায়, তাই আমারও গল্পটা পড়া হয়ে ওঠে না। পড়তে হয় লেখা না হয়ে ওঠা গল্পের ওপর একটা প্রায় গল্প হয়ে ওঠা মেটা-গল্প।

****************************************

ফাহিম এর ছবি

"মেটা-গল্প" - আসলেই তো!

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

সাদাত হোসেন মান্টোর একটা ছোটগল্প আছে। কবিরের হাসি। পারলে পড়বেন।

ফাহিম এর ছবি

পরের বার দেশে গেলে খুঁজে দেখবো। ধন‌্যবাদ।

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

সত্যপীর এর ছবি

চমৎকার!

..................................................................
#Banshibir.

ফাহিম এর ছবি

ধন‌্যবাদ।

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

অতিথি লেখক এর ছবি

হাততালি
দারুণ লাগাল।

----------------------
সুবোধ অবোধ

ফাহিম এর ছবি

ধন‌্যবাদ।

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

ব্রুনো  এর ছবি

গল্প না লেখার গল্পটা চমৎকার হয়েছে হাসি

ফাহিম এর ছবি

আপনার ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগছে! ধন‌্যবাদ।

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

সাত্যকি এর ছবি

বাহ। চমৎকার ! হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্প না হলেও সত্যি ও সুন্দর। চলুক

তিথীডোর এর ছবি

দারুণ। চলুক
অনেকদিন পর লিখলেন।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনি অনেক কিছুই গেলেন বলে কোন কিছু না বলে ।
শাকিল অরিত

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারন হয়েছে ভাই। গুল্লি

মাসুদ সজীব

অতিথি লেখক এর ছবি

কিছু গল্প জেগে থাকে তবু, নিকষ আঁধারে জোনাকির আলোর উৎসব, মাটির গভীর ঘ্রাণ সোনালী ধানের দুধে, নদীর নরম বুকে চিকণ বৃষ্টির ভোর - এই সব তুলে আনো খুঁটে খুঁটে। শূণ্যতা শেষ কথা নয়, শক্তির পুঞ্জ-ফেনা, সৃষ্টির আকর শুধু।
ফাহিম, আন্তরিক আশা রাখি আপনার শক্তিশালী মনন অজস্র গল্প শোনাবে আমাদের - আশার, ভরসার, এগিয়ে চলার, এগিয়ে দেওয়ার।
- একলহমা

তমসা এর ছবি

না হয়ে ওঠা গল্পগুলোর আবহমান দৃশ্যগুলো পিছু ছাড়বে না অনেকদিন।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

চমৎকার হয়েছে না লেখা গল্পের গল্প।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

ফাহিম এর ছবি

সাত্যকি, অতিথি লেখক, তিথীডোর,শাকিল অরিত, মাসুদ সজীব, একলহমা, ত্রিমাত্রিক কবি - সবাইকে অসংখ্য ধন‌্যবাদ।

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুণ। ভাল লাগা জানিয়ে গেলাম।

-নিয়াজ

বন্দনা এর ছবি

না বলে ও অনেক কিছু বলে দিলেন। দারুণ লাগলো।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

র.নাহিয়েন

রীমা মারীয়া  এর ছবি

ভালো লেগেছে লেখাটা।

তানিম এহসান এর ছবি

দারুণ।

স্যাম এর ছবি

মন খারাপ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।